সকালের সংবাদ;
ইতিহাস থেকে জানা যায়, একসময় এ দেশে অগ্রহায়ণ মাস থেকে নববর্ষ শুরু হতো। অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান তোলা হয়, কৃষকের ঘরে ফসল ওঠে। অতএব অগ্রহায়ণ আনন্দের মাস হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। কিন্তু কবে থেকে, কীভাবে বৈশাখ বাংলার নববর্ষ হিসেবে গণ্য হয়েছে, তা ইতিহাসে পরিষ্কার নয়।
উৎসব পালনের জন্য বৈশাখ মাসটি তেমন আরামদায়ক বা সুখকর নয়। তবে বাংলায় পৃথিবীর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফল আম পাকতে শুরু করে বৈশাখের শেষ থেকেই। জ্যৈষ্ঠ মাসে এসে পরিপূর্ণতা পায়। বৈশাখের শেষ থেকেই কিছু জাতের আম বাজারে আসে। এই আমগুলো বৈশাখী নামে অনেক এলাকায় পরিচিত। বৈশাখের শেষ থেকে জ্যৈষ্ঠের সম্পূর্ণ সময়ে অসংখ্য জাতের আম বাজার দখল করে নেয়।
বাংলার সংস্কৃতির একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে নদী, ধান, ইলিশ, আম, রসগোল্লা, কলা, দই, সাপ, কুমির, বাঘ আরও কত–কী! এর মধ্যে আম বাংলার মানুষের মনের বিশেষ একটি স্থানজুড়ে স্থায়ী আসনে প্রতিষ্ঠিত। বৈশাখের শেষ থেকেই আয়োজন শুরু হয় জামাইষষ্ঠীর। এটি একটি পারিবারিক অনুষ্ঠান। আবহমান কাল থেকে বাংলার ঘরে ঘরে এই অনুষ্ঠান হয়ে আসছে। মূলত, আমকে কেন্দ্র করেই অনুষ্ঠানটি জমে ওঠে। যদিও জ্যৈষ্ঠ মাসে অনুষ্ঠিত হয় জামাইষষ্ঠী, কিন্তু এর প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় বৈশাখ থেকেই।
আম নিয়ে গল্প শুরুর আগে ঐতিহাসিক একটি মজার ঘটনা তুলে ধরছি—মোগল সম্রাট জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবর তাঁর শাহি দরবারে একবার এক ভোজন সভার আয়োজন করলেন। বড় বড় রাজন্যবর্গ দাওয়াত পেলেন। সম্রাটের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন বীরবলও সেই অনুষ্ঠানে রয়েছেন। বীরবল তৃপ্তির সঙ্গে তাঁর ভোজন পর্ব শেষ করলেন। সম্রাটের কাছে বিনয়ের সঙ্গে জানালেন, তাঁর পেটে আর জায়গা ফাঁকা নেই। এমন সময় একজন পরিবেশনকারী পাত্রে আম রেখে গেলেন। বীরবল পাকা আম দেখে লোভ সামলাতে পারলেন না। তিনি বেশ কয়েক টুকরা আম খেয়ে ফেললেন। ঘটনাটি সম্রাটের দৃষ্টি এড়াল না। সম্রাট একটু রাগের ভঙ্গিতে বীরবলের দিকে দৃষ্টি ফেরালেন। বীরবল সম্রাটের কাছে গিয়ে অনুনয়ের সঙ্গে বলতে থাকলেন, মহামান্য সম্রাট যখন রাস্তা দিয়ে কোথায়ও যেতে শুরু করেন, সেই রাস্তাটি মানুষের ভিড়ে যতই ব্যস্ত থাকুক, সঙ্গে সঙ্গেই ফাঁকা হয়ে যায়। আপনি যেমন আমাদের সম্রাট, তেমনিভাবে আম হচ্ছে ফলের মধ্যে সম্রাট বা রাজা। আপনাকে যেমনভাবে আমরা রাস্তা ছেড়ে দিই, তেমনি আমকে দেখে পেট আপনা–আপনি তার মধ্যে জায়গা করে দিয়েছে।
Merilআকবর-বীরবলের এই গল্প নিছক একটি গল্প নয়; আম সত্যি সত্যিই ফলের রাজা। আম গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের ফলগুলোর মধ্যে একটি প্রাচীন ফল। ফলটি প্রায় ছয় হাজার বছর আগে থেকে চাষ হয়ে আসছে। দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম, উত্তর–পূর্ব ভারত এবং মিয়ানমারে এই ফলের আদি জন্মভূমি বলে বেশির ভাগ ফলবিজ্ঞানী অভিমত পোষণ করেছেন। উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলে ফলের মধ্যে আম এমন একটি ফল, যার উৎকর্ষ ঘটেছে ব্যাপক চাষাবাদ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে। প্রাচীনকাল থেকেই আমকে ফলের রাজা বলা হয়ে থাকে। স্বাদে, গন্ধে ও পুষ্টিতে এর জুড়ি নেই। পৃথিবীব্যাপী আমের জনপ্রিয়তা, বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহার, স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টিমানের বিবেচনায় বিশ্বে এটি একটি আদর্শ ফল। শীতপ্রধান দেশেগুলোতেও এর কদর আগের চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেড়েছে।
অতি উৎকৃষ্ট জাতের পাকা আমের সঙ্গে জগতের কোনো ফলেরই তুলনা করা চলে না। ভালো জাতের আমের কদর এখন পশ্চিমের দেশগুলোয় আগের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। বিংশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় (পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, মিয়ানমার) ভালো জাতের আমের একক পৃষ্ঠপোষক ছিলেন নবাব, রাজা, মহারাজা, জমিদার, সামন্ত ও ধনাঢ্য ব্যক্তিরা। এখন সময় পাল্টে গেছে। এই জনপ্রিয় ফল গণমানুষের ফলে পরিণত হয়েছে। ভারত, পাকিস্তান ও ফিলিপাইনে আম তাদের দেশে জাতীয় ফল হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত। আমাদের দেশে কাঁঠাল জাতীয় ফল হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও জনপ্রিয়তার বিচারে আম এগিয়ে। এ কারণে আমগাছ জাতীয় বৃক্ষ হিসেবে ২০১০ সালের ১৫ নভেম্বর রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
আমের বৈশিষ্ট্য, গুণাগুণ আর মন কেড়ে নেওয়া স্বাদ ও গন্ধে মুগ্ধ হয়ে পণ্ডিতজনেরা আমের নামের সঙ্গে বহু অলংকার পরিয়েছেন। আমের সমালংকৃত এসব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নাম সাযুয্যপূর্ণ এবং চমৎকারত্বে ভরপুর। আমকে নানারূপে, নানাভাবে ডাকা হয়। যেমন, চ্যূত, নৃপপ্রিয়, কামশর, কামবল্লভ, কামাঙ্গ, সুমদন, কীরেষ্ট, পুষ্পশর, কোকিলাবাস, কোকিলোৎসব, পিকরাগ, প্রিয়ঙ্কু, বসন্তদূত, তুঙ্গভীষ্ট, মধুলী, মাদাঢ্য, মাধবট্রম, মন্মথালয়, মধ্বারস, রসাল, সহকার, সীধুরস, সোমধারা ইত্যাদি। এক আমকে নিয়ে এত কাব্যিক নাম এসেছে আমভক্ত পণ্ডিত, কবি ও কাব্যরসিকদের মাধমে। যুগ যুগ ধরে এ দেশের নৃপতিরা আমকে তাঁদের প্রিয় ফল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন, তাই এটি নৃপপ্রিয়। পুরাণে আমের মঞ্জুরিকে বলা হয় প্রেমের দেবতা মদনের পুষ্পশর। মদনের পঞ্চশরের এক শর হচ্ছে আমের পুষ্পমঞ্জুরি। এই শরের আঘাতে তিনি প্রতিপক্ষকে কাবু করেন, প্রেয়সীর হৃদয়ে জাগিয়ে তোলেন প্রেমাবেগ, তিনি হয়ে ওঠেন কামাতুরা। আম কামোত্তেজক, তাই এর নাম কামাঙ্গ, কামশর, কামবল্লভ, সুমদন। আম মধুসমৃদ্ধ, তাই এর নাম মধুলী, মধ্বারস, সীধুরস। আমের রস দুধের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়া বাঙালির চিরাচরিত রীতি। আমের সুগন্ধযুক্ত মিষ্টি রসকে দুধের সঙ্গে মেশালে এটি হয়ে যায় সোমধারা। সোমধারা শুক্র স্রোতকে শুদ্ধ করে একে আরও বলবান করে। আমের রস মাদকতার সৃষ্টি করে, সে কারণে এর নাম মাদাঢ্য।
দ্বাদশ শতকে বাংলাদেশে সংকলিত সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষায় রচিত কবিতার সংকলন গ্রন্থ ‘সদুক্তিকর্ণামৃতে’ রাজা লক্ষ্মণ সেনের মন্ত্রী কবি উমাপতি ধর আমগাছের মঞ্জুরি এবং ফল নিয়ে সংস্কৃত ভাষায় অপূর্ব একটি কবিতা রচনা করেছিলেন। বাঙালি যে প্রাচীনকাল থেকে আমপ্রিয় জাতি, উমাপতিধরের লেখা আমের প্রশস্তিমূলক এ কবিতা তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পরবর্তী কালে ড. সুকুমার সেন ঈষৎ পরিবর্তিতরূপে কবিতাটির বঙ্গানুবাদ করেছেন, যেটি তাঁর রচিত ‘বঙ্গ ভূমিকা’ গ্রন্থে তিনি উদ্ধৃত করেছেন। কবিতাটি এমন:
‘কোন কোন বৃক্ষ ফুল ফোটাবার কালে সুগন্ধি হয়,
কোন কোন বৃক্ষের কাঁচা ফল হয় সুরভি ও সুস্বাদযুক্ত,
কোন কোন বৃক্ষ আবার ফল পাকলে হয় মনোরম,
কিন্তু ফুল ফোটাবার কাল থেকে ফল পেকে যাওয়া
পর্যন্ত—
আগাগোড়া মাধুর্য এ জগতে একমাত্র আম্রবৃক্ষেই প্রকটিত’,
দিল্লির সুলতান কায়কোবাদ, জালালুদ্দিন, আলাউদ্দিন খিলজী এবং গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের সভাকবি, খেয়ালের জনক এবং সেতারের আবিষ্কর্তা, জগৎ বিখ্যাত কবি আমীর খসরু (১২৫৩-১৩২৫) আমের বড় সমঝদার ছিলেন। আমীর খসরু আমের প্রশংসায় অনবদ্য একটি কবিতা লিখে গেছেন। কবিতায় তিনি আমকে হিন্দুস্তানের সবচেয়ে চমৎকার এবং শ্রেষ্ঠ ফল বলে উল্লেখ করেছেন।
বিশ্বখ্যাত উর্দু ভাষার কবি মির্জা আসাদুল্লাহ গালিব ছিলেন আমের একজন বিশেষ সমঝদার। জানা যায়, তিনি সারা জীবনে প্রায় ৪ হাজার জাতের আম খাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। ভক্তরা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তাঁর কাছে আম পাঠাতেন। এই কবিকে স্মরণে রেখে ভারতের লক্ষ্ণৌ শহরে প্রতিবছর আয়োজন করা হয় একটি বর্ণিল কাব্যানুষ্ঠান যার নাম ‘আম অউর গালিব’। সমগ্র ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে বিশিষ্ট কবিরা এই অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
ইতিহাস বিখ্যাত মরক্কোর পরিব্রাজক ইবনে বতুতা বাংলাদেশের সুস্বাদু পাকা আমের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। মোগল স্থপতি সম্রাট বাবর নিজে আমভক্ত ছিলেন এবং আমকে হিন্দুস্তানের সর্বোৎকৃষ্ট ফল হিসেবে আখ্যা দিয়ে গেছেন। ১৬৭৩ সালে বিখ্যাত লেখক ফ্রাইয়ার আম প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘যদি স্বাদের কথা ধরি, তবে আমের কাছে নেকটারিন (গ্রিক দেবতাদের প্রিয় ফল), পিচ (জামজাতীয় ফল) এবং অ্যাপ্রিকট (খুবানি) অনেক পেছনে।’ বিখ্যাত কবি হ্যামিলটন ১৭২৭ সালে তাঁর একটি লেখায় আরও এক ধাপ বাড়িয়ে বলেন, ‘গোয়ার আম সবচেয়ে বড় (বোম্বাই এবং আলফন্সো) আর পৃথিবীর যেকোনো ফলের চেয়ে স্বাদে, গন্ধে তৃপ্তিকর, রসনারোচক, সরস এবং উপাদেয়।’
পল্লিকবি জসীমউদ্দীন তাঁর কবিতায় মামার বাড়ির যে বর্ণনা দিয়েছেন, সেখানে আমের প্রসঙ্গ এমন সুন্দরভাবে এসেছে যেন আমাদের আবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে দুরন্ত কৈশোরে।
‘ঝড়ের দিনে মামার দেশে আম কুড়াতে সুখ
পাকা জামের মধুর রসে রঙিন করি মুখ;’
মাইকেল মধুসূদন দত্তের একটি কবিতার নাম ‘রসাল ও স্বর্ণলতিকা’ কবিতাটিতে তিনি রসাল বলতে প্রথমে আমগাছকেই বুঝিয়েছেন। আর মধুমাখা ফল বলতে রসাল অর্থাৎ আমকে বুঝিয়েছেন
‘মধুমাখা ফল মোর বিখ্যাত ভুবনে
তুমি কি তা জান না ললনে?
কৌতুক গান রচনায় কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন সেরা। বৈশাখ মাসে কচি আমের টক নিয়ে তার একটি কৌতুক গান-
‘কচি আম-ঝাল-টক খাইয়া গিন্নিমায়
বৌঝির সাথে করে টক্ষাই টক্ষাই!
আইবুড়ো আইবুড়ি জল গেল ছগেলাস”॥
রবীন্দ্রনাথের কাছে ফলের মধ্যে আম ছিল সবচেয়ে প্রিয়। আমের দিনে জোড়াসাঁকো থেকে কুমারখালীর শিলাইদহ কিংবা শাহজাদপুরে আসার সময় সঙ্গে আম নিয়ে আসতেন। ফুরিয়ে গেলে স্ত্রীকে লিখতেন, আমার আম ফুরিয়ে এসেছে। কিছু আম পাঠিয়ে না দিলে অসুবিধা হবে।
‘আমসত্ত্ব দুধে ফেলি
তাহাতে কদলি দলি
সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে
হাপুস হুপুস শব্দ চারিদিক নিস্তব্ধ
পিপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।’
আমকে সমগ্র ভারতবর্ষে জনপ্রিয় করেছেন সম্রাট আকবর। তিনি গঙ্গাতীরবর্তী বিহারের দ্বারভাঙ্গাঁয় তৈরি করেছিলেন এক লাখ আমগাছ নিয়ে একটি বিশাল ফলের বাগান।
সম্রাট জাহাঙ্গীরের আম নিয়ে উক্তি আছে। তা হলো, ‘আমি কাবুলের চমৎকারিত্ব ও সৌন্দর্য মহিমা সব উপভোগ ও অনুভব করেছিলাম। অধিকাংশ ফল খেয়ে তাদের রসমাধুর্য উপভোগ করার অবকাশও আমার হয়েছিল। তবে কাবুলের ফলরাজি যতই সুস্বাদু হোক না কেন, আমার মনে হয় আমের তুলনায় তা বেশি সুস্বাদু নয়।’