ঢাকা ০৬:৩২ অপরাহ্ন, রবিবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ




ওয়ার্ডবয়দের মারধর দিয়েই রোগীর চিকিৎসা শুরু!

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৯:২০:০০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১১ নভেম্বর ২০২০ ১২৫ বার পড়া হয়েছে

দরজা বন্ধ করা কক্ষের ভেতর অন্ধকার। আলো-বাতাস যাতায়াতের নেই কোনও উপায়। ভেতরে বসে চিৎকার করলেও বাইরে থেকে কেউ শুনতে পাবে না। এমনই একটি বিশেষ কক্ষে চিকিৎসার নামে শুরুতেই সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিম শিপনকে আটকে রাখতে চেয়েছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পর্যবেক্ষণের নামে এমন বিশেষ কক্ষে মাদকাসক্ত ও মানসিক স্বাস্থ্যের রোগীদের সপ্তাহখানেক আটকে রাখা হয়। রোগীরা দুর্বল ও নিস্তেজ হয়ে যাওয়ার পর এখান থেকে বের করা হয়। এরপর ওয়ার্ডে বা অন্য কক্ষে দেওয়া হয়। এই কক্ষে কেউ থাকতে না চাইলে তাদের ওয়ার্ডবয়রা মারধর করে, অথবা বিশেষ এক ধরনের জ্যাকেট পরিয়ে ফেলে রাখে, যেটি পরালে রোগীরা হাত-পা ছোটাছুটি করতে পারে না, সোজা হয়ে পড়ে থাকে। ছোট্ট এই কক্ষে একাধিক রোগীকে ফেলে রাখা হয়।

মঙ্গলবার (১০ নভেম্বর) সরেজমিন গিয়ে এবং মাইন্ড এইড মাদক নিরাময় কেন্দ্রের স্টাফদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। আদাবরের বায়তুল আমান হাউজিংয়ের ২ নম্বর সড়কের ২৮১ নম্বর বাড়িটিতে অবৈধভাবে চলছিল এ মাদক নিরাময় কেন্দ্রটি। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের কারও কোনও অনুমোদন নেই। রোগীদের নিয়ে আসার পরই এই বিশেষ কক্ষে বন্দি করে রাখা হতো।

নিরাময় কেন্দ্রের স্টাফ রুমা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভবনের নিচতলায় মেয়েদের এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় পুরুষদের রাখা হয়। নিচতলায় মেয়েদের জন্য একটি এবং দ্বিতীয় তলায় পুরুষের জন্য একটি বিশেষ কক্ষ রয়েছে। এখানে রোগী এনে রাখা হয়। সপ্তাহখানেক রাখার পর বের করা হয়। সিসি ক্যামেরায় বাইরে থেকে তাদের দেখা হয়।’

কেউ এখানে না থাকতে চাইলে তাদের জোর করেই এই কক্ষে ঢুকানো হয় বলেও জানান তিনি।

সাবলীল এএসপি ওয়ার্ডবয়দের সঙ্গে হেঁটেই হাসপাতালের দোতলায় ওঠেন

সোমবার (৯ নভেম্বর) সকাল সাড়ে ১১টার দিকে এএসপি আনিসুল করিম শিপনকে তার ছোট ভাই রেজাউল করিম ও ছোট বোন ডা. উম্মে সালমা সাথীসহ পাঁচ-ছয়জন মিলে আদাবরের মাইন্ড এইড মাদক নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। তিনতলা মাদক নিরাময় কেন্দ্রের নিচতলার বামপাশে একটি কক্ষে ডক্টর চেম্বার এবং অপর কক্ষে ভর্তি কাউন্টার। এখানে বসেই মাদক নিরাময় কেন্দ্রের মালিক ও ম্যানেজার মার্কেটিং ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ জয়, কো-অর্ডিনেটর রেদোয়ান সাব্বির ও চিকিৎসক নুসরাত ফারজানা এএসপি আনিসুলকে ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু করেন। আনিসুল নিচতলার একটি কক্ষে বসে সকালের নাশতা করেন। তিনি এ সময় মাদক নিরাময় কেন্দ্রের সবার সঙ্গে স্বাভাবিক ও সাবলীল আচরণ করেন। আনিসুল নাশতা শেষে ওয়াশরুমে যেতে চান। কিছুক্ষণ পর ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ জয় তাকে ওয়াশরুমে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে দোতলায় নিয়ে যান। এএসপি হেঁটেই তাদের সঙ্গে উপরে যায়।

এই কক্ষেই এএসপিকে হত্যা করা হয়
মাদক নিরাময় কেন্দ্রের একাধিক স্টাফ এএসপিকে শান্ত ও স্বাভাবিক দেখেছেন বলে বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন মাদক নিরাময় কেন্দ্রের স্টাফ (রান্নার কাজ করেন) শারমীন আক্তার। দু’মাস ধরে তিনি এখানে চাকরি করেন।

ভোলার এই তরুণী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা সাধারণ রোগী আসলে সামনে যাই না। তবে সোমবার সকালে এএসপিকে নিয়ে আসার পর কেন যেন আমি সামনে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি তিনি ভালো মানুষ। কথা বলছেন। কিছুক্ষণ পর আরিফ মাহমুদ জয় স্যার তাকে উপরে নিয়ে যান। উপরে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই আমরা সিসি ক্যামেরার মনিটরে দেখতে পাই তাকে ঝাপটে ধরে মারধর করছেন স্টাফরা। তিনি মারা গেছেন, এমন খবর হাসপাতালে ছড়িয়ে পড়ে। আনিসুল করিমের ভাই ও বোন এ সময় দ্রুত অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে বলেন, তবে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে কোনও অক্সিজেনের ব্যবস্থা ছিল না। দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স এনে তারা এখান থেকে চলে যায়।’

ওয়ার্ডবয়দের মারধর ও ভয়ভীতি দিয়েই মাইন্ড এইডের চিকিৎসা শুরু
আনিসুল করিম শিপনকে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে নেওয়ার পর তাকে দ্রুত উপরে নেওয়া হয়। তিনি যে কক্ষে মারা গেছেন, মঙ্গলবার (১০ নভেম্বর) সেই কক্ষে গিয়ে দেখা গেছে, এটি দোতলার বারান্দাঘেঁষা ছোট্ট একটি কক্ষ। ১০ ফুট বাই ৬ ফুটের কক্ষটিতে ফ্লোরে দুটি ফোমের ম্যাট্রেস ফেলা ছিল। লাইট বন্ধ করলেই অন্ধকার। একটি দরজা, কোনও জানালা বা ভেন্টিলেটর নেই। দরজা বন্ধ করে রাখলে বাইরের আলো-বাতাস সেখানে প্রবেশের কোনও উপায় নেই। বিশেষ কায়দায় তৈরি এই কক্ষের দরজা বন্ধ করলে ভেতরে সর্বোচ্চ শব্দ করলেও বাইরে থেকে কিছু শোনা যায় না। কক্ষে একটি এসি ও সিসি ক্যামেরা রয়েছে। এই কক্ষটিতেই মারা যান আনিসুল করিম।

এই কক্ষে কি হয় তা জানতে কক্ষের ভেতরে স্টাফ শারমীন জান্নাতকে নিয়ে প্রবেশ করেন প্রতিবেদক। সেখানে বসেই শারমীন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যারা প্রথম এখানে ভর্তি হয়, তাদের এই কক্ষে এনে আটকে রাখা হয়। প্রস্রাব, পায়খানা সব এখানেই করেন। তা পরবর্তীতে আয়ারা পরিষ্কার করে।’

আটকে রাখা হয় কেন? এর জবাবে তিনি বলেন, ‘যারা প্রথম আসে, তারা অনেক চিৎকার ও হই-হট্টগোল করে, তাই তাদের এখানে আটকে রাখা হয়। এক সপ্তাহ পর এখান থেকে বের করা হয়।’

ছোট্ট এই কক্ষটিতে একসঙ্গে চার-পাঁচ জনকেও আটকে রাখা হয় বলে জানান শারমীন। শারমীন বলেন, ‘আমাদের সাধারণত উপরে আসতে দেওয়া হয় না, ওয়ার্ডবয়রা দেখাশোনা করে পুরুষদের। দ্বিতীয় ও তিনতলায় পুরুষ রোগীদের রাখা হয়। ভবনের নিচতলায় নারী রোগীদের রাখা হয়। তবে কখনও রোগীদের খাবার দিতে আসলে তারা মারধরের কথা বলতো।’

কোনও ব্যবস্থা না নিয়েই অবৈধ নিরাময় কেন্দ্র দেখে চলে গেল স্বাস্থ্য অধিদফতর
রাজধানীর আদাবরের মাইন্ড এইড হাসপাতালের কোনও রকম অনুমোদন নেই বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের ঢাকা জেলার সিভিল সার্জন অফিসার ডা. মইনুল আহসান। তবে কোনও ব্যবস্থা না নিয়েই তিনি চলে যান। কারণ, এর অনুমোদন দেওয়া হয়নি, তাই কোনও ব্যবস্থাও তারা নিতে পারবেন না।

ডা. মইনুল আহসান বলেন, ‘২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মাইন্ড এইড হাসপাতাল চালানোর জন্য অনুমতি চাওয়া হয়েছিল। আমরা তখন পরীক্ষা করে দেখেছি হাসপাতালটি চালানোর মতো সুবিধা ও জনবল কিছুই তাদের ছিল না। সেজন্য মার্চ মাসে তাদের আবেদন আমরা পেন্ডিং (স্থগিত) করি। স্থগিত আদেশের পর তারা যদি কোনও চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে থাকে তা সম্পূর্ণ অবৈধ। তারা এটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ও পুনর্বাসন কেন্দ্র হিসেবে চালাচ্ছিল। এসব প্রতিষ্ঠান চালাতে হলে কিছু ক্লিনিক্যাল ফ্যাসিলিটিজ ও হাসপাতালের ব্যবস্থা রাখতে হয়। যেন জরুরি মুহূর্তে চিকিৎসা দেওয়া যায়। কিন্তু তাদের সে ব্যবস্থা ছিল না।’

হত্যাকাণ্ডের পর ফ্লোর পরিষ্কার করা হয়
এএসপি আনিসুল করিমকে হত্যার পর সিসি ক্যামেরার ফুটেজে পানি দিয়ে ফ্লোর ধুয়ে ফেলতে দেখা যায়। গ্রেফতার ওয়ার্ডবয়রা জানিয়েছে, আনিসুল করিম বমি করেছিল, পরে পানি দিয়ে তা ধুয়ে ফেলা হয়। এদিকে সুরতহালে আনিসুলের নাকে, ঘাড়ে ক্ষত পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

হঠাৎ কেন চুপচাপ হয়ে যায় আনিসুল
আনিসুল করিম সর্বশেষ বরিশাল মহানগর পুলিশে (বিএমপি) কর্মরত ছিলেন। আদাবরে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে তার মৃত্যুর পর বাবা থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলার এজাহারে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘৩/৪ দিন ধরে আনিসুল করিম হঠাৎ চুপচাপ হয়ে যায়। তাকে ৯ নভেম্বর প্রথমে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়। এরপর মাইন্ড এইড হাসপাতালে নেওয়া হয়।’

আনিসুল করিম ৩১তম বিসিএসে নিয়োগপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা। তার ব্যাচের অনেকে পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হয়েছেন। তবে তিনি এখনও পদোন্নতি পাননি।

ঢাকায় আসার আগে ৭ নভেম্বরও আনিসুল করিম দায়িত্ব পালন করেন। এ বিষয়ে বিএমপি কমিশনার শাহাবুদ্দিন খান বলেন, ‘৭ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। ৮ নভেম্বর তার বাবা এসে তাকে নিয়ে যান।’

বরিশাল ট্রাফিক বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কয়েক মাস ধরে আনিসুল করিমের ভেতরে অস্থিরতা ছিল, তবে কী নিয়ে তার মধ্যে এমন অস্থিরতা ছিল, তা কেউ জানাতে পারেননি।

মাদক নিরাময় কেন্দ্রটি পুলিশের জিম্মায়
এএসপি আনিসুল করিমের মৃত্যুর পর মাদক নিরাময় কেন্দ্রটি আদবর থানা পুলিশের জিম্মায় নেওয়া হয়েছে। পুলিশের অনুমতি ছাড়া সেখানে কেউ প্রবেশ ও বের হতে পারছে না। আদাবর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাহিদুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বর্তমানে হাসপাতালটি পুলিশের জিম্মায় থাকবে। এখানে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না।’

আসামিরা সব রিমান্ডে
১৫ জনের নাম উল্লেখ করে সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিম শিপনের বাবা ফয়েজ উদ্দিন আদাবর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। ইতোমধ্যে মাদক নিরাময় কেন্দ্রের মালিকসহ ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তারা প্রত্যেকে সাত দিন করে পুলিশ রিমান্ডে রয়েছেন। রিমান্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন, প্রতিষ্ঠানটির মার্কেটিং ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ জয় (৩৫), কো-অর্ডিনেটর রেদোয়ান সাব্বির, কিচেন শেফ মাসুদ (৩৭), ওয়ার্ডবয় জুবায়েত হোসেন (১৯), ওয়ার্ডবয় তানভীর হাসান (১৮), ফার্মাসিস্ট তানিফ মোল্লা (২০), ওয়ার্ডবয় সঞ্জীব চৌধুরী (২০), ওয়ার্ডবয় অসীম চন্দ্র পাল (২৪), ওয়ার্ডবয় লিটন আহমদ (১৮) ও ওয়ার্ডবয় সাইফুল ইসলাম পলাশ (৩৫)। পলাতক রয়েছে এখনও পাঁচ জন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন
এদিকে মঙ্গলবার দুপুরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা আনিসুল করিম হত্যার বিচারের দাবিতে মাইন্ড এইড মাদক নিরাময় কেন্দ্রের সামনে মানববন্ধন করেছেন। আনিসুল করিম এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের ৩৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন।

ব্যাচমেটরাও চান বিচার
আনিসুল করিমের এমন নির্মম মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ বিসিএসের ৩১তম ব্যাচের পুলিশ কর্মকর্তারা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে কর্মরত তার ব্যাচমেট অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার খন্দকার রবিউল আরাফাত লেলিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মানুষ চিকিৎসা নিতে গেলে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হবে। কিন্তু এটা কোন চিকিৎসা! যেখানে নেওয়ার পরই হায়নার মতো তার ওপর হামলে পড়ে মারধর করা হয়। যে মানুষটি স্বজনদের সঙ্গে হাসপাতালে গেলো, তিনি দায়িত্ব পালন করছেন একদিন আগেও, তাকে এভাবে মেরে ফেললো!’

গাজীপুরে এএসপির দাফন সম্পন্ন
রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে আনিসুল করিমকে গাজীপুরে তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়েছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :




ওয়ার্ডবয়দের মারধর দিয়েই রোগীর চিকিৎসা শুরু!

আপডেট সময় : ০৯:২০:০০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১১ নভেম্বর ২০২০

দরজা বন্ধ করা কক্ষের ভেতর অন্ধকার। আলো-বাতাস যাতায়াতের নেই কোনও উপায়। ভেতরে বসে চিৎকার করলেও বাইরে থেকে কেউ শুনতে পাবে না। এমনই একটি বিশেষ কক্ষে চিকিৎসার নামে শুরুতেই সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিম শিপনকে আটকে রাখতে চেয়েছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পর্যবেক্ষণের নামে এমন বিশেষ কক্ষে মাদকাসক্ত ও মানসিক স্বাস্থ্যের রোগীদের সপ্তাহখানেক আটকে রাখা হয়। রোগীরা দুর্বল ও নিস্তেজ হয়ে যাওয়ার পর এখান থেকে বের করা হয়। এরপর ওয়ার্ডে বা অন্য কক্ষে দেওয়া হয়। এই কক্ষে কেউ থাকতে না চাইলে তাদের ওয়ার্ডবয়রা মারধর করে, অথবা বিশেষ এক ধরনের জ্যাকেট পরিয়ে ফেলে রাখে, যেটি পরালে রোগীরা হাত-পা ছোটাছুটি করতে পারে না, সোজা হয়ে পড়ে থাকে। ছোট্ট এই কক্ষে একাধিক রোগীকে ফেলে রাখা হয়।

মঙ্গলবার (১০ নভেম্বর) সরেজমিন গিয়ে এবং মাইন্ড এইড মাদক নিরাময় কেন্দ্রের স্টাফদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। আদাবরের বায়তুল আমান হাউজিংয়ের ২ নম্বর সড়কের ২৮১ নম্বর বাড়িটিতে অবৈধভাবে চলছিল এ মাদক নিরাময় কেন্দ্রটি। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের কারও কোনও অনুমোদন নেই। রোগীদের নিয়ে আসার পরই এই বিশেষ কক্ষে বন্দি করে রাখা হতো।

নিরাময় কেন্দ্রের স্টাফ রুমা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভবনের নিচতলায় মেয়েদের এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় পুরুষদের রাখা হয়। নিচতলায় মেয়েদের জন্য একটি এবং দ্বিতীয় তলায় পুরুষের জন্য একটি বিশেষ কক্ষ রয়েছে। এখানে রোগী এনে রাখা হয়। সপ্তাহখানেক রাখার পর বের করা হয়। সিসি ক্যামেরায় বাইরে থেকে তাদের দেখা হয়।’

কেউ এখানে না থাকতে চাইলে তাদের জোর করেই এই কক্ষে ঢুকানো হয় বলেও জানান তিনি।

সাবলীল এএসপি ওয়ার্ডবয়দের সঙ্গে হেঁটেই হাসপাতালের দোতলায় ওঠেন

সোমবার (৯ নভেম্বর) সকাল সাড়ে ১১টার দিকে এএসপি আনিসুল করিম শিপনকে তার ছোট ভাই রেজাউল করিম ও ছোট বোন ডা. উম্মে সালমা সাথীসহ পাঁচ-ছয়জন মিলে আদাবরের মাইন্ড এইড মাদক নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। তিনতলা মাদক নিরাময় কেন্দ্রের নিচতলার বামপাশে একটি কক্ষে ডক্টর চেম্বার এবং অপর কক্ষে ভর্তি কাউন্টার। এখানে বসেই মাদক নিরাময় কেন্দ্রের মালিক ও ম্যানেজার মার্কেটিং ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ জয়, কো-অর্ডিনেটর রেদোয়ান সাব্বির ও চিকিৎসক নুসরাত ফারজানা এএসপি আনিসুলকে ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু করেন। আনিসুল নিচতলার একটি কক্ষে বসে সকালের নাশতা করেন। তিনি এ সময় মাদক নিরাময় কেন্দ্রের সবার সঙ্গে স্বাভাবিক ও সাবলীল আচরণ করেন। আনিসুল নাশতা শেষে ওয়াশরুমে যেতে চান। কিছুক্ষণ পর ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ জয় তাকে ওয়াশরুমে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে দোতলায় নিয়ে যান। এএসপি হেঁটেই তাদের সঙ্গে উপরে যায়।

এই কক্ষেই এএসপিকে হত্যা করা হয়
মাদক নিরাময় কেন্দ্রের একাধিক স্টাফ এএসপিকে শান্ত ও স্বাভাবিক দেখেছেন বলে বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন মাদক নিরাময় কেন্দ্রের স্টাফ (রান্নার কাজ করেন) শারমীন আক্তার। দু’মাস ধরে তিনি এখানে চাকরি করেন।

ভোলার এই তরুণী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা সাধারণ রোগী আসলে সামনে যাই না। তবে সোমবার সকালে এএসপিকে নিয়ে আসার পর কেন যেন আমি সামনে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি তিনি ভালো মানুষ। কথা বলছেন। কিছুক্ষণ পর আরিফ মাহমুদ জয় স্যার তাকে উপরে নিয়ে যান। উপরে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই আমরা সিসি ক্যামেরার মনিটরে দেখতে পাই তাকে ঝাপটে ধরে মারধর করছেন স্টাফরা। তিনি মারা গেছেন, এমন খবর হাসপাতালে ছড়িয়ে পড়ে। আনিসুল করিমের ভাই ও বোন এ সময় দ্রুত অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে বলেন, তবে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে কোনও অক্সিজেনের ব্যবস্থা ছিল না। দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স এনে তারা এখান থেকে চলে যায়।’

ওয়ার্ডবয়দের মারধর ও ভয়ভীতি দিয়েই মাইন্ড এইডের চিকিৎসা শুরু
আনিসুল করিম শিপনকে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে নেওয়ার পর তাকে দ্রুত উপরে নেওয়া হয়। তিনি যে কক্ষে মারা গেছেন, মঙ্গলবার (১০ নভেম্বর) সেই কক্ষে গিয়ে দেখা গেছে, এটি দোতলার বারান্দাঘেঁষা ছোট্ট একটি কক্ষ। ১০ ফুট বাই ৬ ফুটের কক্ষটিতে ফ্লোরে দুটি ফোমের ম্যাট্রেস ফেলা ছিল। লাইট বন্ধ করলেই অন্ধকার। একটি দরজা, কোনও জানালা বা ভেন্টিলেটর নেই। দরজা বন্ধ করে রাখলে বাইরের আলো-বাতাস সেখানে প্রবেশের কোনও উপায় নেই। বিশেষ কায়দায় তৈরি এই কক্ষের দরজা বন্ধ করলে ভেতরে সর্বোচ্চ শব্দ করলেও বাইরে থেকে কিছু শোনা যায় না। কক্ষে একটি এসি ও সিসি ক্যামেরা রয়েছে। এই কক্ষটিতেই মারা যান আনিসুল করিম।

এই কক্ষে কি হয় তা জানতে কক্ষের ভেতরে স্টাফ শারমীন জান্নাতকে নিয়ে প্রবেশ করেন প্রতিবেদক। সেখানে বসেই শারমীন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যারা প্রথম এখানে ভর্তি হয়, তাদের এই কক্ষে এনে আটকে রাখা হয়। প্রস্রাব, পায়খানা সব এখানেই করেন। তা পরবর্তীতে আয়ারা পরিষ্কার করে।’

আটকে রাখা হয় কেন? এর জবাবে তিনি বলেন, ‘যারা প্রথম আসে, তারা অনেক চিৎকার ও হই-হট্টগোল করে, তাই তাদের এখানে আটকে রাখা হয়। এক সপ্তাহ পর এখান থেকে বের করা হয়।’

ছোট্ট এই কক্ষটিতে একসঙ্গে চার-পাঁচ জনকেও আটকে রাখা হয় বলে জানান শারমীন। শারমীন বলেন, ‘আমাদের সাধারণত উপরে আসতে দেওয়া হয় না, ওয়ার্ডবয়রা দেখাশোনা করে পুরুষদের। দ্বিতীয় ও তিনতলায় পুরুষ রোগীদের রাখা হয়। ভবনের নিচতলায় নারী রোগীদের রাখা হয়। তবে কখনও রোগীদের খাবার দিতে আসলে তারা মারধরের কথা বলতো।’

কোনও ব্যবস্থা না নিয়েই অবৈধ নিরাময় কেন্দ্র দেখে চলে গেল স্বাস্থ্য অধিদফতর
রাজধানীর আদাবরের মাইন্ড এইড হাসপাতালের কোনও রকম অনুমোদন নেই বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের ঢাকা জেলার সিভিল সার্জন অফিসার ডা. মইনুল আহসান। তবে কোনও ব্যবস্থা না নিয়েই তিনি চলে যান। কারণ, এর অনুমোদন দেওয়া হয়নি, তাই কোনও ব্যবস্থাও তারা নিতে পারবেন না।

ডা. মইনুল আহসান বলেন, ‘২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মাইন্ড এইড হাসপাতাল চালানোর জন্য অনুমতি চাওয়া হয়েছিল। আমরা তখন পরীক্ষা করে দেখেছি হাসপাতালটি চালানোর মতো সুবিধা ও জনবল কিছুই তাদের ছিল না। সেজন্য মার্চ মাসে তাদের আবেদন আমরা পেন্ডিং (স্থগিত) করি। স্থগিত আদেশের পর তারা যদি কোনও চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে থাকে তা সম্পূর্ণ অবৈধ। তারা এটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ও পুনর্বাসন কেন্দ্র হিসেবে চালাচ্ছিল। এসব প্রতিষ্ঠান চালাতে হলে কিছু ক্লিনিক্যাল ফ্যাসিলিটিজ ও হাসপাতালের ব্যবস্থা রাখতে হয়। যেন জরুরি মুহূর্তে চিকিৎসা দেওয়া যায়। কিন্তু তাদের সে ব্যবস্থা ছিল না।’

হত্যাকাণ্ডের পর ফ্লোর পরিষ্কার করা হয়
এএসপি আনিসুল করিমকে হত্যার পর সিসি ক্যামেরার ফুটেজে পানি দিয়ে ফ্লোর ধুয়ে ফেলতে দেখা যায়। গ্রেফতার ওয়ার্ডবয়রা জানিয়েছে, আনিসুল করিম বমি করেছিল, পরে পানি দিয়ে তা ধুয়ে ফেলা হয়। এদিকে সুরতহালে আনিসুলের নাকে, ঘাড়ে ক্ষত পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

হঠাৎ কেন চুপচাপ হয়ে যায় আনিসুল
আনিসুল করিম সর্বশেষ বরিশাল মহানগর পুলিশে (বিএমপি) কর্মরত ছিলেন। আদাবরে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে তার মৃত্যুর পর বাবা থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলার এজাহারে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘৩/৪ দিন ধরে আনিসুল করিম হঠাৎ চুপচাপ হয়ে যায়। তাকে ৯ নভেম্বর প্রথমে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়। এরপর মাইন্ড এইড হাসপাতালে নেওয়া হয়।’

আনিসুল করিম ৩১তম বিসিএসে নিয়োগপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা। তার ব্যাচের অনেকে পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হয়েছেন। তবে তিনি এখনও পদোন্নতি পাননি।

ঢাকায় আসার আগে ৭ নভেম্বরও আনিসুল করিম দায়িত্ব পালন করেন। এ বিষয়ে বিএমপি কমিশনার শাহাবুদ্দিন খান বলেন, ‘৭ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। ৮ নভেম্বর তার বাবা এসে তাকে নিয়ে যান।’

বরিশাল ট্রাফিক বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কয়েক মাস ধরে আনিসুল করিমের ভেতরে অস্থিরতা ছিল, তবে কী নিয়ে তার মধ্যে এমন অস্থিরতা ছিল, তা কেউ জানাতে পারেননি।

মাদক নিরাময় কেন্দ্রটি পুলিশের জিম্মায়
এএসপি আনিসুল করিমের মৃত্যুর পর মাদক নিরাময় কেন্দ্রটি আদবর থানা পুলিশের জিম্মায় নেওয়া হয়েছে। পুলিশের অনুমতি ছাড়া সেখানে কেউ প্রবেশ ও বের হতে পারছে না। আদাবর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাহিদুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বর্তমানে হাসপাতালটি পুলিশের জিম্মায় থাকবে। এখানে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না।’

আসামিরা সব রিমান্ডে
১৫ জনের নাম উল্লেখ করে সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিম শিপনের বাবা ফয়েজ উদ্দিন আদাবর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। ইতোমধ্যে মাদক নিরাময় কেন্দ্রের মালিকসহ ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তারা প্রত্যেকে সাত দিন করে পুলিশ রিমান্ডে রয়েছেন। রিমান্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন, প্রতিষ্ঠানটির মার্কেটিং ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ জয় (৩৫), কো-অর্ডিনেটর রেদোয়ান সাব্বির, কিচেন শেফ মাসুদ (৩৭), ওয়ার্ডবয় জুবায়েত হোসেন (১৯), ওয়ার্ডবয় তানভীর হাসান (১৮), ফার্মাসিস্ট তানিফ মোল্লা (২০), ওয়ার্ডবয় সঞ্জীব চৌধুরী (২০), ওয়ার্ডবয় অসীম চন্দ্র পাল (২৪), ওয়ার্ডবয় লিটন আহমদ (১৮) ও ওয়ার্ডবয় সাইফুল ইসলাম পলাশ (৩৫)। পলাতক রয়েছে এখনও পাঁচ জন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন
এদিকে মঙ্গলবার দুপুরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা আনিসুল করিম হত্যার বিচারের দাবিতে মাইন্ড এইড মাদক নিরাময় কেন্দ্রের সামনে মানববন্ধন করেছেন। আনিসুল করিম এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের ৩৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন।

ব্যাচমেটরাও চান বিচার
আনিসুল করিমের এমন নির্মম মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ বিসিএসের ৩১তম ব্যাচের পুলিশ কর্মকর্তারা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে কর্মরত তার ব্যাচমেট অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার খন্দকার রবিউল আরাফাত লেলিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মানুষ চিকিৎসা নিতে গেলে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হবে। কিন্তু এটা কোন চিকিৎসা! যেখানে নেওয়ার পরই হায়নার মতো তার ওপর হামলে পড়ে মারধর করা হয়। যে মানুষটি স্বজনদের সঙ্গে হাসপাতালে গেলো, তিনি দায়িত্ব পালন করছেন একদিন আগেও, তাকে এভাবে মেরে ফেললো!’

গাজীপুরে এএসপির দাফন সম্পন্ন
রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে আনিসুল করিমকে গাজীপুরে তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়েছে।