স্বাধীনতা যুদ্ধে জামায়াতের অবস্থান এবং পরবর্তীতে রাজনৈতিক পথচলা

- আপডেট সময় : ০৬:০৭:০৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫ ১৬৩ বার পড়া হয়েছে

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা ছিল পাকিস্তানের পক্ষে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতায়। ১৯৭১ সালে এই দলটি পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার পক্ষ নিয়েছিল এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। জামায়াতে ইসলামীর কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে সরাসরি গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ও নির্যাতনের মতো যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
মূল ভূমিকা ও সহায়তাগুলোর মধ্যে ছিল:
আল-বদর ও আল-শামস গঠন ও সহায়তা:
জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যরা “আল-বদর” বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই বাহিনীগুলো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে সমন্বয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবীদের হত্যা ও ধর্ষণের কাজে সহায়তা করে।
বুদ্ধিজীবী হত্যা:
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর যে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়, তার পেছনে আল-বদর বাহিনী এবং জামায়াত-সমর্থিত লোকজনের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। পরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এসব ঘটনার জন্য জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতাকে দোষী সাব্যস্ত করে।
প্রচার ও মতবাদ:
জামায়াতে ইসলামী স্বাধীনতাবিরোধী প্রচার চালায়, একে “ভারতীয় ষড়যন্ত্র” বলে উল্লেখ করে এবং পাকিস্তানকে “ইসলামের দুর্গ” হিসেবে ব্যাখ্যা করে মুক্তিযুদ্ধকে নাস্তিক্যবাদী শক্তির চক্রান্ত হিসেবে প্রচার করে।
পরবর্তী সময়ে বিচার:
স্বাধীনতার পর জামায়াতের এই ভূমিকার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। এই ট্রাইব্যুনাল জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে অনেককে যুদ্ধাপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়, যেমন কাদের মোল্লা, মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, মতিউর রহমান নিজামী প্রমুখ।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামী দীর্ঘদিন ধরে বিতর্কিত এবং কখনো কখনো ষড়যন্ত্রমূলক ভূমিকার জন্য সমালোচিত হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকেই জামায়াত রাজনৈতিক পুনর্বাসনের চেষ্টা করে এবং বিভিন্ন সময়ে নানা কৌশলে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। নিচে তাদের কথিত ষড়যন্ত্রমূলক ভূমিকা ও কৌশলের একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ দেওয়া হলো:
স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি হিসেবে অবস্থান:
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে জামায়াত বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ছিল (১৯৭২-১৯৭৯)। কিন্তু ১৯৭৯ সালে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান জামায়াতকে পুনর্বাসনের সুযোগ দেন, যা অনেকের কাছে ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।
ছদ্মবেশী রাজনীতি:
জামায়াত ইসলামী কখনো সরাসরি, কখনো মিত্রদল হিসেবে জোট গঠন করে ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করেছে। তারা বিএনপির সাথে জোট করে ২০০১ সালে ক্ষমতায় অংশ নেয় এবং সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে তাদের নেতারা দায়িত্ব পান।
জঙ্গিবাদের সাথে আদর্শিক সম্পর্ক:
যদিও সরাসরি জঙ্গি কার্যক্রমের সাথে জামায়াতের সংগঠন হিসেবে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়নি, তবে তাদের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া জামায়াতপন্থী কিছু নেতা এবং সমর্থকরা বিভিন্ন সময়ে জঙ্গি সন্দেহে গ্রেপ্তার হয়েছেন।
রাজনৈতিক দল হিসেবে নিষিদ্ধ হওয়ার পর কার্যক্রম:
২০১৩ সালে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন জামায়াতকে নিবন্ধন বাতিল করে, এবং ২০১৮ সালে হাইকোর্টও তাদের নির্বাচন করার অযোগ্য ঘোষণা করে। এরপর জামায়াত ছদ্মনামে বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার চেষ্টা চালায়। এছাড়া তারা নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরিরও চেষ্টা করে, যেমন “আনসারুল হক ইমাম পরিষদ” বা “আমার বাংলাদেশ পার্টি (AB Party)।
স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে জামায়াতে ইসলামী নানা পর্যায়ে রাজনৈতিক সুবিধা অর্জন করেছে, বিশেষ করে সামরিক শাসন ও জোট রাজনীতির সময়। এসব সুবিধা তাদের পুনর্বাসন, রাজনৈতিক বৈধতা, এবং ক্ষমতার অংশীদারিত্বের মাধ্যমে অর্জিত হয়। নিচে জামায়াতের পাওয়া প্রধান রাজনৈতিক সুবিধাগুলো তুলে ধরা হলো:
স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতিতে জামাতের পুনর্বাসন ও বৈধতা লাভ (১৯৭৯):
১৯৭১ সালের পর জামায়াত নিষিদ্ধ ছিল, কারণ তারা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। ১৯৭৯ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সংবিধান থেকে “ধর্মনিরপেক্ষতা” শব্দটি বাদ দিয়ে জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলোর রাজনীতিতে ফেরার পথ উন্মুক্ত করেন। এ সময় জামায়াতের অনেক নেতা, যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ ছিল, রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন।
স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সঙ্গে জামায়াতের সখ্যতা:
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর যৌথ আন্দোলনের প্রসঙ্গটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তবে এখানে কিছু পরিষ্কার করা দরকার।
১৯৯৬ সালের পূর্ববর্তী সময়, বিশেষ করে ১৯৯৫-৯৬ সালে, তৎকালীন বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে একটি তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে। এই আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ছিল মূল নেতৃত্বে, এবং তাদের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীসহ ১৩ দল ও পরে ৭ দলীয় জোট (জাতীয় পার্টি নেতৃত্বাধীন) ও ১০ দলীয় জোট (জামায়াত নেতৃত্বাধীন)-এর মতো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও নিজেদের মতো করে আন্দোলনে অংশ নেয়।
যদিও আওয়ামী লীগ ও জামায়াত ভিন্ন মতাদর্শের দল, তবুও তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে তারা এক পর্যায়ে আলাদাভাবে একই দাবিতে আন্দোলন করছিল, যা অনেকের কাছে একটি অপ্রত্যাশিত সামঞ্জস্য হিসেবে দেখা গিয়েছিল। তবে এটি কোনো আনুষ্ঠানিক জোট ছিল না—তাদের নিজ নিজ জোট ছিল আলাদা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে এই আন্দোলনের ফলেই ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচন (যা বিএনপি এককভাবে করে) জনগণের বিরোধিতার মুখে পড়ে এবং পরে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যুক্ত হয়। জুন মাসে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে।
জোট সরকারে অংশগ্রহণ:
জামায়াত ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট গঠন করে নির্বাচন করে এবং নির্বাচনে বিজয়ী হয়।
বিএনপির জোট সরকারের সময় জামায়াতের দুইজন নেতা মন্ত্রী হন:
মতিউর রহমান নিজামী (শিল্পমন্ত্রী) আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ (সামাজিক কল্যাণ মন্ত্রী) এ সময় জামায়াত প্রশাসন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এবং রাষ্ট্রীয় নিয়োগে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংগঠন বিস্তার:
ইসলামী ছাত্রশিবির দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠন বিস্তার করে, বিশেষ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ প্রভৃতি জায়গায়। একে ব্যবহার করে জামায়াত ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির কৌশল নেয়।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিলম্বিত করা:
২০০১-২০০৬ সালের মধ্যে জামায়াত ক্ষমতায় থাকার সময় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া কার্যকর হয়নি। বরং এ সময় যুদ্ধাপরাধের প্রসঙ্গ এড়িয়ে চলা হয়।
মিডিয়া ও এনজিও সংযোগ:
জামায়াতপন্থী ব্যবসায়ী ও সমর্থকেরা ইসলামী ব্যাংক, দারুসসালাম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, টিভি চ্যানেল ও পত্রিকা চালুর মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে প্রভাব বিস্তার করে।
বিদেশি সংযোগ ও লবিং:
জামায়াত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন ইসলামপন্থী সংগঠন ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মাধ্যমে সমর্থন ও সহানুভূতি অর্জনের চেষ্টা করে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশের ইসলামিক সংগঠন জামায়াতের পক্ষ নেয়।
এই সুবিধাগুলো জামায়াতকে স্বাধীনতার পরও বারবার রাজনীতিতে ফিরে আসার সুযোগ দিয়েছে। তবে, ২০১৩ সালের যুদ্ধাপরাধ বিচারের পর জামায়াতের রাজনীতি অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে।