আন্দোলন হলেই সড়কে বিশেষ অভিযান
- আপডেট সময় : ০১:১৯:২৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২২ মার্চ ২০১৯ ১৬০ বার পড়া হয়েছে
নিজস্ব প্রতিবেদক,
• আন্দোলনের মুখে পুলিশের অভিযান শুরু
• রেশ কাটলে অভিযানও হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে
• ৭ মাসে ঢাকায় তিন দফা ট্রাফিক শৃঙ্খলা কর্মসূচি
• কর্মসূচি পালন করলেও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরেনি
• গণপরিবহনগুলো সড়কে চলেছে বেপরোয়াভাবে
মালিক সমিতির সিদ্ধান্ত ভঙ্গ করে চুক্তিতে বাস চালানোয় সুপ্রভাতসহ পাঁচটি সংস্থার সদস্যপদ বাতিলের সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলেন পরিবহননেতারা। সেটা গত আগস্টের কথা। তবে বাসগুলো এখনো চলছে, চুক্তিতেই চলছে।
গত মঙ্গলবার কলেজছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে রাজধানীর বাস চলাচলে শৃঙ্খলা আনার ব্যর্থতার বিষয়টি আবার আলোচনায় এসেছে। এর আগেরবার পুলিশ ও পরিবহননেতারা যে প্রতিশ্রুতিগুলো দিয়েছিলেন, এবারও সেগুলো দিয়ে যাচ্ছেন। তবে অভিযোগ আছে, বাসের চেয়ে মোটরসাইকেল ও ব্যক্তিগত যানবাহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই মাঠপর্যায়ের ট্রাফিক কর্মকর্তারা বেশি আগ্রহী।
ঢাকঢোল পিটিয়ে গত সাত মাসে রাজধানীতে তিন দফায় ট্রাফিক শৃঙ্খলা কর্মসূচি পালন করেছে পুলিশ। তবে শৃঙ্খলা ফেরেনি। বাস ও লেগুনার মতো গণপরিবহনগুলো সড়কে চলেছে বেপরোয়াভাবে। পুলিশের বেঁধে দেওয়া শৃঙ্খলা পক্ষ বা শৃঙ্খলা সপ্তাহের কয়েকটা দিন বাসগুলো একটু রয়ে–সয়ে চলে। লেগুনাগুলোর চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এরপর সবই আগের মতো। রংচটা তোবড়ানো বাস আর লেগুনার কিশোর চালকের বেপরোয়াপনাই দেখতে হয় নগরবাসীকে।
সর্বশেষ গত রোববার শুরু হওয়া ট্রাফিক সপ্তাহের মধ্যেই আবরারকে চাপা দেওয়া সুপ্রভাত পরিবহনের বাসটির রাজধানীতে চলাচলের কোনো অনুমোদন ছিল না বলে বিআরটিএ থেকে জানানো হয়েছে। এই বাসের অনুমোদিত রুট মহাখালী থেকে টঙ্গী, ঘোড়াশাল হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পর্যন্ত।
বিআরটিএর উপপরিচালক (প্রকৌশল) শফিকুজ্জামান ভুঞা গতকাল জানান, সুপ্রভাত ও জাবালে নূরের বাসগুলোর চলাচল স্থগিত করে সেগুলোর সব কাগজ চাওয়া হয়েছে। কাগজ যাচাইয়ের জন্য একটি কমিটি করা হয়েছে।
ঢাকা আঞ্চলিক পরিবহন সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা মহানগরের পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া এ বিষয়ে গতকাল একটি অনুষ্ঠানে বলেন, ‘সুপ্রভাতের যে গাড়িটা দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে, তার বিরুদ্ধে ২৭টি মামলা আছে। তার কোনো অধিকার নেই গাড়ি
চালানোর। অন্য যে গাড়িগুলো আছে সেগুলো আপাতত স্থগিত আছে। তাদের সকল কাগজ বিআরটিএতে জমা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সেখানে কাগজগুলো যাচাই করে দেখা হবে। যেগুলোর কাগজ ঠিক নেই, মডেল আউট, সেগুলোর রুট পারমিট বাতিল করে দেওয়া হবে।’
দুর্ঘটনা ঘটানো সুপ্রভাতের ওই বাসটির চালক সিরাজুল ইসলামের বাস চালানোর লাইসেন্সও ছিল না। তিনি হালকা যান চালানোর লাইসেন্স নিয়ে বাস চালাচ্ছিলেন। আর মঙ্গলবার আবরারকে চাপা দেওয়ার আগে আরেক নারী পথচারীকে ধাক্কা দেয় বাসটি। ধাক্কা দিয়ে পালানোর সময়ই এই দুর্ঘটনা ঘটায়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীতে সংঘটিত ৫৩ শতাংশ দুর্ঘটনার কারণ বাস। সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বেপরোয়া বাস চালনাকে দায়ী করেছে এআরআই। ২০১৬ সালের মার্চ থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজধানীতে সংঘটিত দুর্ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণ করে এআরআই বলছে, এ সময়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৬৬৬টি। তাতে ৬৯৯ জন নিহত এবং ১ হাজার ২২৭ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৩৫৪টি দুর্ঘটনাই বাসের কারণে ঘটেছে। ২০১৬ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় ১২৩টি দুর্ঘটনার মধ্যে ৭৫টির কারণ ছিল বাস। ২০১৭ সালে ঢাকায় ২৬৩টি দুর্ঘটনার মধ্যে ১৪৫টি দুর্ঘটনায় বাসের সম্পৃক্ততা ছিল। ২০১৮ সালে ঢাকায় ২৮০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৮৬ জন নিহত হয়। সে বছর ১৩৪টি দুর্ঘটনার কারণ ছিল বাস।
বাসের বিরুদ্ধে অভিযানঃ
এসব সমালোচনার মুখে গত দুই দিন পুলিশকে বাসগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে। যার প্রভাবে নগরীতে বাস চলাচল অর্ধেকে নেমে এসেছে। গতকাল রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকার বিভিন্ন পথে চলাচলকারী অন্তত ২০টি বাস আটক করেছে পুলিশ। সড়কের এক পাশে সারি দিয়ে রাখা ওয়েলকাম, বিকাশ, এম এম লাভলী, মেশকাত, স্বাধীন, লাব্বাইকসহ বিভিন্ন পরিবহনের একাধিক বাস। এগুলোর কোনোটির রুট পারমিট নেই, কোনোটির সংকেত বাতি নষ্ট। অনুমোদনের অতিরিক্ত আসনযুক্ত করা হয়েছে কোনোটিতে। আবার বাসের চালক ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখাতে পারেননি এমন বাসও আছে।
মূলত গত দুই দিন পুলিশ বাসের বিরুদ্ধে অভিযান জোরালো করেছে। এর মধ্যে গতকাল পুলিশ বাসের বিরুদ্ধে নেওয়া ব্যবস্থার হিসাব পৃথকভাবে জানিয়েছে। তাতে দেখা যায়, গতকাল ৩৪৪টি বাসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কাগজপত্র ও ফিটনেস ক্রটির কারণে ৩২৭টি বাসের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা (প্রসিকিউশন) নেওয়া হয়েছে। ১৭টি বাস ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়েছে।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মীর রেজাউল আলম বলেন, ‘বিষয়টা এমন নয় যে বৃহস্পতিবারই প্রথম বাসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’ তাহলে কাগজপত্র ঠিকঠাক নেই, ফিটনেস নেই এমন বাস রাস্তায় চলছে কী করে জানতে চাইলে মীর রেজাউল আলম বলেন, ‘বাস ডাম্পিংয়ের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় তাঁরা লক্কড়ঝক্কড় বাসকে মামলা দিয়ে ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। কিছুদিন পর সেই বাসগুলোই আবার রাস্তায় চলছে। এখানে একটু সমস্যা হচ্ছে।’
চাঁদা ও ঘুষঃ
এদিকে বাস পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, বাস চালাতে তাঁদের নিয়মিত পুলিশ ও পরিবহননেতাদের টাকা দিতে হয়। গাবতলী-যাত্রাবাড়ী পথে চলাচলকারী আট নম্বর বাসের কন্ডাক্টর শাহীন বলেন, তিনি ও গাড়িচালক মিলে পুরোনো আইসার মিনিবাসটি চুক্তিতে নিয়ে চালান। প্রতিদিন মালিককে জমা দিতে হয় ২৩০০ টাকা। মালিকের সঙ্গে চুক্তি হলো, দিন শেষে মালিককে টাকা বুঝিয়ে দিলেই হলো। তবে গাড়ির কোনো যান্ত্রিক সমস্যা দেখা দিলে মালিক সেগুলো মেরামত করিয়ে দেবেন। আর পথে দুর্ঘটনায় গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা মেরামতের দায় চালক ও কন্ডাক্টরের।
শাহীন জানালেন, প্রতিদিন গড়ে চারবার গাবতলী থেকে যাত্রাবাড়ী যাতায়াত করতে পারেন তাঁরা। প্রতিবার যাতায়াতে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা হয়, দিন শেষে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। তবে প্রতিদিন এক হাজার টাকা চাঁদা, আড়াই হাজার টাকা গ্যাস তাঁদের কিনতে হয়। চাঁদার টাকা লাইনম্যানের মাধ্যমে নিয়ে যায় পুলিশ ও পরিবহননেতারা। প্রতিদিনের এক হাজার টাকা চাঁদার মধ্যে মাজার রোডে ৬৬০ টাকা, সায়েদাবাদে ২২০ টাকা, ফার্মগেটে ২০ ও শ্যামলী শিশুমেলায় ২০ টাকা দিতে হয়। এরপর যা থাকে তা তাঁরা ভাগ করে নেন। তবে আগস্ট মাস থেকে প্রায় প্রতি সপ্তাহে একাধিক মামলা দিচ্ছে পুলিশ। এত মামলা হয়েছে যে এখন তাঁদের গাড়িতে কোনো কাগজ ও চালকের লাইসেন্সটিও নেই। সবই পুলিশের কাছে জব্দ।
গত সেপ্টেম্বরে ডিএমপির কমিশনার প্রধান সড়ক থেকে লেগুনা চলাচল বন্ধের কথা বলার পরে কিছুদিন তা বন্ধ ছিল। এখন দেদার চলছে। লেগুনা মালিক সমিতির একজন নেতা বলেন, এখন পুলিশের চাঁদার ভাগ বেড়েছে। এ জন্য তাঁরা ভাড়াও বাড়িয়েছেন। তবে সব পথেই আগের মতো গাড়ি চলছে।
শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ
আবরারের মৃত্যুর প্রতিবাদ ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজধানীর প্রগতি সরণিতে যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে মানববন্ধন করেছেন কিছু শিক্ষার্থী। গতকাল দুপুর পৌনে ১২টার দিকে শতাধিক শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে এই মানববন্ধন শুরু হয়। সেখানে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী রায়হানুল বলেন, পুলিশ তাঁদের সড়কে অবস্থান না নেওয়ার অনুরোধ করেছেন। সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের বিষয়টি মাথায় রাখার কথা বলেছেন। মানববন্ধনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের হাতে জাতীয় পতাকা এবং বিভিন্ন দাবি লেখাসংবলিত প্ল্যাকার্ড ছিল।
এ ছাড়া একই সময়ে সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে ৩০–৩৫ জন শিক্ষার্থী রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে নিরাপদ সড়কের দাবি জানান। তবে এসময় সড়কে যান চলাচল ব্যাহত হয়নি।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একটি অংশ সাত দিন সময় দিয়ে গতকাল থেকে কর্মসূচি স্থগিত করেছে। তবে একটি অংশের এই স্থগিতাদেশ নিয়ে আপত্তি আছে। তারা কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে। তবে গতকাল তেমন কোনো কর্মসূচি চোখে পড়েনি।