আসল মদে কড়াকড়ি, নকল মদ পানে প্রাণহানি
- আপডেট সময় : ১২:৪০:২৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২১ জানুয়ারী ২০২৩ ১৪৭ বার পড়া হয়েছে
বৈধ বার থেকে অ্যাবসুলেট ভোদকার একটি বোতল কিনতে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা দরকার। কিন্তু সাকরাইন উপলক্ষে পুরান ঢাকার কয়েক বন্ধু মিলে কথিত ‘পার্টির’ জন্য সেই বোতল কিনে আনেন সাড়ে ৩ হাজার টাকায়। মামুন হোসেন নামে এক তরুণ এই মদ সরবরাহ করেন। তিনি একসময়ে ঢাকার একটি বৈধ বারে চাকরি করতেন। কিন্তু বোতলের লেভেল দেখে নকল সন্দেহ হওয়ায় সেই মদ পান করেননি কেউ।
শুধু মামুন নন, তার মতো বিভিন্ন ব্যক্তি বাসাবাড়িসহ বিভিন্ন আড্ডায় কম দামে ‘বিদেশি মদ’ হোম ডেলিভারি দিচ্ছেন। এসব মদপানে অসুস্থ হচ্ছেন অনেকে, মৃত্যুও হচ্ছে কারও কারও। কিন্তু লোকলজ্জায় ঘটনা লুকিয়ে রাখছেন অনেকেই। তাই ভেজাল মদ উৎপাদন ও বিক্রিতে জড়িতরা থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
সম্প্রতি কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকসহ পাঁচজনের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর ফের আলোচনায় এসেছে এই ভেজাল মদ। যদিও তারা বিষাক্ত মদপানেই মারা গেছেন, সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত পরীক্ষিত কোনো প্রমাণ না থাকলেও ওই পাঁচজনের ঘনিষ্ঠজন বলছেন, এক আড্ডায় তারা মদপানের পরই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।
কিশোরগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ কালবেলাকে বলেন, ওই পাঁচজন মদপানে মারা গেছেন, এমন অভিযোগ কেউ পুলিশের কাছে করেননি। তবে তাদের মৃত্যু পুলিশ স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছে না। কীভাবে মৃত্যু হলো, মদপান করলে বিষাক্ত মদ কোথায় পেল? সেই তদন্ত চলছে।
এর আগে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার পিকনিকে ভেজাল মদপানে বেশ কয়েক কর্মীর মৃত্যু হয়। প্রায় একই সময়ে এই ধরনের মদপানে বগুড়ায় মারা যান ১৬ জন। এরপর ভেজাল মদ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়।
২০২১ সালের জানুয়ারিতেই রাজধানীর বারিধারা এলাকায় আব্দুল্লাহ আল মামুন নামে এক ব্যবসায়ীর মৃত্যুর পর ওই ঘটনায় মামলা হলে পুলিশ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে। এরপর বেরিয়ে আসে ভেজাল আর নকল মদ তৈরি ও তা বিক্রির ভয়ংকর কাণ্ড।
যে কারণে ভেজাল ও নকল মদের চাহিদা
বৈধ বার এবং ওয়্যারহাউস থাকার পরও বাজারে ভেজাল মদের কেন চাহিদা–সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে মিলেছে নানা তথ্য। জানা গেছে, দেশে মদ আমদানিতে অতি উচ্চ শুল্ক আরোপ রয়েছে। এতে ক্রেতা পর্যায়ে মদের দামও বেশি গুনতে হচ্ছে।
এই সুযোগটাই নিচ্ছে মদের ভেজাল উৎপাদক ও বিক্রিতে জড়িতরা। শুল্ক বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, অ্যালকোহল আমদানিতে ৬০০ থেকে ৬৫০ ভাগ শুল্ক রয়েছে।
সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও অ্যালকোহল আমদানিতে অতি উচ্চ শুল্ক আরোপের বিষয়ে আলোচনা হয়। ওই বৈঠকে বলা হয়, ‘অ্যালকোহলের আমদানিতে শুল্ক অত্যন্ত বেশি হওয়ায় অধিক নিয়ম মেনে বেশি পরিমাণ অ্যালকোহল আমদানি হচ্ছে না। আবার আমদানি করা অ্যালকোহলের দাম অত্যন্ত বেশি হওয়ায় অ্যালকোহলসেবীরা অন্যান্য মাদকের দিকে ঝুঁকছেন।’
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সারা দেশে ১৮৬ বৈধ বার ও ক্লাব রয়েছে। এর বাইরে দেশে প্রায় ২০০টি বৈধ মদ বিক্রয় কেন্দ্র রয়েছে। এ ছাড়া বিদেশি কূটনীতিকদের জন্য শুল্কমুক্ত ১৪টি ওয়্যারহাউস রয়েছে। ওয়্যারহাউস থেকে কূটনৈতিক পাসপোর্টের বিপরীতে প্রতি মাসে ২০০ ডলারের মদ সরবরাহের বিধান রয়েছে।
তবে বার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একসময়ে ওয়্যারহাউসগুলোতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও প্রভাবশালী বার ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ছিল। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ওয়্যারহাউস থেকে শুল্কমুক্ত বিদেশি মদ বের করে তা বেশি দামে বারে এবং হোম ডেলিভারিতে বিক্রি হতো। কিন্তু শুল্ক বিভাগ ওয়্যারহাউসগুলোতে কড়াকড়ি করায় আসল মদের সেই অবৈধ কারবার অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু মদের চাহিদা কমেনি। সেই চাহিদা পূরণ করছে ভেজাল আর নকল মদ।
নিয়মিত মদপান করেন এমন কয়েকজন ব্যক্তি ও কয়েকটি বারের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে ওয়্যারহাউস বা বার থেকে সহজে লাইসেন্স ছাড়াও বিদেশি মদ বের করা যেত। কিন্তু এখন তাতে কড়াকড়ি। লাইসেন্স ছাড়া মদ বের করা গেলেও খরচ দুই থেকে চারগুণ বেশি হয়। তা ছাড়া মদ বহন করতেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভয় রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ভেজাল ও নকল মদের চাহিদা বেড়ে গেছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুরান ঢাকার নিমতলীসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ভেজাল মদ উৎপাদনকারীরা বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদের বোতল সংগ্রহ করে থাকে। এরপর সেই বোতলগুলোয় হুবহু লেভেল লাগিয়ে তাতে নকল মদ ভরা হয়। নতুন কোনো মদসেবী এসব বোতল বা নকল মদ পান করে অসুস্থ না হওয়া পর্যন্ত কিছুই বুঝতে পারে না।
রাজধানীর একটি বারের ব্যবস্থাপক নাম প্রকাশ না করে কালবেলাকে বলেন, বিদেশি মদ আমদানিতে অনেক শুল্ক দিতে হয়, অনেক নিয়ম-বিধিনিষেধ থাকে। ফলে বিদেশি মদ চাহিদার তুলনায় আমদানি হয় কম। এই সুযোগটাই নিচ্ছে ভেজাল চক্র।
যেভাবে তৈরি হয় ভেজাল মদ
ভেজাল মদপানে বারিধারার ব্যবসায়ী আব্দুল্লাহ আল মামুনের মৃত্যুর পর পুলিশ ওই চক্রের ৭ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ ও আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে বেরিয়ে আসে ভেজাল মদ তৈরির আদ্যোপান্ত। ওই চক্রের অন্যতম সদস্য জাহাঙ্গীর আলম জানিয়েছিলেন, ভেজাল মদ তৈরির প্রধান উপকরণ কাঠের আসবাব তৈরির স্পিরিট। এই স্পিরিটের সঙ্গে পোড়া চিনি, কাপড় বা খাবারে ব্যবহৃত রং, চিনি মিশ্রিত পানি ও রাসায়নিক মিশিয়ে তৈরি করা হয় ভেজাল মদ। পরে তা ঢোকানো হয় ভাঙাড়ি দোকান থেকে কিনে আনা পুরোনো মদের বোতলে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, মদপানে কেউ মারা যান না। মদ নয়, মূলত মিথানল নামে ভয়াবহ বিষপানে মানুষের মৃত্যু ঘটে। মদ তৈরির উপাদান ইথানল নামে এক রাসায়নিক। ইথানলের দাম বেশি এবং দেখতে ও গন্ধে প্রায় মিথানলের মতোই। এ কারণে ভেজালকারীরা মিথানল দিয়ে মদ তৈরি করে।
তিনি বলেন, এই মিথানল শরীরে গেলে স্নায়ুতন্ত্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হার্ট অ্যাটাকও হতে পারে। এই দুই কারণেই মানুষের মৃত্যু হয়। শরীরে মিথানল বিষক্রিয়ার কারণে কোষে অক্সিজেন সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়।
চিকিৎসকরা বলছেন, মিথানলের বিষক্রিয়ার সবচেয়ে মারাত্মক প্রভাব পড়ে চোখের স্নায়ুর ওপর। বিষক্রিয়ার শিকার হওয়ার পর বেঁচে গেলেও অনেকেই অন্ধ হয়ে যান। ২০১৭ সালে ‘অ্যানালস অব অকুপেশনাল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল মেডিসিন’ নামে বিখ্যাত জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, অন্তত ৪ থেকে ১২ গ্রাম বিশুদ্ধ মিথানল সরাসরি সেবন করলে একজন মানুষ অন্ধ হয়ে যেতে পারেন। ব্যক্তিভেদে এর চেয়ে কম পরিমাণ বিশুদ্ধ মিথানল সেবনেও অন্ধ হয়ে যাওয়ার বা মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হোম ডেলিভারিতে ভেজাল ও নকল মদের বিক্রি বেশি হলেও বারগুলোতে আমদানি করা বিদেশি মদের নামে বৈধ লাইসেন্সধারীরা কী খাচ্ছেন, তাও নিশ্চিত নন সংশ্লিষ্টরা। কারণ হিসেবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেছেন, গত এক যুগেও দেশের কোনো বার থেকে পান করার সময়ে মদের কোনো নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা করা হয়নি। যে পরীক্ষা করার কথা বারে লাইসেন্স দেওয়ার শর্তে রয়েছে।