উগান্ডার প্রমোদতরী ট্র্যাজেডি
- আপডেট সময় : ০১:৫০:০৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৪৬ বার পড়া হয়েছে
আনন্দ-উল্লাসের উদ্দেশ্য রওনা হওয়া উগান্ডার ‘পার্টি বোট’ এমভি টেম্পলার লেক ভিক্টোরিয়াতে ডুবে যায়। নৌকাডুবির ঘটনায় বেঁচে ফিরে আসা একজন যাত্রী তাশোবিয়া এনসুবুগা সেদিনের স্মৃতিচারণ করে বলছিলেন, ‘ডিজে (ডিস্ক জকি) আমাদের বিরক্ত করে যাচ্ছিল, বারবার ‘নৌকার ভারসাম্য’ রক্ষা করতে বলছিল। একটা সুন্দর গান বেজে উঠবে আর তখনই আপনাকে শুনতে হবে নৌকার ভারসাম্য রক্ষার করুন।’
ততক্ষণে নৌকার সবকিছু যে ঠিকঠাক নেই সেটা বুঝে গিয়েছিলেন তিনিও। এরপর তাদের নৌকাটি উপকূল থেকে ২০০ মিটার দূরে ডুবে যায়।
তাশোবিয়া এনসুবুগা তিন সন্তানের মা। তার ভাগ্য ভালো যে তিনি ও তার বোন জীবিত ফিরে আসতে পেরেছেন। কিন্তু এই নৌ-দুর্ঘটনায় হতভাগ্য ৩০ জন নিশ্চিত মৃত্যুর কবলে পড়েছেন।
এনসুবুগা এবং তার বোন এস্থার বাথাই সম্প্রতি বেঁচে যাওয়া আরও চারজনের সঙ্গে রাজধানী কাম্পালায় দেখা করেন। এর হলেন প্রিন্স আর্নল্ড সিম্বোয়া, ব্রায়ান জেজুঙ্কো, শারিফা এমবাটুডে এবং ফ্রান্সিস এসসেনকেজি।
একটা বিষয়ে এই ছয়জনই একমত আর সেটা হল সেদিন এমভি টেম্পলার-এ তাদের পার্টি দারুণ জমে উঠেছিল।
পেশায় মার্কেটিং ম্যানেজার তরুণ জেজুঙ্কো। বুগুন্ডার রাজার ছোটভাই প্রিন্স ডেভিড ওয়াসাজ্জা ব্যক্তিগতভাবে নিমন্ত্রণ জানালে তাতে সাড়া দিয়ে ওই প্রমোদ ভ্রমণের নৌকায় উঠেছিলেন তিনি।
জেজুঙ্কো বলেন, ‘সেখানে তিনটি গ্রুপের লোকজন ছিল। বুগুন্ডা রাজ্যের লোকজনের একটি গ্রুপ, ব্যবসায়ীদের একটি গ্রুপ এবং রাজকীয় পরিবারের একটি দল।’
আর এমবাটুডে একজন তরুণ নারী উদ্যোক্তা। চীন থেকে গহনা এনে বিক্রি করাই তার ব্যবসা। তিনি নৌকা ভ্রমণ পছন্দ করেন জেনে এক বন্ধু তাকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন।
ওই নৌকার আরোহীদেরকে বলা হয়েছিল তারা কাম্পালার কেকে বিচ থেকে স্থানীয় সময় ১১টার দিকে ছেড়ে যাবে, কে পাম বিচের উদ্দেশ্যে ১২ কিলোমিটার যাত্রা করবে এবং তারপর সন্ধ্যে নাগাদ রাজধানীতে ফিরে আসবে। কিন্তু নৌকাটি ছাড়তে দেরি হয়। তবে ছাড়তে দেরি হলেও লোকজনকে দমাতে পারেনি এবং ততক্ষণে কেকে বিচেই পুরো দমে পার্টি শুরু হয়ে গেছে। হুইস্কিসহ অন্যান্য পানীয় এবং খাবার পরিবেশন চলতে থাকে সম্পূর্ণ বিনে পয়সায়।
কেউ কেউ যদিও দেরি থেকে অন্য কোন নৌকা ভাড়ার কথা বলছিলেন কিংবা নিজেরা এই ট্রিপ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা-বার্তা বলছিলেন, তবে যখন সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা পর অবশেষে এমভি টেম্পলার যখন ইঞ্জিন চালু করলো তখন সবাই চেঁচিয়ে উল্লাস করতে শুরু করে দিল।
এমবাটুডে বলেন, ‘এটা ছিল রোমাঞ্চকর এক মুহূর্ত। আমরা খুবই উত্তেজিত ছিলাম। সবাই চেঁচাচ্ছিল চলো যাই, চলো যাই বলে।’
তবে কেউ জানতো না সঠিকভাবে যে ঠিক কতজন নৌকায় উঠেছে। এসসেনকেজি যতদূর মনে করতে পারেন, আয়োজকদের একজন ৯০ জনের মত অতিথি নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন।
নৌকার ভেতর ডিজে একটা সময় ফুর্তিবাজদের উদ্দেশ্য করে বলে ওঠেন ‘নৌকার ভারসাম্য ঠিক রাখুন’। তার এই চিৎকার অনেককে কেবল বিরক্তই করেনি, বরং মিউজিকের সঙ্গে সঙ্গে ছন্দময় আবহতে রূপ দিয়েছে।
সমস্যা যেটা ছিল তা হলো- অনেকেই জানতো না যে আসলে কোথায় দাঁড়ালে ভারসাম্য ঠিক থাকবে। অথবা তারা এতটাই মদ্যপ হয়ে গিয়েছিল যে এই নির্দেশনার দিকে মনোযোগ দেয়ার অবস্থা তাদের ছিল না।
একটা সময় এনসুবুগা এবং বাথাই লক্ষ্য করলেন নৌকার ভেতর পানি উঠে তাদের ব্যাগ ভিজে যাচ্ছে। দুইবার ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর দুজন যুবক মিলে তা সচল রাখার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। এরপর মিউজিক বন্ধ হয়ে যায় এবং তারপর বন্ধ হয়ে যায় বাতি। যদিও তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে কিন্তু তবুও কার মাঝে তেমন ভয়-ভীতির চিহ্ন ছিল না। এমভি টেম্পলার ছিল বেশ পুরনো এবং ভঙ্গুর ধরনের। এরপর অন্ধকার নেমে আসে। এমবাটুডে পৌনে আটটার দিকে শেষবারের মত তার ফোনের দিকে তাকান। তখন দুজন পুরুষ নৌকা থেকে পানি সেঁচে বাইরে ফেলছিলেন। তারা তাদের কাজের সুবিধার জন্য তাকে ফোনটি রেখে দিতে বলেন। এরপর নৌকাটি তীরের দিকে জরুরি প্রত্যাবর্তনের জন্য ঘুরে যায়।
ডেকের দিকের দরজা খোলা থাকায় সেসময় নৌকার বেশিরভাগ অংশেই পানি ঢুকে যায় এবং ঢেউগুলো আরও ভয়ঙ্কর ও উন্মত্ত হয়ে ওঠে।
এমবাটুডে’র মোবাইলে এইসময় একটি ফোন আসে। কিন্তু তিনি তা রিসিভ করলেন না। ‘যখনই আমি ফোনটি ব্যাগের ভেতর রেখে দিলাম তখনই নৌকাটি পানিতে আছড়ে পড়লো।’
যখন সেটি উল্টে গেল তখন ‘বুফ’ শব্দ হলো। এবং সবাই দেখলো যে, নৌকাটি একদিকে কাত হতে কেবল কয়েক সেকেন্ড সময় নিল।
প্রিন্স আর্নল্ড স্বীকার করেন যে তিনি এতটাই মদ্যপ হয়ে গিয়েছিলেন যে সাঁতার কাটা সম্ভব ছিল না। নিজের মনকে নিজেই বললেন যে সাঁতার কাটবেন না তিনি। নৌকার একপাশের কাঠ ধরে ঝুলে থাকলেন তিনি। কিন্তু মাথা তুলে রাখতে পারছিলেন না। কোনক্রমে এক-একবার মাথা তুলে নিশ্বাস নিচ্ছিলেন। তিনি বলেন তৃতীয়বার যখন মাথা তুললেন, ততক্ষণে লোকজনের চেঁচামেচি কমে যেতে শুরু করেছে অর্থাৎ অনেকেই তখন ডুবে মারা যাচ্ছে। চতুর্থ বার মাথা তোলার পর তিনি মৃতদেহ ভেসে উঠতে দেখেন।
‘তখন আমার পায়ের কাছে একজন মানুষের স্পর্শ পাই। আমি ভাবলাম এই মানুষটিকে যদি লাথি দিয়ে সরিয়ে দেই তাহলে নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবো না। কিন্তু আমি জানতাম লোকটি মারা যাচ্ছে।’
প্রিন্স আর্নল্ড বলেন, ‘কোন কোন সময় আপনি ততটাই স্বার্থপর। একটা সময় অনুভব করলাম লোকটি নিচে চলে যাচ্ছে, সে সঙ্গে নিয়ে গেছে আমার জুতা জোড়া।’
এরপর একজন মাছ ধরার জেলে এসে বাঁচান প্রিন্স আর্নল্ডকে। বেঁচে ফিরে আসা কারও কাছেই লাইফ জ্যাকেট ছিল না, তবে তারা সবাই সাঁতার কাটতে পেরেছিলেন।
বেঁচে ফিরে আসা এই ছয়জন আরোহী কয়েকজন জেলেদের উদ্দেশ্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন যারা তাদের উদ্ধারে এগিয়ে এসেছিল। তবে জেলেদের যেসব নৌকা উদ্ধারকাজের জন্য এগিয়ে এসেছিল তার একটি মানুষের গাদাগাদিতে ডুবে যায়। এটা দেখে জেজুঙ্কো নিজেই সাঁতার কেটে তীরে যাওয়ার মনস্থির করেন। একজন জেলেও ডুবে যান। তীরের দিকে যাবার সময় তিনি দুজন নারীকে দেখেন একে অন্যকে আঁকড়ে ধরে আটকে আছেন। তিনি তাদের একজনকে সাহায্য করেন উপকূলে পৌঁছাতে কারণ সে তার হাত ধরে রেখেছিল।
‘অন্য মেয়েটিকে আমরা রেখে গেলাম, সে কাঁদছিল। সে বলতে থাকে ‘তোমরা আমাকে ফেলে যাচ্ছো, আমি মারা যাব।’ সেই মেয়েটি আদৌ বেঁচে ছিল কি-না কারও জানা নেই।
নৌকাটি উদ্ধারের পর পুলিশ তাদের উদ্ধার কাজ বন্ধ ঘোষণা করে। তারা জানায়, এই দুর্ঘটনায় ৩২ জনের মরদেহ পাওয়া গেছে এবং আনুমানিক ৩৭ জন জীবিত আছেন।
নিহতদের মধ্যে নৌকার এবং যে রিসোর্টটিতে যাওয়ার কথা ছিল সেই রিসোর্টের মালিক বিসাসে এবং তার স্ত্রী শেইলাহ রয়েছেন।
এখনো ২০ থেকে ৬০ জন নিখোঁজ রয়েছেন বলে ধারণা করা হয়। তবে বেঁচে ফিরে আসা অনেকেই এই সংখ্যাটি সঠিক বলে বিশ্বাস করেন না। তাদের সন্দেহ, বেঁচে ফিরে আসা অনেকেই বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে সামনে আসছেন না। প্রমোদতরীতে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত আরোহী তোলা নিয়ে অভিযোগে সয়লাব উগান্ডার বেশিরভাগ সংবাদ মাধ্যম। ‘বিষয়টি নিয়ে কলঙ্কজনক চেহারা দেয়ায় অনেকেই সামনে আসছেন না বলেই আমার বিশ্বাস’- বলেন জেজুঙ্কো।
দুর্ঘটনাটি নিয়ে পুলিশ তদন্ত শুরু করলেও নৌকাটির মালিক পক্ষের দুজনই প্রাণ হারানোর ফলে সে রহস্য উদঘাটন আসলে কতটা সম্ভব হবে সে নিয়ে খুব একটা আশা নেই বলে মনে করছেন অনেকেই।