ঢাকা ০৮:৪৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
Logo মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা আমাদের অঙ্গীকারঃ ড. তৌফিক রহমান চৌধুরী  Logo মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির নতুন বাসের উদ্বোধন Logo মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে শিক্ষকদের ভূমিকা অগ্রগণ্য: ভিসি প্রফেসর ড. মোহাম্মদ জহিরুল হক Logo মঙ্গল শোভাযাত্রা – তাসফিয়া ফারহানা ঐশী Logo সাস্টিয়ান ব্রাহ্মণবাড়িয়া এর ইফতার মাহফিল সম্পন্ন Logo কুবির চট্টগ্রাম স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের ইফতার ও পূর্নমিলনী Logo অধ্যাপক জহীর উদ্দিন আহমেদের মায়ের মৃত্যুতে শাবির মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্ত চিন্তা চর্চায় ঐক্যবদ্ধ শিক্ষকবৃন্দ পরিষদের শোক প্রকাশ Logo শাবির অধ্যাপক জহীর উদ্দিনের মায়ের মৃত্যুতে উপাচার্যের শোক প্রকাশ Logo বিশ কোটিতে গণপূর্তের প্রধান হওয়ার মিশনে ‘ছাত্রদল ক্যাডার প্রকৌশলী’! Logo দূর্নীতির রাক্ষস ফায়ার সার্ভিসের এডি আনোয়ার!




ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে বনানী ‘হত্যার’ দায় রাজউক ও রূপায়নের

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ১০:৪২:১২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০১৯ ১৩৪ বার পড়া হয়েছে

এফআর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ২৫ জনের মৃত্যুর ঘটনাকে নিছক দুর্ঘটনা না বলে ‘হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। ভবনটি নির্মাণে নানা অনিয়ম হওয়ায় এটিকে ‘হত্যাকাণ্ড’ বলছেন বিশেষজ্ঞরাও। এটি ‘হত্যাকাণ্ড’ হলে এখন প্রশ্ন আসে ‘হত্যাকারী’ কে বা কারা? এই ‘হত্যাকারী’ খুঁজে বের করতে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছে ‘বাংলা’।

রাজধানীর অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত আতাতুর্ক এভিনিউর এই ভবনে গতকাল বৃহস্পতিবার অগ্নিকাণ্ডে ২৫ জনের মৃত্যু ঘটেছে। আহত হয়েছেন শতাধিক।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ভবনের নির্মাতা-মালিক ও সামগ্রিকভাবে সরকারকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, মালিক ও নির্মাতা আইন লঙ্ঘন করে ভবন নির্মাণ করেছে। তবে আইন বা বিল্ডিং কোড মানতে মালিককে বাধ্য করার দায়িত্ব রাজউকের। আর রাজউক দায়িত্বে অবহেলা করলে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। তাই এখানে তিনপক্ষই দোষী।

হাউজিং এন্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ আবু সাদেক বলেন, ‘রাজউক যখন একটি ভবনের নকশা অনুমোদন দেয়, এরপর সেই নকশা অনুযায়ী ভবনটি হচ্ছে কি না বা বিল্ডিং কোড মানা হচ্ছে কি না এসব দেখভাল করার দায়িত্বও তাদের। রাজউকের অথরাইজড কর্মকর্তা ও ইন্সপেক্টর রয়েছে। রাজউকের পাসকৃত প্ল্যান অনুযায়ী কাজটি না হলে এসব কর্মকর্তা ও ইন্সপেক্টর ভবনটির নির্মাণকাজ বন্ধ করে দিতে পারেন বা ভবনটি ভেঙেও দিতে পারেন। আইন অনুযায়ী তাদের সেই ক্ষমতা রয়েছে। গতকাল সংস্থটির চেয়ারম্যান গণমাধ্যমে বলেছেন, বনানীর এফআর টাওয়ার ১৮তলা অনুমোদন নিলেও সেটি ২৩তলা করা হয়েছে। রাজউকের নকশাতেও নাকি বিচ্যূতি করা হয়েছে। তিনি নিজেই এগুলো ঘোষণা দিচ্ছেন। ভবন নির্মাণে এতসব বিচ্যূতি ঘটলো তাহলে ওনি কি করলেন?’

সাবেক এ প্রকৌশলী বলেন, ‘বনানীর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আসলে ১৮-২৩তলার সমস্যা না। মূল সমস্যা হলো ভবনটি নির্মাণে বিল্ডিং কোড মানা হয়নি। এত বড় ভবনে অগ্নিনির্বাপণে কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি। ভবন কোড মানা হলে একটি মানুষও গতকাল মারা যেত না। আর এটি মানতে মালিককে বাধ্য করার দায়িত্ব রাজউকের। তাই বনানীতে মৃত্যুর পুরো দায় রাজউকের। তবে আইন না মানায় ভবনের মালিক ও নির্মাতাও সমানভাবে দোষী।’ এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।

আজ পর্যন্ত বিল্ডিং কোডও আধুনিক করা হয়নি জানিয়ে প্রকৌশলী আবু সাদেক বলেন, ১৯৯৩ সালের করা বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবনগুলো নির্মাণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যদিও এটি আধুনিক না। ২০০৭ সালে আমরা বিল্ডিং কোডটিকে আধুনিকায়ন করেছিলাম। যদিও সেটি আজ পর্যন্ত কার্যকর করা হয়নি। তবে বনানীর ঘটনায় ’৯৩ সালের কোড মানা হলেও মৃত্যু এড়ানো যেত বলে মত প্রকাশ করেন তিনি।
বানানী দুর্ঘটনায় তিন পক্ষকে দায়ী করে তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর জাতীয় রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব বলেন, ‘এখানে মৃত্যুর প্রথম দায়ভার হলো ভবন মালিক ও নির্মাতার। ভবন নির্মাতা রূপায়ণ গ্রুপ আইন ভঙ্গ করে ভবন তৈরি করেছে। তারা যে আইন জানে না তা কিন্তু নয়। দ্বিতীয় দায়ভার হলো রাজউকের। তারা নকশা অনুমোদন দিয়েই কাজ শেষ করে ফেলেছে। নকশা অনুযায়ী কাজ হচ্ছে কি না, সে দেখভাল তারা করেনি বা দেখেও কোন ব্যবস্থা নেয়নি।’

তৃতীয় দায়ভারের বিষয়টি উল্লেখ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অধ্যাপক বলেন, ‘মৃত্যুর সামগ্রিক দায়ভার গিয়ে পড়ে সারকারের ওপর। আগের কয়েকটি ঘটনার পরও এসব দুর্ঘটনা রোধে সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে? রাজউক ঠিকমতো দায়িত্ব পালন না করলে সেটি গিয়ে পড়ে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ওপর। আবার মন্ত্রণালয় দিয়েও কাজ না হলো দায়ভার গিয়ে পড়ে প্রধানমন্ত্রীর ওপর। তাই এসব মৃত্যুর দায় সরকারকেই নিতে হবে।’

‘দামি গাড়ি, ব্যয়বহুল সফরসহ সবকিছুর আধুনিকায়ন হলেও ফায়ার সর্ভিসের আধুনিকায়ন হয়নি। আগুন লাগার পরই ঘটনাগুলোতে তাদের যন্ত্রপাতির সল্পতা পরিলক্ষিত হয়। বড় ভবনে দুর্ঘটনা হলেই তাদের অক্ষমতা নজরে আসে। অথচ এত বছরে এসেও সরকার অতিগুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিষ্ঠানকে আধুনিকায়ন করতে পারেনি বা করেনি। এটি খুবই দুঃখজনক’- বলছিলেন অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ।

এটাকে অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড উল্লেখ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হাবিব বলেন, ‘আমাদের দেশে কোন জায়গাতেই আসলে দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহীতা নেই। জনগণের টাকায় বেতন নিয়ে তাদেরই অবহেলায় জনগণের মৃত্যু ঘটছে। এসব অবহেলার কোন বিচার হচ্ছে না। এ মৃত্যুর দায়ভার রাজউক বা রাজউকের চেয়ারম্যান এড়িয়ে যেতে পারেন না।’ এখানে সিটি কর্পোরেশনেরও দায়দায়িত্ব আছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘রাজউকের দায়িত্ব ভবনের নকশা অনুমোদন দেওয়া, নকশা অনুযায়ী নির্মিত হচ্ছে কি না দেখভাল করা ও বছর বছর খতিয়ে দেখা যে সেখানে কোন পরিবর্তন আনা হয়েছে কিনা। অথচ রাজউকের চেয়ারম্যান বললেন ভবনটিতে নকশার বিচ্যূতি করা হয়েছে, কোড মানা হয়নি। দুর্ঘটনার পরে এটা জানা আমার দরকার কী? আগেই ঘোষণা দেন যে কোন ভবন নির্মাণে নকশার বিচ্যূতি করা করেছে, বিল্ডিং কোড মানা হয়নি, তাহলে সেসব ভবনে আমরা যাব না।’

শুক্রবার ঘটনা পরিদর্শনে গিয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বলেছেন, ভবনটি ১৮তলা হওয়ার কথা অথচ হয়েছে ২৩ তলা। সেটাও ১৪ বছর আগে। তাহলে গত ১৪ বছরে রাজউক কী করেছে বলে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।

সুউচ্চ এফআর টাওয়ার গড়তে ভবন নির্মাণের নীতিমালা মানা হয়নি বলে জানিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামও।

ওয়েবসাইট থেকে জানা গেছে, আট কাঠা জমির ওপর নির্মিত ভবনটির প্রতিটি তলায় বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্যে জায়গা রয়েছে ৬ হাজার বর্গফুট।

দমকল বাহিনীর সাবেক মহাপরিচালক আলী আহমেদ গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘এফআর টাওয়ারে আগুন নির্বাপক যন্ত্রপাতির স্বল্পতা ছিলো। এর সিঁড়ি লোকজনদের আগুন থেকে রক্ষা করা মতো উপযুক্ত ছিলো না। যেহেতু লোকজন সবাই ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন এবং ধোঁয়ায় চারপাশ অন্ধকার হয়ে গিয়েছিলো, বিশেষ করে সিঁড়িপথ, সেহেতু জীবন বাঁচাতে অনেকে ভবনটি থেকে লাফ দিয়েছিলেন।’

নিয়ম অনুযায়ী আগুন-রক্ষিত জরুরি নির্গমন পথ এবং আগুনে কয়েকঘণ্টা টিকে থাকার মতো পুরু দেয়াল থাকার কথা। যাতে মানুষ আগুন থেকে রক্ষা পেতে পারেন। ধোঁয়ার কারণে একজনের ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে মৃত্যু হতে পারে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

এ ঘটনায় ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, আগুন লাগা ভবনটির ভেতরে লোকজন জানালার কাঁচ ভেঙ্গে সাহায্যের জন্যে আর্তনাদ করছেন। আগুন থেকে বাঁচার জন্যে সেসময় কয়েকজন ব্যক্তি ভবন থেকে লাফ দেন। অনেকে রশি ও তার বেয়ে নিচে নেমে আসরে চেষ্টা করেন। অনেককে বিভিন্নস্থানে ঝুলে থাকতেও দেখা যায়।

গণমাধ্যমে দেওয়া রাজউক চেয়ারম্যানের বক্তব্য সত্য নয় দাবি করে এফআর টাওয়ারের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রূপায়নের উপদেষ্টা পি জে উল্যাহ বলেন, ‘১৯৯৬ সালে মালিক রাজউক থেকে ১৮তলার অনুমোদন নিয়ে কাজ শুরু করেন। তবে দুই তলা পর্যন্ত কাজ শেষ করার পর ২০০৩ সালে তিনি আমাদের সঙ্গে যুক্ত হন। এরপর ২০০৫ সালে আমরা রাজউক থেকে ২৩তলার অনুমোদন নিই। আমি আসলে বুঝতে পারছি না যে, রাজউক কেন পরের নকশাটার কথা বলছে না।’

বিল্ডিং কোড মেনেই ভবনটি নির্মিত হয়েছে দাবি করে সাবেক এই ক্যাপ্টেন বলেন, ‘১৯৯৬ সালে বিল্ডিং কোডে এতকিছু ছিল না। আমরা তখনকার নিয়ম মেনেই ভবনটি তৈরি করেছি। বর্তমান সময়ে ফায়ার এক্সিটসহ নানা আধুনিক বিষয় বিল্ডিং কোডে যুক্ত হয়েছে।’ তখন এসব কিছুই ছিল না বলে দাবি করেন তিনি।

শুক্রবার সকালে পুড়ে যাওয়া ভবনটি পরিদর্শন শেষে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমও বলেছেন, ‘১৮ তলার অনুমোদন নিয়ে ২৩ তলা করা হয়েছে বনানীর এফ আর টাওয়ার। এটি নিছক দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকাণ্ড। এর জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

ঘটনার দিন রাজউকের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আগুন লাগা ভবনটির নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, ১৮ তলা হিসেবে ভবনটির নকশা ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর অনুমোদন করা হয়। কিন্তু এই ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে ২৩ তলা। শুধু তাই নয়, রাউজকের অনুমোদিত নকশা থেকে এই ভবনের নকশায় অনেক বিচ্যূতি আছে। ভবনটির মালিকপক্ষ ২০০৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রাজউকের কাছে আরেকটি নকশা পেশ করে, যার সঙ্গে রাজউকে সংরক্ষিত নকশার কোনো মিল নেই। অর্থাৎ ২০০৫ সালে পেশ করা নকশাটি বৈধ ছিল না। শুধু তাই নয়, রাজউকের অনুমোদিত নকশা থেকে এই ভবনের নকশায় অনেক বিচ্যুতি আছে।’

এর আগে ২০০৮ সালেও ভবনটিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ওই বছরের ৩১ আগস্টে বেজমেন্ট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়ে পুরো ভবন ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে সৃষ্টি হয়েছিল আতঙ্কজনক পরিস্থিতির। ঘটনার পর এফআর টাওয়ারের অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। এরপর ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিলে হওয়া ভূমিকম্পে হেলে পড়েছিল ভবনটি। এত অব্যবস্থাপনার পরও কোন ধরনের ব্যবস্থা না নেওয়ায় বৃহস্পতিবার এতবড় দুর্ঘটনার মাশুল দিতে হলো বলে মত বিশেষজ্ঞদের।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :




ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে বনানী ‘হত্যার’ দায় রাজউক ও রূপায়নের

আপডেট সময় : ১০:৪২:১২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০১৯

এফআর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ২৫ জনের মৃত্যুর ঘটনাকে নিছক দুর্ঘটনা না বলে ‘হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। ভবনটি নির্মাণে নানা অনিয়ম হওয়ায় এটিকে ‘হত্যাকাণ্ড’ বলছেন বিশেষজ্ঞরাও। এটি ‘হত্যাকাণ্ড’ হলে এখন প্রশ্ন আসে ‘হত্যাকারী’ কে বা কারা? এই ‘হত্যাকারী’ খুঁজে বের করতে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছে ‘বাংলা’।

রাজধানীর অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত আতাতুর্ক এভিনিউর এই ভবনে গতকাল বৃহস্পতিবার অগ্নিকাণ্ডে ২৫ জনের মৃত্যু ঘটেছে। আহত হয়েছেন শতাধিক।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ভবনের নির্মাতা-মালিক ও সামগ্রিকভাবে সরকারকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, মালিক ও নির্মাতা আইন লঙ্ঘন করে ভবন নির্মাণ করেছে। তবে আইন বা বিল্ডিং কোড মানতে মালিককে বাধ্য করার দায়িত্ব রাজউকের। আর রাজউক দায়িত্বে অবহেলা করলে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। তাই এখানে তিনপক্ষই দোষী।

হাউজিং এন্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ আবু সাদেক বলেন, ‘রাজউক যখন একটি ভবনের নকশা অনুমোদন দেয়, এরপর সেই নকশা অনুযায়ী ভবনটি হচ্ছে কি না বা বিল্ডিং কোড মানা হচ্ছে কি না এসব দেখভাল করার দায়িত্বও তাদের। রাজউকের অথরাইজড কর্মকর্তা ও ইন্সপেক্টর রয়েছে। রাজউকের পাসকৃত প্ল্যান অনুযায়ী কাজটি না হলে এসব কর্মকর্তা ও ইন্সপেক্টর ভবনটির নির্মাণকাজ বন্ধ করে দিতে পারেন বা ভবনটি ভেঙেও দিতে পারেন। আইন অনুযায়ী তাদের সেই ক্ষমতা রয়েছে। গতকাল সংস্থটির চেয়ারম্যান গণমাধ্যমে বলেছেন, বনানীর এফআর টাওয়ার ১৮তলা অনুমোদন নিলেও সেটি ২৩তলা করা হয়েছে। রাজউকের নকশাতেও নাকি বিচ্যূতি করা হয়েছে। তিনি নিজেই এগুলো ঘোষণা দিচ্ছেন। ভবন নির্মাণে এতসব বিচ্যূতি ঘটলো তাহলে ওনি কি করলেন?’

সাবেক এ প্রকৌশলী বলেন, ‘বনানীর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আসলে ১৮-২৩তলার সমস্যা না। মূল সমস্যা হলো ভবনটি নির্মাণে বিল্ডিং কোড মানা হয়নি। এত বড় ভবনে অগ্নিনির্বাপণে কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি। ভবন কোড মানা হলে একটি মানুষও গতকাল মারা যেত না। আর এটি মানতে মালিককে বাধ্য করার দায়িত্ব রাজউকের। তাই বনানীতে মৃত্যুর পুরো দায় রাজউকের। তবে আইন না মানায় ভবনের মালিক ও নির্মাতাও সমানভাবে দোষী।’ এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।

আজ পর্যন্ত বিল্ডিং কোডও আধুনিক করা হয়নি জানিয়ে প্রকৌশলী আবু সাদেক বলেন, ১৯৯৩ সালের করা বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবনগুলো নির্মাণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যদিও এটি আধুনিক না। ২০০৭ সালে আমরা বিল্ডিং কোডটিকে আধুনিকায়ন করেছিলাম। যদিও সেটি আজ পর্যন্ত কার্যকর করা হয়নি। তবে বনানীর ঘটনায় ’৯৩ সালের কোড মানা হলেও মৃত্যু এড়ানো যেত বলে মত প্রকাশ করেন তিনি।
বানানী দুর্ঘটনায় তিন পক্ষকে দায়ী করে তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর জাতীয় রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব বলেন, ‘এখানে মৃত্যুর প্রথম দায়ভার হলো ভবন মালিক ও নির্মাতার। ভবন নির্মাতা রূপায়ণ গ্রুপ আইন ভঙ্গ করে ভবন তৈরি করেছে। তারা যে আইন জানে না তা কিন্তু নয়। দ্বিতীয় দায়ভার হলো রাজউকের। তারা নকশা অনুমোদন দিয়েই কাজ শেষ করে ফেলেছে। নকশা অনুযায়ী কাজ হচ্ছে কি না, সে দেখভাল তারা করেনি বা দেখেও কোন ব্যবস্থা নেয়নি।’

তৃতীয় দায়ভারের বিষয়টি উল্লেখ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অধ্যাপক বলেন, ‘মৃত্যুর সামগ্রিক দায়ভার গিয়ে পড়ে সারকারের ওপর। আগের কয়েকটি ঘটনার পরও এসব দুর্ঘটনা রোধে সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে? রাজউক ঠিকমতো দায়িত্ব পালন না করলে সেটি গিয়ে পড়ে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ওপর। আবার মন্ত্রণালয় দিয়েও কাজ না হলো দায়ভার গিয়ে পড়ে প্রধানমন্ত্রীর ওপর। তাই এসব মৃত্যুর দায় সরকারকেই নিতে হবে।’

‘দামি গাড়ি, ব্যয়বহুল সফরসহ সবকিছুর আধুনিকায়ন হলেও ফায়ার সর্ভিসের আধুনিকায়ন হয়নি। আগুন লাগার পরই ঘটনাগুলোতে তাদের যন্ত্রপাতির সল্পতা পরিলক্ষিত হয়। বড় ভবনে দুর্ঘটনা হলেই তাদের অক্ষমতা নজরে আসে। অথচ এত বছরে এসেও সরকার অতিগুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিষ্ঠানকে আধুনিকায়ন করতে পারেনি বা করেনি। এটি খুবই দুঃখজনক’- বলছিলেন অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ।

এটাকে অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড উল্লেখ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হাবিব বলেন, ‘আমাদের দেশে কোন জায়গাতেই আসলে দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহীতা নেই। জনগণের টাকায় বেতন নিয়ে তাদেরই অবহেলায় জনগণের মৃত্যু ঘটছে। এসব অবহেলার কোন বিচার হচ্ছে না। এ মৃত্যুর দায়ভার রাজউক বা রাজউকের চেয়ারম্যান এড়িয়ে যেতে পারেন না।’ এখানে সিটি কর্পোরেশনেরও দায়দায়িত্ব আছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘রাজউকের দায়িত্ব ভবনের নকশা অনুমোদন দেওয়া, নকশা অনুযায়ী নির্মিত হচ্ছে কি না দেখভাল করা ও বছর বছর খতিয়ে দেখা যে সেখানে কোন পরিবর্তন আনা হয়েছে কিনা। অথচ রাজউকের চেয়ারম্যান বললেন ভবনটিতে নকশার বিচ্যূতি করা হয়েছে, কোড মানা হয়নি। দুর্ঘটনার পরে এটা জানা আমার দরকার কী? আগেই ঘোষণা দেন যে কোন ভবন নির্মাণে নকশার বিচ্যূতি করা করেছে, বিল্ডিং কোড মানা হয়নি, তাহলে সেসব ভবনে আমরা যাব না।’

শুক্রবার ঘটনা পরিদর্শনে গিয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বলেছেন, ভবনটি ১৮তলা হওয়ার কথা অথচ হয়েছে ২৩ তলা। সেটাও ১৪ বছর আগে। তাহলে গত ১৪ বছরে রাজউক কী করেছে বলে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।

সুউচ্চ এফআর টাওয়ার গড়তে ভবন নির্মাণের নীতিমালা মানা হয়নি বলে জানিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামও।

ওয়েবসাইট থেকে জানা গেছে, আট কাঠা জমির ওপর নির্মিত ভবনটির প্রতিটি তলায় বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্যে জায়গা রয়েছে ৬ হাজার বর্গফুট।

দমকল বাহিনীর সাবেক মহাপরিচালক আলী আহমেদ গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘এফআর টাওয়ারে আগুন নির্বাপক যন্ত্রপাতির স্বল্পতা ছিলো। এর সিঁড়ি লোকজনদের আগুন থেকে রক্ষা করা মতো উপযুক্ত ছিলো না। যেহেতু লোকজন সবাই ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন এবং ধোঁয়ায় চারপাশ অন্ধকার হয়ে গিয়েছিলো, বিশেষ করে সিঁড়িপথ, সেহেতু জীবন বাঁচাতে অনেকে ভবনটি থেকে লাফ দিয়েছিলেন।’

নিয়ম অনুযায়ী আগুন-রক্ষিত জরুরি নির্গমন পথ এবং আগুনে কয়েকঘণ্টা টিকে থাকার মতো পুরু দেয়াল থাকার কথা। যাতে মানুষ আগুন থেকে রক্ষা পেতে পারেন। ধোঁয়ার কারণে একজনের ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে মৃত্যু হতে পারে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

এ ঘটনায় ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, আগুন লাগা ভবনটির ভেতরে লোকজন জানালার কাঁচ ভেঙ্গে সাহায্যের জন্যে আর্তনাদ করছেন। আগুন থেকে বাঁচার জন্যে সেসময় কয়েকজন ব্যক্তি ভবন থেকে লাফ দেন। অনেকে রশি ও তার বেয়ে নিচে নেমে আসরে চেষ্টা করেন। অনেককে বিভিন্নস্থানে ঝুলে থাকতেও দেখা যায়।

গণমাধ্যমে দেওয়া রাজউক চেয়ারম্যানের বক্তব্য সত্য নয় দাবি করে এফআর টাওয়ারের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রূপায়নের উপদেষ্টা পি জে উল্যাহ বলেন, ‘১৯৯৬ সালে মালিক রাজউক থেকে ১৮তলার অনুমোদন নিয়ে কাজ শুরু করেন। তবে দুই তলা পর্যন্ত কাজ শেষ করার পর ২০০৩ সালে তিনি আমাদের সঙ্গে যুক্ত হন। এরপর ২০০৫ সালে আমরা রাজউক থেকে ২৩তলার অনুমোদন নিই। আমি আসলে বুঝতে পারছি না যে, রাজউক কেন পরের নকশাটার কথা বলছে না।’

বিল্ডিং কোড মেনেই ভবনটি নির্মিত হয়েছে দাবি করে সাবেক এই ক্যাপ্টেন বলেন, ‘১৯৯৬ সালে বিল্ডিং কোডে এতকিছু ছিল না। আমরা তখনকার নিয়ম মেনেই ভবনটি তৈরি করেছি। বর্তমান সময়ে ফায়ার এক্সিটসহ নানা আধুনিক বিষয় বিল্ডিং কোডে যুক্ত হয়েছে।’ তখন এসব কিছুই ছিল না বলে দাবি করেন তিনি।

শুক্রবার সকালে পুড়ে যাওয়া ভবনটি পরিদর্শন শেষে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমও বলেছেন, ‘১৮ তলার অনুমোদন নিয়ে ২৩ তলা করা হয়েছে বনানীর এফ আর টাওয়ার। এটি নিছক দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকাণ্ড। এর জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

ঘটনার দিন রাজউকের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আগুন লাগা ভবনটির নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, ১৮ তলা হিসেবে ভবনটির নকশা ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর অনুমোদন করা হয়। কিন্তু এই ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে ২৩ তলা। শুধু তাই নয়, রাউজকের অনুমোদিত নকশা থেকে এই ভবনের নকশায় অনেক বিচ্যূতি আছে। ভবনটির মালিকপক্ষ ২০০৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রাজউকের কাছে আরেকটি নকশা পেশ করে, যার সঙ্গে রাজউকে সংরক্ষিত নকশার কোনো মিল নেই। অর্থাৎ ২০০৫ সালে পেশ করা নকশাটি বৈধ ছিল না। শুধু তাই নয়, রাজউকের অনুমোদিত নকশা থেকে এই ভবনের নকশায় অনেক বিচ্যুতি আছে।’

এর আগে ২০০৮ সালেও ভবনটিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ওই বছরের ৩১ আগস্টে বেজমেন্ট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়ে পুরো ভবন ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে সৃষ্টি হয়েছিল আতঙ্কজনক পরিস্থিতির। ঘটনার পর এফআর টাওয়ারের অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। এরপর ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিলে হওয়া ভূমিকম্পে হেলে পড়েছিল ভবনটি। এত অব্যবস্থাপনার পরও কোন ধরনের ব্যবস্থা না নেওয়ায় বৃহস্পতিবার এতবড় দুর্ঘটনার মাশুল দিতে হলো বলে মত বিশেষজ্ঞদের।