দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে। মধ্য আয়ের দেশে রূপান্তরিত হচ্ছে দেশ। কিন্তু ধনী-গরিবের ভেতরে বৈষম্য বাড়ছেই। শহরে যেমন সুউচ্চ ভবন বাড়ছে বাড়ছে ধনী-গরিবের বৈষম্য। বাজার থেকে শুরু করে সব জায়গায় সিন্ডিকেটের রাজত্ব। এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের কোনো উদ্যোগ নেয়া যায়নি আজও। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষকে নিঃস্ব করে তুলছে। একদিকে বাড়ছে বিভিন্ন নামের বসবাসের সিটি, শপিংমল বাড়ছে বস্তির সংখ্যাও। মানুষের ভেতরে এই বৈষম্য দূর না হলে কোনো উন্নয়ন ফলপ্রসূ হবে না।
নতুন বছরের প্রথম প্রহরে বছরকে উদ্যাপন করতে বহু রঙের আতশবাজি, ফানুস আর রাতভর ডিজে পার্টির শব্দে প্রকম্পিত হয়েছিল ঢাকার শহরের বিভিন্ন এলাকা। কিন্তু নতুন বছরের সেই আনন্দের ছিটেফোঁটাও স্পর্শ করেনি নগরীর নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনে। ব্যস্ততার মাঝেও নিজেদের টানাপড়েনে চলছেন বস্তির বাসিন্দারা। নতুন বছরের আনন্দ তো দূরের কথা, বস্তিবাসীর প্রত্যেককে থাকতে হয় নানা আতঙ্কের মধ্যে। ছোট একটি জায়গায় গাদাগাদি করে অন্তত ২০০০ মানুষ বাস করছে। তবে বাড়িভাড়া বাড়ানোর নোটিস আসে অহরহ।
নগরীর বড় বড় আকাশ ছোঁয়া বস্তির কাছে গিয়ে দাঁড়ালে দেখা যাবে শত আনন্দের ভেতরেও হাত সম্বল মানুষগুলো একটু আনন্দ করার বা অবসরের সুযোগ পায় না। বস্তিবাসী এসব লোকের কাছে গেলে দেখা যাবে পুরুষ সদস্যরা কাজে বেরিয়ে পড়েছেন। বাড়ির নারী সদস্যরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন ঘরের কাজ সারতে। এই নারীদের অনেকেই আবার আশপাশের এলাকায় গৃহকর্মীর কাজ করেন। তারা যেখানে থাকেন সেখানে প্রতি মাসে একটি ঘর বাবদ ভাড়া গুনতে হয় সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকার মতো। নতুন বছরের আনন্দ তো দূরে থাক, তারা বরং আতঙ্কে আছেন কবে না আবার বাড়িভাড়া বাড়ানোর নোটিস আসে।
ছোট্ট একটি ঘরে একটা বিছানা ফেলে কোনোরকমে থাকতে হয় তাদের। এই ঘরের ভাড়া দিতেও কষ্ট হয়। এভাবেই চলে তাদের জীবন। অন্যদিকে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়তে থাকায় রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় তাদের। আগে ৫শ’ টাকায় হাত ভরে বাজার হতো। এখন ৫শ’ টাকায় এক মুঠ বাজার আনতে পারে না। কয়টা আলু, পেঁয়াজ, সবজি কিনলেই শেষ। প্রায় প্রতিদিনই তাদের খাবার রুটিন আলু, বেগুন না হলে শাক সবজিতে সীমাবদ্ধ। মুরগির মাংস জোটে মাসে দুই একবার। অন্যদিকে গরুর মাংস খাওয়ার কথা চিন্তাতেও আনতে পারেন না। গরুর মাংস খান বছরে একদিন - কোরবানির ঈদে। আর না হলে ভাগ্যে জোটে না খাই না। গ্যাস ও পানির সংকটে থাকে এরা। ভোর ছয়টা থেকে, সারাদিন বিভিন্ন বাড়িতে কাজ সেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিকেল ঘনিয়ে যায়। ততক্ষণে চুলায় কোনো গ্যাস পান না। আবার সিলিন্ডারের গ্যাস ব্যবহারের কোনো সামর্থ্যও তাদের নেই। এমন অবস্থায় শহরে থেকেও মাটির চুলায় কাজ সারতে হয় বেলা করে ফেরা এই মানুষগুলোকে। আবার গরমকালে যখন পানির চাহিদা বেড়ে যায়- তখন তীব্র পানি সংকট এসব বস্তির নিয়মিত চিত্র।
বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় জানা গেছে, বাংলাদেশে শহর এলাকায় মোট জনসংখ্যার ১৯ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। আরও সহজ করে বললে শহরের পাঁচজনের মধ্যে একজনই দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনযাপন করেন এবং শহরের অর্ধেক পরিবার দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ‘বাংলাদেশ সোশ্যাল প্রটেকশন পাবলিক এক্সপেনডিচার রিভিউ’ শিরোনামের প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য জানা যায়। অন্যদিকে গ্রামে দারিদ্র্যের হার তুলনামূলক বেশি প্রায় ২৬ শতাংশ হলেও টিকে থাকার লড়াই শহরে দরিদ্রদের মধ্যেই বেশি। এর কারণ গ্রামের ৩৬ শতাংশ মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধা পান। যেখানে শহরের দরিদ্রদের এই সুবিধা পাওয়ার হার বেশ সীমিত, মাত্র ১১ শতাংশের মতো।
ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে বস্তির এই মানুষগুলো গ্রাম ছেড়ে শহরে এলেও সেই স্বপ্ন অধরাই রয়ে গিয়েছে। গ্রামের চাইতে শহরে আরো বেশি টানাপড়েনের জীবন বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। শহরে থাকার কারণে খরচ বেড়ে গেছে। শহরে তো পানিটা পর্যন্ত আমারে কিনা খাইতে হয়। নিম্ন আয়ের এই মানুষেরা মানবেতরভাবে জীবন যাপন করে। বড় লোকের সংখ্যা বাড়ছে। কয়েকগুণ হারে বাড়ছে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা। এই বৈষম্য কমিয়ে আনা জরুরি। নতুবা এই উন্নয়ন কোনো কাজে আসবে না।