সোনাগাজী পৌরসভার কাউন্সিলর ও সোনাগাজী পৌর আওয়ামী লীগের সদ্য বহিষ্কৃত ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম
সোনাগাজী (ফেনী) প্রতিনিধি;
ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছেন সোনাগাজী পৌরসভার কাউন্সিলর ও সোনাগাজী পৌর আওয়ামী লীগের সদ্য বহিষ্কৃত ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম।
তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডও মঞ্জুর করেছেন আদালত। সোমবার দুপুরে ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম সরাফ উদ্দিন আহমদ এ আদেশ দেন।
মাকসুদ আলম সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির সদস্য।
জানা গেছে, মাকসুদ আলম আলু ব্যবসা থেকে কাউন্সিলর হয়ে রাতারাতি কোটিপতি বনে গেছেন। তারা বাবা মরহুম আহসান উল্যাহ ছিলেন সোনাগাজী বাজারের সবজি বিক্রেতা।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের ২০ মার্চ সোনাগাজী পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে দলীয় নেতাকর্মীদের দিয়ে ব্যালট পেপারে সিল মেরে ৪নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন তিনি। কাউন্সিলর হওয়ার পর থেকে প্রভাব খাটিয়ে সোনাগাজী পৌর এলাকায় একের পর এক জায়গা দখল করতে থাকেন।
‘ভূমিখেকো’ হিসেবেও তিনি ব্যাপক পরিচিতি পান। এক্ষেত্রে ভাই হেলাল ও সবুজ তার সব অপকর্মের নিত্যসঙ্গী। তিন ভাইয়ের বেপরোয়ায় এলাকার মানুষ মুখ খুলতে সাহস পায় না।
সাম্প্রতিক সময়ে হেলালকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইয়াবাসহ গ্রেফতার কর ২ বছরের সাজা দিয়ে আপিল করে জামিনে মুক্তি পান তিনি।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, সোনাগাজী মেইন রোডের পশ্চিম পাশে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মালিকানাধীন জায়গাটি ইজারা নেন নুরুল করিম শিল্পী। তিনি ১৫ বছর ধরে শিল্পী স্টিল কর্পোরেশনের নামে নির্মাণসামগ্রীর ব্যবসা করে আসছেন। তার অর্ধকোটি টাকা মূল্যের আড়াই শতক জায়গাটির ওপর লোলুপ দৃষ্টি পড়ে কাউন্সিলর মাকসুদের।
২০১৭ সালে ২৫ সেপ্টেম্বর শিল্পী স্টিল কর্পোরেশনের জায়গাটি দখল করে ও ১৫ লাখ টাকা মূল্যের মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় জায়গার মালিক নুরুল করিম শিল্পী মামলা দায়ের করেন। মামলা দায়েরের অব্যাহত হুমকি-ধামকিতে সোনাগাজী ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন।
ওই মামলাটি দীর্ঘ তদন্ত শেষে মাকসুদ ও তার সহযোগী আবুল কালাম ভোলাকে অভিযুক্ত করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ২০১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন।
সূত্র জানায়, সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার পাশে টিটি আবদুর রবের কোটি টাকা মূল্যের ৪ শতক জায়গা দখল করে। চরগণেশ পাণ্ডব বাড়িতে জায়গা দখল করে ঘর নির্মাণ করেন মাকসুদ।
সোনাগাজী বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন প্রবাসী আবু সুফিয়ানের স্ত্রী শাহানা আক্তারের ৬ শতক জায়গা দখল করে। প্রতিবাদ করায় প্রবাসী আবু সুফিয়ানকে সোনাগাজী মডেল থানার সামনে গুলি করে হত্যার হুমকি দেয়। এরপর প্রাণভয়ে তিনিও চুপসে যান।
এছাড়া প্রবাসী আবু তাহেরসহ অনেক ব্যক্তির বহু সম্পত্তি দলীয় প্রভাব খাটিয়ে দখল করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া দলের প্রভাব খাটিয়ে উন্নয়নকাজ বাগিয়ে নিয়ে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করে নির্মাণকাজ সম্পাদন করে নিজের আখের গুছিয়েছেন।
৬ এপ্রিল সকালে আলিম পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় যান নুসরাত জাহান রাফি। কয়েকজন তাকে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে করা মামলা তুলে নিতে চাপ দেন। তিনি অস্বীকৃতি জানালে তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।
এ ঘটনায় অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলা, পৌর কাউন্সিলর মাকসুদ আলমসহ ৮ জনের নাম উল্লেখ করে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন রাফির বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান। ১০ এপ্রিল রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা যান অগ্নিদগ্ধ নুসরাত। এর আগে ওই ছাত্রীকে নিজ কক্ষে নিয়ে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সে ঘটনার পর থেকে তিনি কারাগারে আছেন।
যৌন নিপীড়নের ঘটনায় নুসরাতের মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন। ওই মামলা তুলে নিতে অস্বীকৃতি জানানোয় নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পিবিআইয়ের পরিদর্শক মো. শাহ আলম জানান, মাকসুদ আলমকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে ১০ দিনের জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন। বিচারক পাঁচ দিনের আবেদন মঞ্জুর করেছেন। মাকসুদ আলমকে গত ১১ এপ্রিল বৃহস্পতিবার ঢাকার ফকিরাপুল এলাকার একটি আবাসিক হোটেল থেকে গ্রেফতার করা হয়।
এ নিয়ে এ মামলার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ জনকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে দুজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
নুসরাত হত্যা মামলায় এখন পর্যন্ত ১৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে এজাহারভুক্ত ছয় আসামি ছাড়াও আরও সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর আগে ৯ এপ্রিল জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম সরাফ উদ্দিন আহম্মেদের আদালত নূর হোসেন, কেফায়াত উল্যাহ, মোহাম্মদ আলা উদ্দিন ও শহিদুল ইসলামকে পাঁচ দিন করে রিমান্ডের আদেশ দেন।
১০ এপ্রিল অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলাকে সাত দিন এবং আবছার উদ্দিন ও আরিফুল ইসলামকে পাঁচ দিন করে রিমান্ডের আদেশ দেন একই আদালতের বিচারক। পরের দিন ১১ এপ্রিল উম্মে সুলতানা পপি ও যোবায়ের হোসেনের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। ১৩ এপ্রিল জাবেদ হোসেনকে সাত দিনের রিমান্ড দেন জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম মো. জাকির হোসাইন।