রমজানে নগরবাসীকে সন্ধ্যা ছয়টায় বাড়ি ফিরাতে প্রস্তুতি
- আপডেট সময় : ১২:৫০:১৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৭ মে ২০১৯ ৯৪ বার পড়া হয়েছে
হাফিজুর রহমান শফিক;
পবিত্র রমজান আসলেই নগরজীবনে ঘরে-বাইরে সবার ব্যস্ততা বেড়ে যায়। সিয়াম সাধনার এই মাসে রোজাদাররা ঘরে বসে করতে চান ইফতার। প্রতিদিন কর্মব্যস্ততা কাটিয়ে ইফতারের সময় হওয়ার আগেই বাড়ি ফেরার তাগিদ থাকে। কিন্তু বড় বাধা যানজট। এতে নাকাল হতে হয় ঢাকাবাসীকে। এবার রমজান মাসে যানজট এড়িয়ে প্রতিদিন সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে ব্যস্ত নগরবাসীকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ।
তবে পরিকল্পনা থাকলেও এটি বাস্তবায়নে ছয়টি বাধার মুখোমুখি হতে হবে। এই সমস্যাগুলোর সমাধান হলে রমজান মাসে যানজটের কবল থেকে নগরবাসীর স্বস্তি মিলবে বলে মনে করছে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ।
যে ছয় কারণে রোজার মাসে যানজট
এবারের রমজান মাসটি শুরু হবে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে। বাংলা বর্ষপঞ্জির হিসেবে সময়টা বৈশাখ মাসের শেষ সপ্তাহ। বছরের এ সময়টা কালবৈশাখী বয়ে যেতে পারে। কখনোবা বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ও সৃষ্টি হয়। শক্তিশালী হয়ে উঠলে সেই ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে উপকূলীয় অঞ্চলে। এ সময় দেশজুড়ে মুষলধারে বৃষ্টি হয়। এই বৃষ্টির কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতে পারে ঢাকা শহরে। রমজান মাসে এ ধরনের পরিস্থিতি হতে পারে ট্রাফিক বিভাগের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সবচেয়ে বড় বাধা।
রাজধানীতে এই মুহূর্তে চলছে ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট, এমআরটি বা মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ। কিছু দিন আগে এই মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর, শাহবাগ হয়ে প্রেসক্লাব, পল্টন ও মতিঝিল পর্যন্ত। এ জন্য এসব এলাকায় আট লেনের সড়ক সরু হয়ে চার লেন হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও সড়কের প্রস্থ দুই লেনের নিচে নেমে গেছে। ট্রাফিক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারি মাসে যেখানে সার্ক ফোয়ারা, বাংলামোটর এলাকায় ঘণ্টায় ৮০০ গাড়ি অতিক্রম করত, মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ায় এই সংখ্যা নেমে গেছে ঘণ্টায় ৫০০–তে। সকাল ও বিকেলের যানজটের কারণে এই সংখ্যা আরও কমে যায়। এ কারণে যানজট ছড়িয়ে পড়ছে ঢাকা শহরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সড়কে।
রমজান মাসে বেলা তিনটায় ছুটি হবে অফিস-আদালত। ব্যাংক ছুটি হবে সাড়ে তিনটার দিকে। সবাই একসঙ্গে বাড়ি ফিরতে চাইবেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ট্রাফিক বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, রোজার সময় বিকেলে বাসে ওঠার জন্য প্রচুর লোক জড়ো হবেন। বাসের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ভিড়ও বাড়বে। এর মধ্যে যদি টানা বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতা দেখা দেয়, তাহলে রাজপথে যানজট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। বৃষ্টি, মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ ও পথচারী চলাচলের পর ঢাকা মহানগরীর মার্কেট বা শপিং সেন্টারগুলোয় ভিড় রমজান মাসে দুর্ভোগ আরও বাড়াতে পারে।
ট্রাফিক বিভাগের মতে, রোজার মাসে বিপণিবিতানগুলোয় বিক্রি বেড়ে যায়। তখন হাতিরপুল, সার্ক ফোয়ারা, ফার্মগেট ও বায়তুল মোকাররম এলাকার মার্কেটগুলোর সামনে যানজট দেখা যায়।
পুরো রমজান মাসে বঙ্গভবন, গণভবনসহ নগরীর পাঁচ তারকা হোটেল, কনভেনশন সেন্টারে একাধিক ইফতার পার্টি অনুষ্ঠিত হবে। এসব ইফতার পার্টিতে ভিভিআইপি, ভিআইপিদের চলাচলে যানজট দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া ইফতারের পসরা নিয়ে সড়কের দুই ধারে ফুটপাতে বেচাকেনা চলে। এতে করে পথচারীদের চলাচলে দুর্ভোগ দেখা দেয়। তাই ফুটপাতে চলতে না পেরে তখন পথচারীরা সড়ক ব্যবহার করেন। এর ফলে যানবাহনের চলাচল করে বেশ ধীরগতিতে।
সড়কের ওপর হকারদের বসে যাওয়াকে সবশেষ সমস্যা বা বাধা হিসেবে মনে করছে ট্রাফিক বিভাগ। তাদের মতে, কারওয়ান বাজার কাঁচাবাজার, ফার্মগেট, পল্টন, মতিঝিলের মতো প্রধান প্রধান সড়কের দুই পাশে হকার বসলে যানজট ছড়িয়ে যেতে পারে।
রোজার সময় যানজট দূর করে চলাচল নির্বিঘ্ন করতে গত ২৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ট্রাফিক বিভাগ ও মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের বৈঠক হয়েছে। এতে এসব সমস্যা তুলে ধরে আলোচনা করা হয়। এর সমাধানে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর গত ২৫ এপ্রিল ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার সঙ্গে রমজান ও পবিত্র ঈদুল ফিতর উদ্যাপন উপলক্ষে ঢাকা মহানগর এলাকার সার্বিক নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার বিষয়ে বাসমালিক, চালক সমিতি, বিভিন্ন মার্কেট কর্তৃপক্ষ, মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ, ওয়াসা ও ট্রাফিক বিভাগের বিশেষ সমন্বয় সভা হয়।
ডিএমপি সদর দপ্তরে এই সভায় আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, পবিত্র রমজানে জনসাধারণ যাতে নিরাপদে ইফতারের আগে নিজ গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে, সে লক্ষ্যে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ কাজ করবে। সুষ্ঠুভাবে ইন্টারসেকশন ম্যানেজমেন্ট বাস্তবায়ন করা অর্থাৎ ইন্টারসেকশনে কোনো গাড়ি জটলা করে থাকবে না, নির্ধারিত স্থানে গাড়ি পার্কিং, শপিং মলের সামনে বা আশপাশে যানবাহন পার্কিং বন্ধ রাখা, ফুটপাত হকারমুক্ত রাখা, ফুটপাতে গাড়ি পার্কিং না করা এবং মোটরসাইকেল চলতে না পারে, সে ব্যবস্থা করা হবে। এ ছাড়া রিকশা-ভ্যান-ঠেলাগাড়ি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় উঠতে দেওয়া হবে না। এসব বিষয় নিবিড় তদারকির জন্য পিক আওয়ারে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা সড়কে উপস্থিত থেকে যানজট নিয়ন্ত্রণে কাজ করবেন।
সভায় রমজান মাসে অতি জরুরি প্রয়োজন না পড়লে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি না করতে ওয়াসাসহ সংশ্লিষ্ট কর্মীদের বলা হয়েছে। ট্রাফিক বিভাগের ছাড়পত্র ছাড়া ঢাকা শহরের কোনো সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি করা যাবে না।
যানজট নিরসনের উদ্যোগ
রমজান মাস শুরুর আগেই যাত্রী ও পথচারী ভোগান্তি কমাতে কারওয়ান বাজারে একটি পদচারী–সেতু স্থাপন করা হবে। সার্ক ফোয়ারার উত্তর ও দক্ষিণ পাশে মেট্রোরেলের প্রকল্পের জন্য স্ফীত দুটি অংশ ছোট করে দেওয়া হবে। রোজার পর এসব অংশে পিয়ার নির্মাণের কাজ শুরু হবে বলে জানিয়েছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ।
সার্ক ফোয়ারার এই দুই অংশে দুটি জেব্রাক্রসিং করে দেওয়া হবে। বাংলামোটর থেকে সিআর দত্ত সড়কে হকার উচ্ছেদ করা হবে। ফার্মগেট এলাকায় পার্কিং করা যাবে না। খেজুরবাগান থেকে ফার্মগেট পুলিশ বক্স পর্যন্ত সড়কটি মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজের জন্য যান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়ার কথা ছিল। তবে রোজার সময় এই সড়ক চালু রাখা হবে। ঈদের পর সড়কটিতে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হবে। মেট্রোরেলের জন্য উড়োজাহাজ ক্রসিং থেকে আগারগাঁও মোড় পর্যন্ত সড়ক আরেকটু প্রশস্ত করছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর এলাকা হকারমুক্ত রাখা হবে।
এ ছাড়া শপিং সেন্টারগুলোর সামনে পদচারী–সেতু থাকলে, পথচারীদের জন্য সেগুলো ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তাই নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য পদচারী–সেতুর ওপর সিসি ক্যামেরা বসানো হবে।
খালি বাস থাকবে সার্ক ফোয়ারার সামনে
সার্ক ফোয়ারা থেকে কিছু বাস ইউটার্ন করিয়ে বোরাক টাওয়ারের সামনের সড়কে খালি করে রাখা হবে। এসব বাসে যাত্রীরা যেন উঠতে পারেন, সেই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানান ট্রাফিক বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি-পশ্চিম) লিটন কুমার সাহা। তিনি সংবাদ মাধমকে বলেন, বাসের মালিকপক্ষের সঙ্গে কথা বলে এসব বাস ঘুরিয়ে খালি করা হবে। কারণ, এই সার্ক ফোয়ারা এলাকায় প্রচুর মানুষ ইফতারের আগের সময় যানবাহনের জন্য অপেক্ষা করেন। প্রতি ঘণ্টায় ১০টি করে খালি বাস যাত্রী তুলে নেবে।
লিটন কুমার সাহা বলেন, ‘স্বাভাবিক সময়ে মতিঝিল থেকে বিকেল পাঁচটায় অফিস–আদালত ছুটির পর মানুষের বাড়ি ফিরতে কখনো কখনো রাত নয়টা থেকে সাড়ে নয়টা বেজে যায়। রোজার সময় এই ছুটি হবে বিকেল সাড়ে তিনটায়। ইফতারের জন্য একজন রোজাদারের হাতে সময় থাকবে তিন ঘণ্টা। আমরা চাই অফিসফেরত লোকজন যেন পাঁচটার মধ্যে সোনারগাঁও বা বাংলামোটর এলাকা পার হতে পারেন। কারণ, এই এলাকা অতিক্রম করলে যানজট কিছুটা কমে যায়। এর ফলে সহজভাবে সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে মানুষ ঘরে ফিরতে পারবেন।’
জনবলের অভাব বড় বাধা
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) হিসাবে, রাজধানী ঢাকায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ বসবাস করে। এর মধ্যে এক কোটি মানুষ প্রতিদিন নগরীর বিভিন্ন প্রান্তে চলাচল করে থাকে। এত বিপুলসংখ্যক মানুষের চলাচলে ভরসা বাস, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেলসহ ১৩ লাখ যানবাহন। রোজার সময় প্রতিদিন ঢাকা শহরে প্রায় সোয়া এক কোটি মানুষ চলাচল করে। কিন্তু ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের মোট জনবল ৪ হাজার ৮০০। এর সঙ্গে ৫০০ আনসার সদস্য সব সময় কাজ করেন।
রমজান মাসে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে এবার বিভিন্ন মার্কেট কমিটি থেকে আরও ৫০০ সদস্য ট্রাফিক বিভাগের সঙ্গে কাজ করবেন। পুলিশের পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট থেকে আরও এক হাজার সদস্য রমজান উপলক্ষে যোগ দেবেন। ট্রাফিক পুলিশ, পুলিশ ও আনসারের সাত হাজার সদস্যের সঙ্গে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ আরও এক হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ সদস্য কাজ করবেন। সব মিলিয়ে রমজান মাসে দুই কোটি মানুষ, ১৩ লাখ যানবাহনসহ ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে ভরসা আট হাজার জনবল।
যানবাহন ও মানুষের নিয়ন্ত্রণে এই সংখ্যা ভীষণ অপ্রতুল বলে মনে করেন এআরআইয়ের গবেষক ও বুয়েটের সহকারী অধ্যাপক সাইফুন নেওয়াজ। তিনি সংবাদ মাধমকে বলেন, রমজান মাসে সুষ্ঠুভাবে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করতে গণপরিবহনের চলাচলের পরিমাণ বাড়াতে হবে। কারণ, ঢাকার ১৩ লাখ যানবাহনের মধ্যে বাস বা গণপরিবহন রয়েছে মাত্র সাড়ে চার হাজার। প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেলে ১২ লাখ মানুষ চলাচল করতে পারেন। বাকি প্রায় ৭০ লাখ মানুষের ভরসা এই সাড়ে চার হাজার গণপরিবহন।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন সিদ্দিক সংবাদ মাধমকে বলেন, উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত সড়কের মাঝখানে ১১ মিটার জায়গা নিয়ে মেট্রোরেলের কাজ করা হয়েছে। তবে যানবাহন ও লোকজন চলাচল বেশি হওয়ায় আগারগাঁও থেকে মতিঝিল সড়কে এই নিয়মে কাজ করা যাচ্ছে না। সে জন্য যখন যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকু জায়গা ঘেরাও করা হচ্ছে। কাজ বড় না হলে সড়কের ৩ থেকে ৪ মিটার জায়গা ঘিরে রাখা হয়েছে। আবার আরেকটু বড় হলে ৮ মিটার। মূল কাজের সময় ১১ মিটার জায়গা ঘিরে রাখা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। সেফটি ফার্স্ট পলিসি নিয়ে প্রকল্পের কাজ করা হচ্ছে।
পরিচালক আরও বলেন, ‘রোজার সময়ও বিকল্প উপায়ে কাজ করা হবে। আমরা কারওয়ান বাজারে পাশে একটি পদচারী–সেতু নির্মাণ করে দিচ্ছি। ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ট্রাফিক বিভাগের কাছে দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত আলোচনা–পর্যালোচনা করে পরিস্থিতি অনুযায়ী কাজ করছি।’