দেশজুড়ে অস্ত্রের কারবার কুমিল্লার জামায়াত নেতা ওয়ার্ড কাউন্সিলরের!
- আপডেট সময় : ১১:১৮:৫৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১০ জুলাই ২০১৯ ১৪৩ বার পড়া হয়েছে
জাহিদ হাসান রেহান ;
সাধারণ মানুষ তাঁকে জনগণের সেবক মনে করে ভোট দিয়ে কাউন্সিলর বানিয়েছে। অথচ পর্দার আড়ালে তিনি একজন শীর্ষস্থানীয় অস্ত্র কারবারি। দেশজুড়ে তাঁর অস্ত্রের কারবার। ভারী, ছোট-বড় সব ধরনের অস্ত্রের চোরাচালানের সঙ্গে রয়েছে তাঁর সম্পৃক্ততা। তিনি কাজী গোলাম কিবরিয়া। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের এক নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর। কুমিল্লার শীর্ষ স্থানীয় জামায়াত নেতাদেরও একজন তিনি। সম্প্রতি ভয়ংকর একে-২২ অস্ত্র কিনতে এসেছিলেন ঢাকায়। ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট তাঁকে গ্রেপ্তার করতে না পারলেও তাঁর দুই ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে। পরে ওই দুজন গোলাম কিবরিয়ার এই অন্ধকার জগতের আদ্যোপান্ত ফাঁস করে দেয়। এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত সাত দিন তিনি কারো সঙ্গে দেখা দেননি। প্রবল বৃষ্টিতে এলাকায় জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হলেও জনগণের পাশে তাঁকে দেখা যায়নি।
কাজী গোলাম কিবরিয়ার সন্ধান পেলেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে বলে জানিয়েছেন কুমিল্লার কোতোয়ালি থানার ওসি আবু সালাম মিয়া। তিনি সকালের সংবাদকে বলেন, ‘এই জামায়াত নেতা আগে থেকেই খারাপ। তাঁর বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় ১৫টি মামলা রয়েছে। এক বছর আগেও তিনি অস্ত্রসহ একবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। বর্তমানে জামিনে থেকে ফের অস্ত্রের কারবার শুরু করেন।’
সরেজমিনে কুমিল্লায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আন্ডার ওয়ার্ল্ড মাফিয়াচক্রের সঙ্গে কাজী গোলাম কিবরিয়ার সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। জামায়াতের এই নেতা প্রকাশ্যে মানুষের সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করেন। চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা হয়ে ঢাকায় যেসব অস্ত্রের চোরাচালান আসে সেই চক্রের অন্যতম সদস্য তিনি। তাঁর সহযোগী শিবির ক্যাডার আব্দুল হাই হাসিব ওরফে হাতকাটা হাসিব ওরফে বোমা হাসিব এবং জামায়াত নেতা বাবুল উদ্দিন ও সাদেক হোসেন। এরা দীর্ঘদিন ধরে অস্ত্র চোরা কারবারের সঙ্গে যুক্ত।
গত ৩০ জুন সন্ধ্যায় ওয়ারীর স্বামীবাগ এলাকায় রাজধানী সুপার মার্কেটের সামনে থেকে গোলাম কিবরিয়ার ঘনিষ্ঠ সাইদুল ইসলাম মজুমদার ওরফে রুবেল এবং কামাল হোসেন নামে দুজনকে একে-২২ রাইফেল, ৩০ রাউন্ড গুলি ও দুটি ম্যাগজিনসহ গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে নিয়ে এসব তথ্য পেয়েছে সিটিটিসি।
কাউন্সিলর কাজী গোলাম কিবরিয়া এবং হাসিব একসময় শিবিরের দুর্ধর্ষ ক্যাডার ছিলেন। বোমা তৈরি করতে গিয়ে হাসিবের দুই হাতের আঙুল উড়ে গেলেও সে দমেনি। তারা চোরাচালানের মাধ্যমে বিদেশি অস্ত্র এনে সন্ত্রাসীদের কাছে বিক্রি করছেন। নিজ দলের ক্যাডারদেরও তাঁরা অস্ত্রের জোগান দিচ্ছেন।
সিটিটিসির তদন্তে এসব তথ্যের পাশাপাশি আরো উঠে এসেছে রাজনৈতিক কারণে ব্যাকফুটে থাকা জামায়াত-শিবিরের পরিকল্পনায় রয়েছে সরকারের শীর্ষপর্যায়ের কজন রাজনৈতিক নেতাকে নাশকতার মাধ্যমে হত্যা করে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করা। ওই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই একে-২২ রাইফেল ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। একে-২২ রাইফেল ধরা পড়লেও এই চক্রের হাতে এ ধরনের আরো ভারী অস্ত্র থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।
গ্রেপ্তার দুজন স্বীকার করেছে, তারা জামায়াত শিবিরের কর্মী। তারা কুমিল্লার ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাজী গোলাম কিবরিয়া ও অস্ত্র চোরাকারবারি হাসিবের ঘনিষ্ঠ এবং তাঁদের অস্ত্রের বাহক। গ্রেপ্তার রুবেল ট্রাকচালক। হাসিবের ডান হাত হিসেবে কাজ করত কামাল। হাসিব তাকে দিয়েই অবৈধ অস্ত্র বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করত। গ্রেপ্তার দুজনের বাড়ি কুমিল্লার কোতয়ালী থানার শুভপুরে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিবির ক্যাডার হাসিবের বিরুদ্ধে কুমিল্লার বিভিন্ন থানায় ১০টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে কুমিল্লা কোতোয়ালি থানাতেই রয়েছে হত্যা, নাশকতার সাতটি মামলা। ২০১৭ সালে র্যাব হাসিবকে একবার গ্রেপ্তার করেছিল। পরে জামিনে বের হয়ে সে লাপাত্তা হয়ে যায়।
উদ্ধার করা একে-২২ অস্ত্রের মূল মালিক কে, এ নিয়ে চলছে বিস্তর তদন্ত। জানা যায়, চট্টগ্রামের বাবুল নামে একজন প্রথমে এ অস্ত্রটি কিনেছিল। পরে অস্ত্রটি হাসিবের কাছে বিক্রি করা হয়। হাসিব পরে অস্ত্রটি কাউন্সিলর কাজী গোলাম কিবরিয়ার কাছে বিক্রি করতে চেয়েছিল। এ অস্ত্রটি কিনতেই ঢাকায় এসেছিলেন কিবরিয়া। অস্ত্রটি রাশিয়ায় তৈরি। এই একই মডেলের রাইফেল দিয়ে তিন বছর আগে গুলশানের হলি আর্টিজানে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল জঙ্গিরা।
সিটিটিসির স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) জাহাঙ্গীর আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একে-২২ রাইফেল অনেক বড় অস্ত্র। এই অস্ত্র দিয়ে জামায়াত-শিবির নাশকতার পরিকল্পনা করেছিল। ওই চক্রের সদস্য কুমিল্লা এক নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাজী গোলাম কিবরিয়া পালিয়ে গেলেও তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’
সিটিটিসি সূত্র জানায়, অস্ত্রের হাত বদলের সময় কিবরিয়াসহ আরো চারজন অস্ত্র কারবারি সায়েদাবাদ বাস কাউন্টারে ছিল। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে তারা পালিয়ে যায়। রাজধানীতে হঠাৎ এ ধরনের ভারী অস্ত্র আটকের ঘটনাটি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছে পুলিশ।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কমিশনার (ডিআইজি) মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় বেশ কজন জামায়াত নেতার। এর প্রতিশোধ নিতে ও বড় ধরনের নাশকতার জন্য এ ধরনের ভারী অস্ত্র সংগ্রহ করা হতে পারে।’
প্রতিবেদনটি তৈরিতে কুমিল্লা থেকে সহযোগিতা করেছেন আবুল কাশেম হৃদয়।