হাফিজুর রহমান শফিক; দেশের সড়কগুলোতে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দুর্ঘটনা। কোনো কিছুতেই থামছে না মৃত্যুর মিছিল। গত বছর সারাদেশে সাড়ে সাত হাজার নিহত ও প্রায় ১৬ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সড়কে প্রতিনিয়ত বিপুলসংখ্যক মানুষ মারা গেলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চালক বা মালিকের উপযুক্ত শাস্তি হয় না। এছাড়া নতুন আইনে সরাসরি কঠোর শাস্তির বিধান না থাকায় ড্রাইভারসহ সংশ্লিষ্টরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছেন।
এ কারণে সড়ক দুর্ঘটনা কমছে না। তারা মনে করেন, অভিযুক্তদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত হলে বেপরোয়া গাড়ি চালানো অনেকাংশে বন্ধ হবে। আর সবাই সচেতন হলে আশিভাগ দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব।
জানতে চাইলে বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (এআরআই) সাবেক পরিচালক ড. হাসিব মোহাম্মদ আহসান বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় অভিযুক্তদের শাস্তির নজির নেই। অভিযুক্তদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত হলে বেপরোয়া গাড়ি চালানো অনেকাংশে বন্ধ হবে। এতে সড়ক দুর্ঘটনাও হ্রাস পাবে।
এ ছাড়া হাঁটাচলার সুবিধা না দিলে সড়ক দুর্ঘটনার কোনো সমাধান হবে না। মানুষ হাঁটতে চায়, কিন্তু হাঁটতে পারছে না। ফুটপাত যদি হাঁটার জন্য ফ্রি করা না যায়, তাহলে বাধ্য হয়ে৬ মানুষ রাস্তায় নেমে আসবে। আর তখন নিরাপত্তার প্রশ্নই অবান্তর।
সড়ক পরিবহন আইনে সাজার বিধান নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। আইনের ১০৫ ধারায় বলা আছে, এই আইনে যা-ই থাকুক না কেন, মোটরযান চালাতে গিয়ে কোনো দুর্ঘটনায় কোনো ব্যক্তি গুরুতরভাবে আহত বা নিহত হলে এ-সংক্রান্ত অপরাধ দণ্ডবিধির-১৮৬০-এর বিধান অনুযায়ী অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
তবে দণ্ডবিধির ৩০৪ (খ) ধারাতে যা-ই থাকুক না কেন, কোনো ব্যক্তির বেপরোয়া বা অবহেলা করে মোটরযান চালনার কারণে সংঘটিত কোনো দুর্ঘটনায় কোনো ব্যক্তি গুরুতরভাবে আহত বা নিহত হলে ওই চালক সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ডে বা সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
তবে ১১৪ ধারায় বলা আছে, এই আইনের অধীনে অপরাধের তদন্ত, বিচার, আপিল ইত্যাদি ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হত্যার উদ্দেশ্যে প্রমাণিত হলে তা ফৌজদারি কার্যবিধির ৩০২ ধারার অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে, যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। জানা গেছে, গত বছর ২৯ জুলাই রাজধানীর কুর্মিটোলায় জাবালে নূর পরিবহনের তিনটি বাস রেষারেষি করতে গিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের ওপর উঠে পড়ে একটি বাস।
এতে দুই শিক্ষার্থী নিহত ও নয়জন আহত হয়। এ ঘটনায় নিহত শিক্ষার্থী দিয়া খানমের বাবা জাহাঙ্গীর আলম বাদী হয়ে ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলা করেন। তবে এর বিচার কাজ অদ্যাবধি শেষ হয়নি। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন এ মামলায় ৩ এপ্রিল সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য রয়েছে।
২০ এপ্রিল বিআরটিসির একটি বাস গৃহকর্মী রোজিনা আক্তারকে ধাক্কা দেয়। রোজিনা পড়ে গেলে বাসটি তার ডান পায়ের ওপর দিয়ে চলে যায়। এতে তার পা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরবর্তীতে রোজিনা মারা যায়। এ ঘটনায় মামলা দায়েরের মাত্র চারদিন পরই জামিনে ছাড়া পান বিআরটিসির সেই চালক।
গত বছরের ৩ এপ্রিল পান্থকুঞ্জে দুই বাসের চাপায় তিতুমীর কলেজের স্নাতকের শিক্ষার্থী রাজীব হোসেনের ডান হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তিনিও চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এভাবে প্রতিনিয়তই দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যানুযায়ী, সঠিক মনিটরিংয়ের অভাব ও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোসহ প্রায় ১১৫টি কারণে এসব দুর্ঘটনা ঘটছে।
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। সড়কের নিরাপত্তার দাবিতে সামাজিক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া সংগঠন নিরাপদ সড়ক চাইয়ের (নিসচা) তথ্যানুসারে, ২০১৮ সালে ৩ হাজার ১০৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ৪৩৯ জন নিহত হয়েছেন। আর এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন ৭ হাজার ৪২৫ জন। নিহতদের মধ্যে গাড়িচাপায় ১ হাজার ৩৮৫ জন, মুখোমুখি সংঘর্ষে ৫৮৫ জন, উল্টে গিয়ে ২৫৩ জন, খাদে পড়ে ১৩৩ জন এবং অন্যান্যভাবে নিহত হয়েছেন ৬৬৩ জন। দুর্ঘটনা কবলিত পরিবহনের মধ্যে রয়েছে- ৮৭৯টি বাস, ৭৯৩টি ট্রাক, ৬৩৪টি মোটরসাইকেল, কাভার্ডভ্যান ১১৯টি, মাইক্রোবাস ৬৭টি, নসিমন ৫০টি, প্রাইভেটকার ৪৭টি ও মাহেন্দ্র ৩৮টি। নিসচার পরিসংখ্যান মতে ২০১৬ সালে ২ হাজার ৩১৬টি দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ১৫২ জন ও ২০১৭ সালে ৩ হাজার ৩৪৯টি দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৬৪৫ জন নিহত হয়েছিল।
জানতে চাইলে নিসচার চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য সঠিকভাবে আইন প্রয়োগ না করা অন্যতম দায়ী। তাছাড়া আইনের দুর্বলতাও এবং সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলাও রয়েছে। চালকদের প্রশিক্ষিত করার দায়িত্বটা আজ পর্যন্ত কেউ নেননি। সমাজের সব স্তরের মানুষ সচেতন হলেই ৮০ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় অভিযুক্তদের শাস্তি হয় না। পরিবহন শ্রমিকরা এটা মানতেই রাজি নন যে- দুর্ঘটনা রোধ সম্ভব। তারা মনে করেন, রাস্তায় গাড়ি বের হলে দুর্ঘটনা ঘটবেই। অপরাধীদের সাজার নজির সৃষ্টি হলেই সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি পাবে।
এদিকে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যানুসারে, গত বছর ৫ হাজার ৫১৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ২২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। অন্যদিকে সড়ক-রেল-নৌপথ ও আকাশপথে মিলিত দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৭ হাজার ৭৯৬ জন। এসব দুর্ঘটনায় আরও ১৫ হাজার ৯৮০ জন আহত হয়েছে। ২০১৮ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়লেও হতাহতের সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় কিছুটা কমেছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে ৪ হাজার ৯৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৩৯৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল। আহত হয়েছিলেন ১৬ হাজার ১৯৩ জন। যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যানুসারে, ২০১৮ সালে রেলপথে ৩৭০টি দুর্ঘটনায় ৩৯৪ জন নিহত ও ২৪৮ জন আহত হয়েছেন। আর নৌপথে ১৫০টি দুর্ঘটনায় ১২৬ জন নিহত ও ২৩৪ জন আহত হয়েছেন। নিখোঁজ রয়েছেন ৩৮৭ জন। আকাশপথে পাঁচটি দুর্ঘটনায় গত বছর ৫৫ জন নিহত ও ৩২ জন আহত হয়েছেন। গত বছর সড়কে যাদের প্রাণ গেছে, তাদের মধ্যে ৭৮৭ জনই নারী এবং শিশু ৪৮৭ জন। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ১ হাজার ২৫২ জন চালক ও শ্রমিক, ৮৮০ শিক্ষার্থী, ২৩১ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ১০৬ জন শিক্ষক, ৩৪ সাংবাদিক রয়েছেন। সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনায় পড়েছে ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ১১৫টি কারণ জড়িত। এর মধ্যে পাঁচটি বড় কারণ হল-দক্ষ চালকের অভাব, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, বেপরোয়া গতি, সড়কের বেহাল দশা ও আইনের অপপ্রয়োগ। এ পাঁচটির সমাধান হলে সড়ক দুর্ঘটনা একটা সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে।
চালক-মালিকের ‘পক্ষে’ পুলিশ : সড়ক দুর্ঘটনায় ৮০ ভাগ অপমৃত্যুর মামলা হয়। বাকি ২০ ভাগ নিয়মিত মামলায় পুলিশ ও আইন কর্মকর্তাদের গাফিলতিতে অপরাধীরা উপযুক্ত শাস্তি থেকে পার পেয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বাসের চালক ও মালিককে শুরুতেই লঘু শাস্তির ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে বর্তমানে দণ্ডবিধির ৩০৪ (খ) ধারায় মামলা করা হয়। বিচারও সম্পন্ন হয় এ ধারাতেই। ৩০৪ ধারায় চালকদের বিচারে বাধা না থাকলেও অজ্ঞাত কারণে পুলিশ এ ধারায় মামলা তেমন করে না।
জানতে চাইলে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি কাজী মো. নজিবুল্লাহ হিরু বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার সর্বোচ্চ ২০ বছর এবং সর্বনিু ১০ বছর কারাদণ্ড হওয়া উচিত। এর সঙ্গে বড় অঙ্কের জরিমানা ও লাইসেন্স বাতিল করে শাস্তির দু’চারটি নজির সৃষ্টি করতে পারলেই চালকদের মধ্যে একটা সচেতনতা সৃষ্টি হতো ও সবাই সাবধান থাকত। এ ধরনের মামলায় শাস্তির নজির খুবই কম। একপর্যায়ে গিয়ে মামলার বাদী-বিবাদীর মধ্যে আপস হয়ে যায়। সাধারণত দুর্ঘটনার জন্য দণ্ডবিধির ৩০৪ (খ) ধারাতেই মামলা হয়। তবে সেক্ষেত্রে যদি ড্রাইভারের লাইসেন্স না থাকে ও বিষয়টি উদ্দেশ্যমূলক হয় তাহলে অবশ্যই ৩০৪ ধারায় মামলা করতে হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) জনসংযোগ শাখার উপ-কমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তি অথবা বাদীর দেয়া বর্ণনা অনুযায়ী এজাহার তৈরি করা হয়। তদন্তে সাক্ষ্য-প্রমাণে যদি উদ্দেশ্যমূলক হত্যার বিষয়টি প্রমাণ হয়, সেক্ষেত্রে ধারা পরিবর্তন করে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দেয়ার সুযোগ রয়েছে।