ফণীতে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি ‘তেমন নয়’

- আপডেট সময় : ১২:১৮:৩০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৬ মে ২০১৯ ১৭৯ বার পড়া হয়েছে

সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, নওগাঁ, রাজশাহী, জামালপুর অঞ্চলে কিছু পাকা ধান ঝড়ের বাতাসে শুয়ে পড়ার তথ্য জানিয়েছেন কৃষক ও স্থানীয় কর্মকর্তারা।]
অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশে দুর্বল হয়ে ঢোকায় ফসলের ক্ষতি ‘তেমন হয়নি’ বলে জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মীর নুরুল আলম।
তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় দুর্যোগ সাড়াদান সমন্বয় কেন্দ্র (এনডিআরসিসি) ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক যে তথ্য জানিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, ফণীর কারণে ২৬ জেলায় ১ হাজার ৮৩০ একর জমির ফসল সম্পূর্ণ এবং ১ লাখ ১৯ হাজার ৮৩২ একরের ফসল আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১ কোটি ১০ লাখ একর জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়, এ থেকে ১ কোটি ৮০ লাখ টন ফসল উৎপাদন হয়ে থাকে।
এবার বোরো ধান কাটার সপ্তাহ খানেক আগে শনিবার বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে ঢুকে মধ্যাঞ্চলের উপর দিয়ে বয়ে যায় ঘূর্ণিঝড় ফণী।
ভারতের ওড়িশা উপকূলে ঘণ্টায় প্রায় ২০০ কিলোমিটার ঝোড়ো বাতাস নিয়ে আঘাত হানলেও বাংলাদেশে ঢোকার সময় এর গতি ৮০ কিলোমিটারে নেমে এসেছিল।
ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র পেতে অন্তত ২৪ ঘণ্টা সময় লাগবে বলে শনিবার জানিয়েছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান।
রোববার জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মীর নুরুল আলম বলেন, “ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির যে আশঙ্কা করা হচ্ছিল, বাস্তবে বাতাসের তীব্রতা কম থাকায় তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।”
ফণীর আভাসে আগেভাগে ধানকাটা শুরু করেন যশোরের কৃষকরা ফণীর আভাসে আগেভাগে ধানকাটা শুরু করেন যশোরের কৃষকরা
সামগ্রিক ক্ষতির চিত্র পেতে আরও কয়েকদিন সময় লাগবে জানিয়ে তিনি বলেন, “ফসলি জমিতে কতটুকু পানি ঢুকেছে, কী পরিমাণ গাছ হেলে পড়েছে, সেই তথ্যটা আমরা তাৎক্ষণিক পেতে পারি।
“এর ফলে প্রকৃত ক্ষতি কত হল, তা বুঝতে বেশ কয়েকদিন সময় লাগে। কারণ পানি নেমে যাওয়ার পর অনেক গাছই আবার সক্রিয় হয়ে দাঁড়াতে পারে। কিছু ফসল হেলে পড়ে গেলে তা আবার দাঁড়িয়ে যেতে পারে।”
ঘূর্ণিঝড়ের আগেই বিভিন্ন জেলার কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তাদের সতর্ক করা হয়েছিল জানিয়ে এই কৃষি কর্তকর্তা বলেন, “ধান যদি শতকরা ৮০ ভাগ পেকে যায়, সেটা কেটে ফেলতে; সবজি উত্তোলন করা সম্ভব হলে তা উত্তোলন করতে আমরা আগেই বলে দিয়েছিলাম।
“বীজ যেন সংরক্ষণ করা হয় সেই নির্দেশনাও আমাদের ছিল। যাতে যতটুকু সম্ভব ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যায়।”
সাতক্ষীরায় ধানক্ষেত ডুবেছে পানিতে সাতক্ষীরায় ধানক্ষেত ডুবেছে পানিতে ঝড়ে যেসব জেলায় ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে, তার মধ্যে একটি ভোলা।
ভোলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিণয় কৃষ্ণ দেবনাথ বলেন, প্রাথমিক খোঁজ-খবরে দেখা গেছে, ভোলায় মোট সাত হাজার ৮০ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে বোরো তিন হাজার হেক্টর, চিনাবাদান ৯০০ হেক্টর, সবজি ৫২৫ হেক্টর, আউশ ২৫ হেক্টর, ভুট্টা ৩৯১ হেক্টর, মরিচ ২ হাজার ৮০ হেক্টর ও পান বরজ ৮৫ হেক্টর।
চরফ্যাশন, লালমোহন ও ভোলা সদরের বেশ কিছু অংশ ঝড়ের কবলে পড়লেও ক্ষতিগ্রস্ত জমির ধান ও অন্যান্য ফসলের কিছু অংশ কৃষকরা ঘরে তুলতে পারবেন বলে আশা করছেন বিণয় দেবনাথ।
পটুয়াখালী ও ভোলা অঞ্চলে যে মুগডাল চাষ হয়, ঝড়ের আগেই এখানকার জমি থেকে কিছু শস্য তুলে নেওয়া হয়েছিল।
পটুয়াখালী জেলাতেও ফসলের তেমন ক্ষতি হয়নি বলে জানালেন এ জেলার উপ-পরিচালক হৃদয়েশ্বর দত্ত।
তিনি বলেন, আক্রান্ত জমির পরিমাণ ৬ হাজার ৩৪৯ হেক্টর। এর মধ্যে চিনাবাদাম, তিল, মরিচ, পান বরজ, ভুট্টা ও সবজি ও বোরো ধান রয়েছে।
“তিল ও মরিচের ৬০ ভাগ আগেই উত্তোলন করা হয়েছিল; মুগডাল উত্তোলন হয়েছে ৮০ ভাগ,” বলেন হৃদয়েশ্বর দত্ত।
বৃষ্টি আসায় পরে তা আবাদের জন্য তা সুবিধাজনক হবে বলেও জানালেন তিনি। “জোয়ারের পানি ও বৃষ্টি পটুয়াখালী জেলার জন্য সুবিধা হয়েছে। আউশ আবাদে সুবিধা হয়েছে।” ঘূর্ণিঝড়টি খুলনা অঞ্চল দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছিল। ওই অঞ্চলের চুয়াডাঙ্গা জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আলী হাসান তেমন ক্ষতি না হওয়ার কথা জানিয়েছেন।
আলী হাসান বলেন, “পত্রিকা ও গণমাধ্যমে যতটা বলা হচ্ছিল, বাস্তবে এই জেলায় ঝড়ের প্রভাব ততটা লক্ষ্য করা যায়নি। কেবল শুক্রবার মধ্যরাতে কিছুটা দমকা বাতাস বইছিল কিছু সময়ের জন্য।
“গাছে আম আছে, ক্ষেতে তরমুজ আছে। তেমন ক্ষতি হয়নি। বরং এমন বৃষ্টি ফসলের জন্য আরও ভালো হয়েছে। ৩৪ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান ছিল। ৬০ শতাংশ আগেই কাটা হয়ে গেছে। বাকি ৪০ শতাংশের কিছু ধান হেলে পড়েছে। তবে এর জন্য তেমন ক্ষতি হবে না।”
ঝড়ে নওগাঁয় শুয়ে পড়েছে ধান ঝড়ে নওগাঁয় শুয়ে পড়েছে ধান
ঝড়ের প্রভাব বলয়ে থাকা উত্তরাঞ্চলের নওগাঁ জেলার উপ-পরিচালকের দায়িত্বে থাকা কৃষিবিদ মাসুদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঝড়ের আগেই বোরো ধানের ২৫ শতাংশ কাটা হয়েছিল। বাকি ছিল ১ লাখ ৮৮ হাজার হেক্টর বোরো। এর মধ্যে ১৫ হাজার হেক্টর হেলে পড়ছে।”
যে পরিমাণ ধান হেলে পড়েছে রোববারের মধ্যেই কৃষকরা তা কেটে নেবেন বলে জানান তিনি।
বৃষ্টি ঝরিয়ে ফণীর বাতাস দুর্বল হওয়ায় আম বাগান বা উদ্যান ফসলের ক্ষতি হয়নি বলে জানান নওগাঁ জেলার এই কৃষিবিদ।
তিনি বলেন, “আমের কোনো ক্ষতি হয়নি। অন্যান্য ফলেরও অবস্থা ভালো। বৃষ্টি উদ্যান ফসলের জন্য ভালোই হয়েছে। মৃদু বাতাস ছিল, তাই আমের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।”
ফণী স্থল নিম্নচাপে পরিণত হয়ে মধ্যাঞ্চল দিয়ে এগিয়ে ময়মনসিংহ অঞ্চল দিয়ে ভারতের আসামের দিকে চলে যায়।
জামালপুর জেলার উপ-পরিচালক আমিনুল ইসলাম বলেন, এ জেলায় ৬৪০ হেক্টর বোরো ধান মাঠে ছিল।
“তবে তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। শাক-সবজিতে কিছু পানি জমেছিল। পরের দিন তাও নেমে গেছে।”
ময়মনসিংহ জেলায় দুই লাখ ৬২ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ করা বোরো ধানের ২০ ভাগ ঝড়ের আগেই কাটা হয়েছিল বলে জানালেন এ জেলার উপ-পরিচালক আব্দুল মাজেদ।
ঝড়ে কিছু ধান হেলে পড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, যতটুকু হেলেছে এতে তেমন সমস্যা হবে না বলেই তারা মনে করছেন।
বৃষ্টি আর ঢলে তলিয়েছে সুনামগঞ্জের হাওরের ফসল বৃষ্টি আর ঢলে তলিয়েছে সুনামগঞ্জের হাওরের ফসল
এনডিআরসিসির তথ্যানুযায়ী, নোয়াখালীর এক হাজার একর, ফেনীর ৩৩০ একর এবং কক্সবাজারের ৫০০ একর ফসল সম্পূর্ণ ক্ষতি হয়েছে।
এছাড়া নড়াইলের ২২ হাজার ৭২৪ একর, চুয়াডাঙ্গার এক হাজার ৭২৯ একর, সাতক্ষীরার ৪ হাজার ৯৪০ একর, পিরোজপুরের ১৪৮ একর, বরগুনার ১১০ একর, পটুয়াখালীর ৬ হাজার ১৮ একর, বরিশালের ২২ হাজার ৩৬০ একর, ভোলার ২৫ হাজার ৭৭২ একর, নোয়াখালীর ৩ হাজার একর, লক্ষ্মীপুরের এক হাজার ১৭০ একর, ফেনীর এক হাজার ৭৪৩ একর, কক্সবাজারের ৩০০ একর, ঝালকাঠির ৯৮৮ একর, মাদারীপুরের ৮ হাজার ৭০০ একর, যশোরের ২০ হাজার ১৩০ একর ফসল আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব শাহ কামাল বলেন, “কৃষকদের ক্ষতি পুষিতে দিতে কৃষি মন্ত্রণালয়কে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে, শিগগিরই তারা সে উদ্যোগ নেবে। আংশিক ফসল নষ্ট হয়েছে, ওই ফসল ঘরে ওঠার পর কৃষকদের সাপোর্ট দেওয়া হবে।”
ক্ষয়ক্ষতি কম হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, সব বিষয়ই আমাদের হিসেবের মধ্যে রয়েছে। সাত দিন পর বিস্তারিত ও পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পাওয়া যাবে। ওই প্রতিবেদন থেকে কত টাকার ক্ষতি হয়েছে তাও জানা যাবে।”
২১ হাজার ঘর, ২২ কিমি বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত
এই ঝড়ে ২১ হাজার ৩৩টি ঘরবাড়ি ও ২২ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে এনডিআরসিসির তথ্য। এছাড়া প্লাবিত হয়েছে ৫৯টি গ্রাম।
চাঁদপুরে ঝড়ে উড়ে যাওয়া ঘর চাঁদপুরে ঝড়ে উড়ে যাওয়া ঘর
খুলনার ৯৯০টি ঘর সম্পূর্ণ এবং ৩ হাজার ৬৫০টি আংশিক এবং বরগুনার ৭২৫টি সম্পূর্ণ ও সাড়ে ৮ হাজার ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এছাড়া সাতক্ষীরায় ৫৫২টি, পিরোজপুরে ১ হাজার ৬০০টি, পটুয়াখালীতে ২ হাজার ৯২টি, বরিশালে ১ হাজার ১৫টি, নোয়াখালীতে ২৪৫টি, লক্ষ্মীপুরে ১৮১টি, কক্সবাজারে ২৯৯টি এবং নড়াইলে ৩৫৫টি ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
খুলনায় ২টি, পিরোজপুরে ১০টি, পটুয়াখালীতে ১২টি, নোয়াখালীতে ৪টি, ফেনীতে ৮টি এবং কক্সবাজারে ২৩টি গ্রাম প্লবিত হয়েছে।
বাগেরহাটে বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় কয়েকটি গ্রাম বাগেরহাটে বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় কয়েকটি গ্রাম
বাঁধের মধ্যে খুলনায় এক কিলোমিটার, সাতক্ষীরায় ৫ কিলোমিটার, বাগেরহাটে আধা কিলোমিটার, পিরোজপুরে ৪ কিলোমিটার, পটুয়াখালীতে ১০ কিলোমিটার, বরিশালে দশমিক ২ কিলোমিটার, নোয়াখালীতে আধা কিলোমিটার, লক্ষ্মীপুরে দশমিক ২৫ কিলোমিটার, কক্সবাজারে আধা কিলোমিটার, ঝালকাঠিতে দশমিক ১২ কিলোমিটার, মাদারীপুরে দশমিক ০৫ কিলোমিটার, গোপালগঞ্জে দশমিক ০১ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ফণীর তাণ্ডবে বরগুনায় ২ জন এবং ভোলা, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরে একজন করে মোট পাঁচজন মারা গেছে বলে এনডিআরসিসি জানিয়েছে। আহত হয়েছেন ৮৩২ জন, এরমধ্যে নড়াইলের ৭২৮ জন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব শাহ কামাল বলেন, “ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। খাবার নিয়ে যাদের সমস্যা আছে তাদেরকে জিআর চাল বিতরণ অব্যাহত রাখা হবে।”