ঢাকা ০৯:৪৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
Logo মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা আমাদের অঙ্গীকারঃ ড. তৌফিক রহমান চৌধুরী  Logo মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির নতুন বাসের উদ্বোধন Logo মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে শিক্ষকদের ভূমিকা অগ্রগণ্য: ভিসি প্রফেসর ড. মোহাম্মদ জহিরুল হক Logo মঙ্গল শোভাযাত্রা – তাসফিয়া ফারহানা ঐশী Logo সাস্টিয়ান ব্রাহ্মণবাড়িয়া এর ইফতার মাহফিল সম্পন্ন Logo কুবির চট্টগ্রাম স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের ইফতার ও পূর্নমিলনী Logo অধ্যাপক জহীর উদ্দিন আহমেদের মায়ের মৃত্যুতে শাবির মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্ত চিন্তা চর্চায় ঐক্যবদ্ধ শিক্ষকবৃন্দ পরিষদের শোক প্রকাশ Logo শাবির অধ্যাপক জহীর উদ্দিনের মায়ের মৃত্যুতে উপাচার্যের শোক প্রকাশ Logo বিশ কোটিতে গণপূর্তের প্রধান হওয়ার মিশনে ‘ছাত্রদল ক্যাডার প্রকৌশলী’! Logo দূর্নীতির রাক্ষস ফায়ার সার্ভিসের এডি আনোয়ার!




কররের জালে মধ্যবিত্ত

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৭:২৯:৩১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৮ জুলাই ২০১৯ ১২০ বার পড়া হয়েছে

সকালের সংবাদ;

একটি দেশের সমাজ বিনির্মাণে যেমন মধ্যবিত্ত বিশেষ ভূমিকা রাখে, তেমনি সময়ের প্রয়োজনে তারাই সমাজ পরিবর্তনে নেতৃত্ব দেয়। একই সঙ্গে রাষ্ট্রের আধুনিকায়নেও অগ্রভাবে থাকেন তারা। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে অর্থ জোগানের বড় অংশই আসে তাদের হাত থেকে। সেই মধ্যবিত্তকেই হরেকরকম বিচিত্র করের জালে বেঁধে ফেলা হয়েছে আষ্টেপৃষ্ঠে।

এমনভাবে কর কাঠামোর জাল বিস্তার করা হয়েছে যে, এর বেশির ভাগ ভার পড়েছে মধ্যবিত্ত ও চাকরিজীবীদের ওপর। ফলে একদিকে সামাজিক মর্যাদা রক্ষা করতে তাদের ওপর পড়ছে বাড়তি চাপ, অন্যদিকে জীবনযাত্রার ব্যয়ের হিসাব সংকুচিত করতে ব্যস্ত।

অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, যাদের দৈনিক আয় ১০ থেকে ৪০ ডলারের মধ্যেই, তারাই মধ্যবিত্ত। এ হিসাবে এদের বার্ষিক আয় সাড়ে ৩ লাখ থেকে ১৪ লাখ টাকার মধ্যে। তবে আর্থিক সক্ষমতার পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, সামাজিক মর্যাদা, মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক সুযোগ-সুবিধাকেও মানদণ্ডের আওতায় আনা হয়। ওই বিবেচনায় বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের সংখ্যা ৪ কোটির মতো।

জানা গেছে, মধ্যবিত্তদের হরেকরকমের বিচিত্র সব কর দিতে হয়। এর মধ্যে একই কর একাধিকবার দেয়ার নজিরও রয়েছে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই তাদের ওপর চেপেছে করের বোঝা। এর মধ্যে সরাসরি দিতে হয় আয়কর, উৎসে কর, আবগারি শুল্ক, ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক, কর্পোরেট কর, গেইন ট্যাক্স, সিটি কর্পোরেশনের ট্যাক্স। পরোক্ষভাবে দিতে হয়, আমদানি শুল্ক, আগাম কর, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক। এছাড়া নানা সেবা ও পণ্য ক্রয়ে আছে বিচিত্র ধরনের কর।

জীবনধারণের প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের বোঝা বইতে হবে এ শ্রেণীকে। চলতি অর্থবছরের ভ্যাটের প্রভাবে চিনি, ভোজ্যতেল, এলপি গ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যানবাহন, অনলাইনে কেনাকাটার ওপর ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। ফলে এগুলোতে খরচ বাড়বে।

এক কেজি চিনিতে আগে যেখানে ধনী-গরিব নির্বিশেষে ১৪ টাকা কর দিতে হতো, এখন সেখানে ২৩ টাকা কর দিতে হবে। ভোজ্যতেলেও কর দিতে হবে সব শ্রেণীর ভোক্তাকে। এক লিটার ভোজ্যতেলে সাড়ে ৯ টাকার পরিবর্তে এখন দিতে হবে সাড়ে ১৬ টাকা।

প্যাকেটজাত মসলাতেও কেজিপ্রতি ১০-১৫ টাকা কর দিতে হবে। রান্নায় ব্যবহৃত নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী এলপি গ্যাসেও করের বোঝা বাড়ানো হয়েছে। আগে যেখানে ১২ কেজির সিলিন্ডারে কর দিতে হতো ৯ টাকা, এখন সেখানে কর দিতে হবে ৪৪ টাকা।

সিটি গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক বিশ্বজিৎ সাহা যুগান্তরকে বলেন, বাজেটে গৃহীত পদক্ষেপের কারণে ভোজ্যতেল ও চিনিতে ভোক্তাকে বেশি হারে কর দিতে হবে। এক কেজি চিনিতে ২৩ টাকা ও এক লিটার তেলে সাড়ে ১৬ টাকা কর দিতে হবে। আগে যা ছিল যথাক্রমে ১৪ ও সাড়ে ৯ টাকা।

বাজেটে মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপর আরও ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ফলে আগের চেয়ে মোবাইল ফোনে কথা বলার ক্ষেত্রে গ্রাহকদের আরও ৫ শতাংশ বেশি অর্থ খরচ করতে হবে। অর্থাৎ আগে ১০০ টাকা লোড করে যতক্ষণ মোবাইল ফোনে কথা বলা যেত, নতুন বাজেটের ফলে একই সময় কথা বলতে লাগবে ১০৫ টাকা। আগে মোবাইল ফোনে কথা বলার ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ও ২ শতাংশ সারচার্জ আরোপিত ছিল। সব মিলে এ খাতে করের হার ছিল ২২ শতাংশ।

অর্থাৎ ১০০ টাকা মোবাইলে ভরলে কথা বলার সময় ২২ টাকা কর হিসাবে কেটে নেয়া হতো। নতুন বাজেটে মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপর আরও ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করায় এর হার বেড়ে ১০ শতাংশে দাঁড়াচ্ছে। ভ্যাটের হার অপরিবর্তিত রয়েছে। এতে এ খাতে মোট করের হার দাঁড়াবে ২৭ শতাংশ। অর্থাৎ মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপর এখন ২৭ টাকা কর দিতে হবে।

এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, সমাজের বা রাষ্ট্রের বাঁক পরিবর্তনে মধ্যবিত্তই বড় ভূমিকা রাখে। তাদের যদি সুযোগ দেয়া যায়, তারা দেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিতে পারে। কিন্তু তাদের যদি কর ও চার্জের ফাঁদে ফেলে দিয়ে প্রতিদিনের খরচ মেটানোর জন্যই চিন্তা করতে হয়, তাহলে তারা দেশ-সমাজকে নিয়ে চিন্তা করতে পারবে না। এ কারণে তাদের সামাজিক ও আর্থিক স্বস্তি দিয়ে চিন্তার সুযোগ দিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের সামাজিক ও স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনগুলোতে প্রধান ভূমিকা রেখেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। তাদের বেশির ভাগই মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। দেশের সামাজিক ও গবেষণার মাধ্যমে যে অর্জন তার সবগুলোই এদের হাত ধরে এসেছে।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, একটু সাজগোজ করে চলাফেরা করতেও মধ্যবিত্তকে অতিরিক্ত ভ্যাট দিতে হবে। ভালো মানের ব্র্যান্ডেড এবং নন-ব্র্যান্ডেড পোশাকের ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে। অর্থাৎ ভ্যাটের কারণে পোশাকের মূল্য বাড়বে। অতি গরমে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরাতে এখন এসি বাসের চাহিদা বাড়ছে। সেখানেও টিকিট মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। সারা দিন কর্মব্যস্ত থাকার পর সংসারের নিত্যপণ্য, ইলেকট্রনিক সামগ্রী ও পোশাক-পরিচ্ছদ কিনতে অনলাইন কেনাকাটার ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। সেখানেও বাজেটে নতুন করে ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে।

অর্থাৎ অনলাইনে কেনাকাটার খরচ বাড়বে। অবসর সময়ে বাইরে ঘুরতে গেলে আইসক্রিম কিনতেও খরচ বাড়বে। কেননা বাজেটে আইসক্রিমের ওপর নতুন করে ৩ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বসানোয় সব বয়সীদের প্রিয় এ খাবারটির দাম বাড়বে। মিষ্টি কেনায় যথারীতি আগের নিয়মে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। ঢাকা শহরের গণপরিবহন ও যানজটের অবস্থা বিবেচনা করে অনেক মধ্যবিত্ত ব্যক্তিগত গাড়ি বা মোটরসাইকেল কিনেছেন বা কিনতে চান। সেখানে করের বোঝা বাড়ানো হয়েছে। এ ধরনের যানবাহন রেজিস্ট্রেশনে ভ্যাট-ট্যাক্সের পাশাপাশি ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বসানো হয়েছে। অর্থাৎ গাড়ি-মোটরসাইকেল রেজিস্ট্রেশনে ১০ শতাংশ খরচ বাড়বে।

এ তো গেল জীবনধারণের খরচের ওপর কর বৃদ্ধির চিত্র। এর বাইরে মধ্যবিত্তকে আরও কর দিতে হবে। প্রতি বছর মূল্যস্ফীতি হলেও বাজেটে ব্যক্তিশ্রেণীর করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হয়নি। মোটা দাগে মূল বেতন ও বোনাস মিলিয়ে বার্ষিক আয় আড়াই লাখ টাকা পার হলেই বছরে ন্যূনতম ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা আয়কর দিতে হবে।

নিয়োগকারী কোম্পানি বেতন থেকে তা উৎসে কর হিসেবে কেটে রাখবে। অর্থাৎ আয়কর না দিয়ে রেহাই নেই। একটু উচ্চ পদে চাকরি করলে করের হার বাড়বে।

বিয়ে বা জন্মদিনের অনুষ্ঠান করলে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। সিনেমা দেখবেন সেখানে আছে প্রমোদকর। বিদেশে ঘুরতে যাবেন সেখানে দিতে হবে ট্রাভেল ট্যাক্স। সাজগোজ করতে বিউটি পার্লারে যাবেন সেখানেও দিতে হবে ভ্যাট। উচ্চতর পড়াশোনার জন্য বই কিনবেন সেখানে আছে ভ্যাটের থাবা। এভাবে মধ্যবিত্তের প্রায় প্রতিটি চাহিদার বিপরীতে কোনো না কোনো কর দিতে হচ্ছে।

সংসারের দৈনন্দিন খরচ মিটিয়ে কিছু অর্থ সঞ্চয় করবেন সেখানেও দিতে হবে উৎসে কর। সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর উৎসে কর ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। ব্যাংকে সঞ্চয় করবেন, এর মুনাফার বিপরীতে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কর দিতে হবে। এছাড়া ব্যাংকের সার্ভিস চার্জের খড়গ তো রয়েছেই।

ব্যাংকে লেনদেন করবেন এর বিপরীতে হবে আবগারি শুল্ক। ব্যাংকের চেক বই ও বিভিন্ন ধরনের কার্ড (ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ডসহ অন্যান্য) সেবা নেবেন- এমন সব খাতেও রয়েছে চার্জ ও এর ওপর আরোপিত ভ্যাট। এমনকি ব্যাংকের বিভিন্ন সেবা নেয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে বিভিন্ন ধরনের চার্জ ও কর।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, মধ্যবিত্তের ওপর করের চাপ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এ করের বিপরীতে যদি তাদের নাগরিক সেবা দেয়া হয় তাহলে কর দিতে অনেকেই আপত্তি করবেন না। কিন্তু কর দিচ্ছেন, কিন্তু সেবা পাচ্ছেন না। এটা হতে পারে না। ভ্যাট ভোক্তারা যা দিচ্ছেন তাও সরকারের কোষাগারে যাচ্ছে না।

এছাড়া জমি বিক্রি করে যে পরিমাণ বাড়তি অর্থ পাওয়া যাবে, তার বিপরীতে দিতে হবে গেইন ট্যাক্স। শেয়ারবাজারে লেনদেনের বিপরীতে দিতে হয় প্রতি হাজারে ৩০ থেকে ৪০ পয়সা হারে কমিশন। শেয়ারবাজারে অর্জিত মুনাফা থেকে উৎসে কর কেটে রাখা হয়। ৫০ হাজার টাকার বেশি মুনাফা পেলে তার ওপর ১০ শতাংশ কর দিতে হবে।

সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে নিজের বাড়ি নির্মাণের স্বপ্ন দেখেন অনেক মধ্যবিত্ত। সেখানেও করের বোঝা বাড়ানো হয়েছে। এক টন রড কিনতে আগের চেয়ে এখন সাড়ে ৬ হাজার টাকা বেশি খরচ হবে। আর প্রতি ব্যাগ সিমেন্ট কিনতে অতিরিক্ত ৪২ টাকা খরচ করতে হবে। নির্মাণসাগ্রীর এ প্রধান দুই উপকরণের দাম বৃদ্ধির কারণে অনেক মধ্যবিত্তের নিজ বাড়ির স্বপ্ন অধরাই রয়ে যেতে পারে।

ক্ষুদ্র ব্যবসা করবেন? সেখানেও রয়েছে নানা ধরনের করের বোঝা। ঋণ নেবেন, তাতেও আছে নানা ধরনের ফি ও ভ্যাটের বোঝা। জমি বেচাকেনা করলে দিতে হবে টিআইএন। অর্থাৎ করের জালে ঢুকতে হবে। নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে বা পুরনো সংযোগের বিদ্যুৎ বিল দিতেও টিআইএন লাগবে।

বিভিন্ন শিল্পপণ্য ও কাঁচামাল আমদানিতে কর বাড়ানো হয়েছে। ফলে এগুলোর উৎপাদন খরচ যেমন বাড়বে, তেমনি ভোক্তাকে বাড়তি দামে পণ্য কিনতে হবে। এতে শুরুতে উদ্যোক্তাদের বাড়তি কর দিতে হলেও চূড়ান্ত করের চাপ মধ্যবিত্তকেও সামলাতে হবে।

রেস্তোরাঁয় খাবেন- এতেও ভ্যাটের ভার রয়েছে। এসি রেস্তোরাঁয় খেলে ১৫ শতাংশ এবং নন-এসি রেস্তোরাঁয় খেলে সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। শিশুদের নিয়ে বিনোদনের জন্য এমিউজমেন্ট পার্ক ও থিম পার্কে যাবেন, সেখানেও রয়েছে ভ্যাটের আঁচড়। এগুলোতে মোট খরচের সঙ্গে সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :




কররের জালে মধ্যবিত্ত

আপডেট সময় : ০৭:২৯:৩১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৮ জুলাই ২০১৯

সকালের সংবাদ;

একটি দেশের সমাজ বিনির্মাণে যেমন মধ্যবিত্ত বিশেষ ভূমিকা রাখে, তেমনি সময়ের প্রয়োজনে তারাই সমাজ পরিবর্তনে নেতৃত্ব দেয়। একই সঙ্গে রাষ্ট্রের আধুনিকায়নেও অগ্রভাবে থাকেন তারা। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে অর্থ জোগানের বড় অংশই আসে তাদের হাত থেকে। সেই মধ্যবিত্তকেই হরেকরকম বিচিত্র করের জালে বেঁধে ফেলা হয়েছে আষ্টেপৃষ্ঠে।

এমনভাবে কর কাঠামোর জাল বিস্তার করা হয়েছে যে, এর বেশির ভাগ ভার পড়েছে মধ্যবিত্ত ও চাকরিজীবীদের ওপর। ফলে একদিকে সামাজিক মর্যাদা রক্ষা করতে তাদের ওপর পড়ছে বাড়তি চাপ, অন্যদিকে জীবনযাত্রার ব্যয়ের হিসাব সংকুচিত করতে ব্যস্ত।

অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, যাদের দৈনিক আয় ১০ থেকে ৪০ ডলারের মধ্যেই, তারাই মধ্যবিত্ত। এ হিসাবে এদের বার্ষিক আয় সাড়ে ৩ লাখ থেকে ১৪ লাখ টাকার মধ্যে। তবে আর্থিক সক্ষমতার পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, সামাজিক মর্যাদা, মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক সুযোগ-সুবিধাকেও মানদণ্ডের আওতায় আনা হয়। ওই বিবেচনায় বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের সংখ্যা ৪ কোটির মতো।

জানা গেছে, মধ্যবিত্তদের হরেকরকমের বিচিত্র সব কর দিতে হয়। এর মধ্যে একই কর একাধিকবার দেয়ার নজিরও রয়েছে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই তাদের ওপর চেপেছে করের বোঝা। এর মধ্যে সরাসরি দিতে হয় আয়কর, উৎসে কর, আবগারি শুল্ক, ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক, কর্পোরেট কর, গেইন ট্যাক্স, সিটি কর্পোরেশনের ট্যাক্স। পরোক্ষভাবে দিতে হয়, আমদানি শুল্ক, আগাম কর, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক। এছাড়া নানা সেবা ও পণ্য ক্রয়ে আছে বিচিত্র ধরনের কর।

জীবনধারণের প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের বোঝা বইতে হবে এ শ্রেণীকে। চলতি অর্থবছরের ভ্যাটের প্রভাবে চিনি, ভোজ্যতেল, এলপি গ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যানবাহন, অনলাইনে কেনাকাটার ওপর ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। ফলে এগুলোতে খরচ বাড়বে।

এক কেজি চিনিতে আগে যেখানে ধনী-গরিব নির্বিশেষে ১৪ টাকা কর দিতে হতো, এখন সেখানে ২৩ টাকা কর দিতে হবে। ভোজ্যতেলেও কর দিতে হবে সব শ্রেণীর ভোক্তাকে। এক লিটার ভোজ্যতেলে সাড়ে ৯ টাকার পরিবর্তে এখন দিতে হবে সাড়ে ১৬ টাকা।

প্যাকেটজাত মসলাতেও কেজিপ্রতি ১০-১৫ টাকা কর দিতে হবে। রান্নায় ব্যবহৃত নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী এলপি গ্যাসেও করের বোঝা বাড়ানো হয়েছে। আগে যেখানে ১২ কেজির সিলিন্ডারে কর দিতে হতো ৯ টাকা, এখন সেখানে কর দিতে হবে ৪৪ টাকা।

সিটি গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক বিশ্বজিৎ সাহা যুগান্তরকে বলেন, বাজেটে গৃহীত পদক্ষেপের কারণে ভোজ্যতেল ও চিনিতে ভোক্তাকে বেশি হারে কর দিতে হবে। এক কেজি চিনিতে ২৩ টাকা ও এক লিটার তেলে সাড়ে ১৬ টাকা কর দিতে হবে। আগে যা ছিল যথাক্রমে ১৪ ও সাড়ে ৯ টাকা।

বাজেটে মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপর আরও ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ফলে আগের চেয়ে মোবাইল ফোনে কথা বলার ক্ষেত্রে গ্রাহকদের আরও ৫ শতাংশ বেশি অর্থ খরচ করতে হবে। অর্থাৎ আগে ১০০ টাকা লোড করে যতক্ষণ মোবাইল ফোনে কথা বলা যেত, নতুন বাজেটের ফলে একই সময় কথা বলতে লাগবে ১০৫ টাকা। আগে মোবাইল ফোনে কথা বলার ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ও ২ শতাংশ সারচার্জ আরোপিত ছিল। সব মিলে এ খাতে করের হার ছিল ২২ শতাংশ।

অর্থাৎ ১০০ টাকা মোবাইলে ভরলে কথা বলার সময় ২২ টাকা কর হিসাবে কেটে নেয়া হতো। নতুন বাজেটে মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপর আরও ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করায় এর হার বেড়ে ১০ শতাংশে দাঁড়াচ্ছে। ভ্যাটের হার অপরিবর্তিত রয়েছে। এতে এ খাতে মোট করের হার দাঁড়াবে ২৭ শতাংশ। অর্থাৎ মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপর এখন ২৭ টাকা কর দিতে হবে।

এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, সমাজের বা রাষ্ট্রের বাঁক পরিবর্তনে মধ্যবিত্তই বড় ভূমিকা রাখে। তাদের যদি সুযোগ দেয়া যায়, তারা দেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিতে পারে। কিন্তু তাদের যদি কর ও চার্জের ফাঁদে ফেলে দিয়ে প্রতিদিনের খরচ মেটানোর জন্যই চিন্তা করতে হয়, তাহলে তারা দেশ-সমাজকে নিয়ে চিন্তা করতে পারবে না। এ কারণে তাদের সামাজিক ও আর্থিক স্বস্তি দিয়ে চিন্তার সুযোগ দিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের সামাজিক ও স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনগুলোতে প্রধান ভূমিকা রেখেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। তাদের বেশির ভাগই মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। দেশের সামাজিক ও গবেষণার মাধ্যমে যে অর্জন তার সবগুলোই এদের হাত ধরে এসেছে।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, একটু সাজগোজ করে চলাফেরা করতেও মধ্যবিত্তকে অতিরিক্ত ভ্যাট দিতে হবে। ভালো মানের ব্র্যান্ডেড এবং নন-ব্র্যান্ডেড পোশাকের ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে। অর্থাৎ ভ্যাটের কারণে পোশাকের মূল্য বাড়বে। অতি গরমে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরাতে এখন এসি বাসের চাহিদা বাড়ছে। সেখানেও টিকিট মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। সারা দিন কর্মব্যস্ত থাকার পর সংসারের নিত্যপণ্য, ইলেকট্রনিক সামগ্রী ও পোশাক-পরিচ্ছদ কিনতে অনলাইন কেনাকাটার ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। সেখানেও বাজেটে নতুন করে ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে।

অর্থাৎ অনলাইনে কেনাকাটার খরচ বাড়বে। অবসর সময়ে বাইরে ঘুরতে গেলে আইসক্রিম কিনতেও খরচ বাড়বে। কেননা বাজেটে আইসক্রিমের ওপর নতুন করে ৩ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বসানোয় সব বয়সীদের প্রিয় এ খাবারটির দাম বাড়বে। মিষ্টি কেনায় যথারীতি আগের নিয়মে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। ঢাকা শহরের গণপরিবহন ও যানজটের অবস্থা বিবেচনা করে অনেক মধ্যবিত্ত ব্যক্তিগত গাড়ি বা মোটরসাইকেল কিনেছেন বা কিনতে চান। সেখানে করের বোঝা বাড়ানো হয়েছে। এ ধরনের যানবাহন রেজিস্ট্রেশনে ভ্যাট-ট্যাক্সের পাশাপাশি ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বসানো হয়েছে। অর্থাৎ গাড়ি-মোটরসাইকেল রেজিস্ট্রেশনে ১০ শতাংশ খরচ বাড়বে।

এ তো গেল জীবনধারণের খরচের ওপর কর বৃদ্ধির চিত্র। এর বাইরে মধ্যবিত্তকে আরও কর দিতে হবে। প্রতি বছর মূল্যস্ফীতি হলেও বাজেটে ব্যক্তিশ্রেণীর করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হয়নি। মোটা দাগে মূল বেতন ও বোনাস মিলিয়ে বার্ষিক আয় আড়াই লাখ টাকা পার হলেই বছরে ন্যূনতম ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা আয়কর দিতে হবে।

নিয়োগকারী কোম্পানি বেতন থেকে তা উৎসে কর হিসেবে কেটে রাখবে। অর্থাৎ আয়কর না দিয়ে রেহাই নেই। একটু উচ্চ পদে চাকরি করলে করের হার বাড়বে।

বিয়ে বা জন্মদিনের অনুষ্ঠান করলে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। সিনেমা দেখবেন সেখানে আছে প্রমোদকর। বিদেশে ঘুরতে যাবেন সেখানে দিতে হবে ট্রাভেল ট্যাক্স। সাজগোজ করতে বিউটি পার্লারে যাবেন সেখানেও দিতে হবে ভ্যাট। উচ্চতর পড়াশোনার জন্য বই কিনবেন সেখানে আছে ভ্যাটের থাবা। এভাবে মধ্যবিত্তের প্রায় প্রতিটি চাহিদার বিপরীতে কোনো না কোনো কর দিতে হচ্ছে।

সংসারের দৈনন্দিন খরচ মিটিয়ে কিছু অর্থ সঞ্চয় করবেন সেখানেও দিতে হবে উৎসে কর। সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর উৎসে কর ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। ব্যাংকে সঞ্চয় করবেন, এর মুনাফার বিপরীতে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কর দিতে হবে। এছাড়া ব্যাংকের সার্ভিস চার্জের খড়গ তো রয়েছেই।

ব্যাংকে লেনদেন করবেন এর বিপরীতে হবে আবগারি শুল্ক। ব্যাংকের চেক বই ও বিভিন্ন ধরনের কার্ড (ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ডসহ অন্যান্য) সেবা নেবেন- এমন সব খাতেও রয়েছে চার্জ ও এর ওপর আরোপিত ভ্যাট। এমনকি ব্যাংকের বিভিন্ন সেবা নেয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে বিভিন্ন ধরনের চার্জ ও কর।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, মধ্যবিত্তের ওপর করের চাপ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এ করের বিপরীতে যদি তাদের নাগরিক সেবা দেয়া হয় তাহলে কর দিতে অনেকেই আপত্তি করবেন না। কিন্তু কর দিচ্ছেন, কিন্তু সেবা পাচ্ছেন না। এটা হতে পারে না। ভ্যাট ভোক্তারা যা দিচ্ছেন তাও সরকারের কোষাগারে যাচ্ছে না।

এছাড়া জমি বিক্রি করে যে পরিমাণ বাড়তি অর্থ পাওয়া যাবে, তার বিপরীতে দিতে হবে গেইন ট্যাক্স। শেয়ারবাজারে লেনদেনের বিপরীতে দিতে হয় প্রতি হাজারে ৩০ থেকে ৪০ পয়সা হারে কমিশন। শেয়ারবাজারে অর্জিত মুনাফা থেকে উৎসে কর কেটে রাখা হয়। ৫০ হাজার টাকার বেশি মুনাফা পেলে তার ওপর ১০ শতাংশ কর দিতে হবে।

সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে নিজের বাড়ি নির্মাণের স্বপ্ন দেখেন অনেক মধ্যবিত্ত। সেখানেও করের বোঝা বাড়ানো হয়েছে। এক টন রড কিনতে আগের চেয়ে এখন সাড়ে ৬ হাজার টাকা বেশি খরচ হবে। আর প্রতি ব্যাগ সিমেন্ট কিনতে অতিরিক্ত ৪২ টাকা খরচ করতে হবে। নির্মাণসাগ্রীর এ প্রধান দুই উপকরণের দাম বৃদ্ধির কারণে অনেক মধ্যবিত্তের নিজ বাড়ির স্বপ্ন অধরাই রয়ে যেতে পারে।

ক্ষুদ্র ব্যবসা করবেন? সেখানেও রয়েছে নানা ধরনের করের বোঝা। ঋণ নেবেন, তাতেও আছে নানা ধরনের ফি ও ভ্যাটের বোঝা। জমি বেচাকেনা করলে দিতে হবে টিআইএন। অর্থাৎ করের জালে ঢুকতে হবে। নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে বা পুরনো সংযোগের বিদ্যুৎ বিল দিতেও টিআইএন লাগবে।

বিভিন্ন শিল্পপণ্য ও কাঁচামাল আমদানিতে কর বাড়ানো হয়েছে। ফলে এগুলোর উৎপাদন খরচ যেমন বাড়বে, তেমনি ভোক্তাকে বাড়তি দামে পণ্য কিনতে হবে। এতে শুরুতে উদ্যোক্তাদের বাড়তি কর দিতে হলেও চূড়ান্ত করের চাপ মধ্যবিত্তকেও সামলাতে হবে।

রেস্তোরাঁয় খাবেন- এতেও ভ্যাটের ভার রয়েছে। এসি রেস্তোরাঁয় খেলে ১৫ শতাংশ এবং নন-এসি রেস্তোরাঁয় খেলে সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। শিশুদের নিয়ে বিনোদনের জন্য এমিউজমেন্ট পার্ক ও থিম পার্কে যাবেন, সেখানেও রয়েছে ভ্যাটের আঁচড়। এগুলোতে মোট খরচের সঙ্গে সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে।