সমবায় সমিতির ব্যাংকিং প্রতারণায়, দেশজুড়ে ৩০০টিরও বেশি শাখা
- আপডেট সময় : ০৮:৫৩:৩৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৬ জানুয়ারী ২০২১ ২০১ বার পড়া হয়েছে
নিজস্ব প্রতিবেদক;
ব্যাংক সেক্টরে মনিটরিং দুর্বলতা যেন স্পষ্ট। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জনসাধারণের সঙ্গে প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে স্মল ট্রেডার্স কো-অপারেটিভ (এসটিসি) ব্যাংক লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান। সমবায় অধিদফতর থেকে সমিতি পরিচালনার অনুমোদন নিলেও তারা শুরু করেছে ব্যাংকিং কার্যক্রম। সমবায় অধিদফতরের নির্দেশনা মোতাবেক, নারায়ণগঞ্জ এলাকার বাইরে তাদের কার্যক্রম পরিচালনার কোনো অনুমতি না থাকলেও আইন ভঙ্গ করেই ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর, সিলেটসহ দেশজুড়ে ৩০০টির অধিক শাখা খুলেছে এসটিসি ব্যাংক।
সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপারে বিশেষ অনুসন্ধান চালায় বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। অনুসন্ধানে এসটিসি ব্যাংকের অনিয়মের এমন চিত্র উঠে এলে অবৈধ প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করতে সরকারের কাছে সুপারিশ করে বিএফআইইউ।
এ বিষয়ে বিএফআইইউর প্রধান আবু হেনা মোহাম্মদ রাজি হাসান জানান, এসটিসি ব্যাংকের ওপর তদন্ত করেছে বিএফআইইউ। তদন্তে দেখা গেছে, আইন অনুযায়ী ব্যাংকিং কার্যক্রম চালাতে পারবে না তারা। তদন্ত প্রতিবেদনটি সংশ্লিষ্ট অধিদফতরকে দেয়া হয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া গ্রামের সহজ-সরল জনসাধারণের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করে আসছে এসটিসি। ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা জেলাসহ সারাদেশে অবৈধভাবে শাখা অফিস খুলে এ তৎপরতা চালাচ্ছে তারা। প্রতিষ্ঠানটি লোভনীয় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছ থেকেও হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা। এসব কারণে এসটিসি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ফতুল্লা মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করা হয়েছে।
এছাড়া, এসটিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন নিয়েও রয়েছে জটিলতা। এটি ১৯৭৬ সালের ১৭ জুলাই নিবন্ধিত হলেও প্রকৃতপক্ষে সে সময়ের সদস্যদের কোনো অস্তিত্ব নেই। যারা ব্যবস্থাপনা কমিটি বলে এখন দাবি করছে, তারাও দুটি গ্রুপে বিভক্ত। দুটি ব্যবস্থাপনা কমিটির একটি জনৈক আতিকুর রহমানের পক্ষ, যার প্রধান কার্যালয় রাজধানীর মৌচাকের লিলি প্লাজার তৃতীয় তলায়। অপরটি জনৈক আবুল হাসানের পক্ষ, যাদের প্রধান কার্যালয় ফকিরাপুলের এইচ এম সিদ্দিক ম্যানশনে।
জানা যায়, ২০১৯ সালের মে মাসে রাজশাহী নগরের বর্নালী মোড়ে মরিয়ম আলী টাওয়ারের চতুর্থ তলায় প্রতিষ্ঠানটি আঞ্চলিক শাখা অফিস খুলে ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনার কথা প্রচার করে। ব্যাংকিং কার্যক্রমের মতো সঞ্চয়, ডিপিএস ও চলতি হিসাবসহ সব ধরনের ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করে এসটিসি। তবে প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘ব্যাংক’ আর অনুমোদন সমবায় অধিদফতর থেকে হওয়ার খবর জানাজানি হওয়ায় স্থানীয়দের মাঝে এ নিয়ে আতঙ্ক দেখা দেয়।
এর বাইরে রাজশাহী নগরের সাগরপাড়ায় এসটিসি ব্যাংকের রাজশাহী শাখা ও বিভাগীয় কার্যালয়, পবা থানার পাশে নওহাটা, বানেশ্বরের ফাতেমা হক প্লাজায় (তৃতীয় তলায়), মোহনপুরের কেশরহাটে, তানোর পৌরশহরের চেয়ারম্যান প্লাজার দ্বিতীয় তলায়, বাগমারার ভবানীগঞ্জ বাজারের গোডাউন মোড়ে শাখা অফিস খুলে অবৈধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
তদন্ত সূত্র জানিয়েছে, এসটিসি ব্যাংক সমবায় অধিদফতর থেকে সমবায় সমিতি হিসেবে কেবল নারায়ণগঞ্জ জেলায় কাজ করার অনুমতি নিয়েছে। সংশোধিত উপ-আইন অনুযায়ী কর্ম এলাকার বাইরে কার্যক্রম পরিচালনা করা সমবায় সমিতি বিধিমালা ২০০৪ এর ১২(২) এর পরিপন্থী। এছাড়া সমবায় আইন ২০০১, সংশোধিত ২০০২ ও ২০১৩ এর ২৩(১) ধারা অনুযায়ী কোনো সমবায় সমিতি তার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য শাখা অফিস খুলতে পারবে না এবং সমবায় সমিতি আইনের ২৬ ধারা অনুযায়ী সদস্য ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আমানত গ্রহণ বা ঋণ প্রদান করতে পারবে না। কিন্তু এ নিয়ম-নীতি তোয়াক্কা না করেও সমবায় সমিতির নামের সঙ্গে ‘ব্যাংক’ শব্দটি ব্যবহার করে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে এসটিসি।
এসটিসির ওয়েবসাইট ও প্রসপেক্টাসে দেখা গেছে, প্রথম পাতায় ব্যাংকের ৩০০-র অধিক শাখা থাকার বর্ণনা দেয়া হলেও ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে মাত্র ৪৪টির। এসব শখার মাধ্যমে আমানত সংগ্রহ ও ঋণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে এসটিসি।
তারা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা মূল্যমানের শেয়ারও বিক্রি করছে বেশ কিছু নাম দিয়ে। এসব শেয়ারের নাম দেয়া হয়েছে—অংশীদার, নিকট, আস্থা, বিশ্বাস, প্রিয়, আমার ও আপন। পাশাপাশি দৈনিক সঞ্চয় প্রকল্প, মুদারাবা মাসিক সঞ্চয়, মুদারাবা শিক্ষা সঞ্চয়, মুদারাবা হজ্জ সঞ্চয় নামে ব্যাংকের মতো আমানতও নিচ্ছে তারা।
এ বিষয়ে এসটিসি ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান আতিকুর রহমানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তার সাড়া মেলেনি।
জানতে চাইলে সমবায় অধিদফতরের যুগ্ম-নিবন্ধক (ব্যাংক, বীমা ও কৃষি ঋণ) জেবুন নাহার বলেন, এসটিসি যে নাম ব্যবহার করেছে তা সমবায় ও ব্যাংক কোম্পানি আইনের কোনোটাই সাপোর্ট করে না। তাদের অসঙ্গতি ইতোমধ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও দুদককে জানিয়েছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিষয়টি নিয়মিত মনিটরিং করছে। তাছাড়া অনেকগুলো মামলাও চলছে।