ঢাকা ০২:৩৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
Logo মঙ্গল শোভাযাত্রা – তাসফিয়া ফারহানা ঐশী Logo সাস্টিয়ান ব্রাহ্মণবাড়িয়া এর ইফতার মাহফিল সম্পন্ন Logo কুবির চট্টগ্রাম স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের ইফতার ও পূর্নমিলনী Logo অধ্যাপক জহীর উদ্দিন আহমেদের মায়ের মৃত্যুতে শাবির মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্ত চিন্তা চর্চায় ঐক্যবদ্ধ শিক্ষকবৃন্দ পরিষদের শোক প্রকাশ Logo শাবির অধ্যাপক জহীর উদ্দিনের মায়ের মৃত্যুতে উপাচার্যের শোক প্রকাশ Logo বিশ কোটিতে গণপূর্তের প্রধান হওয়ার মিশনে ‘ছাত্রদল ক্যাডার প্রকৌশলী’! Logo দূর্নীতির রাক্ষস ফায়ার সার্ভিসের এডি আনোয়ার! Logo ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতি হওয়া শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অবকাঠামোর সংস্কার শুরু Logo বুয়েটে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র রাজনীতির দাবিতে শাবিপ্রবি ছাত্রলীগের মানববন্ধন Logo কুবি উপাচার্যের বক্তব্যের প্রমাণ দিতে শিক্ষক সমিতির সাত দিনের আল্টিমেটাম




ভোলায় মেঘনার ত্রাস নকীব-শামীমের দশ সেক্টর কমান্ডার, লাল খাতায় লুটের টাকার হিসেব!

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ১২:৫৩:০২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ অগাস্ট ২০২১ ১৩১ বার পড়া হয়েছে

বিশেষ প্রতিনিধি:

ভোলায় নকীব-শামীমের সন্ত্রাসকর্মে দশ সেক্টর কমান্ডার, দিনের লুটের হিসেবের লাল খাতা নিয়ে রাতে আস্তানায় হাজির হন ক্যাডাররা!
নিজস্ব প্রতিবদক, লক্ষ্মীপুর ও ভোলা থেকে ফিরেঃ ভোলার মেঘনা নদীর তলদেশ হতে অবৈধভাবে ড্রেজার দ্বারা বালু লুটের মূল নায়ক জহুরুল ইসলাম নকীব ও তার ভাতিজা আনোয়ার হোসেন শামীম মোরাদারের অন্যায়-অবিচার এবং সন্ত্রাসীকাজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তাদের আশির্বাদপুষ্ট দশ চিহ্নিত ক্যাডারকে। এরা নকীব-শামীম বাহিনীর সেক্টর কমান্ডার হিসেবে পরিচিত। এদের মধ্যে প্রথমজন হচ্ছেন মোঃ খোকন। যিনি নকীব-শামীমের বালু বিক্রির টাকা তোলার দায়িত্ব পালন করছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, লুটের বালু পৌঁছানোর পর খোকন মাঝি নামের এ ব্যাক্তি স্পীড বোট নিয়ে লক্ষ্মীপুর, কমল নগর ও রামগতি এলাকায় গিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা তুলে তা ভোলায় নিয়ে আসেন। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর বালুকাটা শ্রমিকদের দিনের পারিশ্রমিক শোধ করে নির্ধারিত লাল খাতায় আয়-ব্যায়ের হিসেব তুলে রাতের আঁধারে টাকাসহ নকীব-শামীমের দরবারে হাজির হন খোকন। মেঘনা পাড়ে খোকনকে সবাই বালুদস্যুশেঠদের ম্যানেজার হিসেবেই চেনেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বালু লুটেরাদের ম্যানেজার হওয়ার সুবাদে উক্ত খোকনও না-কি পুরো মেঘনা নদী দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন। দোর্দন্ড প্রতাপশালী খোকনের অত্যাচার-অবিচারেও জেলেরা অতিষ্ট বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। বালু বাবাদের আশীর্বাদে ম্যানেজার খোকন এখন কয়েক কোটি টাকার মালিক হয়েছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। জেলা সদর ভোলার পূর্ব ইলিশা ইউনিয়নের জংশন নামক এলাকায় খোকন মাঝির আলীশান বিলাসী বাড়ী সবার নজর কাড়ে। স্থানীয়দের ভাষ্যানুযায়ী একসময়কার বাজারের পানের খিলু বিক্রেতা খোকন বালুদস্যু শামীম-নকীববের দোসর হওয়ার সৌভাগ্য অর্জনের ফলেই তার কপাল খুলে গেছে।

মোঃ সবুজ মাঝি। মেঘনা নদীতে কোষ্ট গার্ডের বিশেষ সোর্স হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিচ্ছেন। যদিও কোষ্টগার্ডের খাতায় এমন সোর্সের নাম মেলেনি। নকীব-শামীমের ইন্টারনাল ইনফরমার হিসেবে কাজ করছেন সবুজ। অভিযোগ রয়েছে যে, কোষ্টগার্ড’র সোর্স পরিচয়ে সবুজ মেঘনা নদীর নিরীহ জেলেদের ভয়ভীতি দেখিয়ে মাছ, জাল এমনকি কখনো জেলেদের একমাত্র সম্বল মাছ ধরার নৌকাটিই লুটে নিয়ে যান। লুটের আয়ের সিংহভাগই নকীব-শামীমের ফান্ডে জমা পড়ে। জংশন বাজারে যেখানে খোকন মাঝির চমকপ্রদ বাড়ী তার পার্শ্বেই একই ডিজাইনে আলীশান বিলাসময় বাড়ী নির্মান করেছেন সবুজ মাঝি। তার প্রভাব-প্রতিপত্তি আর হিংস্রতার শিকারে ভোলার মেঘনার জেলেপাড়াগুলোতে যেন এক অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে।

মোঃ ফারুক বেপারী। তিনি হচ্ছেন নকীব-শামীমের মেঘনা নদীর জেলেদের কাছ থেকে বখড়া তোলার দায়িত্বে। সূত্রমতে, ভোলার ইলিশার মেঘনা বর্ডার থেকে শুরু করে দৌলতখান উপজেলার চৌকিঘাটা এলাকা পর্যন্ত পুরো শাহবাজপুর নৌ-চ্যানেলটি নকীব-শামীমের কব্জায় থাকার কারনে কোন জেলে নিজের ইচ্ছেমতো নদীতে মাছ শিকারে যেতে পারেনা। জেলেরা মাছ শিকারে যাওয়ার পূর্বে নকীব-শামীমের রিভার ফোর্স কমান্ডার ফারুক বেপারির কাছে নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে টোকেন সংগ্রহ করলেই নদীতে যাওয়ার অনুমতি মেলে। মেঘনায় মাছ ধরার কাজে থাকা এমন প্রায় অর্ধশত জেলের সাথে আলাপ করলে তারা নিজেদের নাম গোপনের শর্তে এমন তথ্য দিয়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মেঘনা পাড়ের মৎস্য ঘাটগুলোর অধিকাংশই শামীম-নকীব বাহিনীর দখলে। মৎস্য সেক্টরের প্রধান ফারুক ব্যাপারীর নেতৃত্বে মেঘনা চষে বেড়িয়ে লুন্ঠনের দায়িত্বে আছেন কমপক্ষে দুইশতাধিক দূর্বৃত্ত। কথিত আছে এসব বাহিনীর কাছে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। এরা তাদের গডফাদারের নির্দেশে মেঘনার পরিবেশকে অশান্ত করে রেখেছে বলে বিস্তর অভিযোগের অন্ত নেই। বিভিন্ন তথ্যসূত্রমতে, ভোলার ইলিশা টু লক্ষ্মীপুর রুটে যে কয়টি অবৈধ ট্রলারযোগে যাত্রী পারাপার করা হয় তার অধিকাংশই শামীম-নকীব বাহিনীর। এগুলোর তত্ত্বাবধানের দায়িত্বও পালন করছেন ফারুক বেপারী। এসমস্ত ট্রলারগুলো দ্বারা যাত্রী পরিবহন করে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। জেলেরা জানায়,মেঘনায় যতপ্রকার নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল দ্বারা মাছ শিকার করা হয় সেই জালগুলো ভোলাতে ফারুক বেপারীর কাছ থেকেই জেলেরা কিনে নেয়। নিষিদ্ধ কারেন্ট জালের বিশাল এ চালানের ব্যাবসাটিও নকীব-শামীম নিয়ন্ত্রনে রেখে ফারুক বেপারীর মাধ্যমে রমরমা বাণিজ্য করে যাচ্ছেন তারা। এদের একচ্ছত্র আধিপত্যে অন্য কেউ বাঁধা হয়ে দাড়ালে তাদের আশির্বাদপুষ্ট জলদস্যু বাহিনীর তান্ডবলীলায় মেঘনার পলিযুক্ত ঘোলা পানি রক্তের পলিতে লাল করে দেয়া হয়। জেলেরা জানান,নকীব-শামীমের গৃহপালিত জলদস্যুদের কবল থেকে মেঘনা নদীতে শুধু মৎস্যজীবিরা নয়,খোদ মালবাহী জাহাজগুলো পর্যন্ত নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনা।

সম্প্রতি কোস্টগার্ড দক্ষিন জোনের জোয়ানদের সাড়াশি অভিযানে বিপুল পরিমান অস্ত্রসহ দুই জলদস্যুকে আটক করা হয়েছে। ভোলার তেতুলিয়া নদী থেকে বিপুল পরিমাণ দেশীয় অস্ত্র ও অস্ত্র তৈরির সরঞ্জামসহ এই ২ ডাকাতকে আটক করেছে কোস্ট গার্ড। গত (১৮ আগস্ট) বুধবার ভোর সাড়ে ৪টায় কোস্ট গার্ড দক্ষিণ জোনের বিসিজি বেইস ভোলা কর্তৃক পরিচালিত অভিযানে আটক করা হয় তাদের। বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড সদর দফতরের মিডিয়া কর্মকর্তা লে. কমান্ডার আমিরুল হক এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কুখ্যাত ডাকাত মহসিন বাহিনীর আস্তানায় বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হয়। উক্ত অভিযানে কুখ্যাত ডাকাত মহসিন বাহিনীর অন্যতম দুই সক্রিয় ডাকাত সদস্য মো. হাসান (৫৫) এবং মো. রাকিবকে (২৫) ৩টি দেশীয় পিস্তল, ৪টি রামদা, ৫টি দেশীয় দা, ১টি দেশীয় কুড়াল, ৬টি টর্চ লাইট, ১টি বাইনোকুলার, ৩টি মোবাইল, দেশীয় অস্ত্র তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জামাদি এবং ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত ২টি ইঞ্জিনচালিত কাঠের নৌকাসহ আটক করা হয়। তিনি আরও জানান, এ সময় কোস্ট গার্ডের উপস্থিতি টের পেয়ে কুখ্যাত ডাকাত মহসিনসহ দলের অন্যান্য সদস্যরা পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে ডাকাত সদস্যদের অস্ত্র এবং ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত অন্যান্য মালামালসহ দৌলতখান থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। এছাড়া বিগত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ভোলার মেঘনায় কোস্টগার্ড ও জলদস্যুদের মধ্যে গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় কোস্টগার্ড সদস্যরা জাহাঙ্গীর বাহিনীর প্রধান জাহাঙ্গীরসহ তিন দস্যুকে আটক করেছে। বিগত (৭ জুন) সোমবার বিকেলে মেঘনার মদনপুর এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে তিনটি দেশীয় পিস্তল, দুটি রাম দা এবং দুটি করাত। আটককৃতরা হলেন- বাহিনী প্রধান জাহাঙ্গীর (৪৫) আবদুর রহিম (৪৭), নুর আলম (৪০)। তাদের বাড়ি ভোলা সদরের বিভিন্ন ইউনিয়নে বলে কোস্টগার্ড জানিয়েছে। কোস্টগার্ড দক্ষিণ জোনের লেফটেন্যান্ট এসএম তাহসিন রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, দস্যুরা মেঘনায় ডাকাতির প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। খবর পেয়ে কোস্টগার্ড অভিযানে নামলে দস্যুরা কোস্টগার্ডকে লক্ষ্য করে গুলি চালালে কোস্টগার্ডও পাল্টা গুলি চালায়। কোস্টগার্ড ১২-১৫ রাউন্ড গুলি বিনিময়ের পর অস্ত্রসহ তিন দস্যুকে আটক করতে সক্ষম হন।

এ ঘটনায় ভোলা সদর মডেল থানায় ডাকাতি এবং অস্ত্র উদ্ধার ঘটনায় একটি মামলা দায়ের হয়েছে। এভাবেই এখন ভোলার মেঘনা নদীকে অশান্ত করে রেখেছে ডাকাতদলের পৃষ্ঠপোষকরা। এমন দাবী করেছেন ভুক্তভোগী মৎস্যজীবি, জেলে আর মাঝি-মাল্লারা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসমস্ত জলদস্যুদের হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্র তুলে দিয়ে তাদের চিহ্নিত গডফাদাররা দক্ষিণাঞ্চলের মেঘনা নদীতে নিজেদের আধিপত্য আর পেশী শক্তি বৃদ্ধির কথা জানান দিচ্ছেন। এখানকার জেলেদের দাবী হচ্ছে, আটককৃত জলদস্যুদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই তাদের গডফাদারদের নামসহ শেখরের সন্ধান পাওয়া যাবে।

মোঃ জিহাদ। বাড়ী লক্ষ্মীপুরের কমল নগর এলাকায়। তথ্যমতে, এব্যাক্তি নকীব-শামীমের লক্ষ্মীপুর এলাকার সন্ত্রাসকাজের আঞ্চলিক কমান্ডার হিসেবে দায়িত্বে আছেন। ওই জেলার মেঘনাবুকের বালু লুটের মূল হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয় জিহাদকে। অবৈধভাবে বালু কাটা আর দূর্বৃত্তায়নকর্মের প্রশাসনিক ম্যানেজ মেকার হিসেবে জিহাদ লক্ষ্মীপুরের কমলনগর ও রামগতিতে বেশ পরিচিত। মেঘনায় শাসন-শোষন আর আধিপত্য বিস্তারের শক্তিক্রয়ের মূল্য বাবদ শুধু লক্ষ্মীপুরের কর্তা ব্যাক্তিদের জন্য মাসিক বরাদ্ধ আছে পনের লাখ টাকা। প্রতিমাসে ওই টাকা কখনো জিহাদ আবার কখনো শামীমসহ বিভিন্ন দপ্তরের ক্ষমতাধরদের কাছে পৌঁছে দিয়ে থাকেন। জানা গেছে, উক্ত জিহাদ মেঘনার আলোচিত জলদস্যু বাহিনী জাহাঙ্গীর ও মহসিন গ্রুপের দস্যুপনাযজ্ঞের তদারকির দায়িত্বও পালন করছেন। ভোলার মেঘনা নদীর মধ্যবর্তী এলাকায় জেগে উঠা কয়েকটি জনবসতিপূর্ন চরের মধ্যে অন্যতম কাঁচিয়ার মাঝের চর, রামদেবপুর, বড়াইপুর এবং দৌলতখানের মদনপুর ও চর নেয়ামতপুর অবস্থিত। বিশালাকার এসমস্ত চরাঞ্চলগুলোতে হাজার হাজার ভূমিহীন ভূখানাঙ্গা মানুষের বসবাস। কৃষিকাজ, মাছ শিকার আর গবাদী পশু লালন-পালন করে এসমস্ত মানুষগুলোর জীবন কাটে। চাল-চুলোহীন এসব মানুষরাও না-কি নকীব-শামীমের শোষন বঞ্চনার খড়গ টানতে হয়। উত্তাল মেঘনা পাড়ি দিয়ে এসব মানুষরা চরাঞ্চলে গিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখলেও নকীব-শামীম বাহিনীর তর্জন-গর্জন আর হুঙ্কারে এরা রীতিমতো তটস্ত থাকতে হয়। সরকারী খাস জমিতে বসত করতে গেলে এদেরকে বখড়া দিতে হয়। আর কৃষক ফসল করতে চরের মাটিতে কোদালের কোপ মারার আগেই নির্ধারিত সেলামী পরিশোধ করতে হয় ক্যাডারদের।

সরেজমিন অনুসন্ধানকালে এসমস্ত চরের ভুক্তভোগীরা জানান, জমিতে চাষের জন্য পাওয়ারটিলার নামলে একর প্রতি নকীব-শামীমকে একহাজার দুইশত করে টাকা দিতে হয়। এসব চাঁদার টাকা তোলার জন্য রয়েছে আলাদা বাহিনী। আর এ বাহিনীর সেক্টর কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে জহুরুল ইসলাম নকীববের অপর ভাতিজা সোহেল মোরাদারকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিন শুধু চাষের সেলামী নামক বখড়া-ই তোলা হয় কয়েক লাখ টাকা। কেউ চাঁদা দিতে অপারগ হলে তাকে এর চড়া মাসুল গুনতে হয়। মিথ্যে মামলা কষিয়ে কৃষককে পাঠানো হয় কারাগারের অন্ধকার প্রকষ্টে। তাদের উপর চালানো হয় লোমহর্ষক নিপীড়নের স্টীম রোলার। কৃষকের গবাদী পশু লুট করে বিক্রি করে দেয়া আবার কখনো লুটের গরু-ছাগলে ভূড়িভোজের উল্লাশ করে দূর্বৃত্তরা।

মোঃ বেলায়েত উরফে ভূড়ি বেলায়েত। ভোলার চর বৈরাগী নামক একটি বিশালাকার জনপদে তাকে দখলদার নিযুক্ত করেছেন নকীব-শামীম বাহিনী। ওই চরের জমিদারীর দায়িত্ব পেয়ে ভূড়ি বেলায়েত সেখাকার মানুষদেরকে রীতিমতো অতিষ্ট করে তুলেছেন। চরের বাসিন্দারা জানান,সেখানকার ভূমিতে কৃষিকর্ম করতে গেলে বেলায়েতের লাল খাতায় নাজরানা দিয়ে নাম লিখাতে হয়। চর দখল করে সেখানকার জনপদের নীরিহদের উপর শোষন-বঞ্চনার পাথর চাপিয়ে লাখ লাখ টাকার পাহাড় বানিয়ে আয়েশী জীবন কাটাচ্ছেন নকীব-শামীম।

মোঃ আব্দুর রব ওরফে কন্ডা আব্দুর রব। কাচিয়া ইউনিয়নের মেঘনার অদূরের একটি ঘনবসতিপূর্ণ জনবহুল চরের নাম হলো-মাঝের চর। ওই চরের প্রকৃত বহু মালিক থাকলেও তারা নিজেদের ভূমিতে পা রাখতে সাহস করছে না। জেলেরা জানান, কন্ডা রবের কান্ড-কর্ম আর জুলুমবাজী যেন প্রাক বর্বরাতেকও হার মানায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাঝের চরটি একসময় ভোলার মূল ভূ-খণ্ডের একটি বিশালাকার জনপদ ছিল। যার আয়তন ছিল ভোলা জেলা সদরের বর্তমান আয়তনের দ্বি-গুনেরও বেশী। উত্তাল মেঘনার ভাঙ্গনে ওই জনপদটি একসময় একেবারেই বিলীন হয়ে যায়। নদী ভাঙনের শিকার হয়ে মাঝের চরের হাজারো পরিবার নিঃস্ব হয়ে অন্যত্রে বসতি গড়ে। কালক্রমে যুগাধিকাল পর ওই চরটি ফের জেগে উঠলে নিজেদের ভূমি ফিরে পায় জমির মালিকগন। বেশ কয়েকবছর জমিতে চাষাবাদ আর ফসল বুনে আনন্দে বিভোর থাকেন ভূমির মালিকরা। সেখানে একের পর এক গড়ে উঠে বাসয়োগ্য বসতি। শুরু হয় মানুষের মিলন মেলা। কিন্তু আ’লীগ ক্ষমতায় আসার পর জহুরুল ইসলাম নকীব যখন কাঁচিয়া ইউপি চেয়ারম্যানপদ দখলে নেন তখনই ওই চরের উপর নকীবের শ্যোনদৃষ্টি পড়ে। শুরু হয় ভূমি দখলের খেলা। চরের জনপদে তার পোষা বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে ভূমিদস্যুপনার নাটাই ঘোরাতে থাকে জহুরুল ইসলাম নকীব। তার স্বশস্ত্র ক্যাডাররা মাঝের চরের প্রকৃত মালিকদের উপর সিরিজ হামলা চালাতে থাকেন। সন্ত্রাসীদের অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করায় ভূমিদস্যুদের হামলা আর পৈচাশিকতায় মানুষের রক্তে চরের পলিমাটি লাল হওয়ার ঘটনা ভোলার মানুষ আজো ভূলেনি।

ওই চরের ভূমি মালিকগন জানান, নকীব-শামীমের ক্যাডারদের এমন বিরামহীন নৈরাজ্যকর তান্ডববাজীতে শান্তির ওই জনপদে অশান্তির আগুন ধরানো হয়। ফলে বাপ-দাদার ভূমি ছেড়ে যেতে বাধ্য হন জমির মালিকগন। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, বর্তমানে ওই চরে নকীবের পছন্দের লোকেরাই চাষবাস করছে। আর এসমস্ত চাষী এবং বসবাসকারীরাও নির্ধারিত হারে মাসোয়ারা দিয়ে সেখানে তাদের জীবন-জীবিকার চাকা ঘোরাতে হয়। চরের এসব লোকদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করে নকীব-শামীমের ভান্ডার পূর্ন করার কাজটি-ই করছেন তাদের দলের দস্যু ভূড়ি বেলায়েত। নিজ দলের দস্যুপ্রধানের দেয়া দায়িত্বে থাকার সুবাদে একসময়কার সূই-সূতো আর লেইস ফিতা বিক্রি’র ফেরিওয়ালা বেলায়েত এখন কোটিপতি বনে গিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন ভূড়ি বেলায়েত রুপে।

মোঃ ইসমাঈল। মেঘনায় নিষিদ্ধ বাগদা রেনু পোনামাছ ধরা ও সংগ্রহের দায়িত্বে আছেন তিনি। নকীব-শামীমের অবৈধ আয়ের উৎস্যগুলোর মধ্যে বাগদা রেনু ধরে বিক্রি করা হচ্ছে অন্যতম। ভোলার মেঘনা পাড়ের শ্রেনীপেশার লোকজন জানান, সরকার নদী হতে বাগদা রেনু পোনা ধরা বিষিদ্ধ করে আইন জারি করলেও নকীব-শামীমের কাছে এসব আইনের কোন পাত্তা নেই। বাগদা রেনু পোনা সংগ্রহকারীদের বিরুদ্ধে ভোলায় লোক দেখানো অভিযান পরিচালনা হলেও কার্যত নকীব-শামীম বাহিনীর বেলায় এসব আইনের প্রতিফলন কারো চোখে পড়ে না। তথ্যসূত্র বলছে, মেঘনার বিশাল জলরাশি হতে দুর্বৃত্তরা বাগদা রেনু ধরে সেগুলো খুলনা-সাতক্ষীরার পাইকারদের কাছে বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা আয় করা হয়। সূত্রমতে, মিজান পালোয়ান নামের অপর একজন হচ্ছেন রেনু পোনাগুলো কেরিংএর দায়িত্বে। বিএনপি সরকারের জমানায় উক্ত মিজান ভোলা জেলা বিএনপির এক শীর্ষ নেতার অবৈধ বাগদা রেনুপোনা সিন্ডিকেটের প্রধান হিসেবে কাজ করতেন। এ লাইনে তিনি অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হওয়ায় জার্সি বদল করে মিজান ক্ষমতাসীনদের অবৈধ কাজের পালোয়ান হিসেবে পূর্বের পেশাটি-ই চালিয়ে যাচ্ছেন।

স্থানীয়দের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ভোলার বালুদস্যুখ্যাত নকীব-শামীমের অবৈধ আয় আর সন্ত্রাস কাজের বিভিন্ন সেক্টরে লুটের দায়িত্বে দশজন কমান্ডার নিয়োগের মাধ্যমে ভোলার জনপদে এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছেন। এরা দিনভর তাদের লুন্ঠনের হিসেব-নিকেশের লাল খাতা নিয়ে রাতের আঁধারে নকীব-শামীমের গাজীপুর সড়কের আস্তানায় হাজির হয়ে টাকার বস্তা বুঝিয়ে দেন বলে তথ্য সূত্রটি নিশ্চিত করেছে।

এসব বিষয়ে অভিযুক্ত জহুরুল ইসলাম নকীব ও আনোয়ার হোসেন শামীম মোরাদার গণমাধ্যমের কাছে বরাবরই নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করছেন। আর খোকন, ফারুক বেপারী, সবুজ, বেলায়েত, সোহেল মোরাদার, মিজান পালোয়ান, আব্দুর রব, জিহাদ ও ইসমাঈলের সাথে পৃথকভাবে কথা হলে তারাও এমন কাজে তাদের সংশ্লিষ্টতা নেই বলে দাবী করেন। তারা অনেকেই বলেন, তাদের ব্যবসায়ীক প্রতিপক্ষ একটি গ্রুপ তাদেরকে বেকায়দায় ফেলে নিজেরা লাভবান হতে ষড়যন্ত্র করছেন। এদিকে দিনের পর দিন এদের শোষন-নিষ্পেষন বেড়ে-ই চলেছে। তাই ভোলার ভূক্তভোগী মানুষ এদের দমন-পীড়ন আর নির্মমতার বিরুদ্ধে তড়িৎ ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :




ভোলায় মেঘনার ত্রাস নকীব-শামীমের দশ সেক্টর কমান্ডার, লাল খাতায় লুটের টাকার হিসেব!

আপডেট সময় : ১২:৫৩:০২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ অগাস্ট ২০২১

বিশেষ প্রতিনিধি:

ভোলায় নকীব-শামীমের সন্ত্রাসকর্মে দশ সেক্টর কমান্ডার, দিনের লুটের হিসেবের লাল খাতা নিয়ে রাতে আস্তানায় হাজির হন ক্যাডাররা!
নিজস্ব প্রতিবদক, লক্ষ্মীপুর ও ভোলা থেকে ফিরেঃ ভোলার মেঘনা নদীর তলদেশ হতে অবৈধভাবে ড্রেজার দ্বারা বালু লুটের মূল নায়ক জহুরুল ইসলাম নকীব ও তার ভাতিজা আনোয়ার হোসেন শামীম মোরাদারের অন্যায়-অবিচার এবং সন্ত্রাসীকাজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তাদের আশির্বাদপুষ্ট দশ চিহ্নিত ক্যাডারকে। এরা নকীব-শামীম বাহিনীর সেক্টর কমান্ডার হিসেবে পরিচিত। এদের মধ্যে প্রথমজন হচ্ছেন মোঃ খোকন। যিনি নকীব-শামীমের বালু বিক্রির টাকা তোলার দায়িত্ব পালন করছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, লুটের বালু পৌঁছানোর পর খোকন মাঝি নামের এ ব্যাক্তি স্পীড বোট নিয়ে লক্ষ্মীপুর, কমল নগর ও রামগতি এলাকায় গিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা তুলে তা ভোলায় নিয়ে আসেন। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর বালুকাটা শ্রমিকদের দিনের পারিশ্রমিক শোধ করে নির্ধারিত লাল খাতায় আয়-ব্যায়ের হিসেব তুলে রাতের আঁধারে টাকাসহ নকীব-শামীমের দরবারে হাজির হন খোকন। মেঘনা পাড়ে খোকনকে সবাই বালুদস্যুশেঠদের ম্যানেজার হিসেবেই চেনেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বালু লুটেরাদের ম্যানেজার হওয়ার সুবাদে উক্ত খোকনও না-কি পুরো মেঘনা নদী দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন। দোর্দন্ড প্রতাপশালী খোকনের অত্যাচার-অবিচারেও জেলেরা অতিষ্ট বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। বালু বাবাদের আশীর্বাদে ম্যানেজার খোকন এখন কয়েক কোটি টাকার মালিক হয়েছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। জেলা সদর ভোলার পূর্ব ইলিশা ইউনিয়নের জংশন নামক এলাকায় খোকন মাঝির আলীশান বিলাসী বাড়ী সবার নজর কাড়ে। স্থানীয়দের ভাষ্যানুযায়ী একসময়কার বাজারের পানের খিলু বিক্রেতা খোকন বালুদস্যু শামীম-নকীববের দোসর হওয়ার সৌভাগ্য অর্জনের ফলেই তার কপাল খুলে গেছে।

মোঃ সবুজ মাঝি। মেঘনা নদীতে কোষ্ট গার্ডের বিশেষ সোর্স হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিচ্ছেন। যদিও কোষ্টগার্ডের খাতায় এমন সোর্সের নাম মেলেনি। নকীব-শামীমের ইন্টারনাল ইনফরমার হিসেবে কাজ করছেন সবুজ। অভিযোগ রয়েছে যে, কোষ্টগার্ড’র সোর্স পরিচয়ে সবুজ মেঘনা নদীর নিরীহ জেলেদের ভয়ভীতি দেখিয়ে মাছ, জাল এমনকি কখনো জেলেদের একমাত্র সম্বল মাছ ধরার নৌকাটিই লুটে নিয়ে যান। লুটের আয়ের সিংহভাগই নকীব-শামীমের ফান্ডে জমা পড়ে। জংশন বাজারে যেখানে খোকন মাঝির চমকপ্রদ বাড়ী তার পার্শ্বেই একই ডিজাইনে আলীশান বিলাসময় বাড়ী নির্মান করেছেন সবুজ মাঝি। তার প্রভাব-প্রতিপত্তি আর হিংস্রতার শিকারে ভোলার মেঘনার জেলেপাড়াগুলোতে যেন এক অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে।

মোঃ ফারুক বেপারী। তিনি হচ্ছেন নকীব-শামীমের মেঘনা নদীর জেলেদের কাছ থেকে বখড়া তোলার দায়িত্বে। সূত্রমতে, ভোলার ইলিশার মেঘনা বর্ডার থেকে শুরু করে দৌলতখান উপজেলার চৌকিঘাটা এলাকা পর্যন্ত পুরো শাহবাজপুর নৌ-চ্যানেলটি নকীব-শামীমের কব্জায় থাকার কারনে কোন জেলে নিজের ইচ্ছেমতো নদীতে মাছ শিকারে যেতে পারেনা। জেলেরা মাছ শিকারে যাওয়ার পূর্বে নকীব-শামীমের রিভার ফোর্স কমান্ডার ফারুক বেপারির কাছে নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে টোকেন সংগ্রহ করলেই নদীতে যাওয়ার অনুমতি মেলে। মেঘনায় মাছ ধরার কাজে থাকা এমন প্রায় অর্ধশত জেলের সাথে আলাপ করলে তারা নিজেদের নাম গোপনের শর্তে এমন তথ্য দিয়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মেঘনা পাড়ের মৎস্য ঘাটগুলোর অধিকাংশই শামীম-নকীব বাহিনীর দখলে। মৎস্য সেক্টরের প্রধান ফারুক ব্যাপারীর নেতৃত্বে মেঘনা চষে বেড়িয়ে লুন্ঠনের দায়িত্বে আছেন কমপক্ষে দুইশতাধিক দূর্বৃত্ত। কথিত আছে এসব বাহিনীর কাছে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। এরা তাদের গডফাদারের নির্দেশে মেঘনার পরিবেশকে অশান্ত করে রেখেছে বলে বিস্তর অভিযোগের অন্ত নেই। বিভিন্ন তথ্যসূত্রমতে, ভোলার ইলিশা টু লক্ষ্মীপুর রুটে যে কয়টি অবৈধ ট্রলারযোগে যাত্রী পারাপার করা হয় তার অধিকাংশই শামীম-নকীব বাহিনীর। এগুলোর তত্ত্বাবধানের দায়িত্বও পালন করছেন ফারুক বেপারী। এসমস্ত ট্রলারগুলো দ্বারা যাত্রী পরিবহন করে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। জেলেরা জানায়,মেঘনায় যতপ্রকার নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল দ্বারা মাছ শিকার করা হয় সেই জালগুলো ভোলাতে ফারুক বেপারীর কাছ থেকেই জেলেরা কিনে নেয়। নিষিদ্ধ কারেন্ট জালের বিশাল এ চালানের ব্যাবসাটিও নকীব-শামীম নিয়ন্ত্রনে রেখে ফারুক বেপারীর মাধ্যমে রমরমা বাণিজ্য করে যাচ্ছেন তারা। এদের একচ্ছত্র আধিপত্যে অন্য কেউ বাঁধা হয়ে দাড়ালে তাদের আশির্বাদপুষ্ট জলদস্যু বাহিনীর তান্ডবলীলায় মেঘনার পলিযুক্ত ঘোলা পানি রক্তের পলিতে লাল করে দেয়া হয়। জেলেরা জানান,নকীব-শামীমের গৃহপালিত জলদস্যুদের কবল থেকে মেঘনা নদীতে শুধু মৎস্যজীবিরা নয়,খোদ মালবাহী জাহাজগুলো পর্যন্ত নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনা।

সম্প্রতি কোস্টগার্ড দক্ষিন জোনের জোয়ানদের সাড়াশি অভিযানে বিপুল পরিমান অস্ত্রসহ দুই জলদস্যুকে আটক করা হয়েছে। ভোলার তেতুলিয়া নদী থেকে বিপুল পরিমাণ দেশীয় অস্ত্র ও অস্ত্র তৈরির সরঞ্জামসহ এই ২ ডাকাতকে আটক করেছে কোস্ট গার্ড। গত (১৮ আগস্ট) বুধবার ভোর সাড়ে ৪টায় কোস্ট গার্ড দক্ষিণ জোনের বিসিজি বেইস ভোলা কর্তৃক পরিচালিত অভিযানে আটক করা হয় তাদের। বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড সদর দফতরের মিডিয়া কর্মকর্তা লে. কমান্ডার আমিরুল হক এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কুখ্যাত ডাকাত মহসিন বাহিনীর আস্তানায় বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হয়। উক্ত অভিযানে কুখ্যাত ডাকাত মহসিন বাহিনীর অন্যতম দুই সক্রিয় ডাকাত সদস্য মো. হাসান (৫৫) এবং মো. রাকিবকে (২৫) ৩টি দেশীয় পিস্তল, ৪টি রামদা, ৫টি দেশীয় দা, ১টি দেশীয় কুড়াল, ৬টি টর্চ লাইট, ১টি বাইনোকুলার, ৩টি মোবাইল, দেশীয় অস্ত্র তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জামাদি এবং ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত ২টি ইঞ্জিনচালিত কাঠের নৌকাসহ আটক করা হয়। তিনি আরও জানান, এ সময় কোস্ট গার্ডের উপস্থিতি টের পেয়ে কুখ্যাত ডাকাত মহসিনসহ দলের অন্যান্য সদস্যরা পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে ডাকাত সদস্যদের অস্ত্র এবং ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত অন্যান্য মালামালসহ দৌলতখান থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। এছাড়া বিগত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ভোলার মেঘনায় কোস্টগার্ড ও জলদস্যুদের মধ্যে গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় কোস্টগার্ড সদস্যরা জাহাঙ্গীর বাহিনীর প্রধান জাহাঙ্গীরসহ তিন দস্যুকে আটক করেছে। বিগত (৭ জুন) সোমবার বিকেলে মেঘনার মদনপুর এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে তিনটি দেশীয় পিস্তল, দুটি রাম দা এবং দুটি করাত। আটককৃতরা হলেন- বাহিনী প্রধান জাহাঙ্গীর (৪৫) আবদুর রহিম (৪৭), নুর আলম (৪০)। তাদের বাড়ি ভোলা সদরের বিভিন্ন ইউনিয়নে বলে কোস্টগার্ড জানিয়েছে। কোস্টগার্ড দক্ষিণ জোনের লেফটেন্যান্ট এসএম তাহসিন রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, দস্যুরা মেঘনায় ডাকাতির প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। খবর পেয়ে কোস্টগার্ড অভিযানে নামলে দস্যুরা কোস্টগার্ডকে লক্ষ্য করে গুলি চালালে কোস্টগার্ডও পাল্টা গুলি চালায়। কোস্টগার্ড ১২-১৫ রাউন্ড গুলি বিনিময়ের পর অস্ত্রসহ তিন দস্যুকে আটক করতে সক্ষম হন।

এ ঘটনায় ভোলা সদর মডেল থানায় ডাকাতি এবং অস্ত্র উদ্ধার ঘটনায় একটি মামলা দায়ের হয়েছে। এভাবেই এখন ভোলার মেঘনা নদীকে অশান্ত করে রেখেছে ডাকাতদলের পৃষ্ঠপোষকরা। এমন দাবী করেছেন ভুক্তভোগী মৎস্যজীবি, জেলে আর মাঝি-মাল্লারা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসমস্ত জলদস্যুদের হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্র তুলে দিয়ে তাদের চিহ্নিত গডফাদাররা দক্ষিণাঞ্চলের মেঘনা নদীতে নিজেদের আধিপত্য আর পেশী শক্তি বৃদ্ধির কথা জানান দিচ্ছেন। এখানকার জেলেদের দাবী হচ্ছে, আটককৃত জলদস্যুদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই তাদের গডফাদারদের নামসহ শেখরের সন্ধান পাওয়া যাবে।

মোঃ জিহাদ। বাড়ী লক্ষ্মীপুরের কমল নগর এলাকায়। তথ্যমতে, এব্যাক্তি নকীব-শামীমের লক্ষ্মীপুর এলাকার সন্ত্রাসকাজের আঞ্চলিক কমান্ডার হিসেবে দায়িত্বে আছেন। ওই জেলার মেঘনাবুকের বালু লুটের মূল হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয় জিহাদকে। অবৈধভাবে বালু কাটা আর দূর্বৃত্তায়নকর্মের প্রশাসনিক ম্যানেজ মেকার হিসেবে জিহাদ লক্ষ্মীপুরের কমলনগর ও রামগতিতে বেশ পরিচিত। মেঘনায় শাসন-শোষন আর আধিপত্য বিস্তারের শক্তিক্রয়ের মূল্য বাবদ শুধু লক্ষ্মীপুরের কর্তা ব্যাক্তিদের জন্য মাসিক বরাদ্ধ আছে পনের লাখ টাকা। প্রতিমাসে ওই টাকা কখনো জিহাদ আবার কখনো শামীমসহ বিভিন্ন দপ্তরের ক্ষমতাধরদের কাছে পৌঁছে দিয়ে থাকেন। জানা গেছে, উক্ত জিহাদ মেঘনার আলোচিত জলদস্যু বাহিনী জাহাঙ্গীর ও মহসিন গ্রুপের দস্যুপনাযজ্ঞের তদারকির দায়িত্বও পালন করছেন। ভোলার মেঘনা নদীর মধ্যবর্তী এলাকায় জেগে উঠা কয়েকটি জনবসতিপূর্ন চরের মধ্যে অন্যতম কাঁচিয়ার মাঝের চর, রামদেবপুর, বড়াইপুর এবং দৌলতখানের মদনপুর ও চর নেয়ামতপুর অবস্থিত। বিশালাকার এসমস্ত চরাঞ্চলগুলোতে হাজার হাজার ভূমিহীন ভূখানাঙ্গা মানুষের বসবাস। কৃষিকাজ, মাছ শিকার আর গবাদী পশু লালন-পালন করে এসমস্ত মানুষগুলোর জীবন কাটে। চাল-চুলোহীন এসব মানুষরাও না-কি নকীব-শামীমের শোষন বঞ্চনার খড়গ টানতে হয়। উত্তাল মেঘনা পাড়ি দিয়ে এসব মানুষরা চরাঞ্চলে গিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখলেও নকীব-শামীম বাহিনীর তর্জন-গর্জন আর হুঙ্কারে এরা রীতিমতো তটস্ত থাকতে হয়। সরকারী খাস জমিতে বসত করতে গেলে এদেরকে বখড়া দিতে হয়। আর কৃষক ফসল করতে চরের মাটিতে কোদালের কোপ মারার আগেই নির্ধারিত সেলামী পরিশোধ করতে হয় ক্যাডারদের।

সরেজমিন অনুসন্ধানকালে এসমস্ত চরের ভুক্তভোগীরা জানান, জমিতে চাষের জন্য পাওয়ারটিলার নামলে একর প্রতি নকীব-শামীমকে একহাজার দুইশত করে টাকা দিতে হয়। এসব চাঁদার টাকা তোলার জন্য রয়েছে আলাদা বাহিনী। আর এ বাহিনীর সেক্টর কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে জহুরুল ইসলাম নকীববের অপর ভাতিজা সোহেল মোরাদারকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিন শুধু চাষের সেলামী নামক বখড়া-ই তোলা হয় কয়েক লাখ টাকা। কেউ চাঁদা দিতে অপারগ হলে তাকে এর চড়া মাসুল গুনতে হয়। মিথ্যে মামলা কষিয়ে কৃষককে পাঠানো হয় কারাগারের অন্ধকার প্রকষ্টে। তাদের উপর চালানো হয় লোমহর্ষক নিপীড়নের স্টীম রোলার। কৃষকের গবাদী পশু লুট করে বিক্রি করে দেয়া আবার কখনো লুটের গরু-ছাগলে ভূড়িভোজের উল্লাশ করে দূর্বৃত্তরা।

মোঃ বেলায়েত উরফে ভূড়ি বেলায়েত। ভোলার চর বৈরাগী নামক একটি বিশালাকার জনপদে তাকে দখলদার নিযুক্ত করেছেন নকীব-শামীম বাহিনী। ওই চরের জমিদারীর দায়িত্ব পেয়ে ভূড়ি বেলায়েত সেখাকার মানুষদেরকে রীতিমতো অতিষ্ট করে তুলেছেন। চরের বাসিন্দারা জানান,সেখানকার ভূমিতে কৃষিকর্ম করতে গেলে বেলায়েতের লাল খাতায় নাজরানা দিয়ে নাম লিখাতে হয়। চর দখল করে সেখানকার জনপদের নীরিহদের উপর শোষন-বঞ্চনার পাথর চাপিয়ে লাখ লাখ টাকার পাহাড় বানিয়ে আয়েশী জীবন কাটাচ্ছেন নকীব-শামীম।

মোঃ আব্দুর রব ওরফে কন্ডা আব্দুর রব। কাচিয়া ইউনিয়নের মেঘনার অদূরের একটি ঘনবসতিপূর্ণ জনবহুল চরের নাম হলো-মাঝের চর। ওই চরের প্রকৃত বহু মালিক থাকলেও তারা নিজেদের ভূমিতে পা রাখতে সাহস করছে না। জেলেরা জানান, কন্ডা রবের কান্ড-কর্ম আর জুলুমবাজী যেন প্রাক বর্বরাতেকও হার মানায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাঝের চরটি একসময় ভোলার মূল ভূ-খণ্ডের একটি বিশালাকার জনপদ ছিল। যার আয়তন ছিল ভোলা জেলা সদরের বর্তমান আয়তনের দ্বি-গুনেরও বেশী। উত্তাল মেঘনার ভাঙ্গনে ওই জনপদটি একসময় একেবারেই বিলীন হয়ে যায়। নদী ভাঙনের শিকার হয়ে মাঝের চরের হাজারো পরিবার নিঃস্ব হয়ে অন্যত্রে বসতি গড়ে। কালক্রমে যুগাধিকাল পর ওই চরটি ফের জেগে উঠলে নিজেদের ভূমি ফিরে পায় জমির মালিকগন। বেশ কয়েকবছর জমিতে চাষাবাদ আর ফসল বুনে আনন্দে বিভোর থাকেন ভূমির মালিকরা। সেখানে একের পর এক গড়ে উঠে বাসয়োগ্য বসতি। শুরু হয় মানুষের মিলন মেলা। কিন্তু আ’লীগ ক্ষমতায় আসার পর জহুরুল ইসলাম নকীব যখন কাঁচিয়া ইউপি চেয়ারম্যানপদ দখলে নেন তখনই ওই চরের উপর নকীবের শ্যোনদৃষ্টি পড়ে। শুরু হয় ভূমি দখলের খেলা। চরের জনপদে তার পোষা বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে ভূমিদস্যুপনার নাটাই ঘোরাতে থাকে জহুরুল ইসলাম নকীব। তার স্বশস্ত্র ক্যাডাররা মাঝের চরের প্রকৃত মালিকদের উপর সিরিজ হামলা চালাতে থাকেন। সন্ত্রাসীদের অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করায় ভূমিদস্যুদের হামলা আর পৈচাশিকতায় মানুষের রক্তে চরের পলিমাটি লাল হওয়ার ঘটনা ভোলার মানুষ আজো ভূলেনি।

ওই চরের ভূমি মালিকগন জানান, নকীব-শামীমের ক্যাডারদের এমন বিরামহীন নৈরাজ্যকর তান্ডববাজীতে শান্তির ওই জনপদে অশান্তির আগুন ধরানো হয়। ফলে বাপ-দাদার ভূমি ছেড়ে যেতে বাধ্য হন জমির মালিকগন। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, বর্তমানে ওই চরে নকীবের পছন্দের লোকেরাই চাষবাস করছে। আর এসমস্ত চাষী এবং বসবাসকারীরাও নির্ধারিত হারে মাসোয়ারা দিয়ে সেখানে তাদের জীবন-জীবিকার চাকা ঘোরাতে হয়। চরের এসব লোকদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করে নকীব-শামীমের ভান্ডার পূর্ন করার কাজটি-ই করছেন তাদের দলের দস্যু ভূড়ি বেলায়েত। নিজ দলের দস্যুপ্রধানের দেয়া দায়িত্বে থাকার সুবাদে একসময়কার সূই-সূতো আর লেইস ফিতা বিক্রি’র ফেরিওয়ালা বেলায়েত এখন কোটিপতি বনে গিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন ভূড়ি বেলায়েত রুপে।

মোঃ ইসমাঈল। মেঘনায় নিষিদ্ধ বাগদা রেনু পোনামাছ ধরা ও সংগ্রহের দায়িত্বে আছেন তিনি। নকীব-শামীমের অবৈধ আয়ের উৎস্যগুলোর মধ্যে বাগদা রেনু ধরে বিক্রি করা হচ্ছে অন্যতম। ভোলার মেঘনা পাড়ের শ্রেনীপেশার লোকজন জানান, সরকার নদী হতে বাগদা রেনু পোনা ধরা বিষিদ্ধ করে আইন জারি করলেও নকীব-শামীমের কাছে এসব আইনের কোন পাত্তা নেই। বাগদা রেনু পোনা সংগ্রহকারীদের বিরুদ্ধে ভোলায় লোক দেখানো অভিযান পরিচালনা হলেও কার্যত নকীব-শামীম বাহিনীর বেলায় এসব আইনের প্রতিফলন কারো চোখে পড়ে না। তথ্যসূত্র বলছে, মেঘনার বিশাল জলরাশি হতে দুর্বৃত্তরা বাগদা রেনু ধরে সেগুলো খুলনা-সাতক্ষীরার পাইকারদের কাছে বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা আয় করা হয়। সূত্রমতে, মিজান পালোয়ান নামের অপর একজন হচ্ছেন রেনু পোনাগুলো কেরিংএর দায়িত্বে। বিএনপি সরকারের জমানায় উক্ত মিজান ভোলা জেলা বিএনপির এক শীর্ষ নেতার অবৈধ বাগদা রেনুপোনা সিন্ডিকেটের প্রধান হিসেবে কাজ করতেন। এ লাইনে তিনি অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হওয়ায় জার্সি বদল করে মিজান ক্ষমতাসীনদের অবৈধ কাজের পালোয়ান হিসেবে পূর্বের পেশাটি-ই চালিয়ে যাচ্ছেন।

স্থানীয়দের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ভোলার বালুদস্যুখ্যাত নকীব-শামীমের অবৈধ আয় আর সন্ত্রাস কাজের বিভিন্ন সেক্টরে লুটের দায়িত্বে দশজন কমান্ডার নিয়োগের মাধ্যমে ভোলার জনপদে এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছেন। এরা দিনভর তাদের লুন্ঠনের হিসেব-নিকেশের লাল খাতা নিয়ে রাতের আঁধারে নকীব-শামীমের গাজীপুর সড়কের আস্তানায় হাজির হয়ে টাকার বস্তা বুঝিয়ে দেন বলে তথ্য সূত্রটি নিশ্চিত করেছে।

এসব বিষয়ে অভিযুক্ত জহুরুল ইসলাম নকীব ও আনোয়ার হোসেন শামীম মোরাদার গণমাধ্যমের কাছে বরাবরই নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করছেন। আর খোকন, ফারুক বেপারী, সবুজ, বেলায়েত, সোহেল মোরাদার, মিজান পালোয়ান, আব্দুর রব, জিহাদ ও ইসমাঈলের সাথে পৃথকভাবে কথা হলে তারাও এমন কাজে তাদের সংশ্লিষ্টতা নেই বলে দাবী করেন। তারা অনেকেই বলেন, তাদের ব্যবসায়ীক প্রতিপক্ষ একটি গ্রুপ তাদেরকে বেকায়দায় ফেলে নিজেরা লাভবান হতে ষড়যন্ত্র করছেন। এদিকে দিনের পর দিন এদের শোষন-নিষ্পেষন বেড়ে-ই চলেছে। তাই ভোলার ভূক্তভোগী মানুষ এদের দমন-পীড়ন আর নির্মমতার বিরুদ্ধে তড়িৎ ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।