জাতীয় ডিএনএ ল্যাবে অচলাবস্থা
- আপডেট সময় : ১০:০৮:১১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১২ মে ২০১৯ ১৩২ বার পড়া হয়েছে
নিজস্ব প্রতিনিধি;
দেশে সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত জাতীয় ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরিতে এখন অচলাবস্থা বিরাজ করছে। মেশিন-যন্ত্রাংশ তথা কারিগরি সমস্যা থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠানটির সর্বত্রই বেহালদশা। ল্যাবের প্রধান ‘জেনেটিক এনালাইজার’ মেশিন পাঁচ মাস ধরে নষ্ট। এ অচলাবস্থার কারণে গত ২০ ফেব্রুয়ারি পুরনো ঢাকার চুড়িহাট্টার অগ্নিকান্ডে নিহতদের ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের কাজটি করতে হয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি)।
বর্তমানে ঠিকমতো কাজ করছে না আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ মেশিন ও যন্ত্রাংশ। নেই কোনো মেইনটেন্যান্স বা অটোমেশন ব্যবস্থা। ফলে নিয়মিত ল্যাবের মেশিন-যন্ত্রাংশ দেখভালেরও ব্যবস্থা নেই। নষ্ট বা যান্ত্রিক ত্রুটি হলে বিদেশে নিয়ে মেরামতই একমাত্র ভরসা। পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যাও প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিচারিক কর্মকান্ডে সহায়ক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটির এ দূরাবস্থা যেন দেখারও কেউ নেই।
সরেজমিনে জাতীয় ডিএনএ প্রোফাইলং ল্যাবরেটরিতে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। চাকরি স্থায়ী না হওয়া, পদোন্নতি না হওয়া, জনবল বৃদ্ধি না করাসহ নানা জটিলতার কারণে জাতীয় ডিএনএ ল্যাবরেটরির বিশেষজ্ঞ বা বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সব পর্যায়ের কর্মীদের মাঝেই চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে।
তারা বলছেন, এখানে দীর্ঘদিন ধরে নানা সমস্যার সৃষ্টি হলেও দায়িত্বশীল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঠিকমতো খোঁজখবরও রাখেন না। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল ও জীব প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক এবং ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরির জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শরীফ আখতারুজ্জামান সময়ের আলোকে বলেন, ল্যাবরেটরির মেশিনটি অনেক দিন ধরে নষ্ট এটা সত্যই। তবে সার্বিক বিষয়ে এখন কোনো মন্তব্য করতে চাই না।
তবে জাতীয় ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরির প্রকল্প পরিচালক ড. আবুল হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, জাতীয় ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবরেটরির মেশিনটি নষ্ট কি না সেটি আমার জানা নেই। তবে অধিদফতর গঠনের প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে।
আবুল হোসেন জানান, অধিদফতর সংক্রান্ত বিষয়টি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জনবল অনুমোদনের পর বর্তমানে সেটি অর্থ মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। সেখানে অনুমোদন হলে যাবে সচিব কমিটিতে। তারপর যাবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে।
তবে বিষয়টি ধীরগতিতে এগোচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বাংলাদেশে ২০০৬ সাল থেকে শুরু হওয়া ডিএনএ পরীক্ষা ব্যবস্থাটি বর্তমানে নানা বিচারিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে জটিল সমস্যার সমাধান দিচ্ছে। খুনি-ধর্ষক শনাক্তকরণ, সন্তানের বাবা-মা নির্ণয় এবং নানা ঘটনায় উদ্ধারকৃত পচাগলা অজ্ঞাতনামা লাশ বা আগুনে পুড়ে কয়লা হওয়া লাশের পরিচয় শনাক্তকরণে অনন্য ভূমিকা রাখে ডিএনএ পরীক্ষা। ২০০৬ সাল থেকে চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত আদালতের নির্দেশে ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরিতে বিভিন্ন মামলা সংক্রান্ত ১৫ হাজার ৪৯২টি আলামতের (স্যাম্পুল) ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়েছে। এ ছাড়া ৪ হাজার ৯৩৩টি মামলায় ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে বিচারিক সহায়তা সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের ঘটনাই বেশি। ২০০৬ সাল থেকে চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ধর্ষণের ঘটনায় ন্যাশনাল ডিএনএ ল্যাবে প্রোফাইলিং হয়েছে ২ হাজার ৭৬৮টি। সন্তানের বাবা-মা শনাক্তকরণের ঘটনায় ডিএনএ প্রোফাইলিং হয়েছে ১ হাজার ৪৫০টি। এ জাতীয় ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবের মাধ্যমেই দেশের আলোচিত ডিআইজি আনিসের সাত সন্তানের রহস্য উদঘাটন, রাজশাহীতে সন্তান বদল নিরসন, রানা প্লাজা ও তাজরীন ফ্যাশনে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় নিহতদের পরিচয় শনাক্তসহ বহু আলোচিত ঘটনার সুরাহা করা হয়। অথচ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটি গুরুত্বের অভাবে মুখ থুবড়ে পড়ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
জাতীয় ডিএনএন ল্যাবরেটরির সংশ্লিষ্টরা জানান, দেড় যুগ আগে জাতীয় ফরেনসিক ডিএনএ (ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড) প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি প্রকল্পের আওতায়। এখনও সেই পুরনো প্রকল্পের অধীনেই চলছে দেশের জাতীয় ডিএনএ ল্যাবরেটরি।
সম্প্রতি চতুর্থ ধাপে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে নতুন করে পুরনো লোকজনই নিয়োগপ্রাপ্ত হন। এভাবেই প্রতি ধাপেই পরীক্ষা দিয়ে প্রকল্পে টিকে থাকতে হয় তাদের। অথচ কথা ছিল দ্বিতীয় বা তৃতীয় ধাপেই সব জনবল সরকারিকরণ এবং স্থায়ী হবে। এ ছাড়াও গত ২০১৭ সালের জানুয়ারি-অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসের বেতন বকেয়া আছে। ল্যাবরেটরিতে নিয়োজিত এ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখনও জানেন না ওই ১০ মাসের বেতন তারা কবে পাবেন।
তারা বলছেন, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ড. আবুল হোসেনকে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে এবং ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল ও জীব প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. শরীফ আখতারুজ্জামানকে জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত করে সরকার ২০০৬ সালে ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরির কার্যক্রম শুরু করে। ২০১৩ সাল পর্যন্ত বেশ ভালো গতিতে কার্যক্রম পরিচালনা করা হলেও এরপর থেকে ধীরে ধীরে গতি হারাতে শুরু করে জাতীয় ডিএনএ ল্যাবরেটরি।
জাতীয় ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরির একাধিক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সময়ের আলোকে বলেন, প্রতিনিয়তই অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে জাতীয় ডিএনএ ল্যাবরেটরিতে। এসব সমস্যার কারণে ইতোমধ্যেই গত মাসে চাকরি ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন ড. আশীষ কুমার মজুমদার নামে এক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।
অন্যদিকে সম্প্রতি চতুর্থ ধাপে প্রকল্পে চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধির পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করার মধ্য দিয়ে চাকরি ছাড়েন তানিয়া হোসেন নামে আরেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। তারও আগে আহমেদ ফেরদৌস নামে একজন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা প্রকল্পের এ চাকরি ছেড়ে সিআইডির ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবরেটরিতে চাকরি নিয়েছেন। এর বাইরে অন্য পর্যায়েও অনেকেই অন্যত্রে চাকরি বা বিকল্প কিছু করার চেষ্টা করছেন। এর ফলে যে সমস্যা তৈরি হচ্ছে তা হলো অভিজ্ঞ লোকবল শূন্য হয়ে পড়ছে জাতীয় ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরি।
২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ডিএনএ আইন-২০১৪ প্রণয়ন করা হয়। ওই আইন অনুযায়ী জাতীয় ডিএনএ প্রোফাইলিং অধিদফতর গঠন, সেই অনুপাতে লোকবল নিয়োগ, প্রতি জেলায় ডিএনএ ল্যাবের কার্যক্রম পরিচালনা, জাতীয় ডিএনএ ডাটাবেইজ প্রতিষ্ঠাসহ পরিচালনা সংক্রান্ত এবং নানা বিধিবিধান এতে সংযুক্ত করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত সবকিছু কেবল প্রায় আইনেই সীমাবদ্ধ আছে। প্রকল্পের অধীন থেকে স্বাধীন অধিদফতর আদৌ কবে নাগাদ হবে সেটিও বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট কেউই।
অভিযোগ উঠেছে, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের অবহেলার কারণেই ধীরে ধীরে জাতীয় ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরির অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কারিগরি সমস্যার পাশাপাশি আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ সংলগ্ন নিউক্লিয়ার মেডিসিন ভবনে স্থাপিত এ জাতীয় ডিএনএ ল্যাবরেটরি।
প্রসঙ্গত, বিশ্বজুড়ে সমালোচনার ঝড় তোলা সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও মনিকা লিউনস্কির অনৈতিক সম্পর্কের কথা অনেকেরই জানা। ১৯৯৮ সালের কথা। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন ওই অভিযোগ অস্বীকার করলেও এফবিআই মনিকার একটি পোশাকে লেগে থাকা সিমেনের নমুনা সংগ্রহ করে ‘ডিএনএ’ পরীক্ষা করে। ডিএনএ পরীক্ষায় ক্লিনটন ও মনিকার বিবাহবহিভর্‚ত সম্পর্কের বিষয়টি প্রমাণিত হয়। এর আগেও ইংল্যান্ডের সিরিয়াল ধর্ষক-কিলার কলিন পিচফর্ক ওরফে ইয়ান কেলির গ্রেফতারের ঘটনাও ডিএনএ পরীক্ষার সূত্র ধরেই। এমনকি বাংলাদেশেও পুলিশের সাবেক ডিআইজি আনিসুর রহমানের নিজ সন্তান বলে দাবিকৃত সাত শিশুর (সমবয়সি) অভিভাবকত্ব ভুয়া প্রমাণ করা হয়েছিল ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমেই। এমন বহু আলোচিত হত্যাকান্ড, খুনি, ধর্ষক ও বাবা-মা কিংবা ভাইবোন শনাক্তসহ নানা জটিল রহস্যের সমাধান দিয়ে পৃথিবীজুড়ে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখে ডিএনএ প্রোফাইলিং ব্যবস্থা।
ডিএনএ পরীক্ষায় মূলত বিশেষ বিশেষ অঞ্চলকে তুলনা করে একাধিক ব্যক্তির মাঝে মিল বা অমিল খুঁজে বের করা হয়। এ মিল অমিল খোঁজার মাধ্যমে বিচার ব্যবস্থায় যুগান্তকারী ভ‚মিকা রাখে ডিএনএ।