ঢাকা ০৭:২৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
Logo মঙ্গল শোভাযাত্রা – তাসফিয়া ফারহানা ঐশী Logo সাস্টিয়ান ব্রাহ্মণবাড়িয়া এর ইফতার মাহফিল সম্পন্ন Logo কুবির চট্টগ্রাম স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের ইফতার ও পূর্নমিলনী Logo অধ্যাপক জহীর উদ্দিন আহমেদের মায়ের মৃত্যুতে শাবির মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্ত চিন্তা চর্চায় ঐক্যবদ্ধ শিক্ষকবৃন্দ পরিষদের শোক প্রকাশ Logo শাবির অধ্যাপক জহীর উদ্দিনের মায়ের মৃত্যুতে উপাচার্যের শোক প্রকাশ Logo বিশ কোটিতে গণপূর্তের প্রধান হওয়ার মিশনে ‘ছাত্রদল ক্যাডার প্রকৌশলী’! Logo দূর্নীতির রাক্ষস ফায়ার সার্ভিসের এডি আনোয়ার! Logo ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতি হওয়া শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অবকাঠামোর সংস্কার শুরু Logo বুয়েটে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র রাজনীতির দাবিতে শাবিপ্রবি ছাত্রলীগের মানববন্ধন Logo কুবি উপাচার্যের বক্তব্যের প্রমাণ দিতে শিক্ষক সমিতির সাত দিনের আল্টিমেটাম




দেবী চৌধুরাণী এবং শিবচন্দ্র রায়ের কিংবদন্তী নাপাই চন্ডী মেলার ইতিহাস

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০২:২৮:০৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০১৯ ১৭৯ বার পড়া হয়েছে

মোঃ নুর ইসলাম শেখ: রংপুরের কৃষক বিদ্রোহের স্মারক স্মৃতি নাপাই চন্ডীর মেলা। বৈশাখ মাসের প্রতি বৃহস্পতিবার এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। রংপুর জেলার পীরগাছা উপজেলা সদরের এক কিলোমিটার পশ্চিমে পীরগাছা, রংপুর অভিমূখি পাকা রাস্তা ঘেসে চণ্ডীপুর গ্রামে “নাপাই চন্ডীর”-মেলা বসে । প্রতি বছর মেলায় হাজার হাজার মানুষের মেলবন্ধন ঘটে।

১৭৮৩ সালে রংপুরের ইটাকুমারী ফতেপুর চাকলার জমিদার বাড়ির কৃষক সমাবেশ থেকে দেবী চৌধুরাণী এবং শিবচন্দ্র রায় ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি ও তাদের অনুচর দুর্ধর্ষ ইজারাদার দেবীসিং-এর বিরুদ্ধে প্রজা বিদ্রোহের ডাক দেন। ফতেপুর চাকলার অগ্নিগর্ভ এ বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে গোটা রংপুর ও দিনাজপুরের গ্রামে গ্রামে । দিনাজপুরের কৃষক নুরলদ্দীন কৃষকের দেওয়া “নবাব” পদবি ধারণ করে কৃষক সমাজকে সাথে নিয়ে বিদ্রোহে ঝাঁপিয়ে পড়েন। লালমনিরহাট পাটগ্রামে ইংরেজ বাহিনীর সাথে যুদ্ধে তিনি নিহত হন।

ঠিক একই সময় ১৭৮৩ সালের বৈশাখ মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার নাপাই চন্ডী মেলা প্রান্তরে দেবী চৌধুরাণী ও শিবচন্দ্র রায়ের অনুগামী বিদ্রোহী প্রজারা ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। সম্মুখ সমরে হাড্ডা হাড্ডি লড়াই করে দেবী চৌধুরাণী, শিবচন্দ্র রায়, দেবী চৌধুরাণীর ছোট ভাই কিষ্টকিশোর চৌধুরী সহ ফকিরটারি ও চন্ডীপুর গ্রামের অধিকাংশ ফকির-সন্ন্যাসী এবং সাধারণ মানুষ এ যুদ্ধে শহীদ হন। বেঁচে যাওয়া অল্পসংখ্যক মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামী বীরযোদ্ধাদের মরদেহ আলাইকুড়ি নদী বেষ্টিত জঙ্গলে সমাহিত করে ওই জঙ্গলের নামকরণ করেণ “পবিত্রঝাড়”। অনুরূপ, ইংরেজ বাহিনীর সাথে সামনা সামনি লড়াই করে যে জায়গায় দেবী চৌধুরাণী নিহত হন সেই স্হানের নামকরণ করা হয়” নাপাই চন্ডী।”

শুধু নামকরণেই না,স্হানীয় জনগণ দেবী চৌধুরাণীর স্মৃতিকে চিরন্তন রাখতে বৈশাখ মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার “নাপাই চন্ডী মেলার”গোড়াপত্তন করেণ। যুদ্ধ জয় করে যে স্হানে ইংরেজ বাহিনী বিজয় উল্লাস করে সেই স্হানের নাম হয় “নগরজিৎপুর। “চন্ডী থেকে নাপাই চন্ডীর মেলা-এ এক কিংবদন্তির মেলবন্ধন ।চন্ডীদেবির গোপন আস্তানা থাকার কারণে পীরগাছা ইউনিয়নের এ গ্রামের নাম হয় চন্ডীপুর । চন্ডী অর্থ দেবী, পুর অর্থ নিকেতন বা আস্তানা ।

এ অঞ্চলের লোকজন পীরগাছার মন্থনার জমিদার জয়দুর্গাদেবি ওরফে দেবী চৌধুরাণীকে “চন্ডী-মা” বলে ডাকত। চন্ডী দেবীর মতো গুণ ও কাজ ছিল তাঁর । চন্ডীপুর থেকে নাপাই চন্ডীর নামকরণের পেছনে লুকিয়ে আছে রক্তাক্ত সংগ্রামের যোগসুত্র। রংপুরের আন্চলিক ভাষায় কোন কিছু করতে না পারাটাকে বলে “না পাইম মুই”-। অর্থাৎ আমি বা আমরা পারি না। পীরগাছার চন্ডীপুর গ্রামের নাম হলো “নাপাইচন্ডি”। ইংরেজ বাহিনীর সাথে চন্ডী মরণপণ যুদ্ধ করেও পারলেন না, হেরে গেলেন।

এ কারণেই “নাপাই চন্ডী । “নাপাই চন্ডী ” নামে কোন মৌজার নাম নেই। নাপাই চন্ডী মেলার উঁচু ও জঙ্গলাকীর্ণ জায়গাটাতে দেবী চৌধুরাণীর সৈন্যরা থাকতো এবং দেবী চৌধুরাণীর গোপন আস্তানা পাহাড়া দিতো।, বিরাট মাঠ,মাঠের মাঝে উঁচু গড়। এখানেই তিন গম্বুজ বিশিষ্ট একটা মসজিদ ও লাগোয়া একটা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায় । মসজিদ ও মন্দিরের সামনে রয়েছে একটা বিশাল দিঘি । ফকিরটারি ও চন্ডীপুর গ্রামের সুফি মতবাদের অনুসারি ফকির ও চৈতন্য মতবাদের অনুসারি সন্ন্যাসীরাই ছিল দেবী চৌধুরাণী ও শিবচন্দ্র রায়ের সৈন্যবাহিনী ।

এখানকার দৃশ্যমান মসজিদ ও মন্দির হিন্দু-মুসলিম প্রজাদের প্রতিকী মিলন কেন্দ্র । অসাম্প্রদায়িকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অনাদর ও অবহেলায় আমাদের পূর্ব পুরুষের রক্তাক্ত সংগ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিলুপ্তির পথে। শিবচন্দ্র রায় কলেজ প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে ইতিহাসের দায়মুক্তি মোচনের সামান্য প্রাথমিক কাজের শুরু । সেখানেও প্রচন্ড বাঁধা ।

ঐতিহাসিক প্রজাবিদ্রোহের কিংবদন্তি নেতা দেবী চৌধুরাণী, শিবচন্দ্র রায়ের বাড়ি, নাপাই চন্ডীর মেলা ;চৌধুরাণীর বজরার খাল এসব ঐতিহাসিকস্হান স্মৃতি নিদর্শণগুলিকে সংস্কৃতি ও পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তরিত করার সংগ্রামে পীরগাছা, রংপুর বাসীকে এগিয়ে আসতে হবে।

“জাগো বাহে কোনঠে সবাই কালজয়ী শ্লোগানে উদ্দীপ্ত -রংপুরের এই প্রজাবিদ্রোহের অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল, হিন্দু মুসলিম প্রজাদের মিলিত অভিযান । নুর এ বিদ্রোহের নেতা ছিলেন নুরলদ্দীন,দেবী চৌধুরাণী শিবচন্দ্র রায়,কেনা সরকার ,দর্জি নারায়ণ প্রমুখ।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :




দেবী চৌধুরাণী এবং শিবচন্দ্র রায়ের কিংবদন্তী নাপাই চন্ডী মেলার ইতিহাস

আপডেট সময় : ০২:২৮:০৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০১৯

মোঃ নুর ইসলাম শেখ: রংপুরের কৃষক বিদ্রোহের স্মারক স্মৃতি নাপাই চন্ডীর মেলা। বৈশাখ মাসের প্রতি বৃহস্পতিবার এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। রংপুর জেলার পীরগাছা উপজেলা সদরের এক কিলোমিটার পশ্চিমে পীরগাছা, রংপুর অভিমূখি পাকা রাস্তা ঘেসে চণ্ডীপুর গ্রামে “নাপাই চন্ডীর”-মেলা বসে । প্রতি বছর মেলায় হাজার হাজার মানুষের মেলবন্ধন ঘটে।

১৭৮৩ সালে রংপুরের ইটাকুমারী ফতেপুর চাকলার জমিদার বাড়ির কৃষক সমাবেশ থেকে দেবী চৌধুরাণী এবং শিবচন্দ্র রায় ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি ও তাদের অনুচর দুর্ধর্ষ ইজারাদার দেবীসিং-এর বিরুদ্ধে প্রজা বিদ্রোহের ডাক দেন। ফতেপুর চাকলার অগ্নিগর্ভ এ বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে গোটা রংপুর ও দিনাজপুরের গ্রামে গ্রামে । দিনাজপুরের কৃষক নুরলদ্দীন কৃষকের দেওয়া “নবাব” পদবি ধারণ করে কৃষক সমাজকে সাথে নিয়ে বিদ্রোহে ঝাঁপিয়ে পড়েন। লালমনিরহাট পাটগ্রামে ইংরেজ বাহিনীর সাথে যুদ্ধে তিনি নিহত হন।

ঠিক একই সময় ১৭৮৩ সালের বৈশাখ মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার নাপাই চন্ডী মেলা প্রান্তরে দেবী চৌধুরাণী ও শিবচন্দ্র রায়ের অনুগামী বিদ্রোহী প্রজারা ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। সম্মুখ সমরে হাড্ডা হাড্ডি লড়াই করে দেবী চৌধুরাণী, শিবচন্দ্র রায়, দেবী চৌধুরাণীর ছোট ভাই কিষ্টকিশোর চৌধুরী সহ ফকিরটারি ও চন্ডীপুর গ্রামের অধিকাংশ ফকির-সন্ন্যাসী এবং সাধারণ মানুষ এ যুদ্ধে শহীদ হন। বেঁচে যাওয়া অল্পসংখ্যক মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামী বীরযোদ্ধাদের মরদেহ আলাইকুড়ি নদী বেষ্টিত জঙ্গলে সমাহিত করে ওই জঙ্গলের নামকরণ করেণ “পবিত্রঝাড়”। অনুরূপ, ইংরেজ বাহিনীর সাথে সামনা সামনি লড়াই করে যে জায়গায় দেবী চৌধুরাণী নিহত হন সেই স্হানের নামকরণ করা হয়” নাপাই চন্ডী।”

শুধু নামকরণেই না,স্হানীয় জনগণ দেবী চৌধুরাণীর স্মৃতিকে চিরন্তন রাখতে বৈশাখ মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার “নাপাই চন্ডী মেলার”গোড়াপত্তন করেণ। যুদ্ধ জয় করে যে স্হানে ইংরেজ বাহিনী বিজয় উল্লাস করে সেই স্হানের নাম হয় “নগরজিৎপুর। “চন্ডী থেকে নাপাই চন্ডীর মেলা-এ এক কিংবদন্তির মেলবন্ধন ।চন্ডীদেবির গোপন আস্তানা থাকার কারণে পীরগাছা ইউনিয়নের এ গ্রামের নাম হয় চন্ডীপুর । চন্ডী অর্থ দেবী, পুর অর্থ নিকেতন বা আস্তানা ।

এ অঞ্চলের লোকজন পীরগাছার মন্থনার জমিদার জয়দুর্গাদেবি ওরফে দেবী চৌধুরাণীকে “চন্ডী-মা” বলে ডাকত। চন্ডী দেবীর মতো গুণ ও কাজ ছিল তাঁর । চন্ডীপুর থেকে নাপাই চন্ডীর নামকরণের পেছনে লুকিয়ে আছে রক্তাক্ত সংগ্রামের যোগসুত্র। রংপুরের আন্চলিক ভাষায় কোন কিছু করতে না পারাটাকে বলে “না পাইম মুই”-। অর্থাৎ আমি বা আমরা পারি না। পীরগাছার চন্ডীপুর গ্রামের নাম হলো “নাপাইচন্ডি”। ইংরেজ বাহিনীর সাথে চন্ডী মরণপণ যুদ্ধ করেও পারলেন না, হেরে গেলেন।

এ কারণেই “নাপাই চন্ডী । “নাপাই চন্ডী ” নামে কোন মৌজার নাম নেই। নাপাই চন্ডী মেলার উঁচু ও জঙ্গলাকীর্ণ জায়গাটাতে দেবী চৌধুরাণীর সৈন্যরা থাকতো এবং দেবী চৌধুরাণীর গোপন আস্তানা পাহাড়া দিতো।, বিরাট মাঠ,মাঠের মাঝে উঁচু গড়। এখানেই তিন গম্বুজ বিশিষ্ট একটা মসজিদ ও লাগোয়া একটা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায় । মসজিদ ও মন্দিরের সামনে রয়েছে একটা বিশাল দিঘি । ফকিরটারি ও চন্ডীপুর গ্রামের সুফি মতবাদের অনুসারি ফকির ও চৈতন্য মতবাদের অনুসারি সন্ন্যাসীরাই ছিল দেবী চৌধুরাণী ও শিবচন্দ্র রায়ের সৈন্যবাহিনী ।

এখানকার দৃশ্যমান মসজিদ ও মন্দির হিন্দু-মুসলিম প্রজাদের প্রতিকী মিলন কেন্দ্র । অসাম্প্রদায়িকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অনাদর ও অবহেলায় আমাদের পূর্ব পুরুষের রক্তাক্ত সংগ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিলুপ্তির পথে। শিবচন্দ্র রায় কলেজ প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে ইতিহাসের দায়মুক্তি মোচনের সামান্য প্রাথমিক কাজের শুরু । সেখানেও প্রচন্ড বাঁধা ।

ঐতিহাসিক প্রজাবিদ্রোহের কিংবদন্তি নেতা দেবী চৌধুরাণী, শিবচন্দ্র রায়ের বাড়ি, নাপাই চন্ডীর মেলা ;চৌধুরাণীর বজরার খাল এসব ঐতিহাসিকস্হান স্মৃতি নিদর্শণগুলিকে সংস্কৃতি ও পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তরিত করার সংগ্রামে পীরগাছা, রংপুর বাসীকে এগিয়ে আসতে হবে।

“জাগো বাহে কোনঠে সবাই কালজয়ী শ্লোগানে উদ্দীপ্ত -রংপুরের এই প্রজাবিদ্রোহের অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল, হিন্দু মুসলিম প্রজাদের মিলিত অভিযান । নুর এ বিদ্রোহের নেতা ছিলেন নুরলদ্দীন,দেবী চৌধুরাণী শিবচন্দ্র রায়,কেনা সরকার ,দর্জি নারায়ণ প্রমুখ।