ঘূর্ণিঝড় ‘বায়ু’ আসছে এ মাসেই!
- আপডেট সময় : ১০:০০:১৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৬ মে ২০১৯ ৯৬ বার পড়া হয়েছে
সকালের সংবাদ ডেস্ক;
এ মাসেই ছোবল দিতে পারে আরেকটি ঘূর্ণিঝড়। নামও ঠিকঠাক। এবার ঝড়টির নাম হবে ‘বায়ু’। নামটি ভারতেরই দেওয়া। মে মাসে বঙ্গোপসাগরে আরো দুটি নিম্নচাপ তৈরি হতে পারে বলে এরই মধ্যে আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। চলতি মাসের দীর্ঘমেয়াদি আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, দুটি নিম্নচাপের মধ্যে একটি ঘূর্ণিঝড় মাথাচাড়া দিতে পারে। আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঝড়টি কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা এখনই বলা সম্ভব নয়।
আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা বজলুর রশীদ বলেন, এ মাসে দেশের উত্তর থেকে মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত দুই থেকে তিন দিন মাঝারি ও তীব্র বজ্র ঝড় বা কালবৈশাখী হতে পারে। এ ছাড়া দেশের অন্যত্র তিন-চার দিন হালকা থেকে মাঝারি কালবৈশাখী হতে পারে। কোথাও কোথাও শিলাবৃষ্টিও হতে পারে। আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মাসে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে একটি তীব্র দাবদাহ হতে পারে।
ঘূর্ণিঝড়ের গতিপথ নির্ণয়ের রাডার অচল : ঝড়ের অবস্থান কোথায়, তা জানার জন্য রংপুরে বসানো রাডারটি এক বছর ধরে অচল হয়ে আছে। ১৯৯৯ সালে বসানো রাডারটির আয়ুষ্কালও শেষ। অন্যদিকে ঢাকার আইডিবি ভবনের ওপরে বসানো রাডারটির আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়ায় এর তেমন কার্যকারিতা নেই। ঘূর্ণিঝড়ের অবস্থান নির্ণয়ের জন্য সারা দেশে বসানো পাঁচটি রাডারের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দুটির সর্বশেষ এই হাল। একেকটি রাডার সাড়ে ৪০০ কিলোমিটার এলাকা কাভার করে। ফলে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ফণীর অবস্থান ও গতিপথ নির্ণয় করতে বেশ হিমশিম খেতে হয়েছিল আবহাওয়া অফিসের কর্তাদের। মৌলভীবাজার, খেপুপাড়া ও কক্সবাজারে বাকি তিনটি রাডার মোটামুটি সচল আছে। এই তিনটি রাডারের সাহায্যে মূলত এখন ঘূর্ণিঝড়ের অবস্থান ও গতিপথ ঠিক করে আবহাওয়া অফিস; যদিও রাডারের পাশাপাশি স্যাটেলাইটসহ বিভিন্ন তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে আবহাওয়া ও ঘূর্ণিঝড়ের সর্বশেষ তথ্য সরবরাহ করে থাকেন আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তারা।
এদিকে আবহাওয়ার নির্ভুল পূর্বাভাস পেতে সারা দেশে ২০০টি উপজেলায় স্টেশন বসানোর কাজও চলছে ধীরগতিতে। সারা দেশে এখন আবহাওয়া স্টেশন আছে মাত্র ৪৩টি। ফলে এই ৪৩টি স্টেশনের বাইরে অন্য কোথাও বৃষ্টি হলে কিংবা বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকলে তা বলতে পারছে না আবহাওয়া অফিস। এমন বাস্তবতায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে দেশের ২০০টি উপজেলায় স্বয়ংক্রিয় আবহাওয়া স্টেশন, ৬৫টি স্বয়ংক্রিয় বৃষ্টিমাপক যন্ত্র কেনার প্রকল্পটি অনুমোদন পায় ২০১৭ সালে। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রকল্পটির অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। ফলে সীমাবদ্ধ প্রযুক্তি নিয়ে আবহাওয়া অফিসকে ঘূর্ণিঝড় ও বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিতে হয়।
পরিকল্পনা কমিশন থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, ঘূর্ণিঝড়ের গতিপথ দেখার জন্য ঢাকা ও রংপুরের দুটি রাডার পরিবর্তন করে নতুন রাডার বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল এখন থেকে চার বছর আগে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাজই শুরু হয়নি। নতুন দুটি রাডার বসানো এবং ২০০টি উপজেলায় স্টেশন বসানোর প্রকল্পের পিডির দায়িত্ব পালন করছেন আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা আরিফ রশীদ। তিনি বলেন, রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর থেকে প্রকল্পটি স্থবির। কারণ রাডার আধুনিকায়নে ২২০ কোটি টাকার প্রকল্পের মধ্যে ১৮৬ কোটি টাকা অনুদান দিচ্ছে জাইকা। জঙ্গি হামলার ঘটনায় জাপানের সাত নাগরিক মারা যাওয়ার পর এ প্রকল্পে যাঁরা কাজ করতেন তাঁরা নিজ দেশে চলে যান। আগামী জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ। ফলে প্রকল্পটি সংশোধন করতে হবে। এখন অবশ্য প্রকল্পে গতি এসেছে। প্রকল্পটি সংশোধন করে ২০২৩ পর্যন্ত করা হচ্ছে।
আবহাওয়া অফিসের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন আছে বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও। তাঁরা বলেছেন, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ফণীর গতিপথ এবং আঘাত আনার সময়ের তথ্যে অসংগতি ছিল আবহাওয়া অফিসের। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশের খুলনা অঞ্চল দিয়ে ঢুকে ঠিক কোন কোন এলাকার ওপর দিয়ে যাবে, সেই তথ্যের মধ্যেও ছিল গরমিল। আবহাওয়া অফিস এখন যেভাবে ১ থেকে ১১ নম্বর সংকেত দেয়, সেটি সাধারণ মানুষের জন্য নয় উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১ থেকে ১১ নম্বর সংকেত ব্রিটিশ আমলে তৈরি করা। এই পদ্ধতি মূলত বন্দর ও জাহাজের নাবিকদের জন্য করা হয়েছে। সাধারণ মানুষদের জন্য নয়। বিদ্যমান এই পদ্ধতি সংস্কারের তাগিদও দিয়েছেন তাঁরা। আবহাওয়া অফিস বলেছিল, বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় আঘাত আনবে শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ। ওই রাতে না আসায় রাত ১১টায় বলা হয়েছিল আঘাত হানবে শনিবার সকাল ১১টা নাগাদ। কিন্তু দুটি তথ্যই ভুল ছিল। বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরায় ঘূর্ণিঝড় ফণী আঘাত হেনেছে শনিবার সকাল ৬টা নাগাদ।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, বাংলাদেশে আবহাওয়ার সঠিক গতিপথ নির্ণয়ে প্রচুর টাকা বিনিয়োগ করা উচিত। বাংলাদেশের মতো বিশ্বের কোথাও দুর্যোগে এমন সংকেত দেওয়া হয় না। ১ থেকে ১১ নম্বর সতর্কতা সংকেত সাধারণ মানুষের জন্য কোনো কাজেই আসে না। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় ফণীর কারণে খুলনা ও সাতক্ষীরা যতটা বিপদে ছিল চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এলাকা ততটা নয়। কিন্তু ওই অঞ্চলের জন্যও ৬ ও ৪ নম্বর সতর্কতা সংকেত দেওয়া ছিল। আইনুন নিশাত বলেন, ৫, ৬ ও ৭ নম্বর বিপত্সংকেত একই। এসব মাত্রার মধ্যে কোনো তারতম্য নেই। এ ছাড়া ৮, ৯ ও ১০ নম্বর মহাবিপত্সংকেতের মাত্রাও এক। আইনুন নিশাত মনে করেন, এ ধরনের বিপত্সংকেত দেওয়ার কারণে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। অসন্তোষ তৈরি হয়। মানুষ যখন পরে দেখে সংকেত দেওয়ার পরও তার এলাকায় কিছু হয়নি তখন বিপত্সংকেত সম্পর্কে তার এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। ওই সংকেত দেওয়া হলেও মানুষ বাসাবাড়ি থেকে বের হয় না।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদ বলেন, আবহাওয়া সব সময় পরিবর্তনশীল। ভারতের আবহাওয়া অফিসও দুইবার ভুল করেছে। তারা প্রথমে বলেছে ফণী চেন্নাই উপকূলে আঘাত হানবে। পরে বলেছে অন্ধ্র প্রদেশে। কিন্তু পরে দেখা গেল, ফণী আঘাত হেনেছে ওড়িশায়। তিনি বলেন, এটি বলা খুবই কঠিন যে ঘূর্ণিঝড়ের গতিপথ পরিবর্তন হবে কি না। বিপত্সংকেতের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিপত্সংকেত আমাদের মূল ভিত্তি। মাঝখানে একবার পরিবর্তনের আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু ভালো কোনো বিকল্প না পাওয়ায় আমাদের এটিই গ্রহণ করতে হবে।’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের আবহাওয়া অফিসের সক্ষমতার কিছুটা ঘাটতি আছে। তবে তাদের আন্তরিকতার ঘাটতি ছিল না। আবহাওয়ার পূর্বাভাসের পাশাপাশি আমাদের বাঁধগুলো অত্যন্ত দুর্বল। যদি বাতাসের বেশি গতিবেগ থাকত, তাহলে বাঁধ ভেঙে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যেত।’ কোন জেলায় কতটুকু উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস হবে, সেটিও আবহাওয়া অফিসকে নিপুণভাবে বলার অনুরোধ করেন তিনি।