অনলাইন ডেস্ক;
সরকার ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়তে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে এবং এখন পর্যন্ত যা কিছু অর্জন করেছে, তা প্রণিধানযোগ্য। শুধু শহরেই নয়, জেলা-উপজেলা সদর ছাড়িয়ে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও অনেক তথ্যপ্রযুক্তি সেবা পৌঁছে গেছে। বিশেষ করে ‘ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্র’ দেশব্যাপী গ্রামের মানুষকে অভাবিত সেবা দিয়ে চলেছে। গ্রামীণফোনের পল্লীফোনের ধারণা থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন এটুআই (অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন), তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের (আইসিটি) আওতায় ন্যাশনাল ডেটা সেন্টার তৈরিসহ তথ্যপ্রযুক্তি-সংক্রান্ত নানা প্রকল্প ইতিমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে। আরও বেশ কিছু বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে।
উন্নয়ন অংশীদারেরাও এসব প্রকল্পকে দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন এবং প্রকল্পগুলোতে অর্থায়নের পরিমাণ বাড়িয়ে গবেষণা-সহায়তা দিয়ে চলেছেন। বর্তমানে দেশে প্রায় ১৩ কোটি মোবাইল ফোন গ্রাহক ও ৬ কোটি ৭২ লাখ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী আছেন। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের একটি বড় অংশ, ৬ কোটি ৩১ লাখ গ্রাহক মোবাইল ফোনের মাধ্যমে এটি ব্যবহার করেন। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন ও বিকাশের উদ্যোগগুলোর ফল ইতিমধ্যে আমরা পেতে শুরু করেছি, ভবিষ্যতে তা নিঃসন্দেহে আরও বাড়বে। আশা করা হচ্ছে, ২০২০ সালের শেষে বাংলাদেশে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়ে মোট মোবাইল ব্যবহারকারীর ৪৯ শতাংশে উন্নীত হবে। এই হার ২০১৬ সালের শেষে ছিল প্রায় ২২ শতাংশ। মোবাইল ফোনভিত্তিক আর্থিক পরিষেবা বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় পাঠানো ও স্থানীয়ভাবে অর্থ স্থানান্তরের ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন ঘটিয়েছে। সরকারি পদক্ষেপগুলো মানুষের ঘরে ঘরে প্রযুক্তির সুফল পৌঁছে দেবে বলে অনেকের বিশ্বাস। কারণ, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে খোদ প্রধানমন্ত্রীর যেমন কার্যকর প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তেমনি তাঁর এ–সংক্রান্ত উপদেষ্টাও অব্যাহতভাবে এই খাতের প্রকল্প-কর্মসূচিগুলো নিবিড় নজরে রেখেছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) মন্ত্রণালয় হয়ে উঠেছে সরকারের অন্যতম সক্রিয় মন্ত্রণালয়।
আজকাল ইন্টারনেটের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভর্তির রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন করা যায়, পরীক্ষার ফলও প্রকাশ হয়। বিদেশে চাকরির নিবন্ধন, হজযাত্রার নিবন্ধন, বিভিন্ন ধরনের দাপ্তরিক বা সরকারি ফরম সংগ্রহ, আয়কর রিটার্ন দাখিল, দরপত্রে অংশগ্রহণ ইত্যাদি কাজকর্ম অনলাইনেই সম্পন্ন করা যায়। এগুলো বাংলাদেশে ডিজিটাল জাগরণের অল্প কয়েকটি নমুনা। এ রকম আরও অনেক কার্যক্রম এখন অনলাইনে সম্পন্ন করা হয়। সে রকম উল্লেখযোগ্য দুটি বড় মাপের সেবা কার্যক্রম হলো মোবাইল ব্যাংকিং বা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে লেনদেন এবং অনলাইন ব্যাংকিং।
এ ছাড়া দেশে টেলিমেডিসিন সেবার বিকাশ ঘটছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার অভিযাত্রায় সারা দেশে প্রায় ৫ হাজার ইউনিয়ন ইনফরমেশন সার্ভিস সেন্টার বা ইউনিয়ন তথ্য সেবাকেন্দ্র খোলা হয়েছে। এর ওপরের দিকে আছে জেলা তথ্য সেল ও জাতীয় তথ্য সেল। এসব
তথ্যকেন্দ্র ও সেল স্থাপনের সুফল ভোগ করছে জাতি। পোস্ট অফিস বা ডাকঘরও এখন তথ্যপ্রযুক্তি সেবার আওতায় চলে এসেছে। সরকার দেশব্যাপী ৯ হাজার গ্রামীণ ডাকঘর ও প্রায় ৫০০ উপজেলা ডাকঘরকে ই-সেন্টারে পরিণত করেছে। ডাকঘরের মাধ্যমে মোবাইল মানি অর্ডার ও পোস্টাল ক্যাশ কার্ড, এমনকি ‘নগদ’ ওয়ালেট সেবা চালু করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কার্যালয় ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয় থেকেও গ্রামের লোকজনকে এখন নানা ধরনের ই-সেবা দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে সরকার নানা ধরনের তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর পরিষেবা চালু করার ফলে এখন মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমেছে। এর ফলে মানুষের সময় ও অর্থ—দুটোরই সাশ্রয় হচ্ছে।
শুধু তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য ও সেবা চালুর মধ্যেই সীমিত থাকেনি এ-সংক্রান্ত সরকারি-বেসরকারি কার্যক্রম। প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন ও অধিকতর উন্নত প্রযুক্তি আসছে। ফলে পুরোনো পণ্য-সেবাগুলোর জায়গায় হালনাগাদ পণ্য-সেবা দ্রুত চালু হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় স্মার্টফোনের সক্ষমতা, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট, ক্লাউড কম্পিউটিং, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, রিয়েল-টাইম স্পিচ রিকগনিশন, ন্যানো কম্পিউটার, উইয়ারেবল ডিভাইস ও নিয়ার ফিল্ড কমিউনিকেশন, সাইবার সিকিউরিটি, স্মার্ট সিটিজ ইন্টারনেট—এসব পণ্য-সেবার বিকাশ ঘটছে। ক্লাউড কম্পিউটিং ও কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের বিকাশ এই দশকে বিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তির দিশা পুরোদমে পাল্টে দেবে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা এখন থ্রিডি প্রিন্টিং ও বায়োমেট্রিক চালুর বিষয়েও জোরালোভাবে কথা বলছেন।
দেশকে ডিজিটাল করে তুলতে হলে প্রশাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাসহ সব খাতেই আরও অধিক হারে স্মার্ট মেশিন ও প্রক্রিয়াগত সুযোগ-সুবিধা অর্থাৎ প্রযুক্তির প্রচলন ও ব্যবহার বাড়ানো প্রয়োজন।
বর্তমান যুগে প্রযুক্তি ব্যবহারে মনোযোগ দেওয়া ও এটির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার কোনো বিকল্প বা দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবকাশ নেই। আমাদের সবাইকেই প্রয়োজনীয় প্রযুক্তির ব্যবহার জানতে হবে। এদিক থেকে অবশ্য তরুণ প্রজন্ম অনেক এগিয়ে গেছে। তারা ক্লাউড কম্পিউটিং, থ্রিডি প্রিন্টিং, বিগ ডেটা, ভিডিও গেমস, অ্যানিমেশন, আউটসোর্সিংয়ের মতো নিত্যনতুন প্রযুক্তি সেবা ও ধারণার সঙ্গে বেশ পরিচিত এবং এসব ব্যবহারে বেশ দক্ষ হয়ে উঠছে।
একটি উৎসাহব্যঞ্জক বিষয় হলো আমাদের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য উন্নয়ন–সহযোগীর সহায়তায় দেশব্যাপী প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে আইসিটি বিষয়ে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির জন্য সর্বাত্মক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। স্কুল পর্যায়েও আইসিটি শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে আমরা আইসিটিমন্ত্রীকে দেশের আইসিটি নীতিমালা আধুনিকায়নের কথা বলতে শুনেছি। ন্যাশনাল আইসিটি ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফর বাংলাদেশ, দ্য ন্যাশনাল ডেটা, ভূমি রেকর্ড ডিজিটালকরণ ও আইটি পার্কের মতো বৃহৎ আকারের প্রকল্পগুলো দ্রুত ই-গভর্নেন্স, ই-সেবাসহ অর্থনৈতিক খাতের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় অভূতপূর্ব অবদান রাখবে বলে আমরা আশা করছি।
দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন নির্ভর করছে বর্ধিত বিনিয়োগ, মানবপুঁজির উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ওপর। প্রযুক্তির প্রচলন ও ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে উৎপাদনশীলতা বাড়বে বলে আশা করা যায়। এ ক্ষেত্রে খেয়াল করতে হবে যে প্রতিটি নতুন প্রযুক্তির জন্যই নতুন প্রশিক্ষণ ও দক্ষতার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।