ঢাকা ০৪:০১ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ২৪ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
Logo বিএনপি নেতা মাহিদুর রহমান নেতৃত্বের বিস্ময় Logo স্বৈরাচারের দোসর প্রধান বিচারপতির ধর্ম ছেলে পরিচয়ে মোজাম্মেলের অধর্ম! Logo রাজধানীতে মার্কেট দখল করতে গিয়ে বিএনপি নেতা জাহাঙ্গীর আটক Logo স্কুলের ভেতরে নিয়মিত চলে তাশ ও জুয়া! Logo চাঁদা চাওয়ায় দাকোপে ৫ আওয়ামীলীগ নেতার বিরুদ্ধে মামলা Logo ভোলা জেলা ছাত্র কল্যাণ পরিষদের সভাপতি আল আমিন সম্পাদক শামসউদ্দিন Logo বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির এর উদ্যোগে দুমকিতে ক্যারিয়ার সামিট অনুষ্ঠিত Logo সওজ তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে প্রচারিত প্রকাশিত মিথ্যা সংবাদের প্রতিবাদ Logo বিপ্লবী গান, আবৃত্তি এবং কাওয়ালী গানে মেতেছে আশা বিশ্ববিদ্যালয় Logo ছত্রিশ টাকার নকলনবীশ প্রভাবশালী কোটিপতি!




গাজীপুর জেলা ছাত্রলীগ নেতা জাহাঙ্গীরের ইয়াবা সাম্রাজ্য

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ১১:২৬:৪৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২১ ১৭৫ বার পড়া হয়েছে

গাজীপুর প্রতিনিধি:

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় শনিবার ২৫ হাজার ইয়াবাসহ আটক হন গাজীপুর জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর সরকারের গাড়িচালকসহ ৪ সহযোগী। এ খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার হওয়ার পর গাজীপুরের সর্বত্র ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হয়। ঘটনা জানার পর ক্ষোভ প্রকাশ করছেন দলীয় নেতাকর্মীসহ অনেকে। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে অনুসন্ধানে নামে সংবাদমাধ্যম। এতে বেরিয়ে আসে ছাত্রলীগ নেতা জাহাঙ্গীরের বিষয়ে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গাজীপুর জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর সরকার দীর্ঘদিন ধরে ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। এর আগে বেশ কয়েকবার তার লোকজন দেশের বিভিন্ন স্থানে আটক হলেও শনিবার যাত্রাবাড়ীতে গাড়িচালকসহ ৪ জন গ্রেফতার হওয়ার পর বিষয়টি সামনে আসে।

আটক হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা পুলিশকে জানান, কক্সবাজার থেকে ইয়াবার চালান এনে তারা জাহাঙ্গীর সরকারের হাতে তুলে দেন। তার হাত ধরেই জেলার বিভিন্ন উপজেলায় থাকা মাদক বিক্রেতাদের মাধ্যমে মাদকসেবীদের হাতে পৌঁছায় ইয়াবা।

স্থানীয় ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা জানান, শুধু মাদক ব্যবসাই নয়, জাহাঙ্গীর সরকার শ্রীপুর উপজেলায় গড়ে তুলেছেন অপরাধের সাম্রাজ্য। বিস্তার রেখেছেন চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। এতে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। তার নামে বিভিন্ন মহলে অভিযোগ করেও সুফল পায়নি এলাকাবাসী। অথচ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এলাকার ত্রাস হয়ে ওঠা জাহাঙ্গীরের নামে শ্রীপুর থানাতেই রয়েছে একাধিক মামলা।

শনিবার (১৮ ডিসেম্বর) রাতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী গোলাপবাগ বিশ্বরোড এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৪ ব্যক্তিকে একটি প্রাইভেট কারসহ মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ আটক করে। পরে প্রাইভেট কারের বিশেষ স্থানে লুকানো অবস্থায় ২৫ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এ সময় আটকৃতরা পুলিশকে জানায়, গত তিন মাসের মধ্যে তারা টেকনাফ থেকে আড়াই লাখ ইয়াবা এনেছে। পিকনিকের নামে তারা বিভিন্ন সময় কক্সবাজার থেকে ইয়াবা এনে তুলে দেন ছাত্রলীগ নেতা জাহাঙ্গীরের হাতে। পরে এসব ইয়াবা তার হাত ধরে ছড়িয়ে পড়ে তৃণমূল পর্যায়ে।

এ ঘটনায় আটক চারজনের বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানায় ১৮ ডিসেম্বর রাতে মামলা হয়। মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে ছাত্রলীগ নেতা জাহাঙ্গীর সরকারের নামও। এরপর থেকেই জাহাঙ্গীর সরকার গা-ঢাকা দিয়েছেন। এ বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য তার ব্যবহৃত মুঠোফোন নম্বরে কল দিলে সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে।

অভিযান পরিচালনা করা ডিবি পুলিমের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার মাহাবুবুল হক সজিব বলেন, অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদে যাদের নাম এসেছে, তাদেরও নজরদারি করা হচ্ছে। সবার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আটকৃ ব্যক্তিদের মধ্যে রুবেল ইসলাম জাহাঙ্গীর সরকারের ব্যক্তিগত গাড়িচালক। তিনি ইতিপূর্বে দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলায়ও ইয়াবাসহ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে বীরগঞ্জ থানায় মামলা রয়েছে।

জাহাঙ্গীর সরকার গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের গোদারচালা গ্রামের ইকবাল হোসেন সরকারের ছেলে। তার বাবা তেলিহাটি ইউনিয়ন পরিষদের ২ নং ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য।

সওজের জায়গায় বাজার বসিয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগ
গাজীপুর জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর সরকার উপজেলার এমসি বাজারে সড়ক ও জনপথের জায়গা এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের লেন দখল করে বাজার বসিয়েছেন। প্রায় ৩০০ দোকানির কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা করে ৬০ লাখ টাকা একাকালীন চাঁদা আদায় করেছেন। এ ছাড়া এ বাজার থেকেই প্রতিদিন অর্ধলাখ টাকা চাঁদা আদায় করারও অভিযোগ এ ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে। পরে অবৈধ হিসাবে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বাজারটি উচ্ছেদ করে দিলেও ক্ষমতার অপব্যবহার করে পুনরায় বাজার বসিয়ে চাঁদা আদায় অব্যাহত রেখেছেন জাহাঙ্গীর।

এ বিষয়ে এমসি বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি উপজেলা যুবলীগ নেতা শফিকুল ইসলাম মোড়ল বলেন, বাজারের প্রত্যেক ব্যবসায়ী এই ছাত্রলীগ নেতা জাহাঙ্গীরের চাঁদাবাজির শিকার হয়েছেন। তিনি দলীয় সাইনবোর্ডের আড়ালে ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। এই বাজার নিয়ন্ত্রণেও জাহাঙ্গীর গড়ে তুলেছেন বিশেষ বাহিনী। প্রায়ই এ বাহিনী নিয়ে তিনি মহড়া দেন। কেউ চাঁদা দিতে অস্বীকার করলেই তার ওপর নেমে আসে খড়গ। চলে অমানবিক নির্যাতন। প্রতিবাদ করায় বেশ কয়েকবার তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও হামলা করেন এ মাদক ব্যবসায়ী।

বাজারের পাশের মুলাইদ গ্রামের শহিদুল হক রিপন জানান, তার বাড়ির সামনে দোকানপাট বসিয়ে ছাত্রলীগ নেতা জাহাঙ্গীর চাঁদা আদায় করেন। তার বাড়ির প্রবেশপথও বন্ধ করে দিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ করায় তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেন জাহাঙ্গীর। এ কারণে ভয়ে তিনি আর কিছু বলেননি।

জাহাঙ্গীরের হাতে লাঞ্ছিত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও
ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হলেও বেশ কয়েক বছর ধরে দলীয় কর্মসূচিতে দেখা মেলে না জাহাঙ্গীর সরকারের। নিজের আখের গোছাতে তিনি নানাভাবে নির্যাতন চালিয়েছেন তৃণমূল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ওপর।

শ্রীপুর উপজেলা ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক মাহিম সরকারের বাবা আবুল বাশার এমসি বাজার এলাকায় জেনারেটরের (বিকল্প বিদ্যুৎ) ব্যবসা করতেন। গত আগস্ট মাসে দলবল নিয়ে জাহাঙ্গীর সরকার তাকে ব্যবসা থেকে উচ্ছেদ করেন। এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় মাহিম সরকার ও তার বাবাকে সাজানো মামলা দিয়ে জেলে পাঠানো হয়। দীর্ঘদিন জেল খাটার পর সম্প্রতি জামিনে বের হয়ে আসেন তারা।

মাহিম সরকার বলেন, আগস্ট মাস। শোক দিবসের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এমন সময় আমাদের ওপর নেমে আসে ওই নির্যাতন। জাতির পিতার গত শোক দিবসে আমাকে জেলে থাকতে হয়েছে। এ ঘটনায় তৃণমূলের নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। দল ক্ষমতায় রয়েছে, আমরা সংগঠনকে শক্তিশালী করতে কাজ করছি। অথচ তার হাতে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে।

মাওনা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের নেতা রনি মিয়া বলেন, এমসি বাজার এলাকায় চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করায় তাকে লোকজন নিয়ে মারধর করেন জাহাঙ্গীর সরকার। দলীয় একজন নেতার হাতে এভাবে নাজেহাল হয়ে এখনো তিনি বিমর্ষ।

ছাত্রলীগ নেতার নামে শ্রীপুরে যত মামলা
২০১৬ সালে শ্রীপুর থানার তালতলি গ্রামে কাজী ফার্মের মুরগি প্রক্রিয়াজাতকরণের কারখানায় চাঁদাবাজির সময় ককটেল বিস্ফোরণ ঘটান ছাত্রলীগ নেতা জাহাঙ্গীর সরকার। পরে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে তার বিরুদ্ধে মামলা হয় (মামলা নং ৬৭৪/১৬)। পিবিআই তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে আদালতে।

২০২১ সালের ২৮ এপ্রিল যুবলীগ নেতা শফিক সরকার মারধরের অভিযোগ এনে জাহাঙ্গীরকে অভিযুক্ত করে শ্রীপুর থানায় একটি মামলা করেন (মামলা নং ৭০)। এ ছাড়া ৩ মে আজিজুল ইসলাম নামের একজন বাদী হয়ে জাহাঙ্গীর সরকারের বিরুদ্ধে শ্রীপুর থানায় মামলা করেন (মামলা নং ০৭)। শফিকুল ইসলাম মোড়ল নামের একজন বাদী হয়ে গাজীপুর আদালতে সিআর মামলা (মামলা নং ৬০০/২০২১) করেন জাহাঙ্গীর সরকারের বিরুদ্ধে।

এসব মামলায় অভিযোগ আনা হয়েছে ঢাকায় ইয়াবাসহ গ্রেফতার তার গাড়িচালক রুবেলে বিরুদ্ধে। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে শ্রীপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি রয়েছে (ডায়েরি নং ২২৬, তাং ০৫/৪/১৯)। তার বিভিন্ন অপকর্ম উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ১০ নভেম্বর আবু বকর সিদ্দিক বাদী হয়ে গাজীপুর পুলিশ সুপারের কাছে একটি আবেদন করেছেন।

মাদক বিক্রি না করলেই চলে নির্যাতন
জাহাঙ্গীর সরকারের মাদক সিন্ডিকেট নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে পড়েছে শ্রীপুরের বিভিন্ন গ্রামে। উঠতি বয়সের তরুণদের নিশানা করে তিনি এ সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই তার মূল ব্যবসা পরিচালনা করেন। তার কথামতো মাদক বিক্রি না করায় মুলাইদ গ্রামের সোহেল ও শিমুল মিয়া নামের দুই যুবককে ধরে এনে নির্যাতন করেন। সোহেল মিয়া বলেন, ছাত্রলীগ নেতা জাহাঙ্গীর আমাকে বিভিন্ন স্থানে ইয়াবা বড়ি মাদকসেবীদের হাতে পৌঁছে দিতে বলেন। আমি তার কথামতো কাজ না করায় আমাকে লোকজন দিয়ে ধরে এনে মারধর করে। দীর্ঘদিন স্থানীয়ভাবে চিকিৎসার পর আমি সুস্থ হয়ে উঠি।

এদিকে জাহাঙ্গীর সরকারের মালিকানাধীন এমসি বাজারে গত জুনে মেম্বার ডেকোরেটর নামে একটি দোকানে অভিযান চালায় গাজীপুর জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। সে সময় দোকান থেকে মাদক উদ্ধার করা হয়। পরে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক মোস্তাফিজুর রহমান বাদী হয়ে শ্রীপুর থানায় মামলা করেন (মামলা নং ৩৫)। খবর পেয়ে জাহাঙ্গীর সরকার গা-ঢাকা দেন। এ মামলায় আসামি করা হয়েছে তার ভাই আলমগীর সরকারকেও।

দায় নেবে না গাজীপুর জেলা ছাত্রলীগ
মাদক ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠায় কোনো ব্যক্তির দায় নেবে না গাজীপুর জেলা ছাত্রলীগ।

জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল আলম রবিন বলেন, ইতিমধ্যেই অভিযোগ ওঠা ছাত্রলীগের এই নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে একটি সুপারিশপত্র কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। আমরা আশা করছি, সাংগঠনিকভাবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে কেন্দ্র।

গাজীপুর পুলিশ সুপার এসএম শফিউল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাদক নির্মূলে পুলিশ নানাভাবে কাজ করছে। এমন কোনো অভিযোগ এখনো আমাদের সামনে আসেনি। যেহেতু অভিযোগ উঠেছে, সেহেতু আমরা তদন্ত করব। যার বিরুদ্ধেই মাদক-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠবে, তাকেই আইনের আওতায় আনা হবে; সে যতই ক্ষমতাধর ব্যক্তিই হোক না কেন।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজাহারুল ইসলাম কাজল বলেন, যাত্রাবাড়ী থানায় গত ১৮ ডিসেম্বর মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) রিপন বাদী হয়ে একটি মাদক মামলা করেন। এ মামলায় ৪ অভিযুক্তকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। এ মামলায় ৫ নম্বর আসামি জাহাঙ্গীর সরকার। তাকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :




গাজীপুর জেলা ছাত্রলীগ নেতা জাহাঙ্গীরের ইয়াবা সাম্রাজ্য

আপডেট সময় : ১১:২৬:৪৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২১

গাজীপুর প্রতিনিধি:

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় শনিবার ২৫ হাজার ইয়াবাসহ আটক হন গাজীপুর জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর সরকারের গাড়িচালকসহ ৪ সহযোগী। এ খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার হওয়ার পর গাজীপুরের সর্বত্র ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হয়। ঘটনা জানার পর ক্ষোভ প্রকাশ করছেন দলীয় নেতাকর্মীসহ অনেকে। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে অনুসন্ধানে নামে সংবাদমাধ্যম। এতে বেরিয়ে আসে ছাত্রলীগ নেতা জাহাঙ্গীরের বিষয়ে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গাজীপুর জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর সরকার দীর্ঘদিন ধরে ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। এর আগে বেশ কয়েকবার তার লোকজন দেশের বিভিন্ন স্থানে আটক হলেও শনিবার যাত্রাবাড়ীতে গাড়িচালকসহ ৪ জন গ্রেফতার হওয়ার পর বিষয়টি সামনে আসে।

আটক হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা পুলিশকে জানান, কক্সবাজার থেকে ইয়াবার চালান এনে তারা জাহাঙ্গীর সরকারের হাতে তুলে দেন। তার হাত ধরেই জেলার বিভিন্ন উপজেলায় থাকা মাদক বিক্রেতাদের মাধ্যমে মাদকসেবীদের হাতে পৌঁছায় ইয়াবা।

স্থানীয় ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা জানান, শুধু মাদক ব্যবসাই নয়, জাহাঙ্গীর সরকার শ্রীপুর উপজেলায় গড়ে তুলেছেন অপরাধের সাম্রাজ্য। বিস্তার রেখেছেন চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। এতে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। তার নামে বিভিন্ন মহলে অভিযোগ করেও সুফল পায়নি এলাকাবাসী। অথচ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এলাকার ত্রাস হয়ে ওঠা জাহাঙ্গীরের নামে শ্রীপুর থানাতেই রয়েছে একাধিক মামলা।

শনিবার (১৮ ডিসেম্বর) রাতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী গোলাপবাগ বিশ্বরোড এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৪ ব্যক্তিকে একটি প্রাইভেট কারসহ মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ আটক করে। পরে প্রাইভেট কারের বিশেষ স্থানে লুকানো অবস্থায় ২৫ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এ সময় আটকৃতরা পুলিশকে জানায়, গত তিন মাসের মধ্যে তারা টেকনাফ থেকে আড়াই লাখ ইয়াবা এনেছে। পিকনিকের নামে তারা বিভিন্ন সময় কক্সবাজার থেকে ইয়াবা এনে তুলে দেন ছাত্রলীগ নেতা জাহাঙ্গীরের হাতে। পরে এসব ইয়াবা তার হাত ধরে ছড়িয়ে পড়ে তৃণমূল পর্যায়ে।

এ ঘটনায় আটক চারজনের বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানায় ১৮ ডিসেম্বর রাতে মামলা হয়। মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে ছাত্রলীগ নেতা জাহাঙ্গীর সরকারের নামও। এরপর থেকেই জাহাঙ্গীর সরকার গা-ঢাকা দিয়েছেন। এ বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য তার ব্যবহৃত মুঠোফোন নম্বরে কল দিলে সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে।

অভিযান পরিচালনা করা ডিবি পুলিমের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার মাহাবুবুল হক সজিব বলেন, অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদে যাদের নাম এসেছে, তাদেরও নজরদারি করা হচ্ছে। সবার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আটকৃ ব্যক্তিদের মধ্যে রুবেল ইসলাম জাহাঙ্গীর সরকারের ব্যক্তিগত গাড়িচালক। তিনি ইতিপূর্বে দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলায়ও ইয়াবাসহ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে বীরগঞ্জ থানায় মামলা রয়েছে।

জাহাঙ্গীর সরকার গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের গোদারচালা গ্রামের ইকবাল হোসেন সরকারের ছেলে। তার বাবা তেলিহাটি ইউনিয়ন পরিষদের ২ নং ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য।

সওজের জায়গায় বাজার বসিয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগ
গাজীপুর জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর সরকার উপজেলার এমসি বাজারে সড়ক ও জনপথের জায়গা এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের লেন দখল করে বাজার বসিয়েছেন। প্রায় ৩০০ দোকানির কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা করে ৬০ লাখ টাকা একাকালীন চাঁদা আদায় করেছেন। এ ছাড়া এ বাজার থেকেই প্রতিদিন অর্ধলাখ টাকা চাঁদা আদায় করারও অভিযোগ এ ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে। পরে অবৈধ হিসাবে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বাজারটি উচ্ছেদ করে দিলেও ক্ষমতার অপব্যবহার করে পুনরায় বাজার বসিয়ে চাঁদা আদায় অব্যাহত রেখেছেন জাহাঙ্গীর।

এ বিষয়ে এমসি বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি উপজেলা যুবলীগ নেতা শফিকুল ইসলাম মোড়ল বলেন, বাজারের প্রত্যেক ব্যবসায়ী এই ছাত্রলীগ নেতা জাহাঙ্গীরের চাঁদাবাজির শিকার হয়েছেন। তিনি দলীয় সাইনবোর্ডের আড়ালে ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। এই বাজার নিয়ন্ত্রণেও জাহাঙ্গীর গড়ে তুলেছেন বিশেষ বাহিনী। প্রায়ই এ বাহিনী নিয়ে তিনি মহড়া দেন। কেউ চাঁদা দিতে অস্বীকার করলেই তার ওপর নেমে আসে খড়গ। চলে অমানবিক নির্যাতন। প্রতিবাদ করায় বেশ কয়েকবার তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও হামলা করেন এ মাদক ব্যবসায়ী।

বাজারের পাশের মুলাইদ গ্রামের শহিদুল হক রিপন জানান, তার বাড়ির সামনে দোকানপাট বসিয়ে ছাত্রলীগ নেতা জাহাঙ্গীর চাঁদা আদায় করেন। তার বাড়ির প্রবেশপথও বন্ধ করে দিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ করায় তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেন জাহাঙ্গীর। এ কারণে ভয়ে তিনি আর কিছু বলেননি।

জাহাঙ্গীরের হাতে লাঞ্ছিত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও
ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হলেও বেশ কয়েক বছর ধরে দলীয় কর্মসূচিতে দেখা মেলে না জাহাঙ্গীর সরকারের। নিজের আখের গোছাতে তিনি নানাভাবে নির্যাতন চালিয়েছেন তৃণমূল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ওপর।

শ্রীপুর উপজেলা ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক মাহিম সরকারের বাবা আবুল বাশার এমসি বাজার এলাকায় জেনারেটরের (বিকল্প বিদ্যুৎ) ব্যবসা করতেন। গত আগস্ট মাসে দলবল নিয়ে জাহাঙ্গীর সরকার তাকে ব্যবসা থেকে উচ্ছেদ করেন। এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় মাহিম সরকার ও তার বাবাকে সাজানো মামলা দিয়ে জেলে পাঠানো হয়। দীর্ঘদিন জেল খাটার পর সম্প্রতি জামিনে বের হয়ে আসেন তারা।

মাহিম সরকার বলেন, আগস্ট মাস। শোক দিবসের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এমন সময় আমাদের ওপর নেমে আসে ওই নির্যাতন। জাতির পিতার গত শোক দিবসে আমাকে জেলে থাকতে হয়েছে। এ ঘটনায় তৃণমূলের নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। দল ক্ষমতায় রয়েছে, আমরা সংগঠনকে শক্তিশালী করতে কাজ করছি। অথচ তার হাতে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে।

মাওনা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের নেতা রনি মিয়া বলেন, এমসি বাজার এলাকায় চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করায় তাকে লোকজন নিয়ে মারধর করেন জাহাঙ্গীর সরকার। দলীয় একজন নেতার হাতে এভাবে নাজেহাল হয়ে এখনো তিনি বিমর্ষ।

ছাত্রলীগ নেতার নামে শ্রীপুরে যত মামলা
২০১৬ সালে শ্রীপুর থানার তালতলি গ্রামে কাজী ফার্মের মুরগি প্রক্রিয়াজাতকরণের কারখানায় চাঁদাবাজির সময় ককটেল বিস্ফোরণ ঘটান ছাত্রলীগ নেতা জাহাঙ্গীর সরকার। পরে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে তার বিরুদ্ধে মামলা হয় (মামলা নং ৬৭৪/১৬)। পিবিআই তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে আদালতে।

২০২১ সালের ২৮ এপ্রিল যুবলীগ নেতা শফিক সরকার মারধরের অভিযোগ এনে জাহাঙ্গীরকে অভিযুক্ত করে শ্রীপুর থানায় একটি মামলা করেন (মামলা নং ৭০)। এ ছাড়া ৩ মে আজিজুল ইসলাম নামের একজন বাদী হয়ে জাহাঙ্গীর সরকারের বিরুদ্ধে শ্রীপুর থানায় মামলা করেন (মামলা নং ০৭)। শফিকুল ইসলাম মোড়ল নামের একজন বাদী হয়ে গাজীপুর আদালতে সিআর মামলা (মামলা নং ৬০০/২০২১) করেন জাহাঙ্গীর সরকারের বিরুদ্ধে।

এসব মামলায় অভিযোগ আনা হয়েছে ঢাকায় ইয়াবাসহ গ্রেফতার তার গাড়িচালক রুবেলে বিরুদ্ধে। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে শ্রীপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি রয়েছে (ডায়েরি নং ২২৬, তাং ০৫/৪/১৯)। তার বিভিন্ন অপকর্ম উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ১০ নভেম্বর আবু বকর সিদ্দিক বাদী হয়ে গাজীপুর পুলিশ সুপারের কাছে একটি আবেদন করেছেন।

মাদক বিক্রি না করলেই চলে নির্যাতন
জাহাঙ্গীর সরকারের মাদক সিন্ডিকেট নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে পড়েছে শ্রীপুরের বিভিন্ন গ্রামে। উঠতি বয়সের তরুণদের নিশানা করে তিনি এ সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই তার মূল ব্যবসা পরিচালনা করেন। তার কথামতো মাদক বিক্রি না করায় মুলাইদ গ্রামের সোহেল ও শিমুল মিয়া নামের দুই যুবককে ধরে এনে নির্যাতন করেন। সোহেল মিয়া বলেন, ছাত্রলীগ নেতা জাহাঙ্গীর আমাকে বিভিন্ন স্থানে ইয়াবা বড়ি মাদকসেবীদের হাতে পৌঁছে দিতে বলেন। আমি তার কথামতো কাজ না করায় আমাকে লোকজন দিয়ে ধরে এনে মারধর করে। দীর্ঘদিন স্থানীয়ভাবে চিকিৎসার পর আমি সুস্থ হয়ে উঠি।

এদিকে জাহাঙ্গীর সরকারের মালিকানাধীন এমসি বাজারে গত জুনে মেম্বার ডেকোরেটর নামে একটি দোকানে অভিযান চালায় গাজীপুর জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। সে সময় দোকান থেকে মাদক উদ্ধার করা হয়। পরে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক মোস্তাফিজুর রহমান বাদী হয়ে শ্রীপুর থানায় মামলা করেন (মামলা নং ৩৫)। খবর পেয়ে জাহাঙ্গীর সরকার গা-ঢাকা দেন। এ মামলায় আসামি করা হয়েছে তার ভাই আলমগীর সরকারকেও।

দায় নেবে না গাজীপুর জেলা ছাত্রলীগ
মাদক ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠায় কোনো ব্যক্তির দায় নেবে না গাজীপুর জেলা ছাত্রলীগ।

জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল আলম রবিন বলেন, ইতিমধ্যেই অভিযোগ ওঠা ছাত্রলীগের এই নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে একটি সুপারিশপত্র কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। আমরা আশা করছি, সাংগঠনিকভাবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে কেন্দ্র।

গাজীপুর পুলিশ সুপার এসএম শফিউল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাদক নির্মূলে পুলিশ নানাভাবে কাজ করছে। এমন কোনো অভিযোগ এখনো আমাদের সামনে আসেনি। যেহেতু অভিযোগ উঠেছে, সেহেতু আমরা তদন্ত করব। যার বিরুদ্ধেই মাদক-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠবে, তাকেই আইনের আওতায় আনা হবে; সে যতই ক্ষমতাধর ব্যক্তিই হোক না কেন।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজাহারুল ইসলাম কাজল বলেন, যাত্রাবাড়ী থানায় গত ১৮ ডিসেম্বর মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) রিপন বাদী হয়ে একটি মাদক মামলা করেন। এ মামলায় ৪ অভিযুক্তকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। এ মামলায় ৫ নম্বর আসামি জাহাঙ্গীর সরকার। তাকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে।