নিজস্ব প্রতিবেদক;
গরিব ঘরের সন্তান। পরিবারের সদস্যদের মুখে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোগানের জন্য হন্যে হয়ে ঘোরেন কাজের সন্ধানে। অবশেষে পেয়ে যান সোনার হরিণ। অল্প দিনেই কোটি কোটি টাকা উপার্জন করে স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে আসেন সংসারে। গরিব পরিবারটি পরিচয় পাল্টে হয়ে যায় বনেদি পরিবার। অবিশ্বাস্য এ ধরনের ঘটনা শুধু কল্পনা আর গল্প, সিনেমাতেই মানায়। কিন্তু পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের বেশকিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী এবার সেই সিনেমার গল্পকেও হার মানিয়ে দিয়েছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণাধীন এই প্রতিষ্ঠানটিকে অফিস সুপার হেদায়েত হোসেনের নেতৃত্বে কর্মচারীদের একটি চক্র টাকা তৈরির কারখানা বানিয়ে পাল্টে নিয়েছেন নিজেদের জীবন। ভোগ-বিলাস আর বিত্ত-বৈভব যাদের কাছে একদিন অলীক মনে হতো প্রতিষ্ঠানটির সেই তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীরাই এখন ঘুমাচ্ছেন টাকার বিছানায়। রাজধানীসহ নিজ নিজ গ্রামের বাড়িতে গড়েছেন টাকার পাহাড়। ব্যক্তিগত দামি গাড়ি হাঁকিয়ে আসেন অফিসে। মাসে মাসে বিদেশে গিয়ে প্রমোদ ভ্রমণ না করলে তাদের নাকি পেটের ভাতই হজম হয় না এখন। চোখের সামনে এত সব অনিয়ম হলেও রহস্যজনক কারণে অবৈধ পন্থায় অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলা এসব কর্মচারীর বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা তো নিচ্ছেনই না উপরন্তু এদের বাঁচাতে সব অনিয়ম ও অভিযোগের বিষয়টি এড়িয়ে চলেছেন সুকৌশলে। এসব কর্মচারীর খুঁটির জোর এতটাই বেশি যে, নানা সময় তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত শুরু হলেও তারা ঊর্ধ্বতনদের ম্যানেজ করে তা ঝুলিয়ে দিতে সক্ষম হন। অনেক ক্ষেত্রে তদন্ত রিপোর্টই গায়েব করে ফেলেন।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরে কর্মরতদের অনেকেই জানিয়েছেন, অফিস সুপার হেদায়েত হোসেনের নেতৃত্বে কর্মচারীদের একটি চক্র এসব অনিয়ম, দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি টাকার শ্রাদ্ধ করে চলেছেন। চক্রটির সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে কাজ করছেন হেদায়েত হোসেনের ভাগ্নে ড্রাইভার আজগর হোসেন। ক্ষমতার দাপট, ঘুষ, তদবির বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য এবং টেন্ডারবাজির মাধ্যমে কোটিপতি বনে গেছেন তারা প্রত্যেকেই। তারা জানান, কর্মচারী নেতা হওয়ায় অধিদফতরের কেউই হেদায়েতগংদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পান না। আর নেতা হওয়ার সুবাদেই প্রভাব খাটিয়ে টাইপিস্ট থেকে পদোন্নতি পেয়ে অফিস সুপারভাইজার পদটি দখল করে নেন তিনি। এরপরই পাল্টে যায় তার জীবনযাত্রা। একজন ৩য় শ্রেণির কর্মচারী হয়ে ৫০ লাখ টাকা দামের গাড়ি ব্যবহার করে নিয়মিত অফিসে যাতায়াত করেন তিনি। বছরের পর বছর নিয়মিত অফিসে উপস্থিত না থেকেও সব ধরনের সুবিধা ভোগ করছেন এবং সপদেও বহাল রয়েছেন।
এ বিষয়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) মো. রমজান আলী সংবাদমাধ্যমকে বলেন, অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি ভিন্ন। এসব নিয়ে কিছু বলা যাবে না। আর তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হয়ে প্রায়ই বিদেশ ভ্রমণের বিষয়ে তিনি জানান, আগে জানতে হবে সরকারি কাজে নাকি ব্যক্তিগত কাজে হেদায়েত হোসেন বিদেশ ভ্রমণ করছেন। সরকারি কাজে গেলে অনুমতির একটি বিষয় থাকে আর ব্যক্তিগত কাজে গেলে তো কথাই নেই। অনুমতি ছাড়া একজন সরকারি কর্মচারী প্রায়ই বিদেশ ভ্রমণ করতে পারেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে পরিচালক বলেন, ‘হেদায়েত হোসেনের বিদেশ ভ্রমণের বিষয়েই অমি কিছু জানি না। জানলে তো অনুমতির বিষয়টি আসবে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি সরকারের আমলে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী বরকত উল্লাহ বুলুর আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে তার ডিও লেটার নিয়ে নোয়াখালী থেকে বদলি হয়ে ঢাকার কাওরান বাজার প্রধান কার্যালয়ে আসেন হেদায়েত হোসেন। বিএনপির আদর্শে লালিত হেদায়েত হোসেন বিএনপি সরকারের আমলে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর কর্মচারী সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হন।
সরকারের পালাবদলে তিনি হয়ে যান আওয়ামী লীগপন্থি শ্রমিক নেতা। এরপর আর তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ঘুষ, টেন্ডারবাজি, তদবির ও নিয়োগবাণিজ্য করে শত শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। অভিযোগ উঠেছে, রাজধানীর মোহাম্মদপুরের আদাবর এলাকায় বাইতুল আমান হাউজিংয়ের ৫নং রোডের ম্যারিল্যান্ড নামে অ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্টের ৫ম তলা ও ৮ম তলায় তার রয়েছে ৩৩শ’ স্কয়ার ফিটের পৃথক দুটি ফ্ল্যাট। রাজধানীর আদাবরে ৫ কাঠা জমির ওপর ৯ তলা ভবন বর্তমানে নির্মাণাধীন রয়েছে। এ ছাড়া শ্যামলী স্কয়ার মার্কেটে ৪টি দোকান। বুড়িগঙ্গা সিটিতে রয়েছে কয়েকটি ফ্ল্যাট ও দোকান। তিনি শুধু দামি গাড়িতে করে অফিস করেন তাই নয়, রয়েছে পরিবারের সদস্যদের জন্যও ৩টি দামি গাড়ি। ২০১১, ১২ ও ১৩ সালে অধিদফতরের ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির জনবল নিয়োগ বাণিজ্যেও প্রধান হোতা হিসেবে নাম চলে এসেছে হেদায়েত হোসেনের।
সূত্রমতে, হেদায়েত হোসেনের হঠাৎ আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া এবং একজন ৩য় শ্রেণির কর্মচারীর মাসিক বেতনের আয়ের সঙ্গে সম্পদের মিল না থাকায় তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কার্যালয়ে অভিযোগ করেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরেরই এক কর্মকর্তা। ওই অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তও শুরু হয়েছিল। দুদকের ওই তদন্ত কর্মকর্তা বদলি হওয়ায় বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বর্তমানে দুদকের একজন উপপরিচালককে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
এদিকে অধিদফতরের কয়েকটি স্মারক নং যাচাই করে দেখা গেছে, চলতি বছরের ১৬ মে ছুটি নিয়ে দর্শনীয় স্থান পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া ভ্রমণ করেন হেদায়েত হোসেন। এ ছাড়া আরেক স্মারকে দেখা গেছে, ২০১৭ সালের ১৩ এপ্রিল আজমীর শরিফ জিয়ারতের উদ্দেশ্যে ভারত গমন করেন। সূত্র জানায়, প্রতি বছরই কয়েকবার তিনি দর্শনীয় স্থান পরিদর্শনের কথা বলে দেশের বাইরে বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র পরিদর্শনে সপরিবারে ভ্রমণ করেন।
হেদায়েতের ভাতিজা পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের ড্রাইভার আজগর হোসেনের বিরুদ্ধেও বিস্তর অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তিনি দুটি নিয়োগপত্রে জন্ম তারিখে দুই রকম তথ্য দিয়েছেন। জেলার ৮নং বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম স্বাক্ষরিত এক জন্ম নিবন্ধনে আজগরের জন্ম তারিখ ১৯৮৩ সালের ১ মার্চ উল্লেখ করা হয়েছে। যার নিবন্ধন নং-২৭৪৩। অপরদিকে চাকরি ও প্রকল্পে যোগদানকালে তার জন্ম তারিখ ১৯৭৭ সালের ১ জানুয়ারি উল্লেখ করেছেন আজগর। প্রকল্পে যোগদানের তারিখ ২০০১ সালের ১ জুলাই উল্লেখ করা হয়েছে। যার স্মারক নং-১০২০। আজগরও জন্ম তারিখ জালিয়াতি করে খোদ সরকারের পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরে চাকরি নিয়ে বিভিন্ন অপকর্ম করে এখনো বহালতবিয়তে রয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, আজগর হোসেন ড্রাইভার হলেও কাওরান বাজারস্থ পরিবার পরিকল্পনা অফিসে সর্বোচ্চ পর্যায়ে সম্পর্ক রয়েছে। মূলত নিয়োগ বাণিজ্য, বদলি, বিভিন্ন টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, গাড়ির তেল চুরি, নতুন নতুন প্রকল্পের কর্তা-ব্যক্তিদের সুনজরে থাকায় আজগরের প্রভার লক্ষণীয়।
বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে আজগর হেসেনের স্ত্রীসহ পরিবারের ১২ জন সদস্য পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে চাকরি করছেন। তাদের মধ্যে ৭ জন রয়েছে নোয়াখালীতেই। এসব বিষয়ে হেদায়েত হোসেন ও আজগর হোসেনের কর্মস্থলে কয়েক দফা যোগাযোগ করেও তাদের কাউকে পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনও রিসিভ করেননি তারা।