৫ বছরের চাকরিতে কোটি টাকার ফ্ল্যাট:
দুর্নীতির ছায়ায় রাজউক ইমারত পরিদর্শক মনিরুজ্জামান!

- আপডেট সময় : ১০:০৯:৪০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২১ এপ্রিল ২০২৫ ৯০ বার পড়া হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজউকের ইমারত পরিদর্শক হিসেবে মাত্র ৫ বছরের চাকরি জীবনে কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন মনিরুজ্জামান। ঢাকার দক্ষিণ পীরেরবাগে “আমতলা টাওয়ারে” ১ হাজার ৬৩০ বর্গফুট আয়তনের বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কেনার তথ্য সামনে আসার পর শুরু হয়েছে নানা প্রশ্ন ও আলোচনা। অভিযোগ রয়েছে, তিনি দায়িত্ব পালনের নামে ভবন নির্মাণকারীদের জিম্মি করে বিপুল অঙ্কের ঘুষ আদায় করে গড়ে তুলেছেন এই বিত্ত-বৈভব।
৫ বছরের চাকরি, ২ কোটি টাকার ফ্ল্যাট; সরকারি বেতন কাঠামো অনুযায়ী, রাজউকের একজন ইমারত পরিদর্শকের মাসিক বেতন আনুমানিক ৩০-৪৫ হাজার টাকা। অথচ মনিরুজ্জামান রাজধানীর একটি অভিজাত আবাসিক এলাকায় ২ কোটি টাকা মূল্যের একটি অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন। দক্ষিণ পীরেরবাগের ২২০/৩/সি নম্বর প্লটে অবস্থিত “আমতলা টাওয়ার”-এর ই-৬ নম্বর ফ্ল্যাটটি ১,৬৩০ বর্গফুট আয়তনের। আবাসন খাতে কর্মরত বিভিন্ন এজেন্ট ও স্থানীয়দের মতে, ফ্ল্যাটটির বাজারমূল্য প্রায় ২ কোটি টাকা। প্রশ্ন উঠছে, সরকারি চাকরির বেতন দিয়ে এই ব্যয় কীভাবে সম্ভব? বিশেষ করে যেখানে চাকরির বয়সই ৫ বছর হয়নি।
অভিযোগের পাহাড়: ‘ডেভিয়েশন’ দেখিয়ে অর্থ আদায়; ইমারত পরিদর্শক মনিরুজ্জামান বর্তমানে অথরাইজড অফিসার (জোন-৬/২) এর আওতায় যোগদান করেছেন। এরআগে তিনি মিরপুর এলাকায় দায়িত্ব পালন করছেন। মিরপুর দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা হতে থাকে। অভিযোগকারীদের মতে, তিনি বিভিন্ন নির্মাণাধীন ভবনে গিয়ে নানান ‘ত্রুটি’ দেখিয়ে কাজ বন্ধ করে দেন। পরে মালিকদের কাছে সরাসরি বা মধ্যস্থতাকারী দালালের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেন। অভিযোগ উঠেছে, পরিচালক (জোন-৬) শামীমা মোমেন তাঁকে মিরপুর থেকে এখানে বদলী করে এনেছেন। ইমারত পরিদর্শক মনিরুজ্জামান ঘুষের হাট পরিচালনায় খুব পাকাপোক্ত এই বিবেচনায় তাকে পরিচালক (জোন-৬) এর অধিনস্থে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
একজন ভবন মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা সব নিয়ম মেনেই ভবন তৈরি করছিলাম। হঠাৎ করে মনিরুজ্জামান এসে বলেন, আমাদের বিল্ডিং ‘ডেভিয়েশনে’ পড়েছে। কাজ বন্ধ রাখতে বলেন। পরে তাঁর লোকজন এসে বলে, কিছু ম্যানেজ করলে সব ঠিক হয়ে যাবে। টাকা দিলে রিপোর্ট ঠিক করে দিবেন, না দিলে বারবার হয়রানি।
এ রকম অসংখ্য অভিযোগ পাওয়া গেছে। কেউ কেউ বলেন, মনিরুজ্জামান ‘কাজ বন্ধ রাখার নোটিশ’ দেন, পরে পরোক্ষভাবে যোগাযোগ করে ঘুষ চান। অর্থ না দিলে ভবনের অনুমোদন আটকে দেন বা ভাঙার হুমকি দেন।
পদ্ধতিগত দুর্নীতি: ‘নিয়মের খুঁত খুঁজে বের করে ঘুষ আদায়’; রাজউক সূত্রে জানা যায়, ইমারত পরিদর্শকদের কাজ হলো অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী ভবন নির্মাণ হচ্ছে কিনা তা যাচাই করা। কিন্তু এই দায়িত্বই এখন অনেকের কাছে যেন ঘুষ আদায়ের অস্ত্র হয়ে উঠেছে।
মনিরুজ্জামান কর্তৃক অভিযুক্ত ভবন মালিকদের অভিযোগ, তিনি ‘নিয়ম অনুসারে’ পরিদর্শনের চেয়ে ‘ঘুষ পাওয়ার সুযোগ’ তৈরি করতেই বেশি আগ্রহী। ভবনের কোন জায়গায় একটু ডেভিয়েশন হলে, সেটিকে কেন্দ্র করে পুরো কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। অতঃপর মালিক পক্ষকে প্রভাবিত করে ‘সেটেলমেন্ট’-এর জন্য টাকা দাবি করা হয়।
রাজউকের একাধিক কর্মকর্তা, নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, “এই ধরনের অপকর্ম আমাদের পুরো সংস্থার সুনাম নষ্ট করছে। মনিরুজ্জামান ছাড়া আরও কয়েকজন একইভাবে দুর্নীতি করে চলেছে। কিন্তু এসব চক্র এতটাই প্রভাবশালী যে কেউ সহজে কথা বলতে চায় না।”
দালাল চক্রের ছত্রছায়ায় অপকর্ম মনিরুজ্জামান সরাসরি ঘুষ গ্রহণ না করলেও, তাঁর হয়ে কয়েকজন দালাল ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা কাজ করে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। তারা পরিদর্শনের আগেই ভবন মালিকদের ‘বার্তা’ পৌঁছে দেয়, সবকিছু ঠিক রাখতে হলে কত টাকা লাগবে’। অর্থাৎ, নিয়ম মানার চেয়ে ‘কে কত দিতে পারবে’ সেটাই মূল বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
এ চক্রের কাজের ধরন এমন যে, তারা প্রয়োজন মতো নকশা পরিবর্তনের পরামর্শও দেয় এবং সেটার ‘মিল’ করিয়ে দিতে আরও টাকা দাবি করে। এটি একটি সুপরিকল্পিত সিন্ডিকেটের মতো কাজ করে, যার মূল নেতা হলো মনিরুজ্জামান ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা।
মনিরুজ্জামানের জীবনযাপন এবং সম্পদ নিয়ে অনুসন্ধান চালালে আরও চমকপ্রদ তথ্য বেরিয়ে আসে। তিনি দক্ষিণ পীরেরবাগে ২ কোটি টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট কিনেছেন, বাড্ডা এলাকায় একটি প্লট বুকিং দিয়েছেন, প্রাইভেটকার ব্যবহার করেন, সন্তানদের অভিজাত স্কুলে পড়ান, বিদেশ সফর করেছেন একাধিকবার।
এই সব খরচ তাঁর আয় থেকে মেলানো সম্ভব নয় বলে মনে করছেন দুর্নীতিবিরোধী সংস্থার কর্মকর্তারা।
দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-র এক কর্মকর্তা বলেন, সরকারি চাকরিতে চার বছরের মাথায় যদি কেউ কোটি টাকার সম্পদের মালিক হন, সেটি অবশ্যই উদ্বেগজনক। এটি দুর্নীতির সুস্পষ্ট লক্ষণ। রাজউকের মতো গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার কর্মকর্তারা যদি ঘুষ ও দালালির মাধ্যমে লাভবান হন, তবে নগর পরিকল্পনার ভবিষ্যৎ ভয়াবহ।
তিনি আরও বলেন, এই ঘটনায় দুদক, রাজউকের ভেতর তদন্ত বিভাগ, ও প্রশাসনের হস্তক্ষেপ জরুরি।
রাজউকের অবস্থান: ব্যবস্থা হবে কি?
রাজউকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “আমরা ইতোমধ্যেই কিছু অভিযোগ পেয়েছি মনিরুজ্জামানকে ঘিরে। অভিযোগগুলো প্রাথমিকভাবে যাচাই করা হচ্ছে। সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তবে স্থানীয়দের অনেকেই আশঙ্কা করছেন, আগেও এমন অনেক অভিযোগ উঠলেও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এ ধরনের প্রভাবশালী চক্র অনেক সময় রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকায় দ্রুত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
জনমনে আস্থাহানি ও দুর্নীতির লাগাম টানার সময় এখন নগর উন্নয়নের জন্য রাজউক একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। কিন্তু তার কর্মকর্তা যদি ঘুষ ও হয়রানিকে পেশা বানিয়ে ফেলে, তবে নগরের স্থাপনা যেমন নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে, তেমনি সাধারণ জনগণের মনে গড়ে ওঠে অসন্তোষ ও অবিশ্বাস। মনিরুজ্জামান নামক একজন কর্মকর্তা হয়তো সিস্টেমের ছোট একটা অংশ, কিন্তু তাঁর মতো আরও অনেকেই যদি একই পথে হাঁটে, তবে পুরো রাজউকই একদিন দুর্নীতির ঘাঁটি হয়ে দাঁড়াবে।
এই অবস্থায় নাগরিকদের সচেতনতা, গণমাধ্যমের নজরদারি এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের সক্রিয় হস্তক্ষেপ ছাড়া পরিবর্তনের কোনো উপায় নেই। রাজউক কর্মকর্তা মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ একক কোনো ঘটনা নয়—এটি বাংলাদেশের সরকারি দপ্তরগুলোতে বিদ্যমান দুর্নীতির একটি প্রতীকী চিত্র। এই চিত্র বদলাতে হলে সুশাসনের চর্চা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে এখনই। অন্যথায় আমতলা টাওয়ারের মতো আরও অনেক ভবনের আড়ালে লুকিয়ে যাবে হাজারো দুর্নীতির গল্প।