ঢাকা ০৮:৫৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৩, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
Logo যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সকল দলকে নিয়ে বিএনপির যৌথসভা Logo ১০ হাজার নেতাকর্মী নিয়ে বরিশাল-৩ আসনে নৌকার প্রার্থী স্বপনের মনোনয়নপত্র দাখিল Logo রাজপথ বিএনপির দখলে না থাকলেও বিটিভি  বিএনপি জামায়াতের দখলে! Logo দেশের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় বেস্ট হোল্ডিং Logo অগ্রণী ব্যাংকের ডিজিএম সৈয়দ সালমা উসমানের বেপরোয়া দুর্নীতি! Logo বরিশালের বাকেরগঞ্জে পল্লী চিকিৎসকের ঘরে লুটপাট Logo চাকুরীচ্যুত হওয়ার পরেও বহাল পায়রা বন্দর প্রকৌশলী নাছির: গড়েছে অবৈধ সম্পদের পাহাড়!  Logo ফায়ার সার্ভিসের অপারেশন এখন করাপশনের ত্রিমুখী জুটি Logo মনোনয়নপ্রত্যাশী ৩৩৬২ জনের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন শেখ হাসিনা Logo থিয়েটার কুবি’র নেতৃত্বে সুইটি-হান্নান




কুড়ি বছর ধরে কসাইয়ের কাজ করছেন জমিলা

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ১১:০৭:১৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৪ মে ২০১৯ ১০১ বার পড়া হয়েছে

নিজস্ব প্রতিনিধি;

কসাই শব্দটির সঙ্গে একজন নারীর সম্পর্ক খানিকটা অবাক করে আমাদের। কারণ, কসাই বলতে আমাদের চোখে ভেসে ওঠে একজন পুরুষের ছবি। কিন্তু দীর্ঘ প্রায় কুড়ি বছর ধরে কসাইয়ের তকমা গায়ে লাগিয়ে মাংস বিক্রি করে চলেছেন একজন নারী। শুধু মাংস বিক্রিই নয়, হাটে গিয়ে গরু কেনা, গরু জবাই করা, মাংস কাটা, ওজন দেওয়া প্রায় সব কাজই করেন এই নারী।

এই নারীর নাম জমিলা বেগম (৪৭)। তাঁর বাড়ি দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার শেষ সীমান্তে ৩ নম্বর শতগ্রাম ইউনিয়নের ঝাড়বাড়ি গ্রাম। বাড়ির পাশেই ঝাড়বাড়ি বাজারে মায়ের দোয়া মাংস ভান্ডার। দোকানের ভেতরে টাঙানো ব্যানার। ব্যানারে লেখা, ‘এখানে স্বাস্থ্যসম্মত দেশি আড়িয়া গরুর মাংস সঠিক ওজনে পাওয়া যায়’। মালিক হিসেবে রয়েছেন জমিলা আর পরিচালনা করছেন জমিলার ছেলে জহুরুল ইসলাম (৩৩)।

গতকাল বুধবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ঝাড়বাড়ি বাজারে নিজের দোকানে বসে মাংস কাটছেন জমিলা বেগম। বাইরে অপেক্ষমাণ ক্রেতা। জমিলা বেগম মাংস কাটছেন, ডিজিটাল পাল্লায় মাপছেন, টাকা গুনছেন। কেউ ৫ কেজি, কেউ ৩ কেজি আবার কেউ ১০ কেজি পর্যন্ত মাংসের ক্রেতা রয়েছেন। তাঁকে দেখেই বোঝা যায় পুরোদস্তুর একজন মাংস বিক্রেতা তিনি।

জমিলা বেগম জানান, প্রতি সপ্তাহের সোমবার বাদে ৬ দিনই মাংস বিক্রি করেন তিনি। তবে শুক্রবারে মাংস বিক্রি বেশি হয়। অন্যান্য দিনে মাংস বিক্রি হয় ৭ থেকে ১০ মণ। কিন্তু শুক্রবারে বিক্রি হয় ২০ থেকে ২৫ মণ মাংস। গড়ে প্রতিদিন ৪–৫টি গরু জবাই করে মাংস বিক্রি করেন তিনি। ক্রেতারা আসেন দূর-দূরান্ত থেকে। বিশেষ করে বীরগঞ্জের গড়েয়া, গোলাপগঞ্জ, কাহারোল উপজেলার বসুনিয়া, লাহিড়ী, কালমেঘ, পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ, খানসামা উপজেলা এমনকি ঠাকুরগাঁও ও নীলফামারী থেকেও ক্রেতা আসেন জমিলার দোকানে মাংস কিনতে।
খানসামা উপজেলার ভুল্লির হাট এলাকা থেকে মাংস কিনতে আসা আফজাল হোসেন (৫৫) বলেন, ‘প্রায় দশ বছর ধরে জমিলার এখানে মাংস কিনতে আসি। সঠিক ওজন এবং ভালো মানের গরুর মাংস পাওয়া যায়।’ তিনি বলেন, ‘শুধু আমি নই, আমার চেয়েও দূরের লোক আছে যাঁরা এখানে মাংস কিনতে আসেন।’

আসন্ন ঈদ উপলক্ষে ঈদের দিন থেকে আগে–পরে এক সপ্তাহে অন্তত ৮৫ থেকে ১০০টি গরু জবাই হবে তাঁর দোকানে। গরু কেনায় তাঁকে সহযোগিতা করছেন তাঁর ছেলে জহুরুল ইসলাম। দোকানে আছেন ৫ জন কর্মচারী। যাঁদের বেতন ৭ থেকে ১২ হাজার টাকা।
জমিলা বললেন, শুধু ছেলে নয় গরু ব্যবসায়ীরাও সহযোগিতা করেন তাঁকে। তিনি বলেন, ‘হয়তো গরু কিনতে হাটে গেছি, গরু পছন্দ হয়েছে হাতে টাকা নেই। ব্যবসায়ীরা বাকিতেই দিয়ে দেন। টাকার সমস্যা হলে ছেলেকে পাঠিয়ে দিই। ৩–৪ লাখ পর্যন্ত টাকা চাইলে ব্যবসায়ীদের কাছে সহযোগিতা পাই।’
বীরগঞ্জ উপজেলার গড়েয়া বাজারের গরু ব্যবসায়ী হযরত আলী (৩৮) মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘জমিলার লেনদেন খুবই ভালো। তাঁকে বাকিতে গরু দিই, কারণ জানি টাকা মাইর যাবে না। তা ছাড়া একজন মহিলা মানুষ সাহস করে এই পেশায় আসছেন, তাঁকে আমরা উৎসাহ দিই।’

আলাপচারিতায় জানা যায়, কোনো দিন স্কুলের বারান্দায় যাওয়া হয়নি জমিলা বেগমের। কিন্তু জীবনের হিসাব ঠিকই মেলাতে পেরেছেন তিনি। ১৫ বছর বয়সে জমিলার বাবা পান ব্যবসায়ী জাকির হোসেন মেয়েকে বিয়ে দেন বগুড়ার গোকুল উত্তর পাড়ার ছ’মিল বন্দর এলাকার রফিকুল ইসলাম ভান্ডারীর সঙ্গে। তিনিও পেশায় একজন কসাই। প্রথম প্রথম ভালোই চলছিল দিনগুলো। এক সন্তান জন্মের কিছুদিন পর স্বামী রফিকুল ইসলাম ভান্ডারী মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। ব্যবসাটাও খুইয়ে ফেলেন। ২০০০ সালের শেষ দিকে স্বামী–সন্তানসহ বাবার বাড়ি বীরগঞ্জের ঝাড়বাড়ি এলাকায় চলে আসেন জমিলা। বাবার সামান্য জমি বিক্রি করে বাজারে একটি দোকানে স্বামীসহ আবারও মাংসের দোকান শুরু করেন। ছেলে জহুরুল তখন নবম শ্রেণির ছাত্র। ব্যবসা ভালো চলছিল। পরিবারেও শান্তি ফেরে আবার। এর মধ্যে স্বামী ব্যবসার আড়াই লাখ টাকা নিয়ে পালিয়ে যান। জমিলা তখন তিন মাসের সন্তানসম্ভবা।
এ সময় জমিলার বাবা তাঁর পাশে দাঁড়ান। পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে একমাত্র ছেলে জহুরুলও মায়ের পাশে দাঁড়ান। সেই থেকে এখন পর্যন্ত শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন জমিলা। এক ছেলে, ছেলের বউ আর মেয়ে সোহাগীকে (১৪) নিয়ে সুখের সংসার। বাবার ভিটের পাশেই কিনেছেন আরও ১০ শতাংশ জমি।
জমিলা বেগম বলেন, ‘নিজে পড়াশোনা করতে পারিনি, ছেলেকে বিপদের মধ্যে পড়ে পড়াশোনা শেখানো হয়নি। তবে মেয়েটাকে অনেক দূর পর্যন্ত লেখাপড়া করানোর ইচ্ছে আছে।’ জমিলার মেয়ে ঝাড়বাড়ি উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী সোহাগী বেগম বলে, ‘কসাইয়ের মেয়ে বলে অনেকেই আমার সঙ্গে মিশতে চায় না, তখন খুব খারাপ লাগত। কিন্তু পড়াশোনা ভালো করে করবার কারণে কেউ তেমন কিছু বলে না। আমিও কিছু মনে করি না।’

নারী হয়ে কসাইয়ের কাজ করছেন, কোনো প্রতিকূল অবস্থায় পড়েছেন? জানতে চাইলে জমিলা বলেন, ‘স্বামী চলে যাওয়ার পর প্রথম যখন দোকানে বসা শুরু করি তখন অনেকেই বিরোধিতা করেছিল। এলাকার কিছু লোক থানায়, ইউনিয়ন পরিষদে আমার নামে অভিযোগ দিয়েছিল। কিন্তু এলাকার সবাই তো এক রকম না। কয়েকজন আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সে সময়।’ তবে বর্তমানে সবাই তাঁকে উৎসাহ জোগান, সাহস দেন বলেও জানান তিনি।
এই বাজারে মাংস ব্যবসায়ী রয়েছেন আরও চারজন। ঝাড়বাড়ি বাজারের অন্য এক মাংস বিক্রেতা আয়নাল হক (৩০) বলেন, ‘জমিলা ভাবির কারণে এই বাজারটিকে অনেকেই চিনেছে। আমাদের ব্যবসাও ভালো হয়। মিলেমিশে আছি, আমরা খুব খুশি।’
মাংস বিক্রিতে এলাকার মানুষের আস্থার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছেন জমিলা বেগম। তিনি বলেন, ‘একসময় ৪০–৫০ টাকা কেজি দরে মাংস বিক্রি করেছি। সেই মাংস এখন বিক্রি করছি ৫০০ টাকা কেজি দরে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি বাড়িতে বসে থাকতে পারি না। অসুস্থ হলেও দোকানে চলে যাই।’ তিনি না থাকলে ক্রেতারা তাঁর অপেক্ষায় বসে থাকেন বলেও জানালেন তিনি।
একই কথা বলছেন ঝাড়বাড়ি পরিবেশ উন্নয়ন পরিষদের আহ্বায়ক মো. জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ‘জমিলার কারণে এই এলাকার মাংস বিক্রেতাদের মধ্যে পরিবর্তন এসেছে। বহুদূর থেকে এখন মানুষ আসে এই দোকানে মাংস কিনতে। জমিলা ভাবি না থাকলে দোকানে ক্রেতারা দাঁড়িয়ে থাকে।’
কসাই জমিলা প্রসঙ্গে বীরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইয়ামিন হোসেন বলেন, ‘জমিলার মতো কর্মঠ এবং সংগ্রামী নারী আমার উপজেলায় আছে এ জন্য আমি গর্ববোধ করি। নিজের প্রচেষ্টায় তিনি সাহসী একটি কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরেছেন। আমি তাঁকে সাধুবাদ জানাই। দীর্ঘ সময় ধরে তিনি কোনো প্রকার সমস্যায় পড়েননি। যদি কখনো কোনো সমস্যায় পড়েন আমরা তাঁকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করব।’ তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর আমরা জয়ীতা নারীকে পুরস্কৃত করি। এবার আমরা জমিলার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আসব।’

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :




কুড়ি বছর ধরে কসাইয়ের কাজ করছেন জমিলা

আপডেট সময় : ১১:০৭:১৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৪ মে ২০১৯

নিজস্ব প্রতিনিধি;

কসাই শব্দটির সঙ্গে একজন নারীর সম্পর্ক খানিকটা অবাক করে আমাদের। কারণ, কসাই বলতে আমাদের চোখে ভেসে ওঠে একজন পুরুষের ছবি। কিন্তু দীর্ঘ প্রায় কুড়ি বছর ধরে কসাইয়ের তকমা গায়ে লাগিয়ে মাংস বিক্রি করে চলেছেন একজন নারী। শুধু মাংস বিক্রিই নয়, হাটে গিয়ে গরু কেনা, গরু জবাই করা, মাংস কাটা, ওজন দেওয়া প্রায় সব কাজই করেন এই নারী।

এই নারীর নাম জমিলা বেগম (৪৭)। তাঁর বাড়ি দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার শেষ সীমান্তে ৩ নম্বর শতগ্রাম ইউনিয়নের ঝাড়বাড়ি গ্রাম। বাড়ির পাশেই ঝাড়বাড়ি বাজারে মায়ের দোয়া মাংস ভান্ডার। দোকানের ভেতরে টাঙানো ব্যানার। ব্যানারে লেখা, ‘এখানে স্বাস্থ্যসম্মত দেশি আড়িয়া গরুর মাংস সঠিক ওজনে পাওয়া যায়’। মালিক হিসেবে রয়েছেন জমিলা আর পরিচালনা করছেন জমিলার ছেলে জহুরুল ইসলাম (৩৩)।

গতকাল বুধবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ঝাড়বাড়ি বাজারে নিজের দোকানে বসে মাংস কাটছেন জমিলা বেগম। বাইরে অপেক্ষমাণ ক্রেতা। জমিলা বেগম মাংস কাটছেন, ডিজিটাল পাল্লায় মাপছেন, টাকা গুনছেন। কেউ ৫ কেজি, কেউ ৩ কেজি আবার কেউ ১০ কেজি পর্যন্ত মাংসের ক্রেতা রয়েছেন। তাঁকে দেখেই বোঝা যায় পুরোদস্তুর একজন মাংস বিক্রেতা তিনি।

জমিলা বেগম জানান, প্রতি সপ্তাহের সোমবার বাদে ৬ দিনই মাংস বিক্রি করেন তিনি। তবে শুক্রবারে মাংস বিক্রি বেশি হয়। অন্যান্য দিনে মাংস বিক্রি হয় ৭ থেকে ১০ মণ। কিন্তু শুক্রবারে বিক্রি হয় ২০ থেকে ২৫ মণ মাংস। গড়ে প্রতিদিন ৪–৫টি গরু জবাই করে মাংস বিক্রি করেন তিনি। ক্রেতারা আসেন দূর-দূরান্ত থেকে। বিশেষ করে বীরগঞ্জের গড়েয়া, গোলাপগঞ্জ, কাহারোল উপজেলার বসুনিয়া, লাহিড়ী, কালমেঘ, পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ, খানসামা উপজেলা এমনকি ঠাকুরগাঁও ও নীলফামারী থেকেও ক্রেতা আসেন জমিলার দোকানে মাংস কিনতে।
খানসামা উপজেলার ভুল্লির হাট এলাকা থেকে মাংস কিনতে আসা আফজাল হোসেন (৫৫) বলেন, ‘প্রায় দশ বছর ধরে জমিলার এখানে মাংস কিনতে আসি। সঠিক ওজন এবং ভালো মানের গরুর মাংস পাওয়া যায়।’ তিনি বলেন, ‘শুধু আমি নই, আমার চেয়েও দূরের লোক আছে যাঁরা এখানে মাংস কিনতে আসেন।’

আসন্ন ঈদ উপলক্ষে ঈদের দিন থেকে আগে–পরে এক সপ্তাহে অন্তত ৮৫ থেকে ১০০টি গরু জবাই হবে তাঁর দোকানে। গরু কেনায় তাঁকে সহযোগিতা করছেন তাঁর ছেলে জহুরুল ইসলাম। দোকানে আছেন ৫ জন কর্মচারী। যাঁদের বেতন ৭ থেকে ১২ হাজার টাকা।
জমিলা বললেন, শুধু ছেলে নয় গরু ব্যবসায়ীরাও সহযোগিতা করেন তাঁকে। তিনি বলেন, ‘হয়তো গরু কিনতে হাটে গেছি, গরু পছন্দ হয়েছে হাতে টাকা নেই। ব্যবসায়ীরা বাকিতেই দিয়ে দেন। টাকার সমস্যা হলে ছেলেকে পাঠিয়ে দিই। ৩–৪ লাখ পর্যন্ত টাকা চাইলে ব্যবসায়ীদের কাছে সহযোগিতা পাই।’
বীরগঞ্জ উপজেলার গড়েয়া বাজারের গরু ব্যবসায়ী হযরত আলী (৩৮) মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘জমিলার লেনদেন খুবই ভালো। তাঁকে বাকিতে গরু দিই, কারণ জানি টাকা মাইর যাবে না। তা ছাড়া একজন মহিলা মানুষ সাহস করে এই পেশায় আসছেন, তাঁকে আমরা উৎসাহ দিই।’

আলাপচারিতায় জানা যায়, কোনো দিন স্কুলের বারান্দায় যাওয়া হয়নি জমিলা বেগমের। কিন্তু জীবনের হিসাব ঠিকই মেলাতে পেরেছেন তিনি। ১৫ বছর বয়সে জমিলার বাবা পান ব্যবসায়ী জাকির হোসেন মেয়েকে বিয়ে দেন বগুড়ার গোকুল উত্তর পাড়ার ছ’মিল বন্দর এলাকার রফিকুল ইসলাম ভান্ডারীর সঙ্গে। তিনিও পেশায় একজন কসাই। প্রথম প্রথম ভালোই চলছিল দিনগুলো। এক সন্তান জন্মের কিছুদিন পর স্বামী রফিকুল ইসলাম ভান্ডারী মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। ব্যবসাটাও খুইয়ে ফেলেন। ২০০০ সালের শেষ দিকে স্বামী–সন্তানসহ বাবার বাড়ি বীরগঞ্জের ঝাড়বাড়ি এলাকায় চলে আসেন জমিলা। বাবার সামান্য জমি বিক্রি করে বাজারে একটি দোকানে স্বামীসহ আবারও মাংসের দোকান শুরু করেন। ছেলে জহুরুল তখন নবম শ্রেণির ছাত্র। ব্যবসা ভালো চলছিল। পরিবারেও শান্তি ফেরে আবার। এর মধ্যে স্বামী ব্যবসার আড়াই লাখ টাকা নিয়ে পালিয়ে যান। জমিলা তখন তিন মাসের সন্তানসম্ভবা।
এ সময় জমিলার বাবা তাঁর পাশে দাঁড়ান। পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে একমাত্র ছেলে জহুরুলও মায়ের পাশে দাঁড়ান। সেই থেকে এখন পর্যন্ত শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন জমিলা। এক ছেলে, ছেলের বউ আর মেয়ে সোহাগীকে (১৪) নিয়ে সুখের সংসার। বাবার ভিটের পাশেই কিনেছেন আরও ১০ শতাংশ জমি।
জমিলা বেগম বলেন, ‘নিজে পড়াশোনা করতে পারিনি, ছেলেকে বিপদের মধ্যে পড়ে পড়াশোনা শেখানো হয়নি। তবে মেয়েটাকে অনেক দূর পর্যন্ত লেখাপড়া করানোর ইচ্ছে আছে।’ জমিলার মেয়ে ঝাড়বাড়ি উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী সোহাগী বেগম বলে, ‘কসাইয়ের মেয়ে বলে অনেকেই আমার সঙ্গে মিশতে চায় না, তখন খুব খারাপ লাগত। কিন্তু পড়াশোনা ভালো করে করবার কারণে কেউ তেমন কিছু বলে না। আমিও কিছু মনে করি না।’

নারী হয়ে কসাইয়ের কাজ করছেন, কোনো প্রতিকূল অবস্থায় পড়েছেন? জানতে চাইলে জমিলা বলেন, ‘স্বামী চলে যাওয়ার পর প্রথম যখন দোকানে বসা শুরু করি তখন অনেকেই বিরোধিতা করেছিল। এলাকার কিছু লোক থানায়, ইউনিয়ন পরিষদে আমার নামে অভিযোগ দিয়েছিল। কিন্তু এলাকার সবাই তো এক রকম না। কয়েকজন আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সে সময়।’ তবে বর্তমানে সবাই তাঁকে উৎসাহ জোগান, সাহস দেন বলেও জানান তিনি।
এই বাজারে মাংস ব্যবসায়ী রয়েছেন আরও চারজন। ঝাড়বাড়ি বাজারের অন্য এক মাংস বিক্রেতা আয়নাল হক (৩০) বলেন, ‘জমিলা ভাবির কারণে এই বাজারটিকে অনেকেই চিনেছে। আমাদের ব্যবসাও ভালো হয়। মিলেমিশে আছি, আমরা খুব খুশি।’
মাংস বিক্রিতে এলাকার মানুষের আস্থার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছেন জমিলা বেগম। তিনি বলেন, ‘একসময় ৪০–৫০ টাকা কেজি দরে মাংস বিক্রি করেছি। সেই মাংস এখন বিক্রি করছি ৫০০ টাকা কেজি দরে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি বাড়িতে বসে থাকতে পারি না। অসুস্থ হলেও দোকানে চলে যাই।’ তিনি না থাকলে ক্রেতারা তাঁর অপেক্ষায় বসে থাকেন বলেও জানালেন তিনি।
একই কথা বলছেন ঝাড়বাড়ি পরিবেশ উন্নয়ন পরিষদের আহ্বায়ক মো. জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ‘জমিলার কারণে এই এলাকার মাংস বিক্রেতাদের মধ্যে পরিবর্তন এসেছে। বহুদূর থেকে এখন মানুষ আসে এই দোকানে মাংস কিনতে। জমিলা ভাবি না থাকলে দোকানে ক্রেতারা দাঁড়িয়ে থাকে।’
কসাই জমিলা প্রসঙ্গে বীরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইয়ামিন হোসেন বলেন, ‘জমিলার মতো কর্মঠ এবং সংগ্রামী নারী আমার উপজেলায় আছে এ জন্য আমি গর্ববোধ করি। নিজের প্রচেষ্টায় তিনি সাহসী একটি কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরেছেন। আমি তাঁকে সাধুবাদ জানাই। দীর্ঘ সময় ধরে তিনি কোনো প্রকার সমস্যায় পড়েননি। যদি কখনো কোনো সমস্যায় পড়েন আমরা তাঁকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করব।’ তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর আমরা জয়ীতা নারীকে পুরস্কৃত করি। এবার আমরা জমিলার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আসব।’