বরগুনা প্রতিনিধিঃ
বরগুনা শহরে প্রকাশ্য রাস্তায় শাহনেওয়াজ রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনার তদন্তের মধ্যেই আলোচনায় এসেছে ফেইসবুক মেসেঞ্জারে বন্ড 007 নামে একটি গ্রুপের কিছু কথোপকথন।
বলা হচ্ছে, ওই ফেইসবুক গ্রুপেই রিফাতকে হত্যার পরিকল্পনা সাজানো হয়। এই গ্রুপের নামকরণ হয়েছে জেমস বন্ডের কোড নম্বর ‘জিরো জিরো সেভেন’ এর সঙ্গে মিল রেখে। আর এই গ্রুপের নেতা হলেন রিফাত হত্যার হোতা নয়ন বন্ড, যাকে পুলিশ দুই দিনেও গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
পরিবারের দেওয়া নাম সাব্বির আহম্মেদ, ডাক নাম নয়ন। নিজেকে জেমস বন্ড ভাবতে ভালোবাসেন বলে ২৫ বছর বয়সী ওই যুবক নিজের নাম নিয়েছেন নয়ন বন্ড। ওই নামেই তিনি বরগুনা শহরে পরিচিত। তার মোটর সাইকেলে, বাড়ির দেয়ালে- নানা জায়গায় লেখা রয়েছে বন্ডের সেই 007 কোড নামটি।
বরগুনা সদর থানার ওসি আবির মোহাম্মদ হোসেন জানান, পৌর শহরের বিকেবি রোডের ধানসিঁড়ি এলাকার আবু বক্কর সিদ্দিকীর ছেলে নয়নের বিরুদ্ধে মাদক কেনাবেচা, চুরি, ছিনতাই, হামলা, সন্ত্রাস সৃষ্টিসহ নানা অভিযোগে অন্তত আটটি মামলা রয়েছে।
নয়নের গড়ে তোলা গ্যাং 007 শহরের কলেজ রোড, ডিকেপি, দীঘির পাড়, কেজিস্কুল ও ধানসিঁড়ি এলাকায় নানা ধরনের অপরাধ চালিয়ে আসছিল বলে স্থানীয়দের ভাষ্য।
তারা বলছেন, ওই গ্রুপে নয়নের প্রধান সহযোগী হলেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের ভায়রার ছেলে রিফাত ফরাজী।
রিফাত ফরাজীর পাশাপাশি তার ভাই রিশান ফরাজীকেও পুলিশ খুঁজছে বলে ওসি আবির মোহাম্মদ হোসেন জানান।
ওই মেসেঞ্জার গ্রুপের কথোপকথনের স্ক্রিনশটে দেখা যায়, রিফাত নামে একজন লিখেছেন-‘007এর সবাইরে কলেজে দেখতে চাই’। সাগর নামের একটি আইডি থেকে ওই পোস্ট কপি করে ‘ভিক্টরি’ ইমোটিকন দেখানো হয়।
রিফাত ফরাজীকে ট্যাগ করে মোহাম্মদ নামের একটি আইডি থেকে জানতে চাওয়া হয়- কখন কলেজে থাকতে হবে। রিফাত উত্তর দেন- ৯টার দিকে। পরে রিফাত একটি রামদায়ের ছবি পোস্ট করে সেটি নিয়ে আসতে বলেন।
উত্তরে মোহাম্মদ সেটি নিয়ে আসবেন বলে জানান। পরে হকিস্টিক আনা এবং কালো শার্ট পরে কলেজে যাওয়ার বিষয়েও কথা হয় সেখানে।
ফেইসবুক মেসেঞ্জারের ওই কথোপকথনের বিষয়ে প্রশ্ন করলে বরগুনার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,“মেসেঞ্জারের বিষয়টা ঠিক আছে। তবে এ নিয়ে আমি এখন কিছু বলব না।”
আসামিদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি শুধু এটুকু বলব, আমরা অপারেশনে আছি।”
বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে জেলা শহরের কলেজ রোডে রিফাত শরীফকে (২৩) স্ত্রীর সামনেই কুপিয়ে জখম করে একদল যুবক। বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে রিফাতের মৃত্যু হয়।
রিফাতের ওপর হামলার ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে শুরু হয় আলোচনা। সেখানে দেখা যায়, দুই যুবক রামদা হাতে রিফাতকে একের পর এক আঘাত করে চলেছে। আর তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি স্বামীকে বাঁচানোর জন্য হামলাকারীদের ঠেকানোর চেষ্টা করছেন।
বরগুনার সরকারি কলেজের ডিগ্রি প্রথম বর্ষের ছাত্রী মিন্নি হামলাকারী সবাইকে চিনতে না পারার কথা জানালেও নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজীর নাম বলেছেন।
দুই মাস আগে রিফাতকে বিয়ে করা মিন্নি বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, বিয়ের আগে থেকেই তাকে উত্ত্যক্ত করত, হুমকি দিত নয়ন। বিভিন্ন সময় পথেঘাটে হেনস্তাও করেছে।
ক্রোক এলাকার একজন বাসিন্দা জানান, গতবছর শেষের দিকে দীঘির পাড়ের একটি মেসে হামলা দিয়ে মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ ছিনতাই করে নয়নের বন্ড বাহিনী। পরে ওই মেসের বাসিন্দা ১৫ জন ছাত্র ভয়ে মেস ছেড়ে চলে যায়।
কেজিস্কুল এলাকার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, “চুরি, ছিনতাই, লুটপাটসহ এমন কোনো অপরাধ নাই যা নয়ন বন্ডের দল করেনি।
ক্রোক স্লুইজ গেইট এলাকার কাউন্সিলর শহীদুল ইসলাম নান্না বলেন, “ছাত্রদের মেস থেকে মোবাইল ছিনতাইয়ের ঘটনার সালিশের জন্য ডাকায় রিফাত ফারজীর বাবা দুলাল ফরাজীর সামনেই আমার ওপর ওরা হামলার চেষ্টা করে। আমি তখনকার পুলিশ সুপারসহ রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারস্থ হয়েছিলাম। কিন্তু ওদের কিছুই হয়নি।”
স্ত্রীর বর্ণনায় রিফাত হত্যাকাণ্ডঃ
রিফাত হত্যার ঘটনায় তার বাবা দুলাল শরীফ বৃহস্পতিবার সকালে ১২ জনকে আসামি করে বরগুনা থানায় একটি মামলা করেন। অভিযানে নেমে পুলিশ এজাহারভুক্ত আসামি চন্দন, হাসান এবং সন্দেহভাজন নাজমুল হাসানকে গ্রেপ্তার করে। শুক্রবার তাদের আদালতে হাজির করা হলে বিচারক রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দুলাল বলেন, “দুই দিন পার হলেও মূল আসামিরা ধরা পড়েনি। আমি আশা করি শিগগিরই তারা ধরা পড়বে, আমি আমার ছেলের হত্যার ন্যয়বিচার পাব।”
রিফাত হত্যায় জড়িত ১৩ জনকে পুলিশ ইতোমধ্যে শনাক্ত করেছে জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল শুক্রবার ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশ কাউকে ছাড় দেবে না।
আসামিদের কেউ যাতে পালিয়ে বিদেশে যেতে না পারে, সেজন্য দেশের সব বিমানবন্দর, স্থলবন্দর ও নৌ-বন্দরে সতর্কতা জারি করা হয়েছে বলে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) সোহেল রানা জানান।
বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি শফিকুল ইসলাম বলেন, “আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালিয়ে আসছি। শুধু বরগুনা নয়, সারা দেশের পুলিশকে অপরাধীদের ব্যাপারে তথ্য দেয়া হয়েছে। পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে বিষয়টি মনিটরিং করা হচ্ছে। আমরা আশা করি শিগগিরই আসামিদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে।”