হাফিজুর রাহমান শফিকঃ রাজধানীর সড়কজুড়ে দিন দিন দৃশ্যমান হচ্ছে স্বপ্নের মেট্রোরেল। এগিয়ে চলছে দেশের বহুল আলোচিত প্রথম এই প্রকল্প। রাজধানীর সড়কজুড়ে দৃশ্যমান হচ্ছে স্বপ্নের মেট্রোরেল। উত্তরা দিয়াবাড়ি হয়ে মিরপুর, শেওড়াপাড়া ও আগারগাঁওয়ে সব পাইলিংয়ের কাজ শেষ।মেট্রোরেলের প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিলো পাইলিং সব চ্যালেঞ্জ জয় করে এগিয়ে যাচ্ছে অধিকাংশ পিলারের উপরে স্প্যান বসানো। চলছে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রকল্প চালুর শেষ দিকের কাজ।
পাইলিং ও পিলারের উপর স্বপ্নের মেট্রোরেলে প্রকল্পের স্প্যান বসানোসহ কাজের অগ্রগতি এলাকা ৫০/৫৫ শতাংশ। মিরপুর, শেওড়াপাড়ায় পিলার বসানোর কাজ প্রায় শেষ হয়েছে প্রায়। আবার কোথাও একটু কম হয়েছে। সব মিলিয়ে স্প্যান বসানোসহ মেট্রোরেলের কাজের অগ্রগতি প্রায় ৫৫ ভাগ।উত্তরা দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও রুটে চলতি বছরের মে পর্যন্ত ৪৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ প্রকল্পের কাজ নির্দিষ্ট সময়েই সম্পন্ন হবে বলে দাবি করছে মেট্রোরেল প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)।
মেট্রোরেল প্রকল্পের পরিচালক আফতাব উদ্দিন তালুকদার সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, উত্তরা দিয়াবাড়িতে পিলারের উপর দৃশ্যমান হচ্ছে এ প্রকল্পের স্বপ্নের স্প্যান।সব চেয়ে দৃশ্যমান যে কাজ দেখা যাবে তা হলো মেট্রোরেলের ১৬টি স্টেশন। এই স্টেশনগুলো সড়কের ওপর নির্মাণ করা হবে। আর ট্রেনে প্রতি ঘণ্টায় সড়কের উভয় দিক থেকে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টের ৬০ হাজার যাত্রী চলাচল করতে পারবে। মেট্রোরেলের পিলারে স্প্যানের উপর বসবে মেট্রোরেল ট্র্যাক। এই ট্রাকে থাকবে না পাথর ও কাঠের স্লিপার। কংকিটের স্প্যানের উপর বসবে মেট্রোরেল ট্র্যাক।
জানা গেছে, ২০১২ সালে শুরু হওয়া রাজধানীর এই মেগাপ্রকল্পের নির্মাণ কাজ বর্তমানে কিছুটা সংশোধিত পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে চলছে। সে লক্ষেই ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে স্বপ্নের মেট্রোরেল। উত্তরা দিয়াবাড়ির পর মিরপুর, শেওড়াপাড়া ও আগারগাঁওয়ে দৃশ্যমান হলো ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট বা মেট্রোরেলের কাজ। পিলারের উপর দৃশ্যমান হয়েছে মেগা প্রকল্পের স্প্যান। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের উড়ালপথ এবং স্টেশন নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে চলতি বছরের (২০১৯ সাল) ৩০ ডিসেম্বর।
প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী (পূর্ত) আবদুল বাকি মিয়া সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, প্রকল্পের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে।দেশের পাশাপাশি জাপানে চলছে মেট্রোরেল কোচ নির্মাণ কাজ। মেট্রোরেলে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব কাজই চ্যালেঞ্জিং। তারপরও প্রধান চ্যালেঞ্জ পাইলিংয়ের কাজ ইতোমধেই সফলভাবে সম্পন্ন করেছি।তিনি আরো বলেন, মেট্রোরেল প্রকল্প এলাকায় দেখলেই সবাই বুঝতে পারছেন প্রতিনিয়তই কাজের অগ্রগতি হচ্ছে। একের পর এক স্প্যান পিলারে বসছে। বর্তমানে স্টেশন নির্মাণের কাজও দ্রতু এগিয়ে যাচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে নির্দিষ্ট সময়েই প্রকল্পটির কাজ সম্পন্ন করতে পারবো।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) সূত্র জানায়, ৮টি প্যাকেজের (এমআরটি লাইন-৬) প্রকল্পের উত্তরা অংশে কাজ হচ্ছে ৩ নম্বর প্যাকেজের আওতায়। এর অধীনে উত্তরা থেকে পল্লবী পর্যন্ত ৬ কিলোমিটারের কাজ চলছে। উত্তরায় দুটি পিলারের সম্পূর্ণ কাজ শেষে এর উপর গত ৭ এপ্রিল স্প্যান তোলা হয়েছে।
প্রকল্পের সর্বশেষ অগ্রগতিঃ
>> প্যাকেজ-১, ডিপো এলাকার ভূমি উন্নয়নঃ
প্যাকেজ-১ এর আওতায় এই কাজ। বাস্তব কাজ ২০১৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে নির্ধারিত সময়ের ০৯ (নয়) মাস পূর্বে গত ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি সমাপ্ত হয়েছে। বাস্তব অগ্রগতি শতভাগ।এগিয়ে যাচ্ছে মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজ।
>> প্যাকেজ-২ঃ
প্যাকেজ-২ এর আওতায় চলমান। বাস্তব কাজ ২০১৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর শুরু হয়েছে। সংশোধিত কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথম পর্যায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এলাকার পূর্ত কাজ আগামী ৩০ জুন শেষ হবে। বাস্তব অগ্রগতি ৩০ শতাংশ।
>> প্যাকেজ-৩ ও প্যাকেজ-৪:
প্যাকেজ-৩ ও প্যাকেজ-৪ এর আওতায়। মোট দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৭৩। এই অংশে মোট ৯টি স্টেশন নির্মাণ করা হবে। দুটি প্যাকেজের কাজ ২০১৭ সালের ১ আগস্ট শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রকল্প স্থানান্তর, চেকবোরিং, টেস্ট পাইল ও মূল পাইল সম্পন্ন হয়েছে। মোট ৭৬৬টি পাইল ক্যাপের মধ্যে ৬০০টি পাইল ক্যাপ, ৩৯৩টি পিয়ার হেডের মধ্যে ৩০৩টি পিয়ার হেডের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়াও ১০৮টি আই-গার্ডারের মধ্যে ৯৬টি আই-গার্ডার, ৫ হাজার ১৪৯টি প্রিকাস্ট সেগম্যান্ট কাস্টিংয়ের মধ্যে ২ হাজার ৫৪৯টি প্রিকাস্ট সেগম্যান্ট কাস্টিং নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। ৩ হাজার ৯৩০ মিটার ভায়াডাক্ট দৃশ্যমান হয়েছে।
>> প্যাকেজ-৫:
এই প্যাকেজের আওতায় আগারগাঁও থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত ৩ দশমিক ১৯৫ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট ও ৩টি স্টেশন নির্মাণকাজ চলমান। এ প্যাকেজের বাস্তব কাজ ২০১৮ সালের ১ আগস্ট শুরু হয়েছে। বর্তমানে এ অংশে পরিষেবা স্থানান্তর, চেকবোরিং ও টেস্ট পাইল সম্পন্ন হয়েছে। মূল পাইল নির্মাণের জন্য ২১০টি ট্রায়াল পিটের মধ্যে ১০৮টি ট্রায়াল পিট এবং ৪৫২টি বোরড পাইলের মধ্যে ৬৭ টি বোরড পাইল সম্পন্ন হয়েছে। জাপানের সব থেকে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ১০৪টি স্ক্রু পাইল ফাউন্ডেশনের মধ্যে ১২টি স্ক্রু পাইল ফাউন্ডেশন সম্পন্ন করা হয়েছে। বাস্তব অগ্রগতি ৭ শতাংশ
>> প্যাকেজ-৬:
কারওয়ান বাজার থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ৪ দশমিক ৯২ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট ও ৪টি স্টেশন নির্মাণকাজ চলমান। এ প্যাকেজের বাস্তব কাজ ২০১৮ সালের ১ আগস্ট শুরু করা হয়েছে। বর্তমানে এ অংশে পরিষেবা স্থানান্তর, চেকবোরিং ও টেস্ট পাইল সম্পন্ন হয়েছে। মূল পাইল নির্মাণের জন্য ১৬০টি ট্রায়াল পিটের মধ্যে ৭৯টি ট্রায়াল পিট এবং ৬৫২টি বোরড পাইলের মধ্যে ১৪৪ টি বোরড পাইল সম্পন্ন হয়েছে। জাপানের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ১৩৮টি স্ক্রু পাইল ফাউন্ডেশনের মধ্যে ৩৬টি স্ক্রু পাইল ফাউন্ডেশন সম্পন্ন হয়েছে। বাস্তব অগ্রগতি ৭ শতাংশ।
>> প্যাকেজ-৭, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড মেকানিক্যাল সিস্টেমঃ
প্যাকেজ-৭ এর আওতায় ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড মেকানিক্যাল সিস্টেম সরবরাহ ও নির্মাণ কাজ ২০১৮ সালের ১১ জুলাই শুরু হয়েছে। ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড মেকানিক্যাল সিস্টেম সরবরাহ ও নির্মাণ কাজের আওতায় ডেভিনিটিভ নকশা সম্পন্ন হয়েছে। হাইভোল্টেজ ফিডার ক্যাবল স্থাপনের জন্য টেস্ট পিট খনন, উত্তরা রিসিভিং সাব স্টেশন (আরএসএস) নির্মাণ এবং টঙ্গি ও মানিকনগর গ্রিড সাবস্টেশনে বে নির্মাণের কাজ চলছে। রেল ও ৩৩ কেভি ক্যাবলস, ১৩২ কেভি ক্যাবলস জাহাজিকরণ করা হয়েছে। ব্যালাস্টপ্রি শিপমেন্ট ইন্সপেকশন (পিএসআই) সম্পন্ন হয়েছে। এসব কাজের বাস্তব অগ্রগতি সাড়ে ৭ শতাংশ।
>> প্যাকেজ-৮ এর আওতায় রেল কোচ ও ডিপো ইকুইপমেন্ট সংগ্রগের কাজ এগিয়ে চলেছে। এ প্যাকেজের বাস্তব কাজ ২০১৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর শুরু হয়েছে। বর্তমানে রোলিং স্টক (রেল কোচ) ও ডিপো ইকুইপমেন্ট সংগ্রহের আওতায় সম্পূর্ণ নকশা সম্পন্ন হয়েছে। জাপানে মেট্রোরেলের মকআপ রিভিউ সম্পন্ন হয়েছে। বগি নির্মাণের কাজ চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি জাপানে শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেলের এয়ার কন্ডিশন, ব্রেক ওট্রেন ইনফরমেশন চূড়ান্ত করা হয়েছে। এই প্যাকেজের অগ্রগতি ১৩ দশমিক ১৫ শতাংশ।
ঢাকার যানজট নিরসন ও নগরবাসীর যাতায়াত আরামদায়ক, দ্রুততর ও নির্বিঘ্ন করতে ২০১২ সালে গৃহীত হয় মেট্রোরেল প্রকল্প। এ প্রকল্পের দৈর্ঘ্য হবে উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার। এ এলাকায় বসবাসকারী লাখো নগরবাসী মেট্রোরেল ব্যবহার করে গন্তব্যে যাতায়াত করতে পারবেন। প্রকল্পে ২৪ সেট ট্রেন চলাচল করবে। প্রত্যেকটি ট্রেনে থাকবে ৬টি করে কার। ঘণ্টায় ১শ’ কিলোমিটার বেগে ছুটবে যাত্রী নিয়ে। উভয়দিক থেকে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন বহনে সক্ষমতা থাকবে মেট্রোরেলের। প্রকল্পের মোট ব্যয়
মেট্রোরেল প্রকল্পের ব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) খান মো. মিজানুল ইসলাম রবিবার দুপুরে সকালের সংবাদকে বলেন, দ্রুত এগিয়ে চলেছে মেট্রোরেলের কাজ। স্টেশন নির্মাণকাজও দ্রুত হচ্ছে। যেখানে গ্যাপ রয়েছে সেখানে শুধু স্টেশন নির্মাণ করা হবে। পিলার নির্মাণকাজ শেষ হলেই জাপান থেকে রেডিমেট স্টিলের স্টেশন চলে আসবে। আমরা শুধু পিলারের ওপরে স্টিলের রেডিমেড স্টেশন সেট বসিয়ে দেব।আর এই কর্মযজ্ঞ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই কোচে তৈরির কাজ শেষ হয়ে যাবে। বর্ধিত যে সময় দেওয়া হয়েছে তার মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শেষ করার বিষয়ে আমরা শতভাগ আশাবাদী।
প্রসঙ্গত, রাজধানী ঢাকার অসহনীয় যানজট নিরসন ও নগরবাসীর যাতায়াত আরামদায়ক, দ্রুততর ও নির্বিঘ্ন করতে ২০১২ সালে গৃহীত হয় এই মেট্রোরেল প্রকল্প। এ প্রকল্পের দৈর্ঘ্য হবে উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার। প্রকল্পে ২৪ সেট ট্রেন চলাচল করবে। প্রত্যেকটি ট্রেনে থাকবে ৬টি করে কার। ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার বেগে চলবে যাত্রী নিয়ে কোচগুলো। উভয় দিক থেকে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন বহনে সক্ষমতা থাকবে মেট্রোরেলের। প্রকল্পের মোট ব্যয় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার মধ্যে প্রকল্প সাহায্য হিসেবে জাইকা ঋণ দিচ্ছে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।