অবৈধ ব্যাংকিংয়ের শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংকের চেয়ারম্যান
- আপডেট সময় : ১২:১৭:১৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৩ নভেম্বর ২০১৯ ১৩২ বার পড়া হয়েছে
এইচ আর শফিক;
সমবায় অধিদপ্তর থেকে দি ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ সোসাইটির নিবন্ধন নিয়ে সোসাইটির পরিবর্তে ব্যাংক শব্দটি জুড়ে দিয়ে সাধারন জনগনের কাছে ব্যাংক হিসেবে পরিচিতি লাভ করে প্রতিষ্ঠানটি। আর এই সমিতির অন্তরালেই অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম চালিয়ে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান আবু জাফর চৌধুরী হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়ে এখন সে প্রভাবশালী কোটিপতিদের একজন। ব্যাংক না হলেও অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম চালিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করছে যাচ্ছে মহাসমারোহে। মাত্র তিন কোটি টাকার শেয়ার মূলধনের বিপরীতে হাজার কোটি টাকার আগ্রাসী আমানত সংগ্রহের চিত্র উঠে আসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে। আর একারনে দি মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেডকে অবৈধ ব্যাংকিং ব্যবসা বন্ধের নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে প্রতিষ্ঠানটির কাছে চিঠি দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জবাব চাইলেও সন্তোষজনক উত্তর দিতে পায়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১১ অক্টোবর-২০১৮ সব ধরনের ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ করতে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি দেয়। সমবায় সমিতির কার্যক্রম চালানোর লক্ষ্যে গঠন করা হয় দি মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ সোসাইটি। কিন্তু সমবায়ের আড়ালে অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম চালানো সহ প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে জঙ্গিদের সংগঠনের প্রতি অর্থায়নের অভিযোগও উঠে আসে। পাশাপাশি উচ্চ মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে সারা দেশে ১২০টি শাখার মাধ্যমে দেড় লাখ গ্রাহক থেকে আমানত সংগ্রহ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তাই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবকে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে প্রতিষ্ঠানটির অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধে করণীয় নির্ধারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০১৬ সালের ৩ এপ্রিল প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় সভা করে। সভায় বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধন কার্যালয়, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি, সমবায় অধিদফতর, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি সমবায় অধিদফতর থেকে ১৯৭৩ সালের ‘দি বেঙ্গল কো-অপারেটিভ সোসাইটি অ্যাক্ট-১৯৪০’ এর বিধান অনুযায়ী সমবায় প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধন নিয়েছে। এটি বাংলাদেশ ব্যাংক বা ব্যাংক কোম্পানি আইন-১৯৯১ অনুযায়ী কোনো ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধিত নয়। তবে সমবায় অধিদফতর থেকে এই প্রতিষ্ঠানের নামের শেষে ব্যাংক শব্দ ব্যবহার না করার নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও তার তোয়াক্কা না করেই অবৈধ ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি আমানত সংগ্রহ করেছে হাজার হাজার কোটি টাকার ওপর।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইনজীবী আজমালুল হক কিউসি বলেছেন, প্রতিষ্ঠানটির বৈধ সমবায় কার্যক্রম অব্যাহত রেখে অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অবৈধ ব্যাংকিং পরিচালনা করার প্রমাণও মিলেছে। আর এই প্রতিষ্ঠানের অবৈধ ব্যাংকিংয়ের পাশাপাশি অর্থপাচার ও সন্ত্রাসে অর্থ প্রদান জড়িত কি না সেটি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সমন্বয়সভায়।
অনুষ্ঠিত ওই সভায় সব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিএফআইইউকে প্রয়োজনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নিতে বলা হয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর পরস্পরের মধ্যে সহজে ও অবাধে তথ্য আদান-প্রদানেরও সিদ্ধান্ত হয়েছে সভায়। এ ছাড়া বড় প্রকল্পে অর্থায়নে বন্ড মার্কেট আরো শক্তিশালী করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
সভায় বলা হয়, তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে আইনগত কোনো জটিলতা থাকলে প্রয়োজনে তা সংশোধন এবং যেখানে এ ধরনের জটিলতা নেই সেখানে পারস্পরিক সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করতে হবে। সভায় উপস্থিত একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো: সিরাজুল ইসলাম বলেন, সমবায় প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নিয়ে জনগণের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহের মতো অবৈধ কার্যক্রম চালাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলো সমবায় অধিদপ্তর থেকে লাইসেন্স নেয় সমবায় কার্যক্রম পরিচালনা করবে বলে। কিন্তু তারা নামের শেষে ব্যাংক শব্দ ব্যবহার ও অবৈধ ব্যাংকিং করছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কৈফিয়ত তলব করা হলেই তারা হাইকোর্টে রিট করে। তখন আর কিছু করার থাকে না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, লাখ টাকা জমা রাখলে মাসে দুই হাজার টাকা করে মুনাফা। এমন প্রলোভনে সমবায় সমিতির নামে যাদুর ছোঁয়ায় পুরো মাত্রায় ব্যাংকিং কার্যক্রম প্রতিষ্ঠিত করে এই প্রতিষ্ঠানটি।
অথচ সমবায় অধিদপ্তর ও প্রশাসনের নাকের ডগায় বসেই উচ্চ হারের সুদের প্রলোভন দেখিয়ে দি ঢাকা মাকেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড বাণিজ্যিক ব্যাংকের মতো চেক বই, মেয়াদী আমানত, মাসিক সুদ প্রদানের সুবিধাসহ বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে জনগণের সঙ্গে করেছে ব্যাংকিং প্রতারণা। লোপাট হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। যার অধিকাংশ মালয়েশিয়ায় পাচার হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
১৯৪০ সালের সমবায় আইনের আওতায় আর্থিক কার্যক্রম ১টির বেশি শাখা খোলার নিষেধাজ্ঞা থাকলেও দি ঢাকা মাকেন্টাইল কো অপারেটিভ রাজধানীর মতিঝিল ও মিরপুর, ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জ, বাগেরহাট, খুলনা, জামালপুর, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন জেলায় চালাচ্ছে অবৈধ ব্যাংকিং।
একস্থানে বড় সাইনবোর্ড দিয়ে কার্যক্রম শুরু করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার কিছুদিন পরই বন্ধ করে অন্য জেলায় চলেছে অবৈধ ব্যাংকিং। সমবায় অধিদপ্তরের দেখভালের কথা থাকলেও তাদের নাকের ডগায় চলছে এমন জালিয়াতি। বরং অনেক ক্ষেত্রেই সমবায়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সহযোগিতা করছে। যার প্রমাণ প্রতি বছর অডিট হওয়ার কথা থাকলেও মনগড়া অডিট তৈরি করার কথা উঠে আসে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানেও এরূপ ২০ থেকে ২৫টি সমবায় সমিতির খোঁজ মিলেছে।
যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মাঠে নেমেছে দুদক। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন যাবৎ প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ থাকলেও একটি সিন্ডিকেটের প্রভাবে সমবায় অধিদপ্তর থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। শুধু তাই নয় অবৈধ সুবিধা দিয়ে সমবায় অধিদপ্তরের কতিপয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আর্থিক সুবিধা গ্রহনের প্রমানও মিলেছে দুদকের অনুসন্ধানে। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও এমডিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ ওঠে আসে।