সরকারি যে কোনও প্রকল্প শেষে ওই প্রকল্পের কাজে ব্যবহৃত কম্পিউটার, ল্যাপটপ, গাড়িসহ অন্যান্য অনেক সরঞ্জামের খোঁজ পাওয়া যায় না। এসবের কোনও হদিসই থাকে না অনেক ক্ষেত্রে। বিষয়টি নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা-সমালোচনার পর নির্দেশনা জারি করা হলেও তা কোনও কাজে আসেনি। সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালকরাও এর কোনও দায় নেন না। প্রকল্প শেষ হওয়া মাত্র প্রকল্প পরিচালক অন্যত্র বদলি হয়ে চলে যান। আবার অনেকে প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষে গাড়িসহ যন্ত্রপাতি জমা না দিয়ে প্রকল্পের গাড়ি, কম্পিউটার ল্যাপটপ নিজে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করছেন।
অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্প সংশ্লিষ্ট অনেক অসৎ কর্মকর্তা বা কর্মচারী এসব গাড়ি ও সরঞ্জাম কিছুদিন অবহেলায় ফেলে রেখে তা অকার্যকর দেখিয়ে ধীরে ধীরে তা প্রকল্প এলাকা থেকে নিজেরাই নিজেদের মতো করে সরিয়ে নেয়। পরবর্তীতে যা বাকি থাকে তা অকজো দেখিয়ে একত্রিত করে সব কিছু নিলামে তুলে দিয়ে প্রকল্প এলাকার জায়গা খালি করে তারা। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকের সময়মতো প্রতিবেদন না দেওয়াটা এর জন্য অনেকটা দায়ী বলে মনে করেন সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
সম্প্রতি রাজধানীর অদূরে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন একটি প্রকল্প (শেষ হয়ে গেছে) এলাকায় সরজমিন পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেছে, প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে মাস তিনেক আগে। এখনও সেখানে অবস্থিত প্রকল্প অফিসের সামনে অবহেলায় পড়ে আছে প্রকল্পের কাজে ব্যবহৃত দুটি গাড়িসহ আনুসঙ্গিক যন্ত্রপাতি। অফিসের ভেতরে রয়েছে কম্পিউটার, ল্যাপটপসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি।
নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত একটি বেসরকারি নিরপত্তা সংস্থার সদস্য আনছার আলী অনেকটা ভয়ে ভয়ে বলেন, ‘আমার দায়িত্ব, যাতে বাইরের কেউ কিছু এখান থেকে নিয়ে না যায় তা দেখে রাখা। তবে প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিসাররা যাদের কাছে অস্থায়ী অফিসের চাবি রয়েছে তারা যদি এসে কেউ কিছু নিয়ে যায় তা আমি কীভাবে ঠেকাবো। এ ছাড়া আমি জানবো কী করে যে এসব মাল তিনি নিজে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন?’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে আনছার আলী জানান, ‘অনেক অফিসারকে তো দেখেছে তারা প্রকল্পের কাজে ব্যবহৃত গাড়ি প্রকল্প শেষ হওয়ার পরেও জমা না দিয়ে নিজের কাজে ব্যবহার করছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব গাড়ি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার পরিবারের সদস্যরা তাদের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেন।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষে প্রকল্পের কাজে ব্যবহৃত গাড়ি কম্পিউটার নিজেদের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করি এমন অভিযোগ শতভাগ সত্য নয়। হয়তো অনেকে করে। কিন্তু তাও সঠিক নয়। কারণ, আপাত দৃষ্টিতে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে গেছে মনে হলেও অফিশিয়াল অনেক কাজ তখনও বাকি থাকে, তাই হয়তো অনেক পিডি (প্রকল্প পরিচালক) গাড়ি ব্যবহার করেন। প্রকল্প এলাকায় অফিসে জনবল না থাকায় অনেকেই বাসায় কাজ করেন। তাই হয়তো কম্পিউটার বা ল্যাপটপ বাসায় নিয়ে যান। এতে তো আমি দোষের কিছু দেখি না।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিষয়টি সরকারের শীর্ষ মহলের নজরে এসেছে। এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাই বিষয়টি নিয়ে গত মঙ্গলবার (১৯ মার্চ) জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় কিছু অনুশাসন দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, প্রকল্প সমাপ্ত হওয়ার তিন মাসের মধেই পিসিআর বা প্রকল্প সমাপ্ত প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষে প্রকল্পের গাড়ি, অফিস ও অন্যান্য সরঞ্জাম যথাস্থানে জমা দিতে হবে। প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে দেশেই যারা অবসরে গিয়েছেন তাদের মধ্য থেকে পরামর্শক নিয়োগে গুরুত্ব দিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, প্রকল্প পরিচালকদের প্রকল্প এলাকায় থাকতে হবে এবং একটি প্রকল্পের জন্য একজন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ করতে হবে। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে কারিগরি লোক পাওয়া না গেলে সেক্ষেত্রে অনুমোদন সাপেক্ষে দুটি বা তার বেশি প্রকল্পে একজন পিডি থাকতে পারবেন। এনইসিতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) পক্ষ থেকে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ১৫টি সমস্যা তুলে ধরা হয়েছে বলেও জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানিয়েছেন, ‘উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পরও ওই প্রকল্পের আওতায় কেনা যানবাহন যারা এখনও ফেরত দেননি, তাদের শিগগিরই পরিবহন পুলে যানবাহন জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় যেসব গাড়ি কেনা হয়, প্রকল্পটি শেষ হওয়ার পর নিয়ম অনুযায়ী তা পরিবহন পুলে জমা দেওয়ার কথা। কিন্তু অনেকে তা জমা দেয় না। কোন জিপ কোথায় ব্যবহার হয়, কোথায় ময়লা-আবর্জনা পড়ে অব্যবহৃত পড়ে থাকে, সব তথ্যই তার জানা আছে। সরকারি যানবাহনের যাচ্ছেতাই ব্যবহার ও এর অপব্যবহার নিয়ে এনইসি সভায় আইএমইডি সচিব আবুল মনসুর মোহাম্মদ ফয়েজুল্লাহ প্রধানমন্ত্রীর সামনে প্রতিবেদন তুলে ধরলে তিনি এ নির্দেশনা দেন। এসময় আইএমইডি সচিব মনসুর ফয়জুল্লাহ প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, সারা দেশে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নজরদারির জন্য আইএমইডির কাছে পর্যাপ্ত গাড়ি নেই। তখন প্রধানমন্ত্রী বলেন ‘চাইলে হেলিকপ্টারও পাবেন। আমার কাছে কোনও কিছুর অভাব নেই।”
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘আটটি বিভাগীয় শহরে আইএমডির অফিস চালু করতে হবে। যাতে করে মাঠপর্যায়ে প্রকল্প নজরদারি করা সহজ হয়। আইএমইডিতে যেহেতু প্রকৌশলী নেই, তাই সরকারের নজরদারি করা একমাত্র সংস্থাটির জন্য প্রকৌশল ইউনিট কিংবা ল্যাব করার বিষয়টিও ভাবছেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আইএমইডিকে শক্তিশালী করতে এর জনবল, গাড়িবহর ও যন্ত্রবহর বাড়ানোরও নির্দেশ দিয়েছেন।’