আলম রায়হান;
বরিশালের সাংবাদিক সৈয়দ মেহেদী হাসান ১২ এপ্রিল তার ফেসবুক ওয়ালে দুটি পোস্ট দিয়েছেন। এক. সোনাগাজীর কথিত অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলার মুক্তির দাবিতে পথসভায় নূর উদ্দিনের জ্বালাময়ী বক্তব্যের ভিডিও। দুই. বরিশালে সাংবাদিকদের চাপে আয়োজকদের পলায়ন। সাংবাদিকতার জন্য এ দুটি ঘটনাই চরম উদ্বেগের বলে মনে হচ্ছে। আমার ধারণা, এ জন্য অপশক্তির পাশাপাশি রাষ্ট্রযন্ত্রেরও দায় আছে। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে যে অপকর্ম বিএনপির তথ্যমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা করেছিলেন কেন্দ্রে, তাই ছড়িয়ে গেছে বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। বৈরী এই ধারার বিরুদ্ধে যারা দাঁড়িয়ে আছেন তাদেরকে অনেক চাপ নিতে হচ্ছে। এদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আবার বেশ শোচনীয়।
অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলার নির্দেশে নূর উদ্দিনের পরিকল্পনায় পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয় সোনাগাজীর মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাতকে। এর আগে সিরাজ উদ্দৌলার মুক্তির দাবিতে কথিত মানববন্ধনে এই নূর উদ্দিন সাংবাদিকদের কুলাংগার হিসেবে আখ্যায়িত করে দেখে নেবার হুমকি দিয়েছেন। তবে এ ধরনের হুমকি বিরল কোনো ঘটনা নয়। সাংবাদিক প্রহার, পঙ্গু করে দেয়া; এমনকি হত্যা করার উদাহরণও মোটেই বিরল নয় আমাদের দেশে। এসব হচ্ছে দৃশ্যমান বিষয়, মাথা মোটা অপশক্তির কাজ। এটি সাংবাদিকতার জন্য বৈরিতার উহারণ। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে চরম বৈরিতা হচ্ছে, সাংবাদিকতার মূলে অদৃশ্য কৌশলী আঘাত। যার সূচনা হয়েছিলো বিএনপি সরকারের তথ্যমন্ত্রী থাকাকালে ব্যরিস্টার নাজমুল হুদার হাত ধরে। তবে তিনি বেশি কিছু করেননি; কেবল ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নে দলীয় বিভক্তি টেনে দিয়েছিলেন। আসলে বুদ্ধিমান লোকদের বেশি কিছু করতে হয় না। তাদের সামান্য কৌশল বড় বিপর্যয় ঘটাতে পারে। সরকারের পক্ষ হয়ে এই কাজটিই করেদিয়েছেন সেই সময়কার গুণধর তথ্যমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা। ১৯৯১ সালে অবিভক্ত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সর্বশেষ নির্বাহী কমিটির নির্বাচিত ইসি সদস্য হিসেবে বিষয়টি আমার বেশ জানা আছে।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সেই বিভক্তি সাংবাদিকতাকে দলবাজির দিকে ঠেলে দিয়েছে দ্রুত। দলবাজিতে অনেক সাংবাদিক নেতা আচরণ করেছেন ‘দুই কানকাটা লোকের’ সেই প্রবচনের মতো! সাংবাদিকতা পেশার অধগতির এ ধারায় একএক সময় একএক গ্রুপের কতিপয় দলবাজ ক্ষমতার হালুয়া রুটি লোটার তালে থেকেছেন। ক্রমাগতভাবে এ অবস্থা চলতে থাকা এবং অন্যান্য কারণে সাংবাদিকতা এখন আছে প্রায় খাদের কিনারে। যদিও বর্তমান ইউনিয়ন নেতৃত্ব পেশাদার ভূমিকা পালনের চেষ্টা করছেন বলে ধারণা অনেকের। কিন্তু জগদ্দল পাথর সরানো কি এতো সহজ!
সাংবাদিক সৈয়দ মেহেদী হাসানের পোস্ট অনুসারে দৈনিক আজকের বার্তার প্রকাশিত খবরের শিরোনাম হচ্ছে, ‘অনুষ্ঠানে ফটো সাংবাদিক ৩২, কলম সাংবাদিক দশ, অতঃপর আয়োজকদের পলায়ন।’ সৈয়দ মেহেদীর ভাষায় ‘বরিশাল সাংবাদিক চাষের জন্য যে ঊর্বর ভূমি এটি তার দালিলিক প্রমাণ।’তবে আমার জানামতে, সারা দেশের অবস্থাই মোটামুটি এ রকমই। যা নিয়ে পিআইবির প্রয়াত মহাপরিচালক শাহ আলমগীর বেশ মর্মপীড়ায় ভুগতেন।
বরিশালের সাংবাদিকতা নিয়ে সৈয়দ মেহেদী যে উদাহরণ তুলে ধরেছেন তা কমবেশি পুরো বাংলাদেশেরই হলেও বরিশালের বিষয়টি আমার কাছে বেশি সংকটময় মনে হয়। হয়তো জন্মস্থান নিয়ে আমার আলাদা সংবেদনশীলতার কারণে এমনটি হতে পারে। তবে এখন মনে হচ্ছে, গত প্রায় দুই বছর ধরে অর্জিত আমার ধারণা মোটামুটি যথার্থ। আর এ বিষয়টি আমি জানতে পেরেছি ঘটনাচক্রে। পৈত্রিক জমি ভূমি দস্যুদের কবলে পড়ায়। এর পেছনে বরিশাল মেট্রোপলিটনের এক থানার ওসির সংশ্রব ছিল। বিষয়টি সে সময়কার পুলিশ কমিনার এস এম রুহুল আমিনকে জানিয়েছিলাম। তিনি আন্তরিকভাবে নিয়েছেন। কিন্ত কোনো ফল হয়নি। উল্লিখিত ওসির শেকড় এতোই গভীরে যে, রুহুল আমিনের মতো দাপটের কমিশনারকে পাত্তা না দেবার সাহস দেখিয়েছেন। কিন্তু বিষয়টি কমিশনারকে জানিয়ে তাকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে চাইন। এরপর কত কমিশনার এলোগেলো, কিন্তু সেই ওসির বদলির আদেশ আর আসে না! এ যেন সুনীলের কবিতার বোস্টমির মতো অবস্থা!
প্রায় কুড়ি বছর ধরে বরিশাল চাকরি করা এই গুণধর পুলিশ কর্তা এখনো মেট্রোর এক থানার ওসি হিসেবেই দাপটের সঙ্গে আছেন। শুধু তাই নয়, দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিয়ে, পুলিশের স্বল্প বেতনে চাকরি করেও শহরের অভিজাত এলাকায় বহুতল বাড়ি করতে পেরেছেন এই ওসি। কেউ তাকে কখনো কোন প্রশ্ন করেছে বলে কারো জানা নেই। কারাণ, তিনি সরকারের লোক; তাও আবার পুলিশ!
আর আমি জেনেছি, সরকারের কতিপয় কর্মকর্তা বরিশালের সাংবাদিকতা প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য নানান কৌশলে সক্রিয় রয়েছেন। এদের প্রধান সহযোগী হিসেবে পাশে রয়েছে সাংবাদিক নেতাদের কেউ কেউ। ফলে সাংবাদিকতা পেশার বারোটা বাজানো সহজ হয়েছে। ফলে এরশাদ সরকার আমলে নষ্ট এমপি হিসেবে পরিচিত, সেসময় এমপি হোস্টেলে জুয়ারিদের শিরোমনি ব্যক্তিটির মামলায় বরিশালে সাংবাদিক প্যাদানো খুবই মামুলি বিষয় হয়ে গেছে। মজার বিষয় হচ্ছে, ন্যাক্কারজনক এ ঘটনার কার্যকর কোন প্রতিবাদ হয়নি। অথচ সাংবাদিকের রিপোর্টে নাখোশ ব্যক্তিটি কেবল চোর নন, এই ব্যক্তির চরিত্রও ফুলের মতো পবিত্র এবং উদার! ফলে তিনি বাসার কাজের ছেলের বোনকে বিয়ে করার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। এ ক্ষেত্রে ধর্ম কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্নীতিবাজ এবং সাংবাদিকতা পেশার কতিপয় অসাংবাদিক নেতা ও রাজনীতির একটি অংশ যখন অনৈতিক স্বার্থের হাত মেলায় তখন সাংবাদিকতাসহ সকল নান্দনিকতা ধুলোর লুটোপুটি খেতে বাধ্য। অথচ এই বরিশালের অবস্থান কতটা উপরে ছিল তার কিছু প্রমাণ আছে আবদুল গাফফার চৌধুরীর বয়ানে।
অকালে নাফেরার দেশে চলে যাওয়া পিআইবির মহাপরিচালক শাহ আলমগীরের সময় প্রকাশিত ‘অগ্রজের সঙ্গে একদিন’ সংকলন গ্রন্থ থেকে জানা যায়, আবদুল গাফফার চৌধুরীর সাংবাদিকতা ও লেখক জীবন শুরু হয়েছে বরিশালের পত্রিকা দিয়ে। এদিকে অনেকেই জানেন, বরিশালের পত্রিকা দিয়ে সাংবাদিকতায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন অনেকেই। এদের কেউ প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন জাতীয় পর্যায়ে, অনেকে প্রতিষ্ঠিত স্থানীয় পর্যায়ে। কেউ আবার জাতীয় পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর বিট করার পরও বরিশালে গিয়ে সাংবাদিকতা করেন। কিন্তু এরা সাধারণত আলোচনায় আসেন না। আলোচনায় আসেন তারা, যাদেরকে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে সাংবাদিকতা পেশাকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য। এদের জোয়ারেই অনুষ্ঠানের আয়োজকরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। যে ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে বরিশালের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক আজকের বার্তায়। এই হচ্ছে বরিশালের একটি চিত্র। অথচ এই বরিশাল গর্ব ও ঐতিহ্যের ধারক। এই বরিশালকে বলা হতো প্রাচ্যের ভেনিস। এই বরিশাল সম্পর্কে মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, ‘যখন সমগ্র ভারত গভীর নিন্দ্রায় নিমগ্ন ছিলো তখন বরিশাল ছিলো সদা জাগ্রত।’ এই হচ্ছে বরিশালের অতীত। কেবল সুদূর অতীত নয়, বরিশালের নিকট অতীতও ছিল সমৃদ্ধ।
বরিশাল সম্পর্কে আবদুল গাফফার চৌধুরীর ভাষ্য হচ্ছে, ‘বরিশালে আমার শৈশব কেটেছে। ওখান থেকে মেট্রিক পাস করেছি। বরিশাল তখন অত্যন্ত সমৃদ্ধ শহর ছিল। এখন বড় বড় অট্টালিকা হয়েছে। কিন্তু তার কালচারের মান অনেক নেমে গেছে।’ শুধু কালচার নয়, সাংবাদিকতার মান কোথায় নেমেছে, তার একটি উদাহরণ তো সৈয়দ মেহেদীর পোস্ট থেকে পাওয়া যায়। কিন্তু কী ছিল বরিশালের সাংবাদিকতার অবস্থা? আবদুল গাফফার চৌধুরীর ভাষ্য হচ্ছে, ‘বরিশালে এখন অনেক দৈনিক কাগজ। তখন দুটি কাগজ ছিল। বরিশাল হিতৈশী এবং নকিব। দুটিই অত্যন্ত উন্নতমানের কাগজ ছিল। নকিবে এক সময় কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা লিখেছিলেন।’
নিকট অতীতেও বরিশালের সাংবাদিকতা অনেক সমৃদ্ধ ছিল। বরিশালে এখনো সুষ্ঠু সাংবাদিকতার ধারা অনেক শক্তিশালী। কিন্তু আগাছার আধিক্যে কেবল হলুদ সাংবাদিকরাই নজর কাড়ে! অথচ বরিশালের পত্রিকার মান ছিল গর্ব করার মতো। যা আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখায় ফুটে উঠেছে। কেবল পত্রিকার মান নয়, প্রশাসনের মানও ছিল উন্নত। আবদুল গাফফার চৌধুরীর ভাষায়, ‘অন্নদাশঙ্কর রায় তখন বরিশালের ডিসি। ডিসিকে বলা হতো ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট(ডিএম)। ডিএম লজে প্রত্যেক পূর্ণিমার রাতে একটা আসর বসতো। বড়বড় সাহিত্যিকরা আসতেন।’
পরের যুগে বরিশালের ডিসিদের লজে কাদের আসর বসেছে জানি না। তবে শুনেছি, সদ্য সাবেক একজন ডিসি শহরের সবচেয়ে অভিজাত হোটেল পার্ক-এ অন্যরকম একান্ত আসর বসাতেন। উচ্চমানের হোটেলে সরকারী কর্তার ‘লটরপটর’কাহিনি পুলিশের পর্যবেক্ষণের মধ্যেও ছিল বলে জানা যায়। এরচেয়েও ঘৃন্য আসর বসাতেন বরিশালের প্রথম ডিআইজি জিয়াউদ্দিন নগরীর নিম্নমানের একটি হোটেলে। আবার এ রকম এক আসরে বিশেষ ভালোলাগার টানে ইরানি নামে একাধিক সন্তানের জননীর গভীর প্রেমে পড়েছিলেন এরশাদের শাসনামলে বরিশালের এক ডিসি। তাকে বিয়েও করেছিলেন। এ নিয়ে নানান কেলেংকারির ঘটনা আছে।
সরকারের এই ধরনের অতি গুণধর কর্মকর্তা সকল যুগেই কমবেশি বিরাজমান। যারা চান না, সুষ্ঠু সাংবাদিকতার প্রসার লাভ করুক। হয়তো তাদের কৌশলী খেলা এবং নানান অপরাধী চক্রের কারসাজিতে বরিশালের সমৃদ্ধ সাংবাদিকতার ধারা দ্রুত নেমেছে। এ অধগতির বিপরিতে অনেকে শক্ত অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও পঙ্গপালসম একদল ফটো সাংবাদিকের চাপে অনুষ্ঠান আয়োজকদের পালিয়ে যেতে হয়! আর যেদিকেই চোখ যায়, কেবলই ফটো সাংবাদিক। বরিশালে প্রকৃত ফটো সাংবাদিকদের সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু তাদের চিহ্নিত করা কঠিন। এদিকে রিপোর্টার তেমন একটা দেখা যায় না। এ যেনো একদা প্রবহমান নদীর বুকে কেবলই ধুধু বালুচর! এক সময়ের প্রমত্মা পদ্মা এখন মরা নদী!
গত সপ্তাহে বরিশালে আমি দুই-তিনটি অনুষ্ঠানে গেছি। কিন্তু রিপোর্টার চোখে পড়েনি তেমন। কেবল ফটো সংবাদিক দেখেছি। এমনকি সিটি করপোরেশনের অবসরে যাওয়া ৩৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বহু বছরের চার কোটি টাকারও বেশি পুরনো বকেয়া পরিশোধে মেয়র সাদিকের বাসায় ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠান কাভার করতে রিপোর্টার দেখেছি বলে মনে হয় না। তবে ফটো সাংবাদিক ছিলেন অনেক! এটিই নাকি বরিশালের বাস্তবতা। কিন্তু কেন এই রিপোর্টার খরা?
এ প্রসঙ্গে যাদের সঙ্গে কথা বলেছি তাদের কারো কারো বক্তব্য হচ্ছে, ‘বরিশালের কোনো অনুষ্ঠানে রিপোর্টারদের গুরুত্ব দেয়া হয় না; গুরুত্ব পায় কেবল ফটো সংবাদিকরা।’ এমনটা হয়ে থাকলেও রিপোর্টাররা কেন নিউজ কাভার করা থেকে বিরত থাকবেন? আর অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদেরকে গুরুত্ব দেয়া না দেবার প্রসঙ্গ আসবে কেন? সাংবাদিক তো যাবেন নিউজ কাভার করার জন্য, নিশ্চয়ই জামাই আদর পাবার জন্য নয়। কাজের সুবিধা বিবেচনায় সাংবাদিকদের জন্য আলাদা বসার ব্যবস্থা করার রেওয়াজ আছে বহু প্রাচীন। যদি কেউ এটা না করেন, তবে সেটা তার দৈন্যতা। এতে রিপোর্টারের নোট নিতে অসুবিধা হলেও স্পটে না যাবার যুক্তি কেবল খোড়া নয়, পেশার জন্যও ক্ষতিকর।
আর ফটো সাংবাদিকরা এক শ্রেণির লোকের কাছে অধিক গুরুত্ব পেয়ে থাকেন। এটি বাস্তবতা। এরকম বাস্তবতা প্রথম দেখেছি এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় টোকাইদের বিবেচনায়। হরতাল কাভার করার জন্য সাংবাদিকদের গাড়িতে ক্যামেরাম্যান না থাকলে টোকাইরা গাড়ি আটকে দিতো। রিপোর্টারদের কিছুতেই সাংবাদিক হিসেবে মানতে চাইতো না। একবার এক ‘জ্ঞানী টোকাই’ আমাকে বলেছিল, ‘ও এখনো ক্যামেরা পান নাই!’ তা হলে কী এরশাদ আমলের টোকাইদের মানসিকতাই কপি পেস্ট হয়েছে বরিশালে! নাকি এর দায় সাংবাদিকদেরও আছে খানিকটা? অথবা অনেকটা!
আমার ধারণা, অনুষ্ঠান আয়োজকদের চেয়ে উল্লিখিত বিষয়ে সাংবাদিকদের দায় মোটেও কম নয়। বিশেষ করে সিনিয়র সাংবাদিক এবং সাংবাদিক নেতাদের বেশ দায় আছে বলে আমার ধারণা। মাস কয়েক আগে এ ব্যাপারে আমার খুবই ঘনিষ্ঠ বরিশালের দুই সিনিয়র সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু তারা বিন্দুমাত্র উৎসাহ দেখাননি। একজন বলেছেন, ‘পরামর্শ শোনার মতো অবস্থা এখন আর বরিশালের সাংবাদিকদের নেই, ট্রেনিং নেয়া তো অনেক পরের বিষয়।’
সিনিয়র এই সাংবাদিকের কথাকেই নিদারুণ বাস্তবতা ভেবেছিলাম। কিন্তু ভিন্ন চিত্র দেখলাম ৫ এপ্রিল বরিশালের অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘বরিশাল বাণী’র প্রতিনিধি সম্মেলনে যোগ দেবার সুযোগ পেয়ে। অসম্ভবকে সম্ভব করার মতো উদ্যোক্তা আফরোজা কাজীর পরিকল্পনা ও বিনিয়োগে শহর থেকে অন্তত পাঁচ কিলোমিটার দূরে প্রকৃতির মায়ার জড়ানো বিশাল এলাকা নিয়ে গড়েওঠা নিসর্গ-এ আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে অংশ নেন বরিশালের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় কর্মরত প্রায় অর্ধ শতাধিক সাংবাদিক। সকাল থেকে শেষ বিকেল পর্যন্ত এ সাংবাদিকরা যেভাবে আলোচকদের কথা মন দিয়ে শুনেছেন এবং পেশার খুটিনাটি বিষয়ও জানার অগ্রহ দেখিয়েছেন তাতে আমার মনে হয়েছে, কথিত সিনিয়র সাংবাদিক রত্নটি বরিশালের সাংবাদিকদের প্রবণতা নিয়ে বিরাট এক বিভ্রমের মধ্যে আছেন। হেলাল হাফিজের বিভ্রম কবিতায় যেমন আছে, ‘তোমার গালে তিল দেখে ছুতে গিয়ে উড়ে গেল মাছি।’ অথবা সিনিয়র এই সাংবাদিক অনুজের প্রতি পেশাগত দায়বদ্ধতা এড়িয়ে যাচ্ছেন সচেতনভাবেই। কিন্তু বরিশালে এই অবস্থা চলা উচিত নয় বলে আমার ধারণা।
অন্নদাশঙ্কর রায়ের মতো প্রশাসনের কেউ, কোন সাংবাদিক নেতা, সাংবাদিক মহলের কেউ অথবা অন্য কোন কেন্দ্র থেকে বরিশালের সাংবাদিকদের বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া খুবই জরুরি। এটি সময়ের দাবি। আর, অন্য কেউ এগিয়ে না এলেও, বরিশালের মেয়র সেরনিয়াবাদ সাদিক আবদুল্লাহর এগিয়ে আসা উচিত। বিসিসি’র মতো একটি ধ্বংস প্রায় প্রতিষ্ঠানকে অবলম্বন করে যদি আধুনিক শহর গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের কঠিন পথে হাটার সাহস করেন, তা হলে বরিশালের শুদ্ধ সাংবাদিকতা নিয়ে কেন ভাববেন না আমাদের নগরপিতা? বরিশালের বাস্তবতায় কঠিন কাজ তো তাকেই করতে হবে! যেমন করেছেন তার পিতা ৭৫-এর থিংকট্যাকং-এর নানান কারসাজি মোকাবিলা করে বরিশালে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিকে আওয়ামী লীগের ব্যানারে প্রতিষ্ঠা করার মধ্যদিয়ে। মেয়র সাদিকের প্রতি সাংবাদিকদের প্রত্যাশার বেশ জোরালো বলে আমার মনে হয়েছে অনেকের সঙ্গে আলাপচারিতা।
আলম রায়হান: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক