ইলিশ নিয়ে দুশ্চিন্তায় জেলেরা

- আপডেট সময় : ১০:৪৯:৩০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০১৯ ১০১ বার পড়া হয়েছে

নিষেধাজ্ঞা শেষ হতেই অশান্ত সাগর, ইলিশ নিয়ে দুশ্চিন্তায় জেলেরা, হুমকির মুখে শত শত কোটি টাকার বিনিয়োগ
বরিশাল ব্যুরো:
টানা ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে মাছ ধরা শুরু হতে না হতেই বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের কারণে তীরে ফিরতে শুরু করেছে হাজার হাজার মাছধরা ট্রলার। ২৩ জুলাই নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষে ২৪ জুলাই মাছ ধরতে গিয়েছিল ট্রলারগুলো।
এরই মধ্যে বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকায় ৩নং সতর্ক সংকেত জারি করে আবহাওয়া বিভাগ। গভীর সমুদ্রে থাকা ট্রলারগুলোকে ফিরতে বলা হয়েছে তীরে।
টানা নিষেধাজ্ঞার পর মৌসুমের একবারে শেষ প্রান্তে এসে সাগরে গিয়েও আবার ফিরে আসতে বাধ্য হওয়ায় চোখে অন্ধকার দেখছেন জেলেরা। কত দিনে সাগরের পরিস্থিতি শান্ত হবে এবং সেই পর্যন্ত ইলিশের মৌসুম থাকবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কায় সবাই। সেরকম কিছু হলে মৎস্য ব্যবসায়ী ও আড়তদারসহ বহু জেলেকে পথে বসতে হবে।
এদিকে নিষেধাজ্ঞা শেষে মাছ ধরা শুরু হওয়ায় কমতে শুরু করেছিল ইলিশের দাম। বরিশালসহ দক্ষিণ উপকূলের আড়তগুলোতেও আসতে শুরু করেছিল ইলিশ। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আবারও বাজার ইলিশশূন্য হয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পোমা-ফাইলসাসহ ছোট মাছের প্রজনন মৌসুম হিসাব করে চলতি বছরের ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত সাগরে সব ধরনের মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা দেয় মৎস্য অধিদফতর। যদিও এ নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বাদ-প্রতিবাদ হয়েছে। এর বিপক্ষে নানা যুক্তি দিয়েছিলেন জেলেরা।
একই সমুদ্রে মাছ ধরা ভারতীয় জেলেদের ক্ষেত্রে এ নিষেধাজ্ঞা যেহেতু এপ্রিল এবং মাত্র ১ মাসের জন্যে সেখানে বাংলাদেশে কেন তা ১ মাস পরে তাও আবার ২ মাস হবে সেই প্রশ্ন তোলেন সবাই। জেলেদের জাল যেখানে ৪ বর্গ ইঞ্চি ফাঁসের সেখানে এ জালে রেণু ধরা পড়ার সুযোগ নেই উল্লেখ করে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা না দেয়ারও দাবি ওঠে।
এ দাবিতে উপকূলীয় প্রায় সব জেলায় চলে জেলেদের আন্দোলন-বিক্ষোভ। চট্টগ্রামে মৎস্যমন্ত্রীর গাড়িবহর ঘেরাওয়ের ঘটনা ঘটে।
এ আন্দোলন-সংগ্রামের পেছনে একটি বড় কারণও ছিল। আর তা হল ইলিশের মৌসুম। যার শুরু মে মাসের মাঝামাঝি এবং শেষ আগস্টের প্রথম সপ্তাহে। সবচেয়ে বড় এ মৌসুমেই উৎপাদিত হয় দেশের মোট ইলিশের শতকরা প্রায় ৭৭ ভাগ।
প্রধানত এ মৌসুমের ওপর নির্ভর করেই টিকে থাকে দেশের ইলিশনির্ভর অর্থনীতি। এ মৌসুমে টানা ৬৫ দিন সাগরে মাছ ধরা বন্ধ থাকার নিষেধাজ্ঞা থাকায় ফুঁসে ওঠেন উপকূলের জেলেরা। যদিও সেসব আন্দোলন-সংগ্রামে শেষ পর্যন্ত কোনো লাভ হয়নি। মাছধরা নিষেধাজ্ঞা প্রশ্নে অনড় থাকে সরকার। ফলে ২০ মে থেকে বন্ধ হয়ে যায় সাগরে মাছধরা।
নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ২৪ জুলাই সাগরে মাছ ধরতে যায় হাজার হাজার ট্রলার। এদের মধ্যে ডেইলি ফিশিংয়ে সাগরে যাওয়া ট্রলারগুলো ফিরে আসে ওই দিন রাতেই। আশানুরূপ না হলেও মোটামুটি ভালোই ইলিশ নিয়ে ফেরে ট্রলারগুলো। পরে ২ দিনে সেগুলো পৌঁছে যায় বরিশাল, পটুয়াখালী এবং বাগেরহাটসহ দেশের বড় বড় ইলিশ মোকামে।
টানা ৬৫ দিন পর চালান আসায় কমতে শুরু করে ইলিশের দামও। বরিশাল ইলিশ মোকামের ব্যবসায়ী সেলিম গাজী বলেন, ‘শুক্রবার ৭টি ফিশিং ট্রলার আসে বরিশালে। সবমিলিয়ে মাছের পরিমাণ ছিল ৩ থেকে সাড়ে ৩শ’ মণ। মৌসুমে যেখানে এ মোকামে দৈনিক ৩ থেকে ৪ হাজার মণ ইলিশ আসে সেখানে এ মাছ খড়ের গাদায় সুই খোঁজার মতো হলেও যেখানে একবারেই ইলিশ ছিল না সেখানে সাড়ে ৩শ’ মণই হয়ে দাঁড়ায় অনেক কিছু।
গত ২-৩ ধরেই এভাবেই ইলিশ আসছে মোকামে। সেই সঙ্গে কমতে শুরু করেছে ইলিশের দাম। মাত্র সপ্তাহখানেক আগেও যেখানে ৬০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের মণ ছিল ৫৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা সেখানে মাছ আসতে শুরু করায় তা কমে এসে দাঁড়ায় ২৮ থেকে ৩০ হাজার টাকায়।’
সাগর পাড়ের আলীপুরের মৎস্য ব্যবসায়ী ফজলু গাজী বলেন, ‘যেভাবে মাছ আসছিল তাতে ৪-৫ দিনের মধ্যেই দাম আরও কমে আসবে এমনটাই আশা ছিল। কিন্তু এরই মাঝে খবর আসে সাগরে লঘুচাপ সৃষ্টির। আবহাওয়া বিভাগও জারি করে ৩নং সর্তক সংকেত। এ অবস্থায় আবারও চরম বিপদে পড়েছি আমরা।’
বরগুনা জেলা ট্রলার মালিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ২৪ তারিখে সাগরে যাওয়া উইকলি ফিশিংয়ের ট্রলারগুলোই ছিল আমাদের মূল ভরসা। ৭-১০ দিন সাগরে থেকে এদের প্রতিটি কম করে হলেও ৮০-১০০ মণ ইলিশ নিয়ে তীরে ফেরে। ডেইলি ফিশিংয়ের ক্ষেত্রে যা হয় না। কিন্তু আবহাওয়ার যা পরিস্থিতি তাতে এসব ট্রলার আর সাগরে থাকতে পারবে না। বলতে গেলে শূন্য হাতেই ফিরে আসতে হবে তাদের।
মহিপুর মৎস্য আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিমাই চন্দ্র দাস বলেন, ‘এরই মধ্যে উত্তাল হয়ে উঠেছে সাগর। তীরে ফিরতে শুরু করেছে শত শত ট্রলার। আমরাও যতদূর সম্ভব সাগরে খবর পাঠাচ্ছি ট্রলারগুলোকে তীরে ফিরে আসার জন্য। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে শুরু হওয়া ইলিশের মৌসুম এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। আবহাওয়ার পরিস্থিতি কবে আবার ভালো হবে, কবে আবার জেলেরা মাছ ধরতে ট্রলার নিয়ে সাগরে যেতে পারবেন সেটা নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় আছি।’
বরিশাল ইলিশ মোকামের মৎস্য ব্যবসায়ী, সিকদার ফিশ ট্রেডিংয়ের মালিক জহির সিকদার বলেন, ‘শুধু এ একটি মোকামেই ইলিশ মৌসুমকে সামনে রেখে জেলেদের কয়েকশ’ কোটি টাকা দাদন দিয়েছেন মৎস্য আড়তদাররা। বরগুনা-পটুয়াখালী-ভোলাসহ উপকূলের অন্যান্য মোকামগুলোর হিসাব ধরলে তা কয়েক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। শুধু ট্রলার মালিক আর জেলেরাই নন, ইলিশনির্ভর অর্থনীতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে অসংখ্য বরফ কল, মাছের আড়ত, পরিবহনে ট্রাকসহ বিভিন্ন সেক্টরের কয়েক লাখ মানুষ। ৬৫ দিনের অযৌক্তিক নিষেধাজ্ঞায় এমনিতেই আমাদের কোমর ভেঙে গেছে। তার ওপর বর্তমানে আবহাওয়ার যে পরিস্থিতি তাতে পুরো ইলিশ শিল্পই এখন হুমকির মুখে। সরকার যদি এ ব্যাপারে উদ্যোগ না নেয় তাহলে পথে বসবে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার মানুষ।’
বরিশাল মৎস্য আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিরব হোসেন টুটুল বলেন, বছরে ১২ মাসের প্রায় পুরোটাই কোনো না কোনো নিষেধাজ্ঞায় বন্ধ রাখা হয় জেলেদের মাছ ধরা। সারা বছর যদি নিষেধাজ্ঞাই থাকে তাহলে আমরা মাছ ধরব কখন?