নষ্টরা সরে দাঁড়াও, বঙ্গবন্ধু আসবেন বিপ্লব হবে
- আপডেট সময় : ০৮:৩৫:৫৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০১৯ ১৯৩ বার পড়া হয়েছে
পীর হাবিবুর রহমান;
অবশেষে নুসরাত হত্যার লোমহর্ষক গা শিউরে ওঠা বর্ণনা এসেছে দুই আসামির জবানবন্দিতে। ফেনীর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জাকির হোসেনের আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে নূর উদ্দিন ও শাহদাত হোসেনের বর্ণনায় উঠে এসেছে কতটা নির্মম, নিষ্ঠুর ও হিংস্র হয়ে উঠেছে মানুষ।
সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়ন করেছিলেন অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা। এর আগেও তিনি অনেক ছাত্রীকে যৌন নিপীড়ন করেছেন। কিন্তু নুসরাত অসীম সাহসিকতার সঙ্গে যৌন বিকারগ্রস্ত অধ্যক্ষকে প্রত্যাখ্যানই করেনি, প্রতিবাদ করেছিল। পরিবার তার পাশে দাঁড়িয়েছিল। সে আইনের আশ্রয় নিয়েছিল। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ছত্রচ্ছায়ায় অপ্রতিরোধ্য সিরাজের বর্বরতার পক্ষে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোয়াজ্জেম হোসেন জিজ্ঞাসাবাদের নামে নুসরাতকে আরেক দফা হয়রানি ও নিপীড়ন করেছিলেন। সেই ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সেই ওসিকে প্রথমে প্রত্যাহার এবং অবশেষে গ্রেফতার করা হয়েছে।
নুসরাতের অভিযোগের পর অধ্যক্ষ সিরাজকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এতে স্থানীয় রাজনৈতিক, প্রশাসন ও মাদ্রাসা সিন্ডিকেট বেপরোয়া হয়ে ওঠে। মাদ্রাসায় পরীক্ষা দিতে গেলে নুসরাতকে ছাদে ডেকে নিয়ে গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পাঁচ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছে নুসরাত। মৃত্যুর আগে সে বলে গেছে, ‘আমি বাংলাদেশের জনগণকে বলব, পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে বলে যাব এমনকি প্রধানমন্ত্রীকে বলে যাব।’ মৃত্যুযন্ত্রণার অসহ্য বেদনা সহ্য করেও প্রতিবাদী নুসরাত বলে গেছে।
মানবিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাবই নেননি, নুসরাতের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন। নুসরাতকে সিঙ্গাপুর পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শরীরের ৮৫ ভাগ পুড়ে যাওয়ায় বাবার পড়ানো জানাজা শেষে দাদির কবরের পাশে তাকে শুয়ে যেতে হয়েছে। নুসরাত এ অন্যায়, এ অসভ্য বর্বরতার বিরুদ্ধে জীবন দিয়ে প্রতিবাদ করে গেছে। কোনো চাপের কাছে মাথা নত করেনি। ধর্ষক ও যৌন নিপীড়কদের বিরুদ্ধে এ প্রতিবাদ নুসরাতকে ইতিহাস অমরত্ব দেবে। পাকিস্তানের জঙ্গিবাদের হামলার শিকার হয়েছিল মালালা। নারীশিক্ষা স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল জঙ্গিবাদ। অসভ্য বর্বর পাকিস্তানে নারীশিক্ষার আলো অব্যাহত রাখতে গিয়ে মালালার দুঃসাহসী অভিযান বর্বর জঙ্গিবাদ গুলি করে তার প্রাণ কেড়ে নিয়ে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল। মালালা বেঁচে গিয়ে নোবেল পুরস্কার জয় করেছে। আর তামাম দুনিয়াকে বর্বরতার বিরুদ্ধে আলোড়িতই করেনি, তুমুল ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়েছে।
নুসরাত অপরাধী ও প্রভাবশালী অধ্যক্ষের অশুভ শক্তির চাপের কাছে মাথা নত না করায় অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা তাকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ৬ এপ্রিল সাড়ে ৯টা থেকে পৌনে ১০টার মধ্যে তার শরীরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে জবানবন্দিতে অপরাধীরা বলেছে, নিশাতকে ছাদে মারধর করা হচ্ছে সিরাজের ভাগ্নে পপির এমন তথ্যের ভিত্তিতে নুসরাত ছাদে ছুটে যায়। সেখানে নিশাতকে দেখতে পায়নি। অপেক্ষায় ছিল শামীম, জাবেদ, জোবায়ের ও বোরকা পরিহিত আরেক ছাত্রী। পরে পপি ছাদে ওঠে। মামলা প্রত্যাহার করার জন্য নুসরাতকে বার বার হুমকি দেওয়ার পরও কোনো কাজ না হলে তাকে মুখ চেপে ধরে শামীম। নুসরাতকে ওড়না দিয়ে বুকে চাপ দেয় পপি। ওড়নার একটি অংশ দিয়ে নুসরাতের পা বেঁধে ফেলে আরেক ছাত্রী। এরই মধ্যে নুসরাতের শরীরে কেরোসিন ঢেলে দেয় জোবায়ের। সর্বশেষ ম্যাচের কাঠি দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় জাবেদ। পিবিআইকে এ তদন্তের দায়িত্ব দেওয়ায় চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের সব রহস্য উদ্ঘাটন হচ্ছে একে একে। সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক খন্দকার বজলুল হকও বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেছেন, ছাত্ররা এখন টাকার পেছনে, গাড়ির পেছনে ছোটে। এ লোভ কারা দিয়েছে? শিক্ষকরাই তো রাজনৈতিক নিয়োগ ও অর্থের পেছনে ছোটেন। বজলুল হক খন্দকার অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। আবুল বারকাত জনতা ব্যাংকের। তারা ব্যাংকগুলো কোথায় রেখে গেছেন? বজলুল হকের নিজের শেয়ার বাণিজ্য নামে-বেনামে বিশ্ববিদ্যালয় মার্চেন্ট ব্যাংকের অংশীদায়িত্ব আছে। ২০১০ সালের শেয়ারবাজার বিপর্যয়ের পর ঢাবির আরেক অধ্যাপক খায়রুল হোসেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান হয়ে বলেছিলেন, তিন মাসে পুঁজিবাজার স্থিতিশীল হবে। নিজের ভাগ্য বদলেছে। ১০ বছর ধরে বাজারকে তিনি শেষ তলানিতে নিয়ে গেছেন। আর কত দিন থাকলে এটা শেষ হবে? বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান চালাতে ব্যর্থ।
সোমবার নবনির্বাচিত ডাকসুর সঙ্গে ‘ডাকসু ও হল অভিজ্ঞতা সংসদ শুনি সমৃদ্ধ হই’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেছেন ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের নায়ক, সেই সময়ের ডাকসুর ভিপি, বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য, বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী, প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান ও বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদ। সেখানে তিনি এ ঘটনার ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে বলেন, ফেনীর মাদ্রাসা শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফি হত্যার প্রতিবাদে ডাকসুর কোনো কর্মসূচি না থাকায় আমি মর্মাহত হয়েছি। তিনি সেকালের শিক্ষক ও একালের শিক্ষক সেকালের ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক আর একালের অবস্থা বিশদ বর্ণনা করেছেন অন্তরাত্মার ডাকে। তিনি বলেন, এখানে ডাকসুর ভিপি, জিএস, এজিএস আছেন। বিভিন্ন হল শাখার ভিপি, জিএস আছেন। ফেনীর শিক্ষার্থী নুসরাত হত্যাকাণ্ডের শিকার হলো, আপনাদের কোনো প্রতিবাদ কর্মসূচি নেই! এটা আমাকে মর্মাহত, ব্যথিত ও আহত করেছে। সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। ঐক্যবদ্ধ হয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে।
ডাকসু যেমন নুসরাত হত্যার প্রতিবাদে সারা দেশের ছাত্রসমাজকে প্রতিবাদে উত্তাল করে দিতে পারেনি, তেমনি শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের নায়ক ও তাদের অভিভাবকরা এ পাশবিক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কোনো সমাবেশের ডাক দেয়নি। বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে মানববন্ধন হলেও গণমাধ্যম ঘটনার ভয়াবহতা তুলে আনলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকার কঠোর অবস্থান নিলেও দেশের নিস্তব্ধ নিস্তরঙ্গ রাজনীতি ও প্রগতিশীল নাগরিক সমাজ প্রতিবাদে অগ্নিমুখর হয়নি। এমনকি আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীরা অনেক থাকলেও পদ-পদবিহীন আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমকেই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নুসরাত ও তার পরিবারের পাশে দেখা গেছে। কোনো রাজনীতিবিদ বা নারী নেত্রী অথবা মানবাধিকার নেতা-কর্মীর দেখা মেলেনি! প্রতিবাদী কেউ কেউ যেমন মাদ্রাসা বন্ধ করে দিতে বলেছেন, তেমনি হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শফী নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে ফতোয়া দিলেও দেশের মাদ্রাসাগুলোয় সংঘটিত ছাত্রছাত্রীদের ওপর পাশবিক যৌন নির্যাতন ও যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য দেননি, কিংবা কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার কর্মসূচি ঘোষণা দেননি।
জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে তাঁর নেতৃত্ব তাঁর জীবন যৌবন উৎসর্গ করা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ দেশের স্বাধিকার, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে জনগণ আত্মবলিদান দিতে কার্পণ্য করেনি। বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছে। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, অগ্নিসংযোগ ও বাংলাদেশকে পরিণত করা শ্মশানভূমিতে আড়াই লাখ মা-বোন দিনের পর দিন তাদের ও তাদের দোসরদের দ্বারা গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শুধু শহীদের রক্তে লেখাই নয়, সম্ভ্রমহারা মা-বোনের আর্তনাদ ও দীর্ঘশ্বাসে ভরা। স্বাধীনতার ৫০ বছরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে মাদ্রাসা শিক্ষা যেমন বন্ধ করা সম্ভব নয়, এটি অবাস্তব অতি প্রগতিদের অতি কল্পনাপ্রসূত চিন্তা, তেমনি মাদ্রাসাগুলোতে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার যেভাবে ছেলেমেয়রা হচ্ছে তা জঘন্য পাপাচারের নিকৃষ্ট চিত্রপট।
জর্ডান সফরকালে ডেড সি বা মৃত সাগরের তীরে দাঁড়িয়ে লবণাক্ত জলে নেমে দেখেছি পবিত্র ধর্মগ্রন্থে ব্যভিচারের জন্য লুত নগরীর ধ্বংসের ইতিহাস। এটা শুধু সরকার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বই নয়, এটা রাষ্ট্রের পবিত্র দায়িত্ব মানুষের জানমাল ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তা দেওয়া। আর এ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কেবল প্রগতিশীল শক্তিই নয়, রাজনৈতিক শক্তিই নয়, ইসলামী চিন্তাবিদ থেকে শুরু করে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের এক কথায় জনগণের নৈতিক দায়িত্ব।
শুধু মাদ্রাসায় যৌন নিপীড়ন হয় না। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানির অভিযোগে শিক্ষক ও ছাত্র বহিষ্কারের নজির রয়েছে। সর্বনিম্ন স্তর থেকে উঁচু স্তর, গরিব থেকে বিত্তবান সব শ্রেণি-পেশায় শিক্ষাঙ্গন থেকে কর্মক্ষেত্র, পরিবার থেকে সমাজ যুগের পর যুগ নারী যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে।
আমাদের সমাজ ও পরিবার ছেলেবেলা থেকেই এই বলে সাহস ভেঙে দেয়, এটা বলো না, ওটা বলো না, এটা করো না, ওটা করো না- এমন নিষেধাজ্ঞা জারি করতে করতে। কিন্তু আজকের প্রজন্ম অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে দুনিয়াকে হাতের মুঠোয় দেখতে পাচ্ছে। তাই প্রতিবাদ করতে শিখছে। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত অনেক নারী প্রলোভনে সমর্পণ করেন। অনেকে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে মুখ বুজে সয়ে যান লোকলজ্জার ভয়ে। কিন্তু মাদ্রাসাপড়–য়া আমার ও আমাদের মেয়ে নুসরাত পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যৌনবিকৃত অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার গালে কশে থাপ্পড় মেরেছে। আইনের আশ্রয় নিয়েছে। আইন সিরাজ-উদ-দৌলাকে কারাবন্দী করলেও যে পুলিশ জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বিজয় আনে, সেই পুলিশের এক নষ্ট সদস্য সোনাগাজী থানার ওসি অর্থের লোভে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও দুর্বৃত্ত সিন্ডিকেটের সদস্য হয়ে আইন লঙ্ঘনই করেনি, দায়িত্ব পালনে অবহেলাই করেনি, নিপীড়কের পক্ষে, নির্যাতিতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। সব যৌনবিকারগ্রস্ত ধর্ষক ও নিপীড়ক পুরুষের গালে নুসরাত থাপ্পড় মেরে জানিয়ে দিয়েছে, নষ্ট বিকৃত পুরুষ আড়ালে নারীকে পেলেই ধরে বস, ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে নিপীড়ন কর- এসব বন্ধ কর। নুসরাতরা জীবন দিয়ে প্রতিবাদ করতে শিখেছে। নারীর প্রতি, মেয়েদের প্রতি সম্মান দেখাও। মানুষ হও। না হয় পরিণতি ভয়াবহ হবে।
নুসরাতের প্রতিবাদ, মৃত্যু আবার জানিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফেনী এখনো একটি অভিশপ্ত জনপদের নাম। ফেনীর সামগ্রিক রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অবস্থানের গভীর তদন্ত সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নিস্তব্ধ রাজনীতির এ জমানায় সমাজ যেখানে বোধহীন ও অনুভূতিহীন হয়ে পড়েছে, সেখানে নানা অপকর্ম চলছে। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সিন্ডিকেটের সহায়তায় এমনটিই হচ্ছে। যার খুশি হিজাব পরবে, যার খুশি জিন্স-টিশার্ট পরবে। পোশাক ধর্ষণের জন্য দায়ী নয়। দায়ী মানসিক বিকৃতি। ধর্ষণকামী কুৎসিত মন।
যে কথা বলছিলাম, সেটি হচ্ছে মাদ্রাসা বন্ধ করা সম্ভব নয়। মাদ্রাসাগুলোকে আধুনিকায়ন ও মূলধারায় সম্পৃক্ত করার যে কৌশল শেখ হাসিনা গ্রহণ করেছেন, সেটিই উত্তম। তেমনি গোটা দেশে রাজনৈতিক বাণিজ্যিকীকরণ, সুবিধাভোগী সব শ্রেণি-পেশার মানুষ যেভাবে রাতারাতি শাসক দলের দলদাস, দলকানা ও দলদাসীতে পরিণত হচ্ছেন, মূল্যবোধের যে অবক্ষয় ঘটছে, দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি ও তদবির বাণিজ্যের যে উন্মত্ত বেপরোয়া হাট বসেছে তা প্রতিরোধ করা বড় বেশি জরুরি।
একজন ক্ষুদ্র মানুষ হিসেবে আমার আজন্ম হৃদয়ে যে নেতার নাম অনুরিত হয়, শরীরে শিরায়-উপশিরায় এবং আত্মাজুড়ে যে নেতার নাম বহমান তিনি আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সারা জীবনের সংগ্রাম ছিল মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা। তাঁর জীবন-যৌবন উৎসর্গ করা চিন্তা-চেতনাজুড়ে ছিল দেশ ও মানুষ। দেশের স্বাধীনতা, মানুষের মুক্তি ও গণতান্ত্রিক শোষণমুক্ত অসাম্প্রদায়িক সমাজব্যবস্থা। লাখো শহীদের রক্তে ভেজা বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ ছিল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। পরিবার-পরিজনসহ বিশ্বমোড়লদের নীলনকশায় এ দেশের বিশ্বাসঘাতক একদল খুনির উন্মত্ত আক্রমণে বাঙালি জাতির ইতিহাসের ঠিকানা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে তিনি নিহত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সামরিক শাসনকবলিত বাংলাদেশে তাঁর নামটাই নিষিদ্ধই করা হয়নি, ইতিহাস বিকৃতই হয়নি, আওয়ামী লীগ নামের দলটিকে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টাই হয়নি, মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা থেকে রাষ্ট্রকে বিচ্যুত করা হয়েছিল। তাই যারা আজ মঙ্গল শোভাযাত্রার ফতোয়া দেন, তারা আত্মঘাতী কথা বলছেন। কারণ বাংলাদেশ কোনো ইসলামী প্রজাতন্ত্র নয়। এটা ইরান, আফগানিস্তান বা পাকিস্তান স্টাইলে কিংবা আরব দেশগুলোর মতো প্রত্যাশা করলে ভুল করবেন। এটা মুক্তিযুদ্ধের রক্তে অর্জিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে সব নাগরিকের সমঅধিকার এখানে নিশ্চিত করা হয়েছে। তেমনি যারা একসময় মুজিববিদ্বেষী অতিবিপ্লবী ছিলেন কেউ মাও সে তুংয়ের লাল বই নিয়ে হেঁটেছেন। কেউবা উগ্র হঠকারী পথের রাজনীতি করেছেন। দেউলিয়া হয়ে আজ তারা সবাই সেদিনের আওয়ামী লীগ ও মুজিববিদ্বেষী হয়েও শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগে হাইব্রিড হয়ে বসতি গড়েছেন। তাদের বোঝা উচিত সময়ের বিবর্তনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের ভাষায়, এটি আজ মডারেট মুসলিম কান্ট্রি। এখানে নববর্ষে মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ যেভাবে বর্ণাঢ্য আয়োজনে যেমন বর্ষবরণের উৎসব হবে তেমনি গ্রামে গ্রামে যাত্রাপালাও হবে। আবার ওয়াজ মাহফিলও হবে। কিন্তু কেউ কেউ যেমন মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেন, আল্লাহ-রসুলকে কটাক্ষ করেন তাদেরও বরদাশত করা যাবে না। তেমনি গ্রামে গ্রামে একদল মৌলবাদী যেমন ওয়াজে ধর্মান্ধতা সাম্প্রদায়িকতার বিদ্বেষ ছড়ান, বাঙালি জাতিসত্তার সংস্কৃতিকে হিন্দুদের সংস্কৃতি বলে সমাজকে বিষাক্ত করেন, তাদেরও দমন করতে হবে। সম্প্রীতি শান্তি বিনষ্ট করে সমাজে বিষের বাতাস ছড়ানো ধর্ম বা প্রগতিশীলতা নয়।
শেখ হাসিনার কাঁধে বন্দুক রেখে পরাজিত বিপ্লবীরা নিজেদের লক্ষ্য বা শিকার করার ব্যর্থ চেষ্টা করবেন না। সমাজের সব শ্রেণি-পেশার নব্য আওয়ামী লীগাররা নব্য মুসলমানদের বেশি করে গরু খাওয়ার মতো শেখ হাসিনা বন্দনা করলেও খেয়েপরে ভালো আছেন। থাকেন। সেদিনের আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও মুজিববিদ্বেষী এমনকি কখনোসখনো চরম শেখ হাসিনাবিরোধীরা আজ আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার নামে জিকির করছেন। কিন্তু মনে রাখবেন, মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকারিত্ব বহন করা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ ও তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার শক্তির উৎসই হচ্ছে জনগণ। আপনারা নন। আজকাল সমাজে আড্ডা দিতেও কোথাও যেতে মন চায় না। স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার পরিবারের সন্তান কিংবা এই সেদিনের আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনাবিদ্বেষী বিভিন্ন দল করা হাইব্রিডরা আজ নব্য আওয়ামী লীগ হয়ে আস্ফালন করতে দেখি। বমি আসে। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আপনাদের নেতারা ঔদ্ধত্য দেখিয়েছিলেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর আপনারা মহান নেতার নামের আগে বঙ্গবন্ধু শব্দটি যোগ করতেন না। শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের চরম বিরোধীই নয়, বিদ্বেষী ছিলেন।
গণমানুষের গণমুখী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের পুনরুত্থান দুই দফা ঘটেছে। প্রথম দফা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। তাঁর নেতৃত্বেই এসেছে স্বাধীনতা ও স্বাধীন বাংলাদেশ। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে আপনাদের পূর্বসূরিরাই সেদিন চাটুকার মোসাহেব হয়ে চরিত্র পাল্টেছিল। পঁচাত্তরের পর পায়ে পায়ে মৃত্যুর সঙ্গে দীর্ঘ লড়াই সংগ্রাম করে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে দ্বিতীয় দফা জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলে পরিণত করেছিলেন। আপনারা রিক্ত-নিঃস্ব, এতিম তথাকথিত প্রগতিশীল দলের কর্মী হয়ে সেদিন মাঠে ময়দানে কাজ করেছেন। আজ হালুয়া-রুটির লোভে নব্য আওয়ামী লীগ হয়ে সেসব সুবিধাভোগী পূর্বসূরির পথ অনুসরণ করে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ বন্দনা করছেন। নিজেদের চরিত্র ও বিশ্বাসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে আপনাদের বুক কাঁপে না। নির্বোধ ও অনুভূতিহীন সমাজে রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের সুযোগে আপনারা আজ বাইচান্স আওয়ামী লীগার, বাইচান্স আওয়ামী গণমাধ্যমকর্মী, বাইচান্স আওয়ামী ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও বাইচান্স আওয়ামী প্রশাসনিক কর্মকর্তা, বাইচান্স আওয়ামী শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক কর্মী ও গণমাধ্যমের মুখ হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে, একটি কথাই বলতে চাই, শেখ হাসিনার চেয়ে বড় আওয়ামী লীগার হবেন না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের সন্তান বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমের চেয়ে বড় মুজিব অনুসারী হবেন না।
কাদের সিদ্দিকী একাত্তরে ভারতের সহযোগিতা ছাড়া দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে টাইগার সিদ্দিকী হয়েছেন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর আপনারা ও আপনাদের নেতারা যখন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে মিথ্যা কুৎসিত অপপ্রচার চালিয়েছেন তখন বাঘা সিদ্দিকী বা একমাত্র বেসামরিক খেতাবপ্রাপ্ত বীরউত্তম কাদের সিদ্দিকী প্রতিরোধযুদ্ধে গেছেন। পিতৃহত্যার বদলা নিতে তার বাহিনীতে হাজার হাজার মুজিব অন্তঃপ্রাণ কর্মী যুক্ত হয়েছেন। শতাধিক কর্মী জীবন দিয়েছেন। বিশ্বজিৎ নন্দীর চেয়ে আপনাদের অবদান বেশি নয়।
আজকাল আপনারা বাইচান্স আওয়ামী লীগার, বাইচান্স টিভি মালিক, বাইচান্স আওয়ামী প্রশাসনিক কর্মকর্তা। কাল ক্ষমতা বদল হলে আপনাদের মতো সুবিধাবাদী শ্রেণি খড়কুটোর মতো উড়ে যাবেন। তাই বলছি, এটা বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। এখানে সুবিধাবাদী লুটেরা, হাইব্রিড সুযোগসন্ধানীর কোনো জায়গা নেই। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমার কৃষক, আমার শ্রমিক, গরিব মানুষেরা, অশিক্ষিতরা দুর্নীতি করে না। দুর্নীতি করে শিক্ষিতরা। আসলেই তো আজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কারা দুর্নীতি করে? জাতির মেধাবী সন্তানরা প্রকৌশলী হয়, ডাক্তার হয়, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হয়। প্রশাসনের কর্তা হয়। আজ স্বাস্থ্য খাত, প্রকৌশল খাত ঘিরে কি দুর্নীতির মহোৎসব! এদের রুখতে হবে।
বঙ্গবন্ধু ও তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা গণতন্ত্রের প্রতীক। গণতন্ত্রের দরজা-জানালা খুলে দিতে দিন। গণমাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করতে চাইবেন না। গণমাধ্যম ও রাজনীতির জন্য সামনের সময় চ্যালেঞ্জের। তোমরা সুবিধাবাদী শ্রেণি, নির্লোভ, দেশপ্রেমিক, রাজনীতির পথপ্রদর্শক বঙ্গবন্ধুর নামে শেখ হাসিনার নামে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছ, বিত্তবৈভব গড়েছ। তোমরা সরে দাঁড়াও বঙ্গবন্ধু আসবেন। পঁচাত্তরের পর আমাদের কৈশোর ও তারুণ্যে কঠিন দুঃসময়ে স্লোগান তুলেছিলাম, এক মুজিব লোকান্তরে লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরে। অর্থাৎ প্রতি ঘর থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কর্মীরা বেরিয়ে আসবে। তোমরা যারা দুর্নীতিবাজ ঘুষখোর, তদবিরবাজ সুযোগসন্ধানী লুটেরা, গণতন্ত্রবিরোধী, ধর্মবিদ্বেষী এবং ধর্মান্ধ, তারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বিরোধী। এ দেশ যত দিন থাকবে বঙ্গবন্ধু তত দিন থাকবেন। বঙ্গবন্ধু বিশ্বনন্দিত দুনিয়া কাঁপানো রাজনীতিবিদ। আগামী প্রজন্ম বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠে আসবে। একদিন এ দেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়েছে তাঁর নামে। একদিন এ দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে তাঁর নামে। একদিন এ দেশে তাঁর শক্তির ওপর ভর করে গণতন্ত্রের সংগ্রাম হয়েছে। আগামীতে তাঁর নামে বিপ্লব হবে। তাঁর স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার। অতএব সমাজের সব শ্রেণি-পেশার সুবিধাবাদী নষ্ট মানুষের দল তোমরা সরে দাঁড়াও, বঙ্গবন্ধু আসছেন। বঙ্গবন্ধু এ রাষ্ট্রের শক্তির উৎস। তিনি বার বার ফিরে আসবেন। (সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন)
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।