গুলশান-নয়াপল্টন দুই কার্যালয়ে বিভক্ত বিএনপি
- আপডেট সময় : ১২:৪২:২২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৮ জুলাই ২০১৯ ১০৬ বার পড়া হয়েছে
দুই কার্যালয়ে সিদ্ধান্ত নেন ফখরুল-রিজভী অন্ধকারে অন্য নেতারা
বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয় আর নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ঘিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গুলশান কার্যালয়ে থেকে এবং সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নয়াপল্টনে বসে দলীয় সিদ্ধান্ত নেন। দু’জনই আলাদাভাবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনা নেন। তবে দলীয় এসব সিদ্ধান্তের বিষয়ে অন্ধকারে থাকেন বাকি নেতারা। এ নিয়ে দলের নেতাদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা এসব তথ্য জানালেও কেউ নাম প্রকাশ করে কথা বলতে চান না।
বিএনপি নেতারা জানান, গুলশান ও নয়াপল্টনের মধ্যে বিভক্তি স্পষ্ট হয়ে পড়েছে। জাতীয় ইস্যুতে সিদ্ধান্ত আসে গুলশান থেকে। দলের অভ্যন্তরীণ ও সাংগঠনিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয় নয়াপল্টনে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা থেকে শুরু করে ৫৮৯ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটির অধিকাংশ নেতার সম্পৃক্ততা থাকে না।
দলের এই বিভাজন নিয়ে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর উষ্ফ্মা প্রকাশ করে বলেন, দেশে গণতন্ত্রের সংকট চলছে, রাজনৈতিক অধিকারের জন্য সংগ্রাম চলছে। এ অবস্থায় বিএনপির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মাথাব্যথা অপ্রত্যাশিত। বিএনপি মহাসচিব দাবি করেন, তাদের দল গঠনতন্ত্র অনুযায়ী চলছে। দলে কোনো সমস্যা নেই। দলের সব নেতা সক্রিয় রয়েছেন।
সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীও দাবি করেছেন, বিএনপিতে বিভক্তি নেই। তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশ মেনে কাজ করছেন। দল পরিচালনায় তার নিজের ব্যক্তিগত কোনো সিদ্ধান্ত নেই।
তবে দলীয় সূত্র জানায়, অধিকাংশ প্রভাবশালী নেতা নিষ্ফ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। তাদের সক্রিয় করার উদ্যোগ নেই। দুই কার্যালয় ঘিরে শীর্ষ নেতাদের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের বিষয়টিও এখন প্রকাশ্য। তাদের ঘিরে পৃথক বলয় সৃষ্টি হচ্ছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা জানান, স্থায়ী কমিটির সদস্যদের অন্ধকারে রেখেই সংসদে যোগ দেওয়া, সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়ন, উপনির্বাচনে অংশ নেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে নেতারা তাদের ক্ষোভের কথাও জানিয়েছেন। গত মাসে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও সেলিমা রহমানকে স্থায়ী কমিটির সদস্য করা হয়। তাদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা হয়নি। গুলশান কার্যালয় থেকে এসব সিদ্ধান্ত এসেছে বলে অভিযোগ নয়াপল্টন বলয়ের কট্টরপন্থি নেতাদের। তাদের দাবি, মহাসচিব দলের নেতাদের না জানিয়েই এসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
তবে জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকে বলছেন, মির্জা ফখরুলের এককভাবে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই। এসব সিদ্ধান্ত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলের গঠনতন্ত্রে অর্পিত দায়িত্ব অনুযায়ী নিচ্ছেন। দলের মুখপাত্র হিসেবে মির্জা ফখরুল সেসব সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছেন মাত্র। এখানে মির্জা ফখরুলকে একক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অভিযোগে দোষারোপ করা অবিবেচনাপ্রসূত।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর দল ‘পুনর্গঠনে’র কাজে হাত দিয়েছে বিএনপি। দলীয় সূত্র জানায়, এ কাজে তারেক রহমানের পরামর্শে বৈঠক থেকে শুরু করে কমিটি গঠনের পুরো প্রক্রিয়া এককভাবে সম্পন্ন করছেন রুহুল কবির রিজভী। এতে দলের অন্য নেতাদের সম্পৃক্ততা নেই। এরই মধ্যে দলের ৮১টি সাংগঠনিক ইউনিটের মধ্যে ৭১টির সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। ২৫ জেলায় নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে মৎস্যজীবী দল, তাঁতী দল, কৃষক দল, ওলামা দলের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে।
দলীয় নেতারা জানান, নীতিনির্ধারণী ফোরামে আলোচনা ছাড়াই গুলশান ও নয়াপল্টন থেকে অনেক সিদ্ধান্ত আসছে। দল পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় নেওয়া হয় না ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদকদের পরামর্শ। সভা-সেমিনার ছাড়া আর কোথাও তাদের দেখা যায় না। একই অবস্থা বিষয়ভিত্তিক সম্পাদকদেরও।
স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য অভিযোগ করেন, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের পরামর্শকে গুরুত্ব দেওয়া হতো। দলীয় ফোরামে আলোচনা করা হতো। তবে নির্বাচনের পরে সংসদে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকে তাদের নিয়ে বৈঠক হয়, আলোচনাও হয়। কিন্তু সিদ্ধান্ত কী নেওয়া হবে, তা তারা জানেন না। গুলশান কার্যালয়ের বৈঠক আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। একই অবস্থা নয়াপল্টন কার্যালয়েও। দল পুনর্গঠনের বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তা তারা সংবাদমাধ্যমে জানতে পারেন।
এই নেতা উদাহরণ দিয়ে বলেন, স্থায়ী কমিটিতে দু’জনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী চেয়ারপারসন কিংবা চেয়ারম্যান একক ক্ষমতাবলে কাউকে স্থায়ী কমিটির সদস্য করতে পারেন। তবে রাজনৈতিক শিষ্টাচার হিসেবে নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলে ভালো হতো।
আরেকজন নেতা বলেন, ‘কারচুপি’র নির্বাচনে বিজয়ী সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে বিএনপি আর কোনো ভোটে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। উপজেলা নির্বাচন দলীয়ভাবে বয়কটের পর অংশ নেওয়ায় দুই শতাধিক নেতাকে বহিস্কার করা হয়। তবে বগুড়া-৬ উপনির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়। বিএনপি কেনই বা উপজেলা নির্বাচন বর্জন করল, কেনই বা উপনির্বাচনে অংশ নিল তা তারা জানেন না। দলের মহাসচিব কেন শপথ নিলেন না, কেন বিএনপির বাকি এমপিরা সংসদে গেলেন, তাও তারা বুঝতে পারছেন না।
দলের পুনর্গঠন প্রক্রিয়া নিয়েও সমালোচনা করেন স্থায়ী কমিটির অন্য এক নেতা। তিনি বলেন, দল পুনর্গঠন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে এখন দলীয় ফোরামে এ বিষয়ে কোনো আলোচনা করার সুযোগ নেই। তারা কিছু জানেনও না। কবে, কোন জেলার কমিটি ভেঙে দেওয়া হচ্ছে, নতুন কমিটি দেওয়া হচ্ছে, এ বিষয়ে মহাসচিবও কিছু জানেন না।
দলের একজন ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, জাতীয় নির্বাচনের পর সারাদেশের নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা কাজ করছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের সফরের মাধ্যমে তৃণমূলে দলকে চাঙ্গা করা যেত। তবে চিরাচরিত সেই নিয়মকে বাদ দিয়ে জেলা নেতাদের ঢাকায় এনে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন নেতারা। এভাবে কমিটি গঠন করে তৃণমূলকে কতটুকু সক্রিয় করা যাবে, তা নিয়ে তিনি সন্দিহান। এ নেতা মনে করেন, ঢাকা থেকে চাপিয়ে দেওয়া কমিটির কারণে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। কাঙ্ক্ষিত ফল আসছে না। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে গত মাসে সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল বিএনপি। জেলায় জেলায় নতুন কমিটি গঠন হচ্ছে। কিন্তু বিক্ষোভ কর্মসূচিতে পদপ্রত্যাশীদের পাওয়া যায়নি। হাতেগোনা কয়েকটি জেলায় কর্মসূচি পালন করা হয়েছে।
বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে শুধু রুহুল কবির রিজভীর নেতৃত্বে দলের অঙ্গ সংগঠনের ব্যানারে নয়াপল্টন কার্যালয় থেকে ঝটিকা মিছিল বের করা হয়। কেন দলের স্থায়ী ও কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদেরসহ নগর বিএনপির ব্যাপারে বড় ধরনের মিছিল ও সমাবেশ হয় না? শুধু বারবার একজনের নেতৃত্বে ঝটিকা মিছিল বের করার মাধ্যমে মনে হয় বিএনপি একটি নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল। কেন্দ্রীয় কর্মসূচিতে ঢাকায় অবস্থানরত সব নেতা ও মহানগর নেতাদের থাকা উচিত। আর রাজধানীতে থানাওয়ারি মিছিল-সমাবেশ করলে সেখানে কেন্দ্রীয় ও নগর নেতাদের কে কোথায় থাকবেন, তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া উচিত। এভাবে দল চলতে পারে না।