ঢাকা ০৬:০৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ




দোলেয়ারের জীবনটা বাংলা সিনেমার কাহিনীকেও হার মানায়

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ১১:০৪:৩৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ মে ২০১৯ ৮২ বার পড়া হয়েছে

জেলা প্রতিনিধি চাঁপাইনবাবঞ্জ;
ছেলেটি গরিব দিনমজুর, আর মেয়েটি প্রভাবশালী বড়লোক বাবার মেয়ে। তাদের মধ্যেই প্রেম, এক পর্যায়ে সব কিছু পেছনে ফেলে দুজনের সুখের সংসার। কিন্তু সে সুখের মাঝে ভিলেন হয়ে আসেন মেয়ের বাবা। শুরু হয় নানা সমস্যা। বাংলা সিনেমায় আমরা এমনটা হরহামেশা দেখে থাকলেও দোলেয়ার হোসেন সেন্টুর জীবনটাও যেন এভাবেই সাজানো হয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলে গ্রাম্য মাতব্বরদের সিদ্ধান্তে ১৮ বছর ধরে তালাক না দিয়েও স্ত্রী থেকে আলাদা থাকেন দোলেয়ার হোসেন সেন্টু (৪০)। মাতব্বরদের সিদ্ধন্ত অনুযায়ী একই বাড়িতে স্ত্রী সোফিয়া বেগমের সঙ্গে বসবাস করলেও তার সঙ্গে কোনো শারীরিক সম্পর্ক করতে পারবেন না দেলোয়ার।

তিনি জানান, স্ত্রীকে ঘরে রেখে ১৮ বছর বারান্দায় রাত কাটাতে হচ্ছে তাকে। এমনকি ২০ বছর বয়সী ছেলে শাহিনের (২০) সঙ্গেও তার কোনো সম্পর্ক নেই। ১৮ বছর ধরে মাতব্বরদের রায় ভাঙতে না পেরে এখন পাগল প্রায় দেলোয়ার। দেলোয়ারের দাবি মাতাব্বরদের রায়ের কারণে তার জীবনে এমন দশা।

দোলেয়ার হোসেন সেন্টু জানান, ছোটকালে বাবা মোকবুল হোসেনের মৃত্যুর পর থেকে অন্যের বাড়িতে কামলা খেটে জীবন কাটতো তার। কোনো রকমে গ্রামের সামান্য খাস জমিতে মাটির ঘরে বাস করে আসছিলেন তিনি। ২০০০ সালের এক রাতে একই গ্রামের বিত্তশালী ইলিয়াস মেম্বারের মেয়ে সোফিয়া বেগম ভালবাসার টানে বাবার ধনসম্পদ ত্যাগ করে দেলোয়ারের ঘরে স্ত্রীর মর্যাদার দাবিতে চলে আসেন। সোফিয়াকে তার বাবার বাড়িতে ফেরাতে না পেরে পরদিন নওগাঁর কোর্টে গিয়ে তারা রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করেন।

এ ঘটনায় ইলিয়াস মেম্বার তার মেয়েকে অপহরণের অভিযোগে কোর্টে মামলা করেন ও কয়েক দফায় দেলোয়ারকে মারপিট করেন। কিন্তু তাতেও সোফিয়া বাবার বাড়িতে যেতে রাজি হয়নি। সুখের সংসারে বছর ঘুরে আসে সন্তান শাহিন। এরই মধ্যে সোফিয়ার বাবার ইন্ধনে গ্রাম্য মাতব্বররা সুযোগ খুঁজতে থাকেন। একদিন স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সামান্য কথা কাটাকাটি নিয়ে বসে গ্রাম্য সালিশ।

ওই গ্রামের মৃত আহাম্মদ আলীর ছেলে আলহাজ হারেজ উদ্দীন, নওশাদ, মৃত ওহেদ মন্ডলের ছেলে আব্দুস সাত্তার, মৃত সাইফুদ্দিন মন্ডলের ছেলে বর্তমান নাচোল ইউপির চেয়ারম্যান আব্দুস ছালাম, তৎকালীন ইউপি সদস্য হাফিজুর রহমানসহ সোফিয়ার বাবার পক্ষের লোকজনের যোগসাজশে সোফিয়ার ভরণপোষণ না দেয়া ও স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ঝগড়ার কারণে মাতব্বররা সিদ্ধান্ত দেন, ‘স্ত্রী সোফিয়া দেলোয়ারের ঘরেই থাকবে। কিন্তু দেলোয়ার কোনোদিন স্বামীর অধিকার পাবে না। এ রায় না মানলে দেলোয়ারকে কঠোর শাস্তি দেয়া হবে।’

এ ব্যাপারে দেলোয়ারের স্ত্রী সোফিয়া বেগম জানান, তাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তালাক বা ছাড়াছাড়ি হয়নি। ভরণপোষণ না চালানোর জন্য সালিশদাররা আমাদের আলাদা করে রেখেছেন।

সলিশদার হারেজ উদ্দিন জানান, স্বামী-স্ত্রীর তালাক হয়নি। স্ত্রীকে মারপিট ও ভরণ-পোষণ চালাতে না পারার কারণে ওই রায় দেয়া হয়েছিল। ভেবেছিলাম পরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মিল-মহব্বত হবে।

সাবেক মেম্বার হাফিজুর রহমান ও বর্তমান নাচোল ইউপি চেয়ারম্যান আবদুস ছালাম জানান, মরহুম বেলাল চেয়ারম্যান তাদের স্বামী-স্ত্রীর বিরোধটি নিষ্পোত্তি করার ভার দিয়েছিলেন আমাদের উপর। বিচারের উদ্যোগ নেয়া হলেও সেটি কার্যকর হয়নি। তবে ভুক্তভোগী আমার নিকট বিচারপ্রার্থী হলে সুবিচার করার চেষ্টা করব।

অন্যদিকে দেলোয়ারের দাবি তার শ্বশুর ও গ্রামের সালিশদারেরা তার প্রতি অবিচার করেছেন। এমন বিচারকদের বিচার হওয়া দরকার।

নাচোল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) চৌধুরী জোবায়ের আহাম্মদ বলেন, এ ব্যাপারে থানায় কেউ কোনো অভিযোগ করেননি। যদি কেউ অভিযোগ করে তবে তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :




দোলেয়ারের জীবনটা বাংলা সিনেমার কাহিনীকেও হার মানায়

আপডেট সময় : ১১:০৪:৩৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ মে ২০১৯

জেলা প্রতিনিধি চাঁপাইনবাবঞ্জ;
ছেলেটি গরিব দিনমজুর, আর মেয়েটি প্রভাবশালী বড়লোক বাবার মেয়ে। তাদের মধ্যেই প্রেম, এক পর্যায়ে সব কিছু পেছনে ফেলে দুজনের সুখের সংসার। কিন্তু সে সুখের মাঝে ভিলেন হয়ে আসেন মেয়ের বাবা। শুরু হয় নানা সমস্যা। বাংলা সিনেমায় আমরা এমনটা হরহামেশা দেখে থাকলেও দোলেয়ার হোসেন সেন্টুর জীবনটাও যেন এভাবেই সাজানো হয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলে গ্রাম্য মাতব্বরদের সিদ্ধান্তে ১৮ বছর ধরে তালাক না দিয়েও স্ত্রী থেকে আলাদা থাকেন দোলেয়ার হোসেন সেন্টু (৪০)। মাতব্বরদের সিদ্ধন্ত অনুযায়ী একই বাড়িতে স্ত্রী সোফিয়া বেগমের সঙ্গে বসবাস করলেও তার সঙ্গে কোনো শারীরিক সম্পর্ক করতে পারবেন না দেলোয়ার।

তিনি জানান, স্ত্রীকে ঘরে রেখে ১৮ বছর বারান্দায় রাত কাটাতে হচ্ছে তাকে। এমনকি ২০ বছর বয়সী ছেলে শাহিনের (২০) সঙ্গেও তার কোনো সম্পর্ক নেই। ১৮ বছর ধরে মাতব্বরদের রায় ভাঙতে না পেরে এখন পাগল প্রায় দেলোয়ার। দেলোয়ারের দাবি মাতাব্বরদের রায়ের কারণে তার জীবনে এমন দশা।

দোলেয়ার হোসেন সেন্টু জানান, ছোটকালে বাবা মোকবুল হোসেনের মৃত্যুর পর থেকে অন্যের বাড়িতে কামলা খেটে জীবন কাটতো তার। কোনো রকমে গ্রামের সামান্য খাস জমিতে মাটির ঘরে বাস করে আসছিলেন তিনি। ২০০০ সালের এক রাতে একই গ্রামের বিত্তশালী ইলিয়াস মেম্বারের মেয়ে সোফিয়া বেগম ভালবাসার টানে বাবার ধনসম্পদ ত্যাগ করে দেলোয়ারের ঘরে স্ত্রীর মর্যাদার দাবিতে চলে আসেন। সোফিয়াকে তার বাবার বাড়িতে ফেরাতে না পেরে পরদিন নওগাঁর কোর্টে গিয়ে তারা রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করেন।

এ ঘটনায় ইলিয়াস মেম্বার তার মেয়েকে অপহরণের অভিযোগে কোর্টে মামলা করেন ও কয়েক দফায় দেলোয়ারকে মারপিট করেন। কিন্তু তাতেও সোফিয়া বাবার বাড়িতে যেতে রাজি হয়নি। সুখের সংসারে বছর ঘুরে আসে সন্তান শাহিন। এরই মধ্যে সোফিয়ার বাবার ইন্ধনে গ্রাম্য মাতব্বররা সুযোগ খুঁজতে থাকেন। একদিন স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সামান্য কথা কাটাকাটি নিয়ে বসে গ্রাম্য সালিশ।

ওই গ্রামের মৃত আহাম্মদ আলীর ছেলে আলহাজ হারেজ উদ্দীন, নওশাদ, মৃত ওহেদ মন্ডলের ছেলে আব্দুস সাত্তার, মৃত সাইফুদ্দিন মন্ডলের ছেলে বর্তমান নাচোল ইউপির চেয়ারম্যান আব্দুস ছালাম, তৎকালীন ইউপি সদস্য হাফিজুর রহমানসহ সোফিয়ার বাবার পক্ষের লোকজনের যোগসাজশে সোফিয়ার ভরণপোষণ না দেয়া ও স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ঝগড়ার কারণে মাতব্বররা সিদ্ধান্ত দেন, ‘স্ত্রী সোফিয়া দেলোয়ারের ঘরেই থাকবে। কিন্তু দেলোয়ার কোনোদিন স্বামীর অধিকার পাবে না। এ রায় না মানলে দেলোয়ারকে কঠোর শাস্তি দেয়া হবে।’

এ ব্যাপারে দেলোয়ারের স্ত্রী সোফিয়া বেগম জানান, তাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তালাক বা ছাড়াছাড়ি হয়নি। ভরণপোষণ না চালানোর জন্য সালিশদাররা আমাদের আলাদা করে রেখেছেন।

সলিশদার হারেজ উদ্দিন জানান, স্বামী-স্ত্রীর তালাক হয়নি। স্ত্রীকে মারপিট ও ভরণ-পোষণ চালাতে না পারার কারণে ওই রায় দেয়া হয়েছিল। ভেবেছিলাম পরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মিল-মহব্বত হবে।

সাবেক মেম্বার হাফিজুর রহমান ও বর্তমান নাচোল ইউপি চেয়ারম্যান আবদুস ছালাম জানান, মরহুম বেলাল চেয়ারম্যান তাদের স্বামী-স্ত্রীর বিরোধটি নিষ্পোত্তি করার ভার দিয়েছিলেন আমাদের উপর। বিচারের উদ্যোগ নেয়া হলেও সেটি কার্যকর হয়নি। তবে ভুক্তভোগী আমার নিকট বিচারপ্রার্থী হলে সুবিচার করার চেষ্টা করব।

অন্যদিকে দেলোয়ারের দাবি তার শ্বশুর ও গ্রামের সালিশদারেরা তার প্রতি অবিচার করেছেন। এমন বিচারকদের বিচার হওয়া দরকার।

নাচোল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) চৌধুরী জোবায়ের আহাম্মদ বলেন, এ ব্যাপারে থানায় কেউ কোনো অভিযোগ করেননি। যদি কেউ অভিযোগ করে তবে তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।