ওসি ও ফাঁড়ি ইনচার্জের সহায়তায় শহীদ বুদ্ধিজীবীর পরিবারের জমি দখল!
- আপডেট সময় : ০৯:৪৬:৫১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৮ অগাস্ট ২০১৯ ৯৮ বার পড়া হয়েছে
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
শহীদ বুদ্ধিজীবীর পরিবারের সম্পত্তি দখল করতে সহায়তায় ঢাকা মহানগর পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ ইব্রাহীম খান ছাড়াও আরও দু’জন জড়িত ছিলেন। তারা হলেন বংশাল থানার সাবেক ওসি মো. সাহিদুর রহমান এবং নবাবপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই জাহাঙ্গীর আলম।
পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনেই তাদের দায়িত্বে চরম গাফিলতির বিষয় উঠে আসে। ইব্রাহীম খান রোববার সাসপেন্ড হলেও সাহিদুর ও জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। নামকাওয়াস্তে তাদের বিরুদ্ধে একটি বিভাগীয় মামলা হয়েছে। সাহিদুর কোতোয়ালি থানার ওসি এবং জাহাঙ্গীর মতিঝিলের আল হেলাল পুলিশ বপের সহকারী ইনচার্জ হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে মঙ্গলবার বংশাল থানার সাবেক ওসি সাহিদুর রহমান সমকালকে বলেন, ‘জমি বিরোধ-সংক্রান্ত ঘটনায় যথাযথ ধারায় আমি মামলা রুজু করেছি। জমি দখলে কোনো সহায়তা করিনি। টাকার নেওয়ার বিষয়টি অসত্য।’
অভিযোগ রয়েছে- জমি বেদখলের নেপথ্যে দখলকারীর সঙ্গে পুলিশের তিন কোটি টাকা রফা হয়েছে। এই তিন কোটি টাকার বিনিময়ে নবাবপুরের শেখ জাবেদ উদ্দিনকে জমিটি দখলে সহায়তা করেন তিন পুলিশ কর্মকর্তা। মঙ্গলবার সমকালের কাছে এমন অভিযোগ করেছেন প্রয়াত শামসুল হক খানের ভাতিজা শামছুল হাসান খান।
শামছুল হাসান খান জানান, নবাবপুরের ২২১ নম্বর হোল্ডিংয়ের জমিটি সরকারের অর্পিত সম্পত্তি। শহীদ বুদ্ধিজীবী শামসুল হক খানের পরিবারের সদস্য হিসেবে তারা লিজ নিয়ে ভোগদখল করে আসছিলেন। সেখানে তৈরি তিনতলা বাড়িতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল তাদের। জাল দলিল করে পুলিশের সহায়তায় ২০১৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জাবেদ ও তার সন্ত্রাসীরা বাড়িটি দখল করে এবং বাড়ির লোকজনের হাত-পা বেঁধে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রায় পাঁচ কোটি টাকার মালপত্র ডাকাতি করে। পরে বাড়ি ভেঙে নতুন করে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করে দখলকারী।
ডিসি ইব্রাহীম খান ও ওসি সাহিদুরের কাছে অভিযোগ করেও আইনগত কোনো সহায়তা পাননি ভুক্তভোগীরা। তিনি বলেন, ‘আমি শুনেছি শেখ জাবেদের কাছ থেকে ইব্রাহীম দুই কোটি এবং সাহিদুর এক কোটি টাকা নিয়েছেন। এই টাকার ভাগ জাহাঙ্গীরের কাছেও পৌঁছেছে।’
মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিন দেখা যায়, ২২১ নম্বর হোল্ডিংয়ের গেট বন্ধ। ভেতরে একজন আনসার সদস্যকে বসে থাকতে দেখা যায়। তিনি বলেন, ভেতরে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না, শেখ জাবেদ উদ্দিনের নিষেধ আছে। জাবেদ জমিটির নিরাপত্তায় ১২ জন আনসার সদস্য রেখেছেন বলে জানান তিনি। ছিদ্র দিয়ে ভেতরে দেখা গেল, বেজমেন্ট তৈরি কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি।
ওই আনসার সদস্য জানান, আনুমানিক চার মাস আগে থেকে নির্মাণ কাজ বন্ধ আছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে জাবেদ সম্পর্কে জানতে চাইলে তাদের চেহারায় আতঙ্কের ছাপ লক্ষ্য করা যায়। জাবেদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে রাজি নন। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন বলেন, জাবেদ স্থানীয় বিএনপি নেতা এবং প্রভাবশালী। তার বিরুদ্ধে কথা বললে তারা ওই এলাকায় ব্যবসা করতে পারবেন না।
জানা যায়, ২২১ এর দুই পাশে ২২০ ও ২২২ নম্বর হোল্ডিংয়ের জমিটিও সরকারি সম্পত্তি। জাল দলিল করে সেটি এখন ভোগদখল করছেন জাবেদ।
স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত বুদ্ধিজীবী শামসুল হক খান কুমিল্লার জেলা প্রশাসক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাকে হত্যা করে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য হিসেবে তার মা মাসুদা খানমকে সরকারি অর্পিত সম্পত্তির ২২১ নম্বর হোল্ডিংয়ের চার কাঠা জমি ১৯৭৫ সালে লিজ দেওয়া হয়। মাসুদার মৃত্যুর পর তার দুই ছেলে আজহারুল হক খান ও ফজলুল হক খান লিজ নিয়ে লিজ মানি পরিশোধ করে আসছিলেন।
আজহারুল হক খানের ছেলে শামছুল হাসান খান জানান, জনৈক তপন কুমার বসাকের নামে সরকারি এই সম্পত্তির জাল দলিল করে পাওয়ার অব অ্যার্টনি নেন শেখ জাবেদ উদ্দিন। এ নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। এরই মধ্যে গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর জাবেদ উদ্দিন শেখের নেতৃত্বে ৩০-৩৫ জন সন্ত্রাসী অবৈধভাবে ওই বাড়িতে প্রবেশ করে। তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার মুক্তিযোদ্ধা কেএম শহীদুল্লাহ এবং পরিবারের সদস্যদের হাত-পা বেঁধে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার মালপত্র ডাকাতি করে। বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয় তাদের। বাড়িটি ভেঙে নতুন করে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করে অবৈধ দখলকারীরা। আজহারুল হক খান থানায় গিয়ে কোনো সহায়তা পাননি। প্রকৃত ধারায় মামলাও নেননি সে সময়কার বংশাল থানার ওসি সাহিদুর রহমান। পরে পুলিশ মহাপরিদর্শক এবং ডিএমপি কমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন আজহারুল। পাশাপাশি নবাবপুর দোকান মালিক সমিতির কাছেও লিখিত অভিযোগ জানান তিনি।
শামছুল হাসান খান জানান, আদালত নতুন ভবন নির্মাণ কাজ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই নির্দেশনা অমান্য করে দখলকারীরা। ওসি সাহিদুরকে আদালতের আদেশ কপি দেখিয়ে নির্মাণ কাজ বন্ধ করার সহায়তা চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সাহিদুর তাকে বলেন, আদেশের কপি দেখিয়ে ভবন নির্মাণ কাজ বন্ধ করা যাবে না। ম্যাজিস্ট্রেটকে ঘটনাস্থলে আসতে হবে।
নবাবপুর দোকান মালিক সমিতির সচিব দেলোয়ার হোসেন সমকালকে বলেন, ‘জমি বেদখল হয়ে যাওয়ার বিষয়ে আজহারুল হক খান দোকান মালিক সমিতির কাছে অভিযোগ করেছিলেন। দখলকারী শেখ জাবেদ উদ্দিন স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী এবং দুর্ধর্ষ প্রকৃতির। ভূমিদস্যু হিসেবেও চিহ্নিত। সমিতির নেতৃবৃন্দ ডিসি মোহাম্মদ ইব্রাহী খান ও বংশাল থানার সে সময়ের ওসি মো. সাহিদুর রহমানকে বিষয়টি জানান এবং আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু তারা কোনো সহায়তা করেননি।’
দোলোয়ার বলেন, পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত আছেন জানিয়ে ইব্রাহীম খান তাদের বলেছিলেন, সামনে তার পরীক্ষা। তাই পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত। পরে দেখবেন বিষয়টি। কিন্তু পরে পুলিশ আর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বলে দাবি করেন দোকান মালিক সমিতির এই নেতা।
ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) শেখ নাজমুল আলমকে প্রধান করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি করে ডিএমপি কর্তৃপক্ষ। কমিটির কাছেও অসত্য তথ্য দিয়েছেন ইব্রাহীম খান। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে- ভুক্তভোগীর কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর যথাযথ অনুসন্ধান করে অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব পুলিশের। অথচ তা না করে ডিসি ইব্রাহীম খান, ওসি সাহিদুর রহমান ও এসআই জাহাঙ্গীর আলম পক্ষপাতিত্ব করে পরোক্ষভাবে ফৌজদারি অপরাধকে সহায়তা করেছেন। একই সঙ্গে অপরাধের পুনরাবৃত্তিতে উৎসাহিত করেছেন।