বিশেষ প্রতিবেদক; রূপগঞ্জের গুতিয়াবে এক একরের বেশি জমি ছিল ইস্রাফিল মিয়ার। প্রায় দুই যুগ আগে সরকার তাঁর জমি অধিগ্রহণ করে। স্বপ্ন দেখানো হয়, ওই জমিসহ আশপাশের এলাকা মিলে গড়ে তোলা হবে অত্যাধুনিক এক শহর। এরপর প্রকল্প হয়, ইস্রাফিল প্লটও পান। অনেকের মতো তিনিও স্বপ্ন দেখেন নতুন শহরে নতুন বাড়ির। কিন্তু বাস্তবে তা আর দেখা হয়নি। ১২ বছর আগে তিনি মারা গেছেন। এখনো শেষ হয়নি সেই স্বপ্নের প্রকল্প। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্লটের কাগজ বুঝে পাননি ইস্রাফিলের উত্তরাধিকারীরাও।
স্বপ্নের এই প্রকল্পের নাম ‘পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প’। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) এই প্রকল্পে আবাসিক প্লট আছে ২৫ হাজারের বেশি। এর মধ্যে প্রায় ১৫ হাজার প্লট হস্তান্তর করেছে সংস্থাটি। কিন্তু নাগরিক পরিষেবা না থাকায় প্রকল্প এলাকা এখনো বাসযোগ্য হয়নি।
প্রকল্পটি পাসের পর রাজউক ২০০৪, ২০০৫, ২০০৯ ও ২০১৩ সালে এর নকশা সংশোধন করে। এর পর নকশায় আর কোনো পরিবর্তন আনতে গেলে আদালতের পূর্বানুমতির নির্দেশনা ছিল। কিন্তু অনুমতি না নিয়ে ২০১৭ সালে পঞ্চমবারের মতো নকশা সংশোধনের উদ্যোগ নেয় রাজউক। পঞ্চম সংশোধনীতে প্রায় ১০০ একর জায়গায় ‘আইকনিক টাওয়ার’, আবাসিক প্লটের সংখ্যা বৃদ্ধি, প্রাতিষ্ঠানিক প্লট কাটাছেঁড়া, হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরিবর্তন আনা হয়। এতে মাঠ, উন্মুক্ত স্থান কমানোর পাশাপাশি সেন্ট্রাল বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট—সিবিডি (ব্যবসায়িক ও বাণিজ্যিক অঞ্চল) এলাকার চরিত্র নষ্ট হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতা ও বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে রাজউকের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বলেন, জমি অধিগ্রহণে জটিলতা, স্থানীয় লোকজনের বাধা, মামলার কারণে প্রকল্পটি এখনো শেষ হয়নি। কতজন মানুষের জন্য কতগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল লাগবে, সে অনুযায়ী নকশা সংশোধন করা হয়েছে। এতে মাঠ, উন্মুক্ত স্থান কমেনি, বরং বেড়েছে। আইকনিক টাওয়ার সম্পর্কে তিনি বলেন, এর কারণে সিবিডি এলাকার চরিত্র নষ্ট হবে না। আর প্রাতিষ্ঠানিক প্লট নিয়েও কোনো অনিয়ম হয়নি বলে তিনি দাবি করেছেন।
গোঁজামিল দিয়ে আবাসিক প্লট বৃদ্ধি
নকশার পঞ্চম সংশোধনীতে আবাসিক প্লটের সংখ্যা ২৫ হাজার ১৬ থেকে বাড়িয়ে ২৫ হাজার ৯১ করা হয়। এতে ৩ কাঠার ৬০টি, ৫ কাঠার ১৪টি ও ১০ কাঠার ১টিসহ মোট ৭৫টি প্লট বাড়ে।
রাজউক থেকে পাওয়া নথি অনুযায়ী, ৭৫টি প্লট বাড়ানোর ফলে আবাসিক প্লটের মোট আয়তন বেড়েছে মাত্র ৪ দশমিক ৩৩২ একর। রাজউকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, স্বাভাবিক হিসাব অনুযায়ী, বাড়তি ৭৫টি প্লটের জন্য অতিরিক্ত প্রায় ২১ একর জায়গার প্রয়োজন হবে। কিন্তু মাত্র চার একর জমিতে ৭৫টি প্লটের জায়গা কীভাবে হলো, তা বোধগম্য নয়। তাঁর সন্দেহ, আগে বরাদ্দ দেওয়া প্লটগুলো থেকে একটু একটু করে জায়গা কেটে নেওয়া হয়েছে।
প্রাতিষ্ঠানিক প্লট নিয়ে লুকোচুরি
পূর্বাচলের নকশার চতুর্থ সংশোধনীর পর প্রাতিষ্ঠানিক প্লট ছিল ২২৬টি, মোট আয়তন ছিল ৩৯৭ দশমিক ১৬৬ একর। পঞ্চম সংশোধনীতে প্লট কাটাছেঁড়া করায় আগের চেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক প্লটের মোট আয়তন কমেছে ৮৪ দশমিক ২১২ একর। আর প্লটের সংখ্যা হয়েছে ২২৪। সূত্র বলছে, জমি কমিয়ে প্লটের সংখ্যা বাড়াতে আগের একেকটি প্লট কেটে দুই থেকে তিনটি করা হয়েছে।
নথি অনুযায়ী, পঞ্চম সংশোধনীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩টি থেকে বাড়িয়ে ১৬টি, হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা ২৭টি থেকে ৪৪টি, গবেষণা ও শিক্ষাসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান বা ইনস্টিটিউটের সংখ্যা ৫টি থেকে ২১টি, মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজের সংখ্যা ৬টি থেকে ২৮টি করা হয়েছে। তবে নার্সারি ও প্রাইমারি স্কুলের সংখ্যা কমেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজউকের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বিত্তবান ব্যবসায়ীদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মতো প্লটের চাহিদা অনেক বেশি। কিন্তু সে তুলনায় প্লটের সংখ্যা কম। এ জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ও স্বাস্থ্যসেবাসংক্রান্ত প্লটের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, এতে পূর্বাচল এলাকায় উন্মুক্ত স্থান, খেলার মাঠ, সবুজ এলাকা কিংবা খাল কমেনি। কিন্তু বাস্তবে প্লটের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় মাঠ, উন্মুক্ত এলাকা ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়বে। এতে যে জনঘনত্বের কথা বিবেচনা করে পূর্বাচলের পরিকল্পনা করা হয়েছে, তা ভেঙে পড়বে। যেমনটি হয়েছে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায়।
পূর্বাচলের এই প্রাতিষ্ঠানিক প্লটগুলো বরাদ্দের বিভিন্ন সময় বিজ্ঞপ্তি দেয় রাজউক। এ পর্যন্ত মোট কতটি আবেদন পড়েছে আর কতটি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট দুই শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে দায়িত্বশীল একটি সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ৮৯টি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
আইকনিক টাওয়ার
পূর্বাচলের ১৯ নম্বর সেক্টরটি সিবিডি (ব্যবসায়িক ও বাণিজ্যিক অঞ্চল) এলাকা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছিল। এই এলাকার প্রায় ১০০ একর জমি বরাদ্দ পেয়েছে ‘কনসোর্টিয়াম অব পাওয়ার প্যাক হোল্ডিংস লিমিটেড অ্যান্ড কাজিমা করপোরেশন’। তাদের এখানে ১০০ থেকে ১৪২ তলা আইকনিক টাওয়ার নির্মাণ করার কথা। এ জন্য বাংলাদেশ বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে উচ্চতার ছাড়পত্র ও সেখানকার মাটি এমন ভবনের উপযোগী কি না, তা নিশ্চিত হতে হবে। কিন্তু জমি বরাদ্দ দেওয়ার আগে গুরুত্বপূর্ণ এই দুটি কাজের কোনোটিই করেনি রাজউক।
রাজউকের একটি সূত্র বলছে, আইকনিক টাওয়ার নির্মাণের আলোচনা শুরুর পর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মাধ্যমে মাটি পরীক্ষার জন্য প্রাথমিক আলোচনা করেছিল রাজউক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাটি পরীক্ষা হয়নি। আর উচ্চতার ছাড়পত্রের জন্য বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকেও চিঠি দেওয়া হয়েছিল। চিঠির উত্তরে জানানো হয়েছে, নিয়ম অনুযায়ী সেখানে ৫০ তলার ওপর ভবন নির্মাণ করা সম্ভব নয়। তবে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে তারা উচ্চতার বিষয়টি বিবেচনা করবে। এমন অবস্থায় যদি শেষ পর্যন্ত ৫০ তলার ওপর ভবন নির্মাণ সম্ভব না হয়, তবে জমি বরাদ্দ বাতিলেরও কোনো শর্ত রাখা হয়নি।
সার্বিক বিষয়ে নগর গবেষণাকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, রাজউককে নিয়ে অনেক কথা শোনা যায়, বিশেষ করে অনিয়মের। এসব সর্বোচ্চ পর্যায়ে অনুসন্ধান ও তদন্ত হওয়া উচিত। ব্যক্তিবিশেষ বা প্রতিষ্ঠানের জন্য ছাড় দেওয়া হলে তা সার্বিকভাবে কল্যাণকর হয় না। পূর্বাচলের মূল প্রকল্পের কাজ শেষ না করে এর মধ্যেও আরও প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। এত দিনেও পূর্বাচল প্রকল্প শেষ করতে না পারায় রাজউকের সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, শুধু পূর্বাচল নিয়েই গভীর পর্যালোচনা হওয়া উচিত।