কামাল হোসেন। ছিলেন পাসপোর্ট অফিসের দালাল। থাকতেন কুড়েঁর ঘরে। পড়ালেখাও করেননি বেশি, ২০০৭ সালে লক্ষণপুর নুরুল হক বহুমুমী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ফেল করেছেন। সেই কামাল আজ প্রায় শত শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। যেন আঙুল ফুলে কলা গাছ। এটা বললেও ভুল হতে পারে কামালের ক্ষেত্রে। মাত্র পাঁচ বছর আগেও যে ব্যক্তি পাসপার্টের দালালি করতেন তার কী করে হয় এতো টাকা? সেই কামালের বন্ধু মহলও অবাক। তাদের ভাষ্যমতে, ‘আলাদিনের চেরাগ পেয়েছেন কামাল।’
সূত্র মতে, কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার লক্ষণপুরের নুর মোহাম্মদের ছেলে মো. কামাল হোসেন। বাবা কৃষিকাজ করতেন। কুমিল্লা পাসপোর্ট অফিসে নিয়মিত যাতায়াত করতেন কামাল। সময়ের সাথে সাথে পাসপোর্ট অফিসে দালালিতে মন দেয় কামাল। সেখানেও মন বসে না এই কোটিপতি। বর্তমান মন্ত্রী পরিষদের একজন ক্ষমতাসীন সদস্যের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেন। তারপর থেকে খুঁলে যায় কপাল। পিছনে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। সেই মন্ত্রীর হাত ধরেই একের পর এক সাফল্য আসে পাসপোর্টের দালালের। নিজ গ্রামে ক্রয় করেছেন কয়েক বিঘা জমি। গড়েছেন সম্পৃক্তির পাহাড়। শুধু গ্রামে নয়, কুমিল্লা শহরেও গড়েছেন ফ্ল্যাট, প্লট ও বিলাসী বাড়ি। ক্রয় করেছেন শত কোটির টাকার জমি। পাসপোর্টের দালাল থেকে শত কোটি টাকার মালিক হওয়ার রহস্য উদঘাটন করতে এরই মধ্যে চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। মনোহরগঞ্জের কামাল হোসেনের ব্যপারে খোজ খবর নিচ্ছেন বলে দুদকের একাধিক সূত্র জানিয়েছেন।
সাজিদ
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর আফতাব নগরে চলছে একটি আলিশান ফ্লাটের কাজ। সেটি হচ্ছে আফতাব নগরের রোড নং ৮, ব্লক এইচ, বাড়ি নং ১০। কুমিল্লার মনোহরগঞ্জে ৫০ একর জমি। এছাড়া কুমিল্লা শহরের হাউজিং স্টেটে ৬য় তলার বাড়ির দুইটি ফ্লোর ব্র্যাক ব্যাংকের শাখার। ফ্ল্যাটগুলো মো. কামাল হোসেনের। তবে যানা গেছে, সেই কামাল হোসেন বর্তমানে ঠিকাদারী কর্মে ব্যস্ত। তার ব্যবসার পুজি রয়েছে ২ কোটি ৯২ লাখ ১৫ হাজার ৭শত ৪৯ টাকা। সেই হিসেবে তিনি বর্তমানে কর দিচ্ছেন। করের পরিসম্পদ, দায় ও ব্যয় বিবরণীতে কুমিল্লা সিমটিতে ৩শত এবং লাকসাম, দিশাবন্দর ও লক্ষণপুর মৌজায় ৬৮ শতক জমির মালিকানা উল্লেখ করেছেন। এছাড়া যমুনা ব্যাংকের কুমিল্লা শাখা প্রায় ১শত ৭২টি টাকা রয়েছে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেন। বর্তমানে একটি পাজারো গাড়ীর মালিকও তিনি। কামাল হোসেন শুধু টাকার পিছেই ঘুরেনি। তিনি খুলনায় ও বাগেরহাটে দুইটি বিয়ে করেছেন। সেই দুই স্ত্রী আদালতে মামলা করেছেন।
সূত্রে আরো জানা গেছে, মনোহরগঞ্জ উপজেলার লক্ষণপুর বাজারের নিতাই ফার্নিচার দোকানের পূর্ব পাশে প্রায় ৮০শতক জমির উপর রাস্তার পাশে ২০টি ছোট দোকান নির্মাণ করেছে। কুমিল্লার শাকতলায় নিজের ৬ শতক জায়গার উপরে ফাইলিং চলছে বলে জানা গেছে।
এদিকে কুমিল্লা শহরে বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান যমুনা ব্যাংক লিমিটেডের কান্দিরপাড় শাখায় ব্যাংক কার্যালয়ের মধ্যে একটি কক্ষ কামালের ঘুষ লেনদেন এর কাজে ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। তাও সেটি আবার খোদ ব্যাংকের ম্যানেজারের পাশের কক্ষটি। ব্যাংকিং আইনের পরিপন্থী এ কাজে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপক নুরে আলম সিদ্দিকীর ইচ্ছাতেই হয়েছে বলে দাবি করেছেন ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ও ব্যাংকের সাধারণ গ্রাহকরা।
যমুনা ব্যাংকের গ্রাহকদের দাবি, ব্যবস্থাপক নূরে আলম সিদ্দিকীর পাশের রুমটি মূলত স্থানীয় প্রভাবশালী নেতার ঘনিষ্ট হিসেবে পরিচিত কামাল হোসেন দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করে আসছেন। লেনদেন চলাকালীন সময়েও ঐ রুমটিতে লোকজন নিয়ে স্থানীয় মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কাজ ও বদলীর লেনদেন চলে বলে দাবি তাদের। যেখানে নিয়মিত ব্যাংকটির ব্যবস্থাপকও দীর্ঘ সময় নিয়ে অংশগ্রহণ করেন। যার ফলে প্রতিনিয়ত ব্যাংকটির শাখাতে আসা গ্রাহকদের লেনদেনের নিরাপত্তা বিঘিœত ও জটিলতা সৃষ্টি হয় বলে অভিযোগ গ্রাহকদের।
অভিযোগ আছে একজন মন্ত্রীর পিএস পরিচয় দেয়া কামাল হোসেন যমুনা ব্যাংকের কান্দিরপাড় শাখাতে শুধু ঘুষ লেনদেনের কার্যালয় খুলেই ক্ষ্যান্ত হননি, ব্যাংকটিতে তিনি ব্যবস্থাপক নুরে আলম সিদ্দিকীর সাথে সমন্বয় করে অনৈতিকভাবে লেনদেনও করে থাকেন। যেখানে প্রত্যক্ষভাবে ব্যবস্থাপক নূরে আলম সিদ্দিকীও আর্থিকভাবে লাভবান হন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া ব্যাংকের মধ্যে দখল করা কক্ষটিতে প্রতিনিয়ত পুরো কুমিল্লার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, গৃহায়ন ও গণপূর্ত অধিদপ্তর সহ অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের টেন্ডার ভাগাভাগি হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। যেখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন ঠিকাদারদের আনাগোনা ও সরব উপস্থিতি থাকে। নির্মানাধীন বহুতল ভবনটির দ্বিতীয় তলায় বর্তমানে যমুনা ব্যাংকের শাখা পরিচালিত হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যমুনা ব্যাংকের কান্দিরপাড় শাখায় এসব অস্বাভাবিক কার্যক্রম এবং নিয়মিত আড্ডা, ঠিকদারদের আনাগোনা, বিভিন্ন লেনদেনের জন্য ব্যাংকের শাখা অফিসটি কুমিল্লায় বেশ পরিচিত। এছাড়া কান্দিরপাড় শাখার ব্যবস্থাপক নূরে আলম সিদ্দিকী যমুনা ব্যাংকে যোগদান করার পর তার নামে খোদ যমুনা ব্যাংকেই ৩৭ টি ব্যাংক হিসাব এবং কামাল হোসেনের নামে ৩৬ টি ব্যাংক হিসাব রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। বেসরকারি একটি ব্যাংকের একজন ব্যবস্থাপকের এবং তার ব্যবসায়িক বন্ধু কামাল হোসেনের এতগুলো ব্যাংক হিসাব থাকাটা ব্যাংকিং আইনে অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে নূরে আলম সিদ্দিকীর ও কামাল হোসেনের বিভিন্ন ব্যাংকে ১০০টির অধিক ব্যাংক হিসাব রয়েছে। অভিযোগ আছে, এসব ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ইপিজি টেন্ডার বাণিজ্য ও নানা ভাবে ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের অপচেষ্টা করে আসছে নূরে আলম সিদ্দিকী।
সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন ধরনের সরকারি টাকা যেমন ইপিজি টেন্ডার এর পে অর্ডার, বিভিন্ন ধরনের ভাতা, উৎসব বোনাস ও ব্যাংকের বিভিন্ন হেডের মাধ্যমে সরকারি ফান্ড আত্মসাৎ করে তা নিজের নামে আনার জন্য এতগুলো ব্যাংক হিসাব খুলেছেন নূরে আলম সিদ্দিকী। এছাড়া তিনি ব্যাংকে বিভিন্ন প্রবাসী গ্রাহক ও স্থানীয় গ্রাহকের ব্যাংক হিসাব থেকে তাদের বিনা অনুমতিতে অর্থ উত্তোলন করে শেয়ার ব্যবসা, বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয় ব্যবসা ও নিজের ব্যক্তিগত ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন বলেও দাবি স্থানীয়দের।
মূলত নূরে আলম সিদ্দিকীর বাড়ি কুমিল্লায় হওয়ায় তিনি এসব অপকর্ম করে আসছেন বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন তার সহকর্মীরা।
এছাড়া কুমিল্লা কান্দিরপাড় শাখার ব্যবস্থাপক ও কামাল হোসেন খোদ ব্যাংকেই নিয়মিত মাদক সেবন করেন বলে অভিযোগ করেন সহকর্মীরা। ইয়াবা এবং ফেনসিডিল সহ বেশ কয়েকবার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হলেও রাজনৈতিক প্রভাবে বারবার ছাড়া পেয়ে যান। ক্ষমতার দাপট দেখানো যমুনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপক নূরে আলম সিদ্দিকী ও তার বিশেষ বন্ধু কামাল হোসেনের বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ ব্যাংক একাউন্ট থাকা এবং লেনদেন অস্বাভাবিক হওয়ায় তা নিয়ে বিভিন্ন সরকারি দফতরে অনুসন্ধান চলছে বলেও জানা গেছে।
এসব বিষয়ে জানতে যমুনা ব্যাংক কুমিল্লা কান্দিরপাড় শাখার ব্যবস্থাপক নূরে আলম সিদ্দিকীকে ফোন করা হলেও তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া গেছে। অপরদিকে কামাল হোসেনও ফোন ধরেননি।