ঢাকা ০৬:৪৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
Logo মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা আমাদের অঙ্গীকারঃ ড. তৌফিক রহমান চৌধুরী  Logo মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির নতুন বাসের উদ্বোধন Logo মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে শিক্ষকদের ভূমিকা অগ্রগণ্য: ভিসি প্রফেসর ড. মোহাম্মদ জহিরুল হক Logo মঙ্গল শোভাযাত্রা – তাসফিয়া ফারহানা ঐশী Logo সাস্টিয়ান ব্রাহ্মণবাড়িয়া এর ইফতার মাহফিল সম্পন্ন Logo কুবির চট্টগ্রাম স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের ইফতার ও পূর্নমিলনী Logo অধ্যাপক জহীর উদ্দিন আহমেদের মায়ের মৃত্যুতে শাবির মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্ত চিন্তা চর্চায় ঐক্যবদ্ধ শিক্ষকবৃন্দ পরিষদের শোক প্রকাশ Logo শাবির অধ্যাপক জহীর উদ্দিনের মায়ের মৃত্যুতে উপাচার্যের শোক প্রকাশ Logo বিশ কোটিতে গণপূর্তের প্রধান হওয়ার মিশনে ‘ছাত্রদল ক্যাডার প্রকৌশলী’! Logo দূর্নীতির রাক্ষস ফায়ার সার্ভিসের এডি আনোয়ার!




৯০ ভাগ ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার অপ্রয়োজনীয়

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৭:৫৪:২৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০১৯ ১৩০ বার পড়া হয়েছে

সকালের সংবাদ; 
প্রেসক্রিপশন ছাড়াই দোকানে বিক্রি হচ্ছে জীবনরক্ষাকারী ওষুধ অ্যান্টিবায়োটিক। রোগীর দেহে প্রয়োজনীয়তা থাকলেই চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে থাকেন। কিন্তু এ নিয়ম মানছেন না কেউ। দেশে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহারের বিষয়ে সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান। বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিক দেন দোকানদার যার মধ্যে ৯০ ভাগ অপ্রয়োজনীয়। প্রয়োজন হলেও তারা চিকিৎসক না হওয়ায় অ্যান্টিবায়োটিকের সঠিক ডোজটা দিতে পারছেন না বা সম্পূর্ণ ডোজ দিচ্ছেন না।’
তিনি বলেন, দেশে মুরগি, গরু এবং ছাগলের মাংস থেকেও মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করছে। এ অবস্থা অবশ্যই আতঙ্কজনক। সারাদেশে আড়াই লাখ ফার্মেসি আছে। দিনে যদি তারা চার থেকে পাঁচজনকে অ্যান্টিবায়োটিক দেয় তাহলে আনুমানিক ২০ লাখ অ্যান্টিবায়োটিক একদিনে দেওয়া হচ্ছে। এটা প্রেসক্রিপশন ছাড়া দেওয়া হচ্ছে, যার ৯০ ভাগ অপ্রয়োজনীয়।
এ চিকিৎসক বলেন, অ্যান্টিবায়োটিকের বিষয়ে প্রথম কথা হচ্ছে ‘সাধারণত রেজিস্ট্যান্সের ড্রাইভিং ফোর্স কত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয় তার ওপর দেখা হয়। কারণ ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে দেখা হলে ব্যাকটেরিয়ার একটা স্থিতি তৈরি হয় এবং সেই স্থিতিটাই আসলে রেজিস্ট্যান্স। ব্যাকটেরিয়া বাঁচার পদ্ধতিটা শিখে ফেলে। যেহেতু প্রতিদিন এই রকম লাখ লাখ অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হচ্ছে তাই ব্যাকটেরিয়াগুলোর সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিকগুলোর দেখা হচ্ছে এবং ব্যাকটেরিয়াগুলো অ্যান্টিবায়োটিককে চিনে ফেলছে। তাদের মধ্যে কোনও কোনও ব্যাকটেরিয়া বাঁচার একটা নিয়ম শিখে ফেলছে এবং তারা যখন লাখ লাখ কোটি কোটি হয়ে যায় তখন আর অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে না। তখন আর ব্যাকটেরিয়াগুলো সেই অ্যান্টিবায়োটিকে মারা যায় না। যতবেশি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার হবে তত বেশি সমস্যা বাড়ে। বাংলাদেশে যেহেতু কোনও প্রয়োজন ছাড়াই বেশি ব্যবহার হচ্ছে তাই আমাদের এই ড্রাইভিং ফোর্সটাকে প্রথমে কমাতে হবে।’
অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে বাংলাদেশে মুরগি পালনে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। প্রায় ২৪টার মতো অ্যান্টিবায়োটিক আছে যা মুরগি পালনে ব্যবহার হচ্ছে। এর মধ্যে তিন ধরনের কোলিস্টিন, সিপ্রোফক্সাসিন, এজিথ্রোমাইসিন মুরগিকে প্রতিদিন খাওয়ানো হচ্ছে। বড় প্রাণীর ক্ষেত্রেও মাঝে মাঝেই দেওয়া হচ্ছে। মুরগিকে অ্যান্টিবায়োটিক সকাল বেলায় পানির সঙ্গে দেওয়া হয় যেন মুরগির ইনফেকশন না হয়। মানে মুরগির যেন মহামারী না লাগে। সুস্থ মুরগিকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো হচ্ছে যেন অসুস্থ না হয়। এর ফলে সেই মুরগি অসুস্থ হয় না, মুরগির মলমূত্রের সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক পানিতে যায় এবং পানির সঙ্গে থাকা ব্যাকটেরিয়াগুলোর সঙ্গে দেখা হয় এবং তারাও রেজিস্ট্যান্স হয়ে যায়। ওরা এরপরে জিন পাঠিয়ে দেয় মানুষকে যে ব্যাকটেরিয়াগুলো আক্রমণ করবে সেই ব্যাকটেরিয়াকে। এর ফলে সেই ব্যাকটেরিয়াগুলো মানুষকে পরবর্তী সময়ে আক্রমণ করে। কিন্তু মুরগিতে ব্যবহার করার কারণে সেই মানুষটি যখন আক্রান্ত হলো তখন সেই ব্যাকটেরিয়া দিয়ে আর সিপ্রোফক্সাসিন, কোলিস্টিন কাজ করবে না। দেশের কোটি কোটি মুরগিকে সকাল বেলা পানির সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হচ্ছে। এটাকে আমরা বলি সিলেক্টিভ প্রেসার। দুর্বল ব্যাকটেরিয়াগুলো মারা যায় এবং সবল ব্যাকটেরিয়াগুলো বেঁচে যায়। তাই অন্তত এই তিনটি অ্যান্টিবায়োটিক মুরগিকে দেওয়া বন্ধ করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে, চিকিৎসক নন কিন্তু চিকিৎসা করেন এমন প্যারামেডিকস, পল্লী চিকিৎসকরাও ভুল ডোজে অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছেন। চিকিৎসক নন কিন্তু নিজেদের চিকিৎসক দাবি করেন এমন লোকের সংখ্যা আমাদের দেশে লক্ষাধিক। যারা নামের আগে ডাক্তার লিখেন। লোকেও মনে করে তারা ডাক্তার। তাদের আমরা বলি কোয়াক। এরা পল্লী চিকিৎসক, সাকমো। এদের নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। কারণ তাদের লেখাপড়া দিয়ে তারা বড়জোর পাঁচ থেকে তিনটা অ্যান্টিবায়োটিক দিতে পারেন। কিন্তু তারা সবই দিচ্ছেন।’
চতুর্থত, কোনও ব্যাকটেরিয়ার সেনসিটিভিটি কেমন তার টেস্ট হয় দেশের মাত্র ১০ থেকে ১২টা জায়গায়। এর ফলে যেটা হচ্ছে প্রায় ৫০টা জেলায় কোনও ব্যাকটেরিয়ার সেনসিটিভিটি কেমন সেটা না জেনে ডাক্তারদের বই থেকে পড়া জ্ঞান দিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক রোগীকে দিতে হয়। এতে ব্যাকটেরিয়ার রেজিস্ট্যান্স প্রতিদিন বদল হয়, কিন্তু ডাক্তাররা এটার ব্যাপারে সচেতন নয়। তারা ধরে নেন মানুষ তো আগে অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে এসেছে। তারা অকারণে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি শক্তিশালী নতুন বা ঝুঁকিপূর্ণ অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করেন। তারা যে কারণটা বলেন, আগে অ্যান্টিবায়োটিক খেয়েছে। এটা আসলে খুবই ভুল যুক্তি। এই যুক্তিতে কখনও অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া যায় না। দেখা উচিত ছিল সেনসিটিভিটি। তাই দেশের ন্যূনতম সব জেলা সদর হাসপাতালে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সি পরীক্ষা করা প্রয়োজন। অন্তত অঞ্চলভিত্তিক মেডিক্যাল কলেজগুলোতে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হোক কিংবা যেসব ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা হচ্ছে সেই তথ্য প্রকাশ করতে হবে। তাহলে চিকিৎসকরা সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন কোনটা এখন রেজিস্ট্যান্স হয়ে গেছে, কোনটা এখন ব্যবহার করতে হবে।
অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘পঞ্চম বিষয়টি হচ্ছে, চিকিৎসকের পড়ার ক্ষেত্রে মাত্র দুই ভাগ অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে পড়ানো হয়। এটা বাড়িয়ে ২৫ ভাগ করলে চিকিৎসকরা সচেতন হবেন। মেডিক্যাল কারিকুলামে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট এবং পোস্ট গ্র্যাজুয়েটে এটার গুরুত্ব বাড়ানো উচিত। একই সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের নীতিমালা সবখানে করতে হবে। তিনি বলেন, সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিকের রঙ লাল করতে হবে। এটা করে সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হবে, এই লাল রঙ আপনি চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনোভাবেই খাবেন না।’
আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) রোগীর ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে শঙ্কার বিষয়ে তিনি বলেন, দেশের বেসরকারি হাসপাতাল থেকে বিএসএমএমইউতে যেসব রোগী আসেন তাদের লিভার ও হার্ট ফেইলিউর থাকে। রোগীর মৃত্যুর আশঙ্কা আগে থেকেই তৈরি হয়। তার কম্প্রোমাইজ ফাংশনের কারণে রোগী যখন ব্যাকটেরিয়া দিয়ে ইনফেকটেড হয় তখন সেই ব্যাকটেরিয়াগুলো তিনি অন্য হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসেন। আইসিইউতে ৩-৭ দিন থেকে টাকার অভাবে এখানে আসেন রোগী। জটিলতম কেস। আইসিইউ সবসময় ঝুঁকিপূর্ণ, তবে বলা যাবে না যে এই ব্যাকটেরিয়ার কারণে রোগী মারা গেছেন। কিন্তু তাদের ব্যাকটেরিয়ার কালচার যদি আমরা দেখি, দেখা যাবে যে ওই সময় ড্রাগের বিরুদ্ধে ৮০ ভাগ রেজিন্ট্যান্স ছিল। যতজন মারা যায়, তার মধ্যে ৭০-৮০ ভাগ রেজিস্ট্যান্ট পাওয়া যাবে সেটা হয়তো বেশিরভাগই এই ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত। তবে এই ব্যাকটেরিয়ার কারণেই রোগীর মৃত্যু হয়েছে এটা বলা যাবে না। কারণ আগে থেকেই রোগী ঝুঁকিতে ছিল। তিনি বলেন, আইসিইউতে মারা যাওয়া প্রতি ১০ জনের আটজনের ক্ষেত্রে দেখা যাবে, নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়া রেজিস্ট্যান্স ছিল।
প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার (২৫ এপ্রিল) বিশেষজ্ঞ বা রেজিস্ট্রার্ড চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ বিক্রি বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ওষুধ প্রশাসনের মহাপরিচালককে (ডিজির) সার্কুলার জারি করতে বলা হয়েছে। ওই সার্কুলারের মাধ্যমে সব জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও সিভিল সার্জনকে দুই দিনের মধ্যে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন আদালত।
এর আগে গত ২২ এপ্রিল ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফে ‘সুপারবাগস লিংকড টু এইট আউট অব টেন ডেথস ইন বাংলাদেশ আইসিইউ-স’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ৮০ শতাংশ রোগীর মৃত্যুর জন্য অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধকারী সুপারবাগ দায়ী। দ্য টেলিগ্রাফের ওই প্রতিবেদনটি সংযুক্ত করে আইনজীবী সৈয়দ সাইয়েদুল হক সুমন আদালতে রিট আবেদন করেন।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :




৯০ ভাগ ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার অপ্রয়োজনীয়

আপডেট সময় : ০৭:৫৪:২৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০১৯

সকালের সংবাদ; 
প্রেসক্রিপশন ছাড়াই দোকানে বিক্রি হচ্ছে জীবনরক্ষাকারী ওষুধ অ্যান্টিবায়োটিক। রোগীর দেহে প্রয়োজনীয়তা থাকলেই চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে থাকেন। কিন্তু এ নিয়ম মানছেন না কেউ। দেশে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহারের বিষয়ে সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান। বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিক দেন দোকানদার যার মধ্যে ৯০ ভাগ অপ্রয়োজনীয়। প্রয়োজন হলেও তারা চিকিৎসক না হওয়ায় অ্যান্টিবায়োটিকের সঠিক ডোজটা দিতে পারছেন না বা সম্পূর্ণ ডোজ দিচ্ছেন না।’
তিনি বলেন, দেশে মুরগি, গরু এবং ছাগলের মাংস থেকেও মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করছে। এ অবস্থা অবশ্যই আতঙ্কজনক। সারাদেশে আড়াই লাখ ফার্মেসি আছে। দিনে যদি তারা চার থেকে পাঁচজনকে অ্যান্টিবায়োটিক দেয় তাহলে আনুমানিক ২০ লাখ অ্যান্টিবায়োটিক একদিনে দেওয়া হচ্ছে। এটা প্রেসক্রিপশন ছাড়া দেওয়া হচ্ছে, যার ৯০ ভাগ অপ্রয়োজনীয়।
এ চিকিৎসক বলেন, অ্যান্টিবায়োটিকের বিষয়ে প্রথম কথা হচ্ছে ‘সাধারণত রেজিস্ট্যান্সের ড্রাইভিং ফোর্স কত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয় তার ওপর দেখা হয়। কারণ ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে দেখা হলে ব্যাকটেরিয়ার একটা স্থিতি তৈরি হয় এবং সেই স্থিতিটাই আসলে রেজিস্ট্যান্স। ব্যাকটেরিয়া বাঁচার পদ্ধতিটা শিখে ফেলে। যেহেতু প্রতিদিন এই রকম লাখ লাখ অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হচ্ছে তাই ব্যাকটেরিয়াগুলোর সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিকগুলোর দেখা হচ্ছে এবং ব্যাকটেরিয়াগুলো অ্যান্টিবায়োটিককে চিনে ফেলছে। তাদের মধ্যে কোনও কোনও ব্যাকটেরিয়া বাঁচার একটা নিয়ম শিখে ফেলছে এবং তারা যখন লাখ লাখ কোটি কোটি হয়ে যায় তখন আর অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে না। তখন আর ব্যাকটেরিয়াগুলো সেই অ্যান্টিবায়োটিকে মারা যায় না। যতবেশি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার হবে তত বেশি সমস্যা বাড়ে। বাংলাদেশে যেহেতু কোনও প্রয়োজন ছাড়াই বেশি ব্যবহার হচ্ছে তাই আমাদের এই ড্রাইভিং ফোর্সটাকে প্রথমে কমাতে হবে।’
অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে বাংলাদেশে মুরগি পালনে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। প্রায় ২৪টার মতো অ্যান্টিবায়োটিক আছে যা মুরগি পালনে ব্যবহার হচ্ছে। এর মধ্যে তিন ধরনের কোলিস্টিন, সিপ্রোফক্সাসিন, এজিথ্রোমাইসিন মুরগিকে প্রতিদিন খাওয়ানো হচ্ছে। বড় প্রাণীর ক্ষেত্রেও মাঝে মাঝেই দেওয়া হচ্ছে। মুরগিকে অ্যান্টিবায়োটিক সকাল বেলায় পানির সঙ্গে দেওয়া হয় যেন মুরগির ইনফেকশন না হয়। মানে মুরগির যেন মহামারী না লাগে। সুস্থ মুরগিকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো হচ্ছে যেন অসুস্থ না হয়। এর ফলে সেই মুরগি অসুস্থ হয় না, মুরগির মলমূত্রের সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক পানিতে যায় এবং পানির সঙ্গে থাকা ব্যাকটেরিয়াগুলোর সঙ্গে দেখা হয় এবং তারাও রেজিস্ট্যান্স হয়ে যায়। ওরা এরপরে জিন পাঠিয়ে দেয় মানুষকে যে ব্যাকটেরিয়াগুলো আক্রমণ করবে সেই ব্যাকটেরিয়াকে। এর ফলে সেই ব্যাকটেরিয়াগুলো মানুষকে পরবর্তী সময়ে আক্রমণ করে। কিন্তু মুরগিতে ব্যবহার করার কারণে সেই মানুষটি যখন আক্রান্ত হলো তখন সেই ব্যাকটেরিয়া দিয়ে আর সিপ্রোফক্সাসিন, কোলিস্টিন কাজ করবে না। দেশের কোটি কোটি মুরগিকে সকাল বেলা পানির সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হচ্ছে। এটাকে আমরা বলি সিলেক্টিভ প্রেসার। দুর্বল ব্যাকটেরিয়াগুলো মারা যায় এবং সবল ব্যাকটেরিয়াগুলো বেঁচে যায়। তাই অন্তত এই তিনটি অ্যান্টিবায়োটিক মুরগিকে দেওয়া বন্ধ করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে, চিকিৎসক নন কিন্তু চিকিৎসা করেন এমন প্যারামেডিকস, পল্লী চিকিৎসকরাও ভুল ডোজে অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছেন। চিকিৎসক নন কিন্তু নিজেদের চিকিৎসক দাবি করেন এমন লোকের সংখ্যা আমাদের দেশে লক্ষাধিক। যারা নামের আগে ডাক্তার লিখেন। লোকেও মনে করে তারা ডাক্তার। তাদের আমরা বলি কোয়াক। এরা পল্লী চিকিৎসক, সাকমো। এদের নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। কারণ তাদের লেখাপড়া দিয়ে তারা বড়জোর পাঁচ থেকে তিনটা অ্যান্টিবায়োটিক দিতে পারেন। কিন্তু তারা সবই দিচ্ছেন।’
চতুর্থত, কোনও ব্যাকটেরিয়ার সেনসিটিভিটি কেমন তার টেস্ট হয় দেশের মাত্র ১০ থেকে ১২টা জায়গায়। এর ফলে যেটা হচ্ছে প্রায় ৫০টা জেলায় কোনও ব্যাকটেরিয়ার সেনসিটিভিটি কেমন সেটা না জেনে ডাক্তারদের বই থেকে পড়া জ্ঞান দিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক রোগীকে দিতে হয়। এতে ব্যাকটেরিয়ার রেজিস্ট্যান্স প্রতিদিন বদল হয়, কিন্তু ডাক্তাররা এটার ব্যাপারে সচেতন নয়। তারা ধরে নেন মানুষ তো আগে অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে এসেছে। তারা অকারণে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি শক্তিশালী নতুন বা ঝুঁকিপূর্ণ অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করেন। তারা যে কারণটা বলেন, আগে অ্যান্টিবায়োটিক খেয়েছে। এটা আসলে খুবই ভুল যুক্তি। এই যুক্তিতে কখনও অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া যায় না। দেখা উচিত ছিল সেনসিটিভিটি। তাই দেশের ন্যূনতম সব জেলা সদর হাসপাতালে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সি পরীক্ষা করা প্রয়োজন। অন্তত অঞ্চলভিত্তিক মেডিক্যাল কলেজগুলোতে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হোক কিংবা যেসব ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা হচ্ছে সেই তথ্য প্রকাশ করতে হবে। তাহলে চিকিৎসকরা সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন কোনটা এখন রেজিস্ট্যান্স হয়ে গেছে, কোনটা এখন ব্যবহার করতে হবে।
অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘পঞ্চম বিষয়টি হচ্ছে, চিকিৎসকের পড়ার ক্ষেত্রে মাত্র দুই ভাগ অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে পড়ানো হয়। এটা বাড়িয়ে ২৫ ভাগ করলে চিকিৎসকরা সচেতন হবেন। মেডিক্যাল কারিকুলামে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট এবং পোস্ট গ্র্যাজুয়েটে এটার গুরুত্ব বাড়ানো উচিত। একই সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের নীতিমালা সবখানে করতে হবে। তিনি বলেন, সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিকের রঙ লাল করতে হবে। এটা করে সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হবে, এই লাল রঙ আপনি চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনোভাবেই খাবেন না।’
আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) রোগীর ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে শঙ্কার বিষয়ে তিনি বলেন, দেশের বেসরকারি হাসপাতাল থেকে বিএসএমএমইউতে যেসব রোগী আসেন তাদের লিভার ও হার্ট ফেইলিউর থাকে। রোগীর মৃত্যুর আশঙ্কা আগে থেকেই তৈরি হয়। তার কম্প্রোমাইজ ফাংশনের কারণে রোগী যখন ব্যাকটেরিয়া দিয়ে ইনফেকটেড হয় তখন সেই ব্যাকটেরিয়াগুলো তিনি অন্য হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসেন। আইসিইউতে ৩-৭ দিন থেকে টাকার অভাবে এখানে আসেন রোগী। জটিলতম কেস। আইসিইউ সবসময় ঝুঁকিপূর্ণ, তবে বলা যাবে না যে এই ব্যাকটেরিয়ার কারণে রোগী মারা গেছেন। কিন্তু তাদের ব্যাকটেরিয়ার কালচার যদি আমরা দেখি, দেখা যাবে যে ওই সময় ড্রাগের বিরুদ্ধে ৮০ ভাগ রেজিন্ট্যান্স ছিল। যতজন মারা যায়, তার মধ্যে ৭০-৮০ ভাগ রেজিস্ট্যান্ট পাওয়া যাবে সেটা হয়তো বেশিরভাগই এই ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত। তবে এই ব্যাকটেরিয়ার কারণেই রোগীর মৃত্যু হয়েছে এটা বলা যাবে না। কারণ আগে থেকেই রোগী ঝুঁকিতে ছিল। তিনি বলেন, আইসিইউতে মারা যাওয়া প্রতি ১০ জনের আটজনের ক্ষেত্রে দেখা যাবে, নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়া রেজিস্ট্যান্স ছিল।
প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার (২৫ এপ্রিল) বিশেষজ্ঞ বা রেজিস্ট্রার্ড চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ বিক্রি বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ওষুধ প্রশাসনের মহাপরিচালককে (ডিজির) সার্কুলার জারি করতে বলা হয়েছে। ওই সার্কুলারের মাধ্যমে সব জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও সিভিল সার্জনকে দুই দিনের মধ্যে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন আদালত।
এর আগে গত ২২ এপ্রিল ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফে ‘সুপারবাগস লিংকড টু এইট আউট অব টেন ডেথস ইন বাংলাদেশ আইসিইউ-স’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ৮০ শতাংশ রোগীর মৃত্যুর জন্য অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধকারী সুপারবাগ দায়ী। দ্য টেলিগ্রাফের ওই প্রতিবেদনটি সংযুক্ত করে আইনজীবী সৈয়দ সাইয়েদুল হক সুমন আদালতে রিট আবেদন করেন।