সীমান্তের মুসলমানরা কতটুকু লবণ খাবে নির্ধারণ করে দেয় বিএসএফ!
- আপডেট সময় : ১২:৩৫:৫৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ৩১ মার্চ ২০১৯ ১৫০ বার পড়া হয়েছে
আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
‘নুন! তিন কেজি! কেন রে?’ বিএসএফ জওয়ানটি বৃদ্ধ সাজাহান আলীর বাজারের ব্যাগ থেকে লবণের প্যাকেট বার করতে করতে দাঁত খিঁচিয়ে উঠলেন, ‘আমাদের তো এক কেজিতে তিন মাস চলে যায়। তোর ধান্দাটা কী?’
সাজাহান বিড়বিড় করল, ‘বাড়িতে গরু আছে। গরু খায়।’ ‘ওখানে’-সীমান্তরক্ষী বাহিনীর জওয়ানটি এক সহকর্মীকে আঙুল তুলে দেখালেন, ‘রেখে দে। এক কেজির বেশি নিতে দিবি না। গরু খায়, না বাংলাদেশে পাচার হয়, জানা আছে।…..আরে, তোর ব্যাগে তো শুঁটকিও দেখছি। কত আছে?’
ভয়ার্ত সাজাহান বললে, ‘দু’কেজি।’ জওয়ান বললেন, ‘বাজারে ফেরত দিয়ে আয়। পাঁচশোর বেশি নেয়া যাবে না।’
দু’একজন গ্রামবাসী বলল, ‘না, শুঁটকি তো প্রায়ই লাগে। যেতে দেন, কত্তা।’
জওয়ান আরও কড়া হলেন, ‘যেতে দেব? অসম দেখেছিস, ঠিক হয়ে গিয়েছে। মোদিজিকে আর একবার আসতে দে (ক্ষমতায় আসা), ঠিক হয়ে যাবি।’
জওয়ান ও গ্রামবাসীর মধ্যকার সংলাপটি আজ রোববার ভারতের জনপ্রিয় বাংলা পত্রিকা আনন্দবাজারে প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি করেছেন সাংবাদিক গৌতম চক্রবর্তী। তিনি তার প্রতিবেদনে মোদির শাসনামলে সীমান্তবর্তী স্থানীয় মুসলমানদের ওপর বিএসএফের অনৈতিক হস্তক্ষেপ ও বেপরোয়া মনোভাবটি তুলে ধরেছেন। এসব অসঙ্গতি নিয়ে সাংবাদিকদের অসহায়ত্বের বিষয়টিও ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন এই প্রতিবেদক।
তিনি তার প্রতিবেদনে বলেছেন, এসব দৃশ্য সাংবাদিকরা চোখে দেখলেও কিছু করতে পারেন না। শুধুই চুপচাপ দৃশ্যের জন্ম দেখে যেতে হয়। দৃশ্য যে কত! এরপর নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, নৌকায় কালজানি নদী পেরিয়ে চর বালাভূত গ্রামে যাওযার আগে বিএসএফ আমার আধার কার্ডটিও (ভারতের জাতীয় পরিচয়পত্র) জমা নিয়ে রেখে দিয়েছিল। গ্রাম থেকে ফের নদী পেরিয়ে এ পারের ক্যাম্পে এসে সেই কার্ড ফেরত পেয়েছি। লাদাখ থেকে অরুণাচল কোত্থাও যেতে এভাবে আধার বা ভোটার আইডি জমা রাখতে হয় না-এই জায়গাটাই ব্যতিক্রম।
ব্যতিক্রমী এই চর বালাভূত গ্রামটা পাকিস্তানে নয়, ভারতেই। কোচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ থেকে চল্লিশ মিনিট গাড়িতে এসে তার পর নৌকোয় নদী পেরোনো। ১৮০০ ভোটারের বাস, প্রত্যেকেই মুসলমান। বাজারহাট, হাসপাতাল যাতায়াতে নৌকাই ভরসা। গ্রামে পাকা রাস্তা নেই, নেই বিদ্যুৎ। সন্ধ্যার পর আজও হারিকেনই ভরসা। সরকারি প্রচেষ্টায় কয়েক বছর আগে নতুন হাসপাতাল হয়েছে, তবে সেখানে ডাক্তার নেই।
প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি ভাঙনের ফলে নদীগর্ভে। সপ্তাহে দু’দিন দাতব্য চিকিৎসালয়ে এক কম্পাউন্ডার বসেন, বিপদেআপদে তিনিই ভরসা। রাতবিরোতে মেয়েদের প্রসববেদনা উঠলে ডাক্তারের পাশাপাশি বিএসএফকে জানাতে হয়। বিএসএফ অনুমতি দিলেই তো রাতে নৌকা এ পারে আসবে!
গ্রামে রবিউল ইসলামের মুদির দোকানের হিসাব-নিকাশের খাতাটি কলমের দাগে শতচ্ছিন্ন। লেখা ছিল, তিন কেজি তালমিছরি। সেটি কেটে এক কেজি। তিন পিস সাবান কেটে এক পিস। মোদির ভয় দেখানো, কথায় কথায় দেশবাসীর মধ্যে স্মাগলার খোঁজা বিএসএফ-ই কাটাকাটি করে মুদিখানার চূড়ান্ত তালিকা বানিয়ে দিয়েছে। ‘বিয়ে-শাদিতে লোক খাওয়াতে আগে গোমাংস আনা যেত, এখন সেটাও আনা যায় না’-বলছিলেন এক গ্রামবাসী।
গ্রামে পালাপার্বণে, ধর্মীয় উৎসবে বা ইসলামি শিক্ষার আসর বসাতেও কয়জন আসবেন, তাদের গ্যারান্টার কারা থাকবেন-সব বিএসএফকে জানাতে হয়। গণতান্ত্রিক দেশে আমার ইচ্ছামাফিক যা খুশি খেতে, পরতে পারি, যেখানে ইচ্ছা যেতে পারি-এই সুন্দর কথাটি পাঠ্য বইয়ে থাকে, চর বালাভূতের জীবনে নয়।
বিএসএফের বক্তব্য, বাংলাদেশ-সংলগ্ন এই গ্রাম থেকেই গরু ও নানা জিনিস পাচার হয়। গ্রামবাসীরা বলছেন, বাইরের লোক যদি বালাভূত গ্রামে এসে পাচার করে, সে দায় আমরা কেন নেব? তারা আরও বলছেন, সীমান্তে বিএসএফের টহলদারির জন্য রাস্তা আছে। তারা সেখানে পাহারা না দিয়ে এই নদীর ধারেই বা কেন থাকেন? অতিষ্ট গ্রামবাসীরা এ বিষয়ে স্থানীয় সাব-ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেটকে স্মারকলিপি দিয়েছেন, একদিন খেয়াঘাটও বন্ধ রাখা হয়েছিল।
যে গ্রাম বিএসএফের উপস্থিতি নিয়ে এত ক্ষিপ্ত, তারা নিশ্চয় ‘অ্যান্টি ন্যাশনাল’! নদী পেরোনোর পর গ্রামের মিজানুর রহমান তার বাইকে চাপিয়ে আমাকে নিয়ে গেলেন অন্যদিকে। নদীতে আধডোবা কয়েকটি কাঠের খুঁটি। গ্রামের লোক নিজেরাই পঞ্চায়েতের নেতৃত্বে প্রায় ৬ লাখ টাকা চাঁদা তুলে নদীতে বাঁধ দিয়েছেন। এর নাম ভারতবর্ষ!