ঢাকা ০১:১৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
Logo মঙ্গল শোভাযাত্রা – তাসফিয়া ফারহানা ঐশী Logo সাস্টিয়ান ব্রাহ্মণবাড়িয়া এর ইফতার মাহফিল সম্পন্ন Logo কুবির চট্টগ্রাম স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের ইফতার ও পূর্নমিলনী Logo অধ্যাপক জহীর উদ্দিন আহমেদের মায়ের মৃত্যুতে শাবির মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্ত চিন্তা চর্চায় ঐক্যবদ্ধ শিক্ষকবৃন্দ পরিষদের শোক প্রকাশ Logo শাবির অধ্যাপক জহীর উদ্দিনের মায়ের মৃত্যুতে উপাচার্যের শোক প্রকাশ Logo বিশ কোটিতে গণপূর্তের প্রধান হওয়ার মিশনে ‘ছাত্রদল ক্যাডার প্রকৌশলী’! Logo দূর্নীতির রাক্ষস ফায়ার সার্ভিসের এডি আনোয়ার! Logo ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতি হওয়া শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অবকাঠামোর সংস্কার শুরু Logo বুয়েটে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র রাজনীতির দাবিতে শাবিপ্রবি ছাত্রলীগের মানববন্ধন Logo কুবি উপাচার্যের বক্তব্যের প্রমাণ দিতে শিক্ষক সমিতির সাত দিনের আল্টিমেটাম




জিরো থেকে হিরো ,যেন বনে যাওয়াদের কাহিনি

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ১১:৪৩:০৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৭ অক্টোবর ২০১৯ ৯২ বার পড়া হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদন:

বড়লোক হতে কার না ইচ্ছে হয়? কিন্তু কয়জনে তা হতে পারে? তার পরও কেউ কেউ বড়োলোক হয়। আর অন্যেরটা মেরে, কেটে,কেড়ে, যে কোনোভাবে একবার বড়োলোক হলেই কেল্লা ফতে। সে আরো আরো বড়োলোক হয়। ফুলে-ফেঁপে কেবলই প্রসারিত হতে থাকে। আমাদের দেশে বড়লোক মানে লম্বা,চওড়া, মস্ত লোক কিংবা বড় মাপের মানুষ নয়; এদেশে বড়োলোক মানে হচ্ছে টাকাওয়ালা লোক। যার যত বেশি টাকা সে তত বেশি বড়লোক।

টাকার একটা ধর্ম আছে, টাকা সব সময় তার স্বজাতি অর্থা টাকা খোঁজে। যার টাকা আছে তার কাছেই টাকা এসে ভিড় জমায় ও ধরা দেয়। টাকায় টাকা আনে বাংলা ভাষায় এ প্রবাদ বুঝি তাই সৃষ্টি হয়েছে।যদিও টাকায় টাকা আনে এ প্রবাদটি সর্বাংশে সত্য নয়। একটি গল্পের মাধ্যমে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাক। সহজ-সরল প্রকৃতির গরিব মানুষ শুনল যে, টাকায় টাকা আনে। এ কথা শুনে লোকটি উৎসাহিত হয়ে পড়ে। টাকা কিভাবে বা কোন প্রক্রিয়ায় টাকা আনে তা সে বুঝতে পারছিল না। লোকটি অনেক কষ্টে সঞ্চয় করা ১০০ টাকার একটি নোট বিছানার নিচে যত্ন করে রেখে দেয়। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা বিছানা উলটে দেখে টাকায় টাকা এনেছে কি না। মাসের পর মাস চলে যায় কিন্তু এতে কোনো লাভ হয় না।

অগত্যা লোকটি ১০০ টাকার নোটটি পকেটে নিয়ে এদিক-সেদিক হেঁটে বেড়ায় আর ভাবে, টাকা কিভাবে টাকা আনে। এক সন্ধ্যায় সে হাঁটতে হাঁটতে দেখে, এক মহাজন সারা দিনের লেনদেন শেষে দোকানে বসে অত্যন্ত মগ্ন হয়ে টাকা গুণছে। লোকটি সঙ্গে সঙ্গে মওকা পেয়ে যায়। সে সন্তর্পণে ১০০ টাকার নোটটি মহাজনের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা টাকার গদিতে ছুড়ে মারে। মহাজন নির্বিকার মনে টাকা গুণে চলে। টাকা গোনা শেষ করে মহাজন তা সিন্দুকে ঢুকিয়ে যখন দোকান বন্ধের উদ্যোগ নিতে যাবে, তখন ঐ গরিব লোকটি আড়াল থেকে সামনে আসে এবং মহাজনের কাছে তার ১০০ টাকা ফেরত চায়। মহাজন কোনো কিছু বুঝতে না পেরে লোকটির দিকে অবাক চোখে তাকায়।

লোকটি তখন মহাজনের কাছে পুরো ঘটনা বর্ণনা করে বলে, আমি শুনেছিলাম টাকায় টাকা আনে। আপনি যখন টাকা গুনছিলেন, তখন আমার ১০০ টাকার একটি নোট আপনার টাকার মধ্যে ছুড়ে মারি। কিন্তু দেখলাম আমার নোটটি আপনার কোনো নোটকে তো আনতে পারলই না, উলটো আপনি আমার নোটটিসহ সব টাকা সিন্দুকে রেখে দিলেন। এবার মহাজন দোকানের ঝাঁপ ফেলতে ফেলতে বলে, আপনি ঠিকই শুনেছেন যে, টাকায় টাকা আনে। কিন্তু ব্যাপার হলো বেশি টাকা কম টাকা আনে, কম টাকা বেশি টাকা আনে না। আপনার কম টাকাকে আমার বেশি টাকা গিলে ফেলেছে। সুতরাং এখন কেটে পড়ুন!

জগতে যাদের কম টাকা, তাদের টাকা কেবলই বেশি টাকার মাঝে হারিয়ে যায়! আসলে সবকিছুরই একটা বিশেষ কায়দা বা তরিকা আছে। বেশি বেশি টাকা উপার্জনেরও বিশেষ কায়দা আছে। সবাই তা পারে না। সবাইকে দিয়ে সেটা হয় না। এর জন্য লাগে ইচ্ছে, সাহস, রাজনৈতিক পরিচয়, সেই পরিচয়কে ব্যবহার করবার কায়দা, প্রশাসনসহ বড়োদের ম্যানেজ করার দক্ষতাসহ আরো নানা গুণ। বেশি বেশি টাকা বানানোর জন্য মানুষকে অনেক বেশি কৌশল প্রয়োগ করতে হয়। আমাদের দেশে বৈধ পথে টাকা কামানোর, টাকা বানানোর সুযোগ খুব বেশি নেই। যদি নীতি-নৈতিকতা,আদর্শ মেনে সপথে থেকে স উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল হওয়া যায় তাহলে হয়তো জীবন চলবে কিন্তু বড়লোক হওয়া হবে না। আর গরিবের জীবন কেউই চায় না। তাই সবাই বড়লোক হতে চায়, টাকার পেছনে ছুটে বেড়ায়।

বিল গেটস বলেছেন, যখন তোমার পকেট ভর্তি টাকা থাকবে তখন শুধু তুমি ভুলে যাবে যে ‘তুমি কে’; কিন্তু যখন তোমার পকেট ফাঁকা থাকবে তখন সমগ্র দুনিয়া ভুলে যাবে ‘তুমি কে’! জগতে টাকার চেয়ে বড়ো বাহাদুর কেউ নাই, টাকার চেয়ে প্রয়োজনীয় কিছু নাই। টাকা হলে বাঘের দুধের চা খাওয়া যায়। রাধাকে নাচানো যায়। অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। তাই তো সবাই জীবনভর কেবল টাকার পেছনে ছোটে। টাকার পিছে ছুটতে গিয়ে অনেকেই হয় বোকা, টাকার নেশায় চলতে গিয়ে কেউবা খায় ধোঁকা। তবুও সবাই চায় টাকা, টাকা শুধুই টাকা।

চালাক মানুষেরা টাকার পেছনে শিকারি কুকুরের মতো ছুটেই চলে, ছুটেই চলে। অনেকে ছুটতে ছুটতে সেই টাকার ভান্ডারের সন্ধান পেয়েও যান। সম্প্রতি আমরা ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠন যুবলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত কয়েক জন ব্যক্তির সন্ধান পেয়েছি যারা নানা উপায়ে বিপুল টাকার মালিক হয়েছেন। অনেক টাকা বিদেশেও পাচার করেছেন।

গ্রেপ্তার হওয়া যুবলীগ নেতা জি কে শামীম, মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, মোহামেডান ক্লাবের ডাইরেক্টর ইনচার্জ মো. লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, সম্রাটের সহযোগী এনামুল হক আরমান, কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের সভাপতি মোহাম্মদ শফিকুল আলম ফিরোজ, অনলাইন ক্যাসিনোর হোতা সেলিম প্রধান এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান, ঢাকা উত্তর সিটি কপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তারিকুজ্জামান রাজীব, গেন্ডারিয়ার দুই আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক এনু, রূপন ভূঁইয়াসহ অনেকের সম্পর্কে বিভিন্ন লোমহর্ষক তথ্য জানা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, ক্যাসিনো, জুয়া, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখল, খুন ইত্যাদির মাধ্যমে তারা প্রত্যেকে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। মজার ব্যাপার হলো, এদের অনেকেই আবার ক্ষমতাসীন দলে এসেছেন বিএনপি বা জাতীয় পার্টি থেকে। তারা কেউই বড়ো কোনো নেতা নন। কিন্তু অর্থে-বিত্তে-দাপটে ভিভিআইপির মর্যাদায় আসীন ছিলেন। পত্রপত্রিকায় অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে তাদের কীর্তিকাহিনির খবর ছাপা হচ্ছে। কী বিস্ময়কর তাদের উত্থানের গল্প, একেবারে রূপকথার মতো!

উদাহরণ হিসেবে সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তারিকুজ্জামান রাজীবের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। পত্রিকায় তার সম্পর্কে লিখেছে : ‘মোহাম্মদপুর-বসিলা-ঢাকা উদ্যানসহ আশপাশের এলাকার অঘোষিত সম্রাট তারিকুজ্জামান রাজীব দিনমজুর থেকে চাঁদাবাজি ও দখলের টাকায় ধনকুবের হয়ে ওঠেন। ২০১৪ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হওয়ার পর থেকেই বদলে যেতে থাকেন রাজীব। এই কয়েক বছরেই যুবলীগের থানা পর্যায়ের এই নেতা মালিক হয়েছেন কয়েক শ কোটি টাকার।

নামে-বেনামে তার অন্তত ছয়টি বাড়ি রয়েছে মোহাম্মদপুর এলাকায়। রয়েছে দেশ-বিদেশে বিভিন্ন সম্পত্তি। যেখানেই যান, তার গাড়িবহরের সামনে-পেছনে থাকে শতাধিক সহযোগীর একটি দল। নিজের সংগ্রহে রয়েছে মার্সিডিস, বিএমডব্লি­উ, ক্রাউন প্রাডো, ল্যান্ডক্রুজার ভি-৮, বিএমডব্লিউ স্পোর্টস কারসহ নামীদামি সব ব্র্যান্ডের গাড়ি। সরকারি জায়গা দখল করে ভাড়া দেওয়া, বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসা, জমি দখল, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্ম করেই আয় গড়ে তুলেছেন বিশাল সাম্রাজ্য।

জানা যায়, মোহাম্মদপুর এলাকায় যুবলীগের রাজনীতি দিয়েই শুরু হয় রাজীবের রাজনৈতিক জীবন। মাত্র এক বছরের রাজনীতি করেই বাগিয়ে নেন মোহাম্মদপুর থানা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক পদ। এরপর ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বনে যান। কেন্দ্রীয় যুবলীগের আলোচিত দপ্তর সম্পাদক আনিসুর রহমানকে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা দিয়ে এ পদ কেনেন রাজীব।

অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদপুর, বেড়িবাঁধ, বসিলা এলাকার পরিবহনে চাঁদাবাজি রাজীবের নিয়ন্ত্রণে। অটোরিকশা, লেগুনা, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও বাস থেকে প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকা চাঁদা তোলে তার লোকজন। পাঁচ বছর ধরে এলাকার কোরবানির পশুর হাটের ইজারাও নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন রাজীব।’

রাজীবসহ গ্রেপ্তার হওয়া যুবলীগ নেতাদের কীর্তিকাহিনি পড়ে ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে যায়! ছোটোবেলায় আমরা পাঠ্যপুস্তকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, হাজী মুহম্মদ মুহসীন, বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু প্রমুখ মহামানবদের জীবনী পাঠ করতাম। আর শ্রদ্ধাবনত চিত্তে তাদের কীর্তিকে স্মরণ করতাম! আর এখনকার ছেলেমেয়েরা পত্রপত্রিকায়, টেলিভিশনে প্রতিদিন এমন রাজীব, জি কে শামীম, খালেদ, আনিসুর, সম্রাটদের জীবনী পাঠ করে ও দেখে। এদের প্রত্যেকের জীবনীই কিন্তু অত্যন্ত আকর্ষণীয়, চিত্তাকর্ষক। কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাবার, জিরো থেকে সুপার হিরো হওয়ার গল্প!

কালের নিয়মে কতকিছু বদলায়। মহাপুরুষদের সংজ্ঞাও এখন বদলে গেছে! ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগররা এখন ব্যাকডেটেড। একালের সুপার হিরো হচ্ছেন রাজীব, জি কে শামীম, খালেদ, আনিসুর, সম্রাটরা! পরিশেষে দাবি জানাই, এই মহামহিমদের জীবনী পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হোক। যাতে করে কিভাবে টাকা বানাতে হয়, জিরো থেকে হিরো হতে হয়, সে পাঠ নিয়ে দেশবাসী উপকৃত হতে পারে।

 লেখক :রম্যরচয়িতা

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :




জিরো থেকে হিরো ,যেন বনে যাওয়াদের কাহিনি

আপডেট সময় : ১১:৪৩:০৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৭ অক্টোবর ২০১৯

নিজস্ব প্রতিবেদন:

বড়লোক হতে কার না ইচ্ছে হয়? কিন্তু কয়জনে তা হতে পারে? তার পরও কেউ কেউ বড়োলোক হয়। আর অন্যেরটা মেরে, কেটে,কেড়ে, যে কোনোভাবে একবার বড়োলোক হলেই কেল্লা ফতে। সে আরো আরো বড়োলোক হয়। ফুলে-ফেঁপে কেবলই প্রসারিত হতে থাকে। আমাদের দেশে বড়লোক মানে লম্বা,চওড়া, মস্ত লোক কিংবা বড় মাপের মানুষ নয়; এদেশে বড়োলোক মানে হচ্ছে টাকাওয়ালা লোক। যার যত বেশি টাকা সে তত বেশি বড়লোক।

টাকার একটা ধর্ম আছে, টাকা সব সময় তার স্বজাতি অর্থা টাকা খোঁজে। যার টাকা আছে তার কাছেই টাকা এসে ভিড় জমায় ও ধরা দেয়। টাকায় টাকা আনে বাংলা ভাষায় এ প্রবাদ বুঝি তাই সৃষ্টি হয়েছে।যদিও টাকায় টাকা আনে এ প্রবাদটি সর্বাংশে সত্য নয়। একটি গল্পের মাধ্যমে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাক। সহজ-সরল প্রকৃতির গরিব মানুষ শুনল যে, টাকায় টাকা আনে। এ কথা শুনে লোকটি উৎসাহিত হয়ে পড়ে। টাকা কিভাবে বা কোন প্রক্রিয়ায় টাকা আনে তা সে বুঝতে পারছিল না। লোকটি অনেক কষ্টে সঞ্চয় করা ১০০ টাকার একটি নোট বিছানার নিচে যত্ন করে রেখে দেয়। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা বিছানা উলটে দেখে টাকায় টাকা এনেছে কি না। মাসের পর মাস চলে যায় কিন্তু এতে কোনো লাভ হয় না।

অগত্যা লোকটি ১০০ টাকার নোটটি পকেটে নিয়ে এদিক-সেদিক হেঁটে বেড়ায় আর ভাবে, টাকা কিভাবে টাকা আনে। এক সন্ধ্যায় সে হাঁটতে হাঁটতে দেখে, এক মহাজন সারা দিনের লেনদেন শেষে দোকানে বসে অত্যন্ত মগ্ন হয়ে টাকা গুণছে। লোকটি সঙ্গে সঙ্গে মওকা পেয়ে যায়। সে সন্তর্পণে ১০০ টাকার নোটটি মহাজনের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা টাকার গদিতে ছুড়ে মারে। মহাজন নির্বিকার মনে টাকা গুণে চলে। টাকা গোনা শেষ করে মহাজন তা সিন্দুকে ঢুকিয়ে যখন দোকান বন্ধের উদ্যোগ নিতে যাবে, তখন ঐ গরিব লোকটি আড়াল থেকে সামনে আসে এবং মহাজনের কাছে তার ১০০ টাকা ফেরত চায়। মহাজন কোনো কিছু বুঝতে না পেরে লোকটির দিকে অবাক চোখে তাকায়।

লোকটি তখন মহাজনের কাছে পুরো ঘটনা বর্ণনা করে বলে, আমি শুনেছিলাম টাকায় টাকা আনে। আপনি যখন টাকা গুনছিলেন, তখন আমার ১০০ টাকার একটি নোট আপনার টাকার মধ্যে ছুড়ে মারি। কিন্তু দেখলাম আমার নোটটি আপনার কোনো নোটকে তো আনতে পারলই না, উলটো আপনি আমার নোটটিসহ সব টাকা সিন্দুকে রেখে দিলেন। এবার মহাজন দোকানের ঝাঁপ ফেলতে ফেলতে বলে, আপনি ঠিকই শুনেছেন যে, টাকায় টাকা আনে। কিন্তু ব্যাপার হলো বেশি টাকা কম টাকা আনে, কম টাকা বেশি টাকা আনে না। আপনার কম টাকাকে আমার বেশি টাকা গিলে ফেলেছে। সুতরাং এখন কেটে পড়ুন!

জগতে যাদের কম টাকা, তাদের টাকা কেবলই বেশি টাকার মাঝে হারিয়ে যায়! আসলে সবকিছুরই একটা বিশেষ কায়দা বা তরিকা আছে। বেশি বেশি টাকা উপার্জনেরও বিশেষ কায়দা আছে। সবাই তা পারে না। সবাইকে দিয়ে সেটা হয় না। এর জন্য লাগে ইচ্ছে, সাহস, রাজনৈতিক পরিচয়, সেই পরিচয়কে ব্যবহার করবার কায়দা, প্রশাসনসহ বড়োদের ম্যানেজ করার দক্ষতাসহ আরো নানা গুণ। বেশি বেশি টাকা বানানোর জন্য মানুষকে অনেক বেশি কৌশল প্রয়োগ করতে হয়। আমাদের দেশে বৈধ পথে টাকা কামানোর, টাকা বানানোর সুযোগ খুব বেশি নেই। যদি নীতি-নৈতিকতা,আদর্শ মেনে সপথে থেকে স উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল হওয়া যায় তাহলে হয়তো জীবন চলবে কিন্তু বড়লোক হওয়া হবে না। আর গরিবের জীবন কেউই চায় না। তাই সবাই বড়লোক হতে চায়, টাকার পেছনে ছুটে বেড়ায়।

বিল গেটস বলেছেন, যখন তোমার পকেট ভর্তি টাকা থাকবে তখন শুধু তুমি ভুলে যাবে যে ‘তুমি কে’; কিন্তু যখন তোমার পকেট ফাঁকা থাকবে তখন সমগ্র দুনিয়া ভুলে যাবে ‘তুমি কে’! জগতে টাকার চেয়ে বড়ো বাহাদুর কেউ নাই, টাকার চেয়ে প্রয়োজনীয় কিছু নাই। টাকা হলে বাঘের দুধের চা খাওয়া যায়। রাধাকে নাচানো যায়। অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। তাই তো সবাই জীবনভর কেবল টাকার পেছনে ছোটে। টাকার পিছে ছুটতে গিয়ে অনেকেই হয় বোকা, টাকার নেশায় চলতে গিয়ে কেউবা খায় ধোঁকা। তবুও সবাই চায় টাকা, টাকা শুধুই টাকা।

চালাক মানুষেরা টাকার পেছনে শিকারি কুকুরের মতো ছুটেই চলে, ছুটেই চলে। অনেকে ছুটতে ছুটতে সেই টাকার ভান্ডারের সন্ধান পেয়েও যান। সম্প্রতি আমরা ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠন যুবলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত কয়েক জন ব্যক্তির সন্ধান পেয়েছি যারা নানা উপায়ে বিপুল টাকার মালিক হয়েছেন। অনেক টাকা বিদেশেও পাচার করেছেন।

গ্রেপ্তার হওয়া যুবলীগ নেতা জি কে শামীম, মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, মোহামেডান ক্লাবের ডাইরেক্টর ইনচার্জ মো. লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, সম্রাটের সহযোগী এনামুল হক আরমান, কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের সভাপতি মোহাম্মদ শফিকুল আলম ফিরোজ, অনলাইন ক্যাসিনোর হোতা সেলিম প্রধান এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান, ঢাকা উত্তর সিটি কপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তারিকুজ্জামান রাজীব, গেন্ডারিয়ার দুই আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক এনু, রূপন ভূঁইয়াসহ অনেকের সম্পর্কে বিভিন্ন লোমহর্ষক তথ্য জানা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, ক্যাসিনো, জুয়া, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখল, খুন ইত্যাদির মাধ্যমে তারা প্রত্যেকে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। মজার ব্যাপার হলো, এদের অনেকেই আবার ক্ষমতাসীন দলে এসেছেন বিএনপি বা জাতীয় পার্টি থেকে। তারা কেউই বড়ো কোনো নেতা নন। কিন্তু অর্থে-বিত্তে-দাপটে ভিভিআইপির মর্যাদায় আসীন ছিলেন। পত্রপত্রিকায় অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে তাদের কীর্তিকাহিনির খবর ছাপা হচ্ছে। কী বিস্ময়কর তাদের উত্থানের গল্প, একেবারে রূপকথার মতো!

উদাহরণ হিসেবে সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তারিকুজ্জামান রাজীবের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। পত্রিকায় তার সম্পর্কে লিখেছে : ‘মোহাম্মদপুর-বসিলা-ঢাকা উদ্যানসহ আশপাশের এলাকার অঘোষিত সম্রাট তারিকুজ্জামান রাজীব দিনমজুর থেকে চাঁদাবাজি ও দখলের টাকায় ধনকুবের হয়ে ওঠেন। ২০১৪ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হওয়ার পর থেকেই বদলে যেতে থাকেন রাজীব। এই কয়েক বছরেই যুবলীগের থানা পর্যায়ের এই নেতা মালিক হয়েছেন কয়েক শ কোটি টাকার।

নামে-বেনামে তার অন্তত ছয়টি বাড়ি রয়েছে মোহাম্মদপুর এলাকায়। রয়েছে দেশ-বিদেশে বিভিন্ন সম্পত্তি। যেখানেই যান, তার গাড়িবহরের সামনে-পেছনে থাকে শতাধিক সহযোগীর একটি দল। নিজের সংগ্রহে রয়েছে মার্সিডিস, বিএমডব্লি­উ, ক্রাউন প্রাডো, ল্যান্ডক্রুজার ভি-৮, বিএমডব্লিউ স্পোর্টস কারসহ নামীদামি সব ব্র্যান্ডের গাড়ি। সরকারি জায়গা দখল করে ভাড়া দেওয়া, বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসা, জমি দখল, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্ম করেই আয় গড়ে তুলেছেন বিশাল সাম্রাজ্য।

জানা যায়, মোহাম্মদপুর এলাকায় যুবলীগের রাজনীতি দিয়েই শুরু হয় রাজীবের রাজনৈতিক জীবন। মাত্র এক বছরের রাজনীতি করেই বাগিয়ে নেন মোহাম্মদপুর থানা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক পদ। এরপর ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বনে যান। কেন্দ্রীয় যুবলীগের আলোচিত দপ্তর সম্পাদক আনিসুর রহমানকে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা দিয়ে এ পদ কেনেন রাজীব।

অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদপুর, বেড়িবাঁধ, বসিলা এলাকার পরিবহনে চাঁদাবাজি রাজীবের নিয়ন্ত্রণে। অটোরিকশা, লেগুনা, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও বাস থেকে প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকা চাঁদা তোলে তার লোকজন। পাঁচ বছর ধরে এলাকার কোরবানির পশুর হাটের ইজারাও নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন রাজীব।’

রাজীবসহ গ্রেপ্তার হওয়া যুবলীগ নেতাদের কীর্তিকাহিনি পড়ে ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে যায়! ছোটোবেলায় আমরা পাঠ্যপুস্তকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, হাজী মুহম্মদ মুহসীন, বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু প্রমুখ মহামানবদের জীবনী পাঠ করতাম। আর শ্রদ্ধাবনত চিত্তে তাদের কীর্তিকে স্মরণ করতাম! আর এখনকার ছেলেমেয়েরা পত্রপত্রিকায়, টেলিভিশনে প্রতিদিন এমন রাজীব, জি কে শামীম, খালেদ, আনিসুর, সম্রাটদের জীবনী পাঠ করে ও দেখে। এদের প্রত্যেকের জীবনীই কিন্তু অত্যন্ত আকর্ষণীয়, চিত্তাকর্ষক। কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাবার, জিরো থেকে সুপার হিরো হওয়ার গল্প!

কালের নিয়মে কতকিছু বদলায়। মহাপুরুষদের সংজ্ঞাও এখন বদলে গেছে! ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগররা এখন ব্যাকডেটেড। একালের সুপার হিরো হচ্ছেন রাজীব, জি কে শামীম, খালেদ, আনিসুর, সম্রাটরা! পরিশেষে দাবি জানাই, এই মহামহিমদের জীবনী পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হোক। যাতে করে কিভাবে টাকা বানাতে হয়, জিরো থেকে হিরো হতে হয়, সে পাঠ নিয়ে দেশবাসী উপকৃত হতে পারে।

 লেখক :রম্যরচয়িতা