অনলাইনে প্রতারণা : বিদেশে পাচার ১৭ হাজার কোটি টাকা!
- আপডেট সময় : ০৮:৪২:২৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৮ জুলাই ২০২১ ১৭১ বার পড়া হয়েছে
অনলাইন ডেস্ক: দেশের মধ্যে কোথাও একটিও অফিস নেই, শুধু অনলাইনে ওয়েব পেজ ঠিকানা। ওয়েব পেজে বিভিন্ন ধরনের মুনাফার আশ্বাস দিয়ে গ্রাহক সংগ্রহ। এরপর কৌশলে গ্রাহকের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা আদায় করে বিদেশে পাচার। ছয় মাস ধরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা শাখাসহ (সিআইসি) বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা যৌথভাবে নজরদারি করে তথ্য-প্রমাণসহ এমন ৫৪ প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করেছে। এসব প্রতিষ্ঠান ৬০ লাখের বেশি গ্রাহকের কাছ থেকে ১৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নিয়ে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। বয়সে তরুণরা এসব প্রতারণায় বেশি জড়িত। তাঁদের অনেকে ডেসটিনির মতো প্রতিষ্ঠানে আগে কাজ করেছেন।
সিআইসি থেকে এনবিআর চেয়ারম্যানের দপ্তরে পাঠানো প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য জানা যায়। ৫৪ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িতদের আটক করতে অভিযান জোরদার করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের অনলাইন পেজ অকার্যকর করা হয়েছে।
সিআইসির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইউজেএসটি সার্ভিসেস নামের একটি প্রতিষ্ঠান প্রায় দুই লাখ গ্রাহক সংগ্রহ করে এক হাজার ২৫৫ কোটি টাকা প্রতারণা করে নিয়েছে। ইয়ং লিং কর্টিজেস নামের প্রতিষ্ঠান তিন লাখ ১০ হাজার গ্রাহক সংগ্রহ করে ৩০০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা হাতিয়েছে। ইউজে সুপার নামের প্রতিষ্ঠান সাত লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে ২৭৭ কোটি ৩৪ লাখ ১২ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। জাস্ট নাউ নামের প্রতিষ্ঠান পাঁচ লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে ৬০০ কোটি টাকা নিয়ে পাচার করেছে। লাইক মি ওয়ার্ল্ড নামের প্রতিষ্ঠান দুই লাখ ১৭ হাজার গ্রাহক সংগ্রহ করে ৩০০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে পাচার করেছে। এভাবে ৫৪ প্রতিষ্ঠান ৬০ লাখের বেশি গ্রাহকের কাছ থেকে প্রতারণা করে ১৭ হাজার কোটি টাকার বেশি পাচার করেছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে নওগাঁ জেলার জাহেদ হোসেন নামের এক ব্যক্তি ইউজে সুপার নামের প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখেন, প্রতিষ্ঠানটির একাধিক মোবাইল ব্যাংকিং নম্বরে এক হাজার ২০০ টাকা পাঠিয়ে গ্রাহক হতে হবে। এরপর প্রতিষ্ঠানটির একাধিক মোবাইল ব্যাংকিং নম্বরে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৫০ হাজার টাকা পাঠালে দুই টন এসি পাবেন গ্রাহক। বাজারে দুই টন এসির দাম ৭০ হাজার টাকা হলেও ইউজে সুপারের মাধ্যমে শর্ত মেনে কিনলে ৫০ হাজার টাকায় পাওয়া যাবে। এ ছাড়া বোনাস হিসেবে গ্রাহককে দেওয়া হবে একটি ওয়াশিং মেশিন, একটি ওভেন এবং একটি রাইস কুকার। তবে এসব পণ্য পেতে টাকা পাঠানোর পর গ্রাহককে এক থেকে দেড় মাস অপেক্ষা করতে হবে। চাকরিজীবী জাহেদ হোসেন সব শর্ত মেনে টাকা পাঠানোর চার মাসেও একটি পণ্যও পাননি। প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যোগাযোগের জন্য যে ই-মেইল আইডি দেওয়া আছে, সেখানে তিনি বারবার মেইল করেও কোনো উত্তর পাননি। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করতে গিয়ে সিআইসিসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা শাখা বড় ধরনের প্রতারণার খোঁজ পায়। গত বছরের নভেম্বরে প্রতিষ্ঠানটির মূল পরিকল্পনাকারী আল আমীর শাহিনকে আটক করা হয়। তাঁকে জেরা করে জানা যায়, ইউজে সুপার সাত লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে ২৭৭ কোটি ৩৪ লাখ ১২ হাজার টাকা নিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করেছে। এই ব্যক্তি ২০০ কোটি টাকার বিট কয়েন কিনেও অর্থ পাচার করেছেন। তাঁর গ্রাহকদের বেশির ভাগই উপজেলা পর্যায়ে বসবাস করেন। সাধারণ মানুষকে প্রতারণা করে নিজের পকেটে বড় অঙ্কের অর্থ ভরলেও সরকারি কোষাগারে একটি টাকাও ভ্যাট-কর জমা দেননি। এরপর সিআইসিসহ অন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দুই শতাধিক অনলাইনসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে নজরদারিতে রেখেছে।
সিআইসির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রতারণা করতে বেশ কয়েকটি মডেল ব্যবহার করা হয়; যেমন—ডিসকাউন্ট মডেল, বোনাস মডেল, সদস্য দিয়ে সদস্য সংগ্রহ মডেল। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রচারণায় দেশের জনপ্রিয় ব্যক্তিদের অর্থের বিনিময়ে ব্যবহার করা হয়েছে। জনপ্রিয় ওই ব্যক্তিরা প্রতিষ্ঠানের জালিয়াতির বিষয়ে কিছু না জেনেই কাজ করেছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ডিসকাউন্ট মডেল : অনলাইনে প্রলোভন দেখানো হয়েছে, প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক হলেই কম দামে পণ্য কেনার সুবিধা পাওয়া যাবে। তবে টাকা পরিশোধের এক থেকে দুই মাস পরে পণ্য পাওয়া যাবে। উদাহরণ দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউটি সার্ভিসেস জুতা, ব্র্যান্ডের পোশাক, এসি, টিভি, কম্পিউটার, মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য অর্ধেক দামে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহক সংগ্রহ করে থাকে। এসব প্রলোভনে আকৃষ্ট হয়ে অনেকে পণ্য কেনার জন্য অগ্রিম টাকা জমা দিয়েছেন। নামসর্বস্ব এই প্রতিষ্ঠানের শর্ত থাকে, পণ্য পাওয়ার ৩০ দিন আগে পণ্যের মূল্য হিসেবে অর্থ জমা দিতে হবে। এভাবে গত বছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ছয় লাখ ক্রেতা পণ্য পাওয়ার আগেই অর্থ জমা দিয়েছেন। মাত্র ২২ হাজার ক্রেতাকে পণ্য সরবরাহ করা হয় এবং বাকি অর্থ প্রতিষ্ঠানটির মালিক আত্মসাৎ করে পাচার করে দিয়েছেন।
বোনাস মডেল : ওয়েব পেজে গিয়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এক হাজার বা ৮০০ টাকা পাঠিয়ে গ্রাহক হতে হয়। এরপর পেজের বিভিন্ন অপশনে গিয়ে ক্লিক করলে ২০ টাকা, ২৫ টাকা বা তারও বেশি বোনাস হিসেবে গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবে বা মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টে জমা হতে থাকে। এক হাজার বা ৮০০ টাকা নিয়ে বোনাস হিসেবে সর্বোচ্চ ১০০ বা ২০০ টাকা দিয়ে বোনাস দেওয়া বন্ধ করে দেয় প্রতিষ্ঠান। এভাবে বোনাস দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে অনেক বেশি মানুষকে গ্রাহক বানিয়ে দু-একবার বোনাস দিয়ে বাকি টাকা প্রতারক নিজের পকেটে ভরে। এভাবে লাখ লাখ মানুষকে প্রতারণা করে হাজার কোটি টাকা আয় করেছে অনলাইনে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানগুলো।
সদস্য দিয়ে সদস্য সংগ্রহ : প্রতিবেদনে বলা হয়, এ পদ্ধতিতে প্রথমে একজন এক হাজার ২০০ টাকা দিয়ে গ্রাহক হয়ে আরো চারজনকে গ্রাহক করেন। প্রথম জন এক হাজার ২০০ টাকাই কম্পানিকে দিয়ে দেন। পরের চারজনের প্র্রতিজনের এক হাজার ২০০ টাকার ৪০০ টাকা প্রথম গ্রাহক নিয়ে বাকি ৮০০ টাকা কম্পানিতে দিতে হয়। এভাবে চেইনের মাধ্যমে চলে গ্রাহক সংগ্রহ। এভাবে বিপুল গ্রাহক সংগ্রহ করে প্রতারণা করা হয়।