ইভ্যালির আশ্বাস ফাঁদে গ্রাহকরা
- আপডেট সময় : ১২:৩৭:৫৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ অগাস্ট ২০২১ ১৪১ বার পড়া হয়েছে
অনলাইন ডেস্ক: গত জুলাই মাসে লকডাউনের সময় টি-১০ অফারে অনলাইনে পণ্য বিক্রির প্রতিষ্ঠান ইভ্যালিতে একটি পালসার বাইক অর্ডার করেছিলেন নজরুল ইসলাম। ১০ দিনের মধ্যে সেটি সরবরাহ করার কথা ছিল; কিন্তু এখন পর্যন্ত তিনি বাইক সরবরাহ পাননি। অথচ জুন মাসে ইভ্যালির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কেনা পণ্য হাতে পাওয়ার পর মূল্য পরিশোধের নীতিমালা করার সিদ্ধান্ত জানায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
প্রায় ৪০ দিন পর গতকাল রবিবার ইভ্যালির ধানমন্ডির কার্যালয়ে এসে বুথে যোগাযোগ করলে নজরুলকে কাস্টমার কেয়ারে পাঠানো হয়।
তিনি বলেন, ‘এখনো আমার পালসার বাইকটি ডেলিভারি করেনি। কাস্টমার কেয়ার থেকে বলল, শিগগিরই বাইকটি ডেলিভারি করা হবে। ’
প্রতারণার অভিযোগ ওঠায় কয়েক মাস ধরে আলোচনায় থাকা ইভ্যালির ধানমন্ডির কার্যালয়টি গতকালই খুলেছে। এর আগে করোনাভাইরাস সংক্রমণ মোকাবিলায় সরকারঘোষিত বিধি-নিষেধের কথা বলে কার্যালয়টি বন্ধ রাখা হয়। ইভ্যালির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ ওঠার পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত ৪ জুলাই একটি নীতিমালা জারি করে। এতে বলা হয়, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজধানীতে পাঁচ দিনের মধ্যে এবং অন্য শহরে ১০ দিনের মধ্যে গ্রাহককে পণ্য সরবরাহ করতে হবে। পণ্য হাতে পাওয়ার পর মূল্য পরিশোধ করবে। এ ছাড়া ইভ্যালির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারের চার প্রতিষ্ঠানকে চিঠি পাঠায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
প্রতিষ্ঠান চারটি হলো দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। ইভ্যালির ওপর করা বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শন প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে ৪ জুলাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এসব চিঠি পাঠায়।
কিন্তু ইভ্যালি এখনো প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে পণ্যের অর্ডার নিচ্ছে এবং সময়মতো পণ্য সরবরাহ করছে না। গতকাল প্রতিষ্ঠানটির ধানমন্ডির কার্যালয় খোলার পর সকাল থেকে গ্রাহকরা এসে সেখানে ভিড় জমান। তাদের জন্য বেশ কয়েকটি বুথ বসানো হয়েছিল।
একাধিক পাওনা গ্রাহক জানান, আগের মতো পণ্য খুব দ্রুত পেয়ে যাবেন বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তবে গ্রাহকরা অভিযোগ করছেন, কোম্পানিটির দ্বারে দ্বারে ঘুরেও তারা পণ্য পাচ্ছেন না। গ্রাহকদের পণ্য দেওয়ায় মৌখিক আশ্বাস দিলেও বারবার সময় বাড়াচ্ছে ইভ্যালি। ইভ্যালির একাধিক গ্রাহক অভিযোগ করেন যে ১০, সাত ও তিন দিন কিংবা ৪৫ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহের আশ্বাস দিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে এই প্রতিষ্ঠান।
এ প্রতিবেদক গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কার্যালয়টির সামনে অবস্থান করেন। এ সময় প্রতিবেদকের সঙ্গে বেশ কয়েকজন গ্রাহকের কথা হয়। ইভ্যালিতে অর্ডার করেও পণ্য না পাওয়া গ্রাহকরা জানান, গতকাল আবারও কোম্পানিটির কাস্টমার কেয়ার থেকে তাদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে যে, কয়েক দিনের মধ্যেই তারা পণ্য পেয়ে যাবেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন গৃহিণী ডিপ ফ্রিজ, গিফট কার্ডসহ প্রায় ৮০ হাজার টাকার পণ্য অর্ডার করেছিলেন। প্রায় দেড় মাস আগে তিনি এসব পণ্যের অর্ডার দিয়েছিলেন। এর মধ্যে একটি অফার ছিল সাত দিনে পণ্য সরবরাহ করার। কিন্তু সেটিও তিনি পাননি। গতকাল ধানমন্ডির কার্যালয়ে এসে তিনি ধরনা দেন। তিনি বলেন, কাস্টমার কেয়ার থেকে তাকে আরও কয়েক দিন অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে। সামনে হয়তো পণ্য পেয়ে যাবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
কাস্টমার কেয়ার থেকে বের হয়ে নাম প্রকাশ না করে একজন গ্রাহক জানান, ফেব্রুয়ারি মাসে একটি ফ্রিজ অর্ডার করেছিলেন। ৪৫ দিনের সময় পার হয়ে গেছে। এখনো ফ্রিজটি পাননি। তাকে কাস্টমার কেয়ার থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে যে অক্টোবরের মধ্যে পণ্যটি দেওয়া হবে।
আরেক গ্রাহক জানান, ১০ মার্চ পাঁচ লাখ টাকার একটি বাইক অর্ডার করেছিলেন। গতকাল তাকে কাস্টমার কেয়ার থেকে জানানো হয়, পণ্য পেতে সময় লাগবে আরও তিন মাস। এ সময় উপস্থিত সাংবাদিকরা ইভ্যালির কর্মীদের কাছে কম্পানিটির পক্ষ থেকে বক্তব্য চান। তবে প্রতিষ্ঠানটির জনসংযোগ কর্মকর্তা পরিচয় দেওয়া মেজবাহ উদ্দিন জানান, তিনি কম্পানির চেয়ারম্যানের অনুমতি ছাড়া কোনো ধরনের বক্তব্য দিতে পারবেন না।
পণ্য অর্ডার দিয়ে পাননি এমন কতজন গ্রাহক গতকাল বুথে এসেছেন জানতে চাইলে ইভ্যালির একাধিক কর্মী মেজবাহ উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। কিন্তু মেজবাহ উদ্দিন এ ব্যাপারে কোনো তথ্য দেননি।
এ প্রতিবেদক ইভ্যালির বেশ কয়েকজন গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এর মধ্যে রাজধানী রামপুরার বাসিন্দা আবির হোসেন (২৭) জানান, গত ২০ মার্চ ইভ্যালির অনলাইন অ্যাপ থেকে সাইক্লোন অফারে ‘পাওয়ার ব্যাংক’ অর্ডার দেন। ৪৫ দিনের মধ্যে পণ্য দেওয়ার কথা; কিন্তু পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো পণ্য পাননি তিনি। এ ছাড়া ৩১ মার্চ কিছু শ্যাম্পু অর্ডার করলে গত ৮ জুলাই সরবরাহ দেওয়া হয়েছে বলে অ্যাপে দেখানো হয়। কিন্তু তিনি পণ্য হাতে পাননি। এমনকি এসএমএস, কল কোনোটিই দেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এসব সমস্যার বিষয়ে আবির একাধিকবার গ্রাহক সেবার নম্বরে কল দিলেও প্রতিবারই তারা আন্তরিক দুঃখিত বলে দ্রুতই পণ্য পাওয়ার আশ্বাস দেয়। কিন্তু পণ্য আর দেয়নি।
মো. সাগর নামের এক তরুণ উদ্যোক্তা বলেন, ‘বিভিন্ন সময় ইভ্যালি থেকে পণ্য নিয়েছি। প্রথম দিকে লেনদেন ভালো থাকলেও কয়েক মাস ধরে খুব টেনশনে আছি। আট লাখ ৭০ হাজার টাকা ফেরতের চেক দেওয়া হয়েছে ফেব্রুয়ারি মাসে। ২৫ জুলাই চেক দিয়ে টাকা তোলার তারিখ দেওয়া ছিল; কিন্তু সেই তারিখে পাইনি। পরে বলা হয়েছে চলতি মাসের মধ্যে পাব। এ মাসও শেষ হওয়ার পথে। কী হবে বুঝতে পারছি না। ’ তিনি জানান, ইভ্যালি গ্রাহক সেবার নম্বরে ফোন করলেই বলে, দ্রুত সমাধান করে দেবে। এ ছাড়াও তার আরও প্রায় দুই লাখ টাকার অন্যান্য পণ্যের অর্ডার দেওয়া আছে। এগুলোর কোনো অগ্রগতি নেই। এসব টাকার অনেকটা পরিবারের অমতেই এখানে বিনিয়োগ করেছিলেন। তাই নীরবে এই যন্ত্রণা তাকে একাই সহ্য করতে হচ্ছে। এভাবে তার ভগ্নিপতিও প্রায় ২৭ লাখ টাকার চেক ও তার বন্ধুবান্ধবের অনেকেই পণ্য ও চেক জমা দিয়ে টাকা পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন বলে জানান সাগর।
এসব বিষয়ে গ্রাহকের উদ্দেশ্যে গত বুধবার রাতে ফেসবুক লাইভে এসে ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ রাসেল ক্ষুব্ধ ও হতাশ গ্রাহকদের ধৈর্য ধরার অনুরোধ জানান এবং অর্ডার করা পণ্য সরবরাহের জন্য সময় চান। একই সঙ্গে আরো নতুন উদ্যমে কাজ করার কথা বলেন। গত শনিবার বিকাল ৫টা পর্যন্ত এ লাইভ চার লাখ ৮২ হাজার ফেসবুক ব্যবহারকারী দেখেছেন। এর মধ্যে ৮৫ হাজার মন্তব্য আসে। এসব মন্তব্যে ইভ্যালি প্রতারণা, পণ্য ও রিফান্ড (টাকা ফেরতের) চেকের টাকা না পাওয়ার কথা জানিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন গ্রাহকরা।
গ্রাহকদের অনেকেই বলেছেন, গত বছরের অর্ডার করা পণ্য এবং রিফান্ড চেকের টাকা এখনো পাননি তারা। ইভ্যালির সঙ্গে কয়েকবার যোগাযোগ করেও ব্যর্থ হয়েছেন।
ইরফান তাসিন নামের একজন মন্তব্য করেন, ‘২০২০ সালের ১৬ আগস্ট ফ্রিজ অর্ডার করে এখনো পাইনি। ’ এসব মন্তব্যকারীর মধ্যে কারো কারো ১০ থেকে ১৫টি দামি পণ্যও রয়েছে। কিছু মন্তব্যে ইভ্যালি কর্তৃপক্ষ দুঃখ প্রকাশ করে উত্তর দিয়ে গ্রাহকদের ধৈর্য ধরার কথা ও দ্রুত সমস্যা সমাধানের কাজ করছে বলে জানায়।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ইভ্যালির পাঠানো সম্পদ বিবরণীতে মোট দায় ও মূলধন দেখানো হয়েছে ৫৪৩ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। এটি ১৫ জুলাই পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির হিসাব। এর মধ্যে মূলধন মাত্র এক কোটি টাকা, বাকি ৫৪২ কোটি ৯৯ লাখ টাকাই দায়, যা গ্রাহক ও পণ্য সরবরাহকারী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো ইভ্যালির কাছে পাওনা।
সম্পদের তথ্য পাওয়ার বিষয়ে ওই দিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) মো. হাফিজ উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘ইভ্যালির কাছে তিন সপ্তাহে তিন ধরনের তথ্য চেয়েছি। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি সম্পদ ও দায়ের হিসাব দিয়েছে। বাকি তথ্যগুলো পাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে আন্ত মন্ত্রণালয় কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ’