ইন্টারনেট বিক্রির ‘ডাকাতি’তে বাংলাদেশ নিকৃষ্টতম!
- আপডেট সময় : ০২:৩৮:০২ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩ এপ্রিল ২০১৯ ১৯৮ বার পড়া হয়েছে
বাংলাদেশে গেলে আমি মোটামুটি বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি! এ যে কী এক যন্ত্রণা, সেটা আজকের এই যুগে যেকোনো মানুষই বুঝবেন।
দীর্ঘ তিন বছর ধরে আমি ভারতে থাকি, গবেষণার কাজে। স্বভাবতই ইন্টারনেটের ওপর আমার নির্ভরতা অনেক বেশি। সেই আলোকেই এই লেখাটি লিখছি। একদম অভিজ্ঞতা থেকে।
আমার অভিজ্ঞতা বলে, পৃথিবীতে বাংলাদেশই সম্ভবত সেই দেশ, যেখানে ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার নাম করে মানুষের পরিশ্রমের টাকা সবচেয়ে বেশি ‘ডাকাতি’ করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। অথচ, মানুষ কত অসহায়, ঠিকঠাক সেবাটা ব্যবহারও করতে পারে না!
২.
আমার ইন্টারনেটের অফার, ট্যারিফ ও ব্যবহার্য তরিকা সম্পর্কে জ্ঞান খুবই কম। তবুও, যতটুকু বুঝি, ইন্টারনেট সবচেয়ে বেশি দুটি উপায়ে ব্যবহার করি আমরা। একটি ফাইবার অপটিক ক্যাবল দিয়ে; আরেকটি মোবাইল ডাটার মাধ্যমে।
ফাইবার অপটিক ক্যাবল দিয়ে যেটা ব্যবহার করি, সেটাকে সহজ ভাষায় আমরা বলি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট। ব্রডব্যান্ড আবার বাংলাদেশের সর্বত্র পাওয়া যায় না। অধিকাংশ উপজেলা শহরেই ব্রডব্যান্ড নেই। থাকলেও, শম্বুকগতি!
প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ছে, বাংলাদেশে একটা সময় উপজেলাগুলোতে ক্যাবলের মাধ্যমে স্যাটেলাইট চ্যানেল (কথ্য ভাষায়, ডিশ লাইন) সরবরাহেরও অপ্রতুলতা ছিল। এখন তো উপজেলা শুধু নয়, ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়েও ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে স্যাটেলাইট চ্যানেল। সুতরাং, ক্যাবলের মাধ্যমে ইন্টারনেটও হয়তো ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবে একদিন। কিন্তু, কোটি টাকার প্রশ্ন হলো, সেই দিনটা কবে আসবে?
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের একটি কথা মনে পড়ছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পেয়েই তিনি বলেছিলেন যে, ইন্টারনেটের দাম কমাবেন। এরপর, ফেব্রুয়ারিতে আইসিটি মেলা ২০১৮’র উদ্বোধনকালে তিনি জানিয়েছিলেন – ‘সবার কাছে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেয়া এবং ইন্টারনেটের দাম কমানোর জন্য সরকার তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ইতোমধ্যে ইনফো সরকার ১ এবং ২ বাস্তবায়িত হয়েছে। এখন ইনফো সরকার ৩ এর মাধ্যমে দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে ফাইবার অপটিক ক্যাবলের মাধ্যমে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পৌঁছে দেয়া হবে। ২০১৮ সালের মধ্যে কাজটি সম্পন্ন হবে। এই প্লাটফর্মটি তৈরি হলে গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেটের দাম আরো কমবে।’ (ঢাকা টাইমস, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮)
এক বছর পরের প্রকৃত চিত্র কী? ইউনিয়ন তো দূরের কথা, বহু উপজেলাতে পর্যন্ত তারের ব্রডব্যান্ড যায়নি। তো সর্বত্র ইন্টারনেট গেলেই না কেবল বলা যাবে যে, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা! কিন্তু, সত্যের খাতিরে আমাদের বলতেই হবে যে, ব্রডব্যান্ড দিয়ে সর্বত্র ইন্টারনেট ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব না। যেটা দিয়ে সম্ভব, সেটা কর্তারা হয় ধরতে পারছেন না নতুবা একটু অতীতে গিয়ে শিক্ষা নিচ্ছেন না। আমি বলছি।
বাংলাদেশে যখন মোবাইল এলো, ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল ল্যান্ডফোন। মনে পড়ে কীভাবে কমে গিয়েছিল টিএন্ডটি ল্যান্ডফোনের জন-আবেদন? আগে কোনো বাড়িতে ল্যান্ডফোন রাখাকে আভিজাত্য হিসেবে মনে করা হতো। আজ কোথায় সেই আভিজাত্য! মানুষ এখন বাস্তবতায় পা রেখে বুঝেছে যে, ঘরে-বাইরে সর্বত্র সংযুক্ত থাকার জন্য তো আসলে মোবাইলই সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম। অতএব, ঘরের ল্যান্ডলাইন কাটা পড়ে গেল! ইন্টারনেটের ক্ষেত্রেও ওই একই কথাটাই বলতে হবে। ঘর কিংবা বাহির, মানুষ এখন সর্বক্ষণ যুক্ত থাকতে চায় ইন্টারনেটের সঙ্গে। তারের ব্রডব্যান্ড দিয়ে সেটা কোনভাবেই সম্ভব না। মানুষের এই যুক্ত থাকতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়ন করার শ্রেষ্ঠ উপায় আসলে মোবাইল-ইন্টারনেট। ফলে, ভরসার জায়গাটা টেলিকম অপারেটর কোম্পানিগুলোর মোবাইল ডাটাই। বিটিআরসির তথ্য মতে, বাংলাদেশে গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক ও সরকারি অপারেটর টেলিটক এই সেবা দিচ্ছে। এদের প্রদত্ত মোবাইল ডাটাই হয় মডেম নতুবা সেলফোনের মাধ্যমে ব্যবহার করি আমরা।
এই লেখাটি টেলিকম কোম্পানিগুলোর সেই ‘মোবাইল ডাটা’র নিয়ন্ত্রণহীন গগণচুম্বি মূল্য নিয়েই।
৩.
বাংলাদেশের ‘মোবাইল ডাটা’র মূল্য বিষয়ে কথা বলার আগে, সাম্প্রতিক একটি জরিপের প্রসঙ্গে কথা বলা যাক। জরিপটি করেছে ‘ক্যাবল’ নামের যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান। সেই জরিপে বিশ্বের ২৩০টি দেশে চলমান বিভিন্ন ইন্টারনেট প্যাকেজ ও প্ল্যানগুলো থেকে কমপক্ষে ১ জিবির মূল্য হিসাব করে একটি তালিকা করা হয়েছে। তালিকায় বিশ্বে সবচেয়ে সাশ্রয়ী মূল্যে ইন্টারনেট সরবরাহের ক্ষেত্রে এক নম্বরে রয়েছে ভারত। বাংলাদেশ রয়েছে ১৩তম স্থানে। এক ও তেরোর মধ্যে পার্থক্য খুব বেশি নয় নিশ্চয়ই। কিন্তু, দুটি দেশের ইন্টারনেটের মূল্য তুলনা করলে দেখা যাবে পরিস্থিতি আসলে এই স্বল্প পার্থক্যের মতো এতো সহজ নয়।
জরিপকারী প্রতিষ্ঠানটি ভারতের ৫৭টি ইন্টারনেট প্ল্যান পর্যালোচনা করেছে, ৯ নভেম্বর ২০১৮-তে। তাতে ফলাফল বলছে, ভারতে এক জিবির গড় মূল্য ০.২৬ ইউএস ডলার। এক জিবির সর্বনিম্ন মূল্য ০.০২ ইউএস ডলার। সর্বোচ্চ মূল্য ১.৪০ ইউএস ডলার। অন্যদিকে, বাংলাদেশেরও প্রায় কাছাকাছি প্ল্যানই পর্যালোচনা করেছে তারা ২৯ অক্টোবর ২০১৮-তে। বাংলাদেশ থেকে নিয়েছে ৫৩টি প্ল্যান। বাংলাদেশে এক জিবির গড় মূল্য ০.৯৯ ইউএস ডলার। সর্বনিম্ন মূল্য ০.১৮ এবং সর্বোচ্চ ৩.৮১ ইউএস ডলার। আগ্রহীরা এখান থেকে বিস্তারিত দেখে নিতে পারেন (https://www.cable.co.uk/mobiles/worldwide-data-pricing/)।
তুলনাটা যখন এলোই, তখন আমি বরং আরও সহজ ও দৃশ্যমান উদাহরণ দেখাই। আমার মনে হয়, ভারতে কোন কোন কোম্পানি টেলিকম অপারেটর হিসেবে ব্যবসা করছে, তা বাংলাদেশের সচেতন নাগরিকদের অজ্ঞাত নয়। জিও, রিলায়ান্স, আইডিয়া, এয়ারটেল, ভোডাফোন এগুলোই মোটামুটি শীর্ষ কোম্পানি। আর আছে রাষ্ট্রীয় টেলিকম প্রতিষ্ঠান বিএসএনএল। বিভিন্ন কোম্পানির প্রভাব বিভিন্ন প্রদেশে একেক রকম। গুজরাতে যেমন আইডিয়ার জনপ্রিয়তা বেশি, পশ্চিম বাংলায় এয়ারটেল আর ভোডাফোনের। কিন্তু, এদের ট্যারিফগুলো দেখলে বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মাথায় হাত পড়তে বাধ্য!
আমার নিজের উদাহরণটা আগে দেই। আমি এখানে এসে ব্যবহার শুরু করলাম আইডিয়া থ্রি-জি সিম। এর মাত্র চার-পাঁচ মাস পরেই জিওর ভিও-এলটিই (ভয়েস ওভার লং টার্ম ইভালিউশন, যা থ্রি-জি’র চেয়ে ১০ গুণ অধিক গতিশীল নেটওয়ার্ক) গতিসম্পন্ন ফোর-জি-তে চলে যাই। আম্বানি গ্রুপের রিলায়ন্সের জিও ফোর-জি সিম ভারতের বাজারে আসে ২০১৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর এবং সঙ্গে সঙ্গেই জিও মোবাইল-ইন্টারনেটের ব্যবসায় রীতিমতো ‘বিপ্লব’ ঘটিয়ে ফেলে। ফলে, প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে, অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অন্যান্য কোম্পানিগুলোকেও স্বল্পমূল্যে মনমাতানো ‘অফার’ নিয়ে হাজির হতে হয়েছিল সহসাই। এবার সে কথাটিতেই আসছি। বলছি, ‘জিও ধামাকা’ বাজারে কীভাবে ভূমিকম্পন সৃষ্টি করেছে, সে কথায়। সেজন্য সবার আগে বর্তমান ট্যারিফ প্ল্যানগুলোতে একটু মোটাদাগে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।
আমি সাধারণত জিওর যে প্ল্যানটি ব্যবহার করি, সেটার মূল্য ৩৯৯ ভারতীয় রূপি। এই প্ল্যানের মেয়াদ ৮৪ দিন। এই প্ল্যানে প্রতিদিন পাওয়া যায় ১.৫ জিবি ডাটা, মানে সর্বমোট ১২৬ জিবি। এই ডাটা আমি আমার মোবাইল ও ল্যাপটপে ওয়াইফাই (জিওফাই পোর্টেবল বা ভ্রাম্যমান রাউটারের মাধ্যমে) আকারে ব্যবহার করে। এতেই আমার হয়ে যায়। এমনকি ল্যাপটপ ব্যবহারের পরও, কখনও কখনও আমার দিনে ১ জিবি করে অব্যবহৃতও থেকে যায়! এতে কোনোদিন আফসোস হয়েছে বলেও মনে হয় না।
জিওর প্রতিদিন ১ জিবি থেকে ৫ জিবি পর্যন্ত অফার আছে, বিভিন্ন মেয়াদে। সর্বোচ্চ অফারটি হলো ৭৯৯ ভারতীয় রূপিতে ২৮ দিনের জন্য ১৪০ জিবি, মানে প্রতিদিন ৫ জিবি। যাদের ইন্টারনেট বহুমাত্রিক কাজে ও অনেক ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন তারা সাধারণত এ ধরনের প্ল্যান কিনেন।
এবার অন্যান্য প্রধান অপারেটরগুলোর দিকে তাকাই। এয়ারটেলের ৮৪ দিন মেয়াদে ৩৯৯ রূপিতে পাওয়া যায় প্রতিদিন ১ জিবি। আরেকটি প্ল্যানে ২৮ দিন মেয়াদের প্রতিদিন ১ জিবির মূল্য ১৭৯ রূপি। এভাবে বিভিন্ন মূল্য ও মেয়াদে কোম্পানিটি ১০০ এমবি থেকে ৬০ জিবি পর্যন্ত ক্রয়সীমা রেখেছে। ভোডাফোনের ৮৪ দিনে মেয়াদে প্রতিদিন ১.৫ জিবির মূল্য ৪৭৯ রূপি। এদেরও ২৮ দিনের প্রতিদিনের জন্য ১ জিবির মূল্য ১৭৯ রূপি। আইডিয়াও একই মেয়াদ ও খরচে সমান অফার দিচ্ছে। আইডিয়া অবশ্য ৮২ দিনের মেয়াদে প্রতিদিন ১.৪ জিবি হারে দেয় ৪৪৯ রূপিতে। চরম প্রতিযোগিতার যুগে ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছে, এই প্ল্যানটি আসলে তারই প্রমাণ!
তবে, মোবাইল ডাটায় চমক দিতে না পারলেও, সম্প্রতি সবচেয়ে বড় চমক নিয়ে এসেছে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব টেলিকম অপারেটর বিএসএনএল। এফটিটিএইচের (ফাইবার টু দ্যা হোম) আওতায় মাত্র ১.১০ রূপিতে তারা দিচ্ছে ১ জিবি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট। যেটা কি না ভারতের সকল ইন্টারনেট ট্যারিফের মধ্যে সর্বনিম্ন। বিভিন্ন প্ল্যানের আওতায় এই এফটিটিএইচের সর্বনিম্ন ব্যান্ডউইথ বা ডাউনলোড গতি ৫০ এমবিপিএস! জিওর আশ্চর্যজনক পদক্ষেপকেও টপকে গেছে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠানটি। ভাবা যায়!
(বিভিন্ন অপারেটরের প্ল্যানগুলো আরও বিস্তারিত দেখতে পারেন এখানে: https://www.91mobiles.com/recharge-plans) এছাড়া কোম্পানিগুলোর নিজস্ব ওয়েবসাইটেও যেতে পারেন।
আশা করি, যেটুকু উদাহরণ দিয়েছি, তাতেই আপনার চোখ ছানাবড়া হওয়া সারা। কিন্তু প্রিয় পাঠক, গল্পের আরেকটি অংশ এখনও বলা বাকি আছে। আপনার বিশ্বাস হবে কিনা জানি না, এই যে ইন্টারনেটের অফারগুলো কোম্পানিগুলো দিচ্ছে, এগুলোর সঙ্গে যুক্ত আছে আনলিমিটেড ভয়েস কল, প্রতিদিন ১০০ এসএমএস এবং স্টেট রোমিংয়ের (এক প্রদেশের সিম আরেক প্রদেশে গেলে তা ভারতে রোমিংয়ের আওতায় পড়ে) আউটগোয়িং ও ইনকামিং একদম ফ্রি! মানে কল ও এসএমএস করার জন্য গ্রাহককে অতিরিক্ত কোন টাকা খরচ করতে হয় না। আপনার একটি এন্ড্রোয়েড ফোন আছে, ইন্টারনেট ডাটা প্যাক কিনে ফেলুন যে কোন মেয়াদের। কল আর এসএমএস নিয়ে কোন চিন্তাই করতে হবে না! গুড এন্ড সার্ভিস ট্যাক্স (জিএসটি) নিয়েও বাড়তি চিন্তা নেই। সবই ওই মূল্যের মধ্যেই সংযুক্ত আছে। উপরি পাওনা হলো, মাঝেমধ্যেই এসব ট্যারিফে ন্যূনতম ৫০ টাকা ‘ক্যাশব্যাক কুপন’-ও পাওয়া যায়!
এক জিও’র ধাক্কা ও ধামাকা কীভাবে সব কোম্পানির ব্যবসানীতি বদলে দিয়েছে ভাবতে পারছেন!
মজার ব্যাপার হলো, কল আর এসএমএস যে ফ্রি এটা আমার কোনদিনও মাথাতেই আসে না। কেননা, অতো কথা বলার সময় কোথায়! বাংলাদেশে ভারত থেকে কল করতে লাগে মাত্র ২ রূপি। অন্যান্য অপারেটরগুলো থেকে কল করলেও মোটামুটি এমনই খরচ হয়। ভাবতে পারছেন কি!
বাংলাদেশে যে কবে এরকম কোন ‘জিও’র ধাক্কা লাগবে কে জানে! অথচ, বাংলাদেশে তো সরকার সর্বনিম্ন কলরেটই নির্ধারণ করে দিয়েছে ৪৫ পয়সা, সর্বোচ্চ ২ টাকা! এসব বাধ্যবাধকতা না থাকলে নাকি ছেলেমেয়েরা বখে যাবে! কী আশ্চর্য সব যুক্তি! আপনারা একবার কি ভারতের দিকে তাকানোর সময় পান না?
ভারতীয় সমাজে ইন্টারনেট, কলরেট, এসএমএস—এসব প্রপঞ্চ এখন প্রতিদিনকার ডালভাত খাওয়ার মতো হয়ে গেছে। কেউ এগুলো নিয়ে সেভাবে বসেও নেই। অথচ, এই তো চার-পাঁচ বছর আগেও, ভারতে ব্রডব্যান্ডের ইন্টারনেটের সর্বনিম্ন গতি মাত্র ৫১২ কেবিপিএস ছিল বলে মানুষের হাহাকারের সীমা ছিল না! আর এখন, এখানে সেভাবে কেউ ব্রডব্যান্ড ব্যবহার করার কথা ভাবেও না। মোবাইল-ডাটা যে খেল দেখিয়ে দিচ্ছে, তাতে তারের ব্রডব্যান্ড বিষয়টিই এখন নিষ্প্রয়োজনীয়তার দিকে চলে যাচ্ছে!
এখানে মানুষের ২৪ X ৭ মোবাইল ডাটা চালু করাই থাকে। মানে, সর্বক্ষণ ব্যক্তি আপনি নেটের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও, আপনার ডিভাইস যুক্ত হয়ে আছে। এই ভারত তারুণ্যের জয়গান গাওয়া ভারত। এই ভারতের তরুণ গবেষকরাই ভারতের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ব র্যাংকিংয়ে একশ’র মধ্যে জায়গা করিয়ে দিচ্ছে। আবার এরাই ইন্টারনেট ও অ্যান্ড্রোয়েড ব্যবহারের সংখ্যায় সারা পৃথিবীকে টক্কর দিচ্ছে। অথচ, প্রায় একই পরিবেশ ও সংস্কৃতি বহন করে বাংলাদেশ পড়ে আছে মান্ধাতার আমলের চিন্তাভাবনায়! মোবাইল ডাটা অন রাখা যায় না। চালু রাখলেই ডাটা শেষ হয়ে যাওয়ার ভয়। এতো ‘ডাটা-ভীতি’ নিয়ে কি ‘ডিজিটাল দেশ’ হয়!
ভারতে চলমান যেসব ডাটা প্ল্যান নিয়ে আলোচনা হলো উপরে, তার পরে বাংলাদেশে বিভিন্ন অপারেটর প্রদত্ত প্ল্যানগুলো নিয়ে ন্যূনতম শব্দ খরচ করাটা রীতিমতো হাস্যকর ও বাতুলতা মাত্র! শুধু এটুকু বলি, বাংলাদেশের বাজারে জিও যদি একবার ঢুকতে পারে, তাহলে বর্তমানে ক্রিয়ারত অপারেটরগুলোর অস্তিত্ব নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে! এই অপারেটরগুলো এখন বলছে ইন্টারনেটের দাম কমানো সম্ভব না। এই ধোকাটি দিতে দিতে তারা অভ্যস্ত করে ফেলেছে জনগণকে। অথচ, কোম্পানিগুলো বোধহয় বুঝতেও পারছে না যে, একদিন পরিস্থিতি সেই রাখাল বালকের মতো হবে। সত্যই একদিন বনের ‘বাঘ’ লোকালয়ে আসবে। কিন্তু সেদিন মানুষ মুখ ঘুরিয়ে নিলে করার কিছু থাকবে না। অতএব, সময় থাকতে সতর্ক হওয়া ভালো। পুঁজিবাদের বাজারে ও প্রতিযোগিতার যুগে অধিক মুনাফাখোরদের গণেশ উল্টে যেতে কিন্তু খুব বেশি সময় লাগার কথা না!
৪.
কথা হতে পারে, ভারত পারলে বাংলাদেশে সম্ভব নয় কেন? কী থাকতে পারে সম্ভাব্য উত্তর, সেগুলো ভাবা যেতে পারে।
বাংলাদেশের অপারেটরগুলো তো মুখের ওপর উত্তর দিয়ে দেবে যে, ভারতের সঙ্গে তুলনা চলে না কারণ, ভারত বড় দেশ, তাদের বাজার বড়, লোকসংখ্যা অনেক। সুতরাং ওখানে মোবাইল ডাটার দাম কম থাকাই স্বাভাবিক।
তাই কি? কোম্পানিগুলো এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে, আমাদের কর্তাব্যক্তিদের উচিত, কাগজ-কলম নিয়ে হিসাব দেখিয়ে দেওয়া। বাংলাদেশের টেলিকমিউনিকেশন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির নিজস্ব ওয়েবসাইট থেকে কিছু তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরছি। সংস্থাটির উপাত্ত অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, বাংলাদেশে মোবাইল ফোন সাবস্ক্রাইবার হলো ১৫৮.৪৩৮ মিলিয়ন বা ১৫ কোটি ৮৪ লক্ষাধিক এবং ইন্টারনেট সাবস্ক্রাইবার ৯২.০৬১ মিলিয়ন বা ৯ কোটি ২০ লক্ষাধিক।
সংখ্যাগুলো খেয়াল করুন। পৃথিবীর অসংখ্য দেশে এই পরিমাণ জনসংখ্যাই তো নেই! পৃথিবীর অনেক দেশের আয়তন বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। কিন্তু, জনসংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে কম। ৯ কোটির চেয়ে কম জনসংখ্যা আছে পৃথিবীতে কমপক্ষে ১৭৮টি দেশের!
এই তথ্যটি দূরে সরিয়ে রেখেও, শুধু ভারত ও বাংলাদেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব আমরা বিবেচনা করতে পারি। ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউয়ের ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, ভারতে যেখানে প্রতি বর্গ কি.মি.-তে বসবাস করে ৪১৬ জন, বাংলাদেশে সেখানে ১১৩৯ জন। অর্থাৎ, বাংলাদেশে ইন্টারনেট সেবাদাতা কোম্পানিগুলোর এ এক বিশাল সুবিধা যে, খুব অল্প জায়গার মধ্যে তারা অনেক বেশি মানুষের সঙ্গে ব্যবসাটা করতে পারে। ফলে, এটা যে কী পরিমাণ লাভজনক এক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে তারা সেটা স্বীকার করবে না।
তারা হয়তো তখন ‘ক্যাবলে’র সেই জরিপটির প্রসঙ্গ টেনে এনেই আপনাকে বোঝাবে, যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা-জাপান-চীন-যুক্তরাজ্য-জার্মানি-ফ্রান্সের ইন্টারনেটের দাম কত বেশি!
অথচ, আইএমএফের এপ্রিল-২০১৮ সালের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী (বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ উপাত্তটি ২০১৭ সালের বিধায় সেটি এড়িয়ে গেলাম), যে দেশের মাথাপিছু বাৎসরিক আয় (পিপিপি’র ভিত্তিতে) মাত্র ৪৫৬১ ইউএস ডলার এবং র্যাংকিং ১৩৮, তার তুলনা কি না করতে হবে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে! যে ভারতের মাথাপিছু আয় ৭৭৮৪ ও র্যাংকিং ১২৬, সেই দেশটির সঙ্গেই তো আমাদের তুলনাটা করতে হবে যে ঠিক কোথায় আমরা রাহুগ্রাসের শিকার হচ্ছি!
এবার আসুন, আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউয়ের তথ্যগুলোকে সমন্বয় করে ‘ক্যাবলে’র জরিপের তালিকায় যে দেশগুলো ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অবস্থান করছে, তাদের নিয়ে সামান্য আলোচনা করি। দ্বিতীয় থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত আছে যথাক্রমে কিরগিজস্তান, কাজাকিস্তান, ইউক্রেন, রুয়ান্ডা, সুদান, শ্রীলঙ্কা, মঙ্গোলিয়া, মিয়ানমার, কঙ্গো ডিআর, ইসরাইল এবং রাশিয়া। বাংলাদেশের পরের দুটি স্থানে যথাক্রমে ফিনল্যান্ড ও মালয়েশিয়া। ওপিআরের তথ্যানুযায়ী, এই ১৫টি দেশের মধ্যে জনসংখ্যার ঘনত্বের বিচারে বাংলাদেশ সবার উপরে এবং দ্বিতীয়তে থাকা রুয়ান্ডার চেয়েও ২.৩ গুণ বেশি জন-ঘনত্ব আমাদের। আয়তনে যথাক্রমে শ্রীলঙ্কা, রুয়ান্ডা ও ইসরাইল বাংলাদেশের চেয়ে ছোট। আর আইএমএফের তালিকা বলছে, বার্ষিক মাথা পিছু আয়ে শুধু সুদান (১৪২), কিরগিজস্তান (১৪৮), রুয়ান্ডা (১৬৯) ও কঙ্গো ডিআর (১৯১) আমাদের পেছনে আছে। ভারতের কথা না হয় বাদই দিলাম, প্রতি বর্গ কি.মি.-তে যে দেশে মাত্র ৩১ জন মানুষ বাস করে, সেই কিরগিজস্তানের মতো দেশে যদি এক জিবি ডাটার সর্বোচ্চ মূল্য ০.৪৮ ইউএস ডলার হতে পারে, তাহলে বাংলাদেশে তেমন স্বল্পমূল্যে মোবাইল ডাটা ক্রয়-বিক্রয় কোন অসুর-শক্তির ক্ষমতাবলে সম্ভব হচ্ছে না– তা জানতে এবং সেই ‘মহিষাসুর বধ’ করতে বাংলাদেশের রাজপথে যে আন্দোলন দানা বাঁধেনি এখনও, এটাই সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়!
অন্যদিকে, ‘ক্যাবলে’র জরিপে বাংলাদেশের পেছনে থাকার পরও, ফিনল্যান্ড ও মালয়েশিয়াকে আলোচনায় নিয়েছি এটা বোঝাতে যে, এদের জন-ঘনত্ব বাংলাদেশের তুলনায় এতো কম ও মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের চেয়ে এতো এতো বেশি যে, অধিক মূল্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের বাহাদুরি করার সক্ষমতা দেশ দু’টির আছে। ‘মধ্যম আয়ে’র ‘গৌরবে গৌরবান্বিত’ বাংলাদেশের জনগণের কি আদৌ সেই ক্ষমতা আছে? সুতরাং, ইন্টারনেট সেবাদানে বাংলাদেশের এই পরিস্থিতিকে দুনিয়ার নিকৃষ্টতম বলবেন না তো কী বলবেন!
একটা দেশের বাজারে কোন একটি পণ্যের মূল্য আকাশ থেকে টুপ করে পড়ে হুট করে নির্ধারিত হতেই পারে না। নাগরিকদের ক্রয় ক্ষমতা ও সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বাস্তবতাও এর সঙ্গে যুক্ত। এতোগুলো তথ্য-উপাত্তের পর বাস্তবতা আসলে কী বলে, সেটা মনে হয় পাগলও ভালো বুঝবে!
শুধু মোবাইল অপারেটিংয়ের ব্যবসাই নয়, বাংলাদেশ হলো এমন একটি দেশ, যেখানে যেকোন পণ্যের ক্ষেত্রে ব্যবসায় টাকা লগ্নি করে খুব সহজে লাভ করা যায়। কারণ, দেশটা ছোট হলেও, এখানে মানুষ অথৈ। অল্প জায়গায় বিস্তৃত হয়ে এতো বেশি ভোক্তা বা গ্রাহকের কাছে পৌঁছে যাবার সহজ উপায় কোন দেশে আছে?
ইন্টারনেট গ্রহীতার সংখ্যাটাই দেখুন না। কী হইহই করে বাড়ছে এই সংখ্যা! বিটিআরসির ওই একই নথিতে দেখা যাচ্ছে, ২০১২ সালে ফেব্রুয়ারিতে এই সংখ্যাটা ছিল ৩ কোটি ১১ লক্ষ। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে যেটা কমে ৩ কোটির সামান্য বেশি হয়েছিল। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে গিয়ে দেখা গেল গ্রাহকসংখ্যা বেড়েছে সামান্যই– ৩ কোটি ৬০ লক্ষ। অথচ, গত পাঁচ বছরে কতগুণ বেড়েছে ইন্টারনেটের গ্রাহক, একবার শুধু দেখুন – ২.৫৫ গুণ! আর সামগ্রিকভাবে গত ১০ বছরের হিসাব নিয়ে বসলে তো নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে!
বিটিআরসির বরাত দিয়ে বিবিসির (২৩ জুলাই ২০১৮) একটি প্রতিবেদন জানাচ্ছে যে, ২০০৮ থেকে ১০ বছরে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০০ গুণ বেড়েছে! ২০০৮ সালে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৮ লাখ, ২০১৮ সালে গিয়ে হয়েছে সেটা ৮ কোটি ৭৮ লাখ। অর্থাৎ, জুলাই ২০১৮ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০১৯ পর্যন্ত মাত্র ৭ মাসেই বাংলাদেশে ইন্টারনেট গ্রাহক বেড়েছে প্রায় ৪২ লাখ। বাড়ছে তো বাড়ছেই।
গ্রাহক-সংখ্যা বৃদ্ধির এমন রকেট-গতির পরও অপারেটর কোম্পানিগুলো আপনাকে বলবে, ইন্টারনেটের দাম কমানো যাবে না। তাতে তাদের ব্যবসা ক্ষতির মুখে পড়বে এবং এও বলবে, ব্যান্ডউইথের দাম কমানোর সঙ্গে ইন্টারনেটের দাম কমার কোন সম্পর্ক নেই। বিটিআরসি বলবে, আমরা ব্যাপারটা দেখছি। মন্ত্রণালয় বলবে, আমরা প্রয়োজনে ভর্তুকির ব্যবস্থা করছি; ‘এক দেশ এক রেটে’ করার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। আসলে সব অশ্বডিম্ব!
অশ্বডিম্ব কী করে বুঝবেন? আমাদের একটা ‘টেলিটক’ নামক রাষ্ট্রীয় অপারেটর ছিল (ছিলই বলছি), যেটা দিয়ে বাজার কাঁপিয়ে বহুজাতিকের মুখে ঝামা ঘষে দেওয়া যেত। কে জানে, হয়তো কোন এক অদৃশ্য শক্তির কাছে জনগণের টেলিটককে নতজানু করে রাখা হয়েছে! যারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ব্রাত্য করে ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের লাভের গুড়ের লোভ সামলাতে পারে না, তাদের কাছে আপনি কী আশা করেন?
সরকারি হিসাব অনুযায়ীই, যে দেশে মোট জনগণের অর্ধেকের চেয়ে বেশি মানুষ ইন্টারনেটের গ্রাহক, সেই দেশে ইন্টারনেট তো নামমাত্র মূল্য বিক্রয় করা উচিত। তাতেও লাভ বৈ ক্ষতি হবে না। অথচ, গত অক্টোবরেও, ‘ক্যাবল’ নামক জরিপকারী প্রতিষ্ঠানটি জানাচ্ছে, ১ জিবির সর্বোচ্চ মূল্য ছিল ৩.৮১ ডলার বা ৩২০ টাকা! আহা, মানুষের কষ্টের উপার্জন কী নির্দয়ভাবে বহুজাতিক নেট-ডাকাতরা জিম্মি করে ফেলেছে বাংলাদেশে! পুঁজিবাদের যুগে অর্থনৈতিক শোষণের এ হলো ‘স্মার্টেস্ট টেকনিক’!
আহ, ইন্টারনেট! এমন দেশকে তুমি ‘ডিজিটাল’ বানানোর প্রকল্প দেখিয়েছ, যার রোগ আছে, কিন্তু রোগের দাওয়াই নেই! দাওয়াই যদিওবা আছে, সেটার ব্যবস্থাপত্র লেখার চিকিৎসক নেই!
গৃহীত