গুড় তৈরি করা হচ্ছেআখ ছাড়াই চিনির সঙ্গে ময়দা, ফিটকিরি ও ক্ষতিকর রঙসহ নানা উপকরণ মিশিয়ে উৎপাদন হচ্ছে গুড়। সুন্দরগঞ্জের বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের সাতগিরি গ্রামের একাধিক বাড়িতে গড়ে উঠেছে ভেজাল গুড় তৈরির এসব কারখানা। উৎপাদিত ভেজাল গুড় বিভিন্ন এলাকায় বাজারজাতও করা হচ্ছে।
সাতগিরি গ্রামের বাসিন্দা রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘গ্রামের আব্দুল লতিফ, ছামু ও কফিলসহ কয়েকজন দীর্ঘদিন ধরে আখ ছাড়াই সংগ্রহ করা পচা রসে গুড় তৈরি করছেন। নোংরা পরিবেশে এসব গুড় তৈরি হচ্ছে। কিন্তু, প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না।’
সাতগিরি গ্রামের শফিকুল ইসলাম ও হোসেন আলী বলেন, ‘তাদের বাড়ির পাশেই আলম ও শাহানুর মিয়া বাড়িতে গুড়ের কারখানা গড়ে তুলেছেন। আলম ও শহানুর ছাড়াও আনোয়ার, আলম মিয়াসহ কয়েকজনের বাড়িতে ভেজাল গুড় তৈরির কারখানা রয়েছে। এসব ভেজাল গুড় স্থানীয় ব্যবসায়ী ছাড়াও বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ী এসে কিনে নিয়ে গিয়ে বাজারজাত করছে।’
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) এর ওয়েবসাইট সূত্রে জানা গেছে, দানাদার গুড় উৎপাদনের জন্য পরিপূর্ণ পরিপক্ব আখ প্রয়োজন। উপযোগী জাতগুলো হলো- ঈশ্বরদী ১৬, ঈশ্বরদী ২৬, ঈশ্বরদী ৩০, ঈশ্বরদী ৩৩, ঈশ্বরদী ৩৮। প্রচলিত আখ মাড়াইকলের রস আহরণ ক্ষমতা ৪৫-৫০ ভাগ। বাংলাদেশে ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত উন্নত আখ মাড়াইকলের রস আহরণ ক্ষমতা প্রায় ৬০ ভাগ।
গুড় তৈরি করা হচ্ছেসুন্দরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প.প. কর্মকর্তা ডা. মো. ইয়াকুব আলী বলেন, ‘ক্ষতিকারক উপকরণ দিয়ে তৈরি ভেজাল গুড় মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এসব গুড় খাওয়ার ফলে মরণব্যাধি ক্যান্সার, লিভারে পচনসহ নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’
গুড় ব্যবসায়ী আব্দুল লতিফের দাবি, তিনি নিজের জমিতে আখ চাষ করেন। সেই আখ বাড়িতে মাড়াই করে রস সংগ্রহ করেন। সংগ্রহ করা রস আগুনে জাল দিয়ে গুড় তৈরি করেন। তবে, সামান্য রঙ মেশান।
ব্যবসায়ী ছামু বলেন, ‘এ গুড় আমরা নিজেরাও খাই। গুড়গুলো ভালোভাবে তৈরি করতে চেষ্টা করি।’
বামনডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের ৪ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য ও সাতগিরি গ্রামের বাসিন্দা মো. রানু মিয়া বলেন, ‘অসাধু ব্যবসায়ীরা একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলে অবৈধ ভেজাল গুড়ের রমরমা ব্যবসা করছে। এসব ভেজাল গুড় তৈরির কারখানা বন্ধে প্রশাসনকে একাধিকবার জানানো হয়েছে। এরমধ্যে গত বছরের ৩০ জুলাই প্রশাসন কয়েকটি বাড়িতে অভিযান চালায়। এরপর পুনরায় এ বিষয়ে প্রশাসনকে বারবার বলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।’
কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) গাইবান্ধা জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবু জাফর সাবু বলেন, ‘ভেজালকারীদের আইনের আওতায় আনা হোক।’
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর গাইবান্ধার সহকারী পরিচালক মো. মাসুম আলী বলেন, ‘এর আগেও ভেজাল গুড় তৈরির কারখানায় অভিযান চালানো হয়। আবারও ভেজাল গুড় উৎপাদন ও বাজারজাতকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে ভেজাল গুড় তৈরির সঙ্গে জড়িতদের নাম ঠিকানা সংগ্রহ করা হয়েছে। দ্রুত এসব গুড় তৈরির কারখানা বন্ধ করাসহ উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বামনডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. নাজমুল হোসেন বলেন, ‘এর আগেও ভেজাল গুড় তৈরির অভিযোগে হোসেন আলী নামে এক ব্যবসায়ীকে ছয় মাসের জেল দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। তারপরও ভেজাল গুড় তৈরি হচ্ছে। আমি উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলবো।’
সুন্দরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. সোলেমান আলী বলেন, ‘এর আগেও অভিযান চালিয়ে গুড় তৈরি বন্ধ এবং জড়িত ব্যবসায়ীদের ভ্রাম্যমাণ আদালতে জেল-জরিমানা করা হয়েছে। আবারও এসব ভেজাল গুড় তৈরির কারখানা বন্ধ ও ভেজালকারী ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
শুধু আশ্বাস নয়, এসব গুড় উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এমনটাই দাবি প্রকৃত ব্যবসায়ী ও এলাকাবাসীর।
গুড় তৈরি করা হচ্ছেকৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) এর ওয়েবসাইট সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন কারণে গুড় পরিশোধন করা কঠিন। কারণগুলো হলো- রোগ ও পোকা আক্রান্ত আখ, অপরিপক্ব বা অধিক পরিপক্ব আখ, রসে অধিকমাত্রায় গ্লুকোজ ও ফ্রুকটোজ, আখের জাত ও রস জ্বাল দেওয়ার ভুল পদ্ধতি ইত্যাদি। এসব কারণে উন্নতমানের দানাদার গুড় উৎপাদন সম্ভব হয় না। এ অবস্থায় গুড় প্রস্তুতকারকরা গুড়ের রঙ দ্রুত পরিবর্তনের জন্য অতিমাত্রায় রাসায়নিক পরিশোধক দ্রব্য হাইড্রোজ ব্যবহার করে। যা মানবদেহের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই রস পরিশোধনের জন্য ঢেড়ঁস গাছের কাণ্ড বা শিমুল গাছের শিকড় বা বন ঢেঁড়সের কাণ্ড বা ঘৃতকুমারীর রস ব্যবহার করা হয়। ৫০০ গ্রাম বনঢেঁড়স গাছের কাণ্ডের সবুজ অংশ ছোট ছোট টুকরো করে কেটে ও থেঁতলিয়ে ২ থেকে ২.৫ লিটার পানির মধ্যে দুহাতে ১০-১৫ মিনিট ঘষলে ২-৩ লিটার নির্যাস তৈরি হয়। ১৮৫-২২৫ কেজি ধারণক্ষমতা সম্পন্ন কড়াই বা প্যানের আখের রস পরিশোধন করার জন্য ২-৩ লিটার বন ঢেঁড়সের নির্যাস লাগে। অর্থাৎ প্রতি কেজি রসে ১৫-২৫ গ্রাম নির্যাস দিতে হয়। অথবা ঘৃতকুমারীর ওপরের সবুজ খোসা ছুরি দিয়ে তুলে ভেতরের পিচ্ছিল নির্যাস বের করতে হয়। প্রতি কেজি আখের রসে ১০-১৫ গ্রাম এই নির্যাস দিতে হয়। প্যান বা কড়াইয়ে আখের রস জ্বাল দিলে প্রচুর গাদ ওঠে। এই গাদ ছাকনা দিয়ে তুলতে হবে। এরপর বনঢেঁড়সের রস অথবা ঘৃতকুমারীর রস কড়াইয়ে ফুটন্ত আখের রসে মিশিয়ে আশানুরূপ রস পরিশোধন করা যায়। এই ভেষজ নির্যাস মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর তো নয়ই বরং উপকারী। কারণ এই নির্যাসে প্রোটিনজাতীয় পদার্থ থাকে। গাছ থেকে বাকল আলাদা করে বলের মতো গোল করে পেঁচিয়েও সরাসরি ফুটন্ত আখের রসে ব্যবহার করা যায়। রস ঘনীভূত হওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত বাকল কড়াইয়ের উত্তপ্ত রসের মধ্যে কিছু সময় পরপর নাড়া দিতে হবে। এতে আখের রসে বিদ্যমান ময়লা নির্যাসের সঙ্গে জমাট হয়ে দ্বিতীয়বার গাদে পরিণত হয়ে ভেসে উঠবে, যা ছাকনা দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। রস ঘনীভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রসের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। এ অবস্থায় রস হাতল দিয়ে ঘন ঘন নাড়তে হবে এবং চুলার আগুন কমাতে হবে। কাচের গ্লাসের পরিষ্কার ঠাণ্ডা পানিতে গরম একটু রস ঢেলে দিলে যদি জমাট বাঁধে তাহলে বুঝতে হবে রস জ্বাল সম্পন্ন হয়েছে। চুলা থেকে রসের কড়াই নামিয়ে একটু ঠাণ্ডা করে ছাঁচের বা পাত্রে ঢেলে দিলে রস জমাট বেঁধে দানাদার গুড় তৈরি হবে। এই গুড়ের রস উজ্জ্বল সোনালি হলুদ হয়। হাইড্রোজ দেওয়া গুড়ে হাইড্রোজের গন্ধ থাকে এবং রঙ হালকা সাদাটে বা অনুজ্জ্বল সোনালি হয়।