রূপকথার গল্পের মতোই যেন তাজহাট জমিদার বাড়ি
- আপডেট সময় : ০৩:০৪:৩৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩ নভেম্বর ২০২১ ২৫৯ বার পড়া হয়েছে
অনলাইন ডেস্কঃ
পাঠ্যপুস্তকে পড়া আর টেলিভিশনের পর্দায় দেখা রূপকথার গল্পের মতোই যেন তাজহাট জমিদার বাড়ির ইতিহাস। রঙে রসে ভরা প্রাচীনতম রঙ্গপুরে (বর্তমান রংপুর) এক সময় ব্যবসা হতো হীরা, মানিক ও জহরতের। বিক্রি হতো নামীদামী হীরা, মানিক ও জহরতখচিত তাজ বা টুপির। আর এই স্বর্ণ ব্যবসা শুরু করেছিলো মান্নালাল রায়। যিনি সুদূর পাঞ্জাব থেকে রঙ্গপুরের মাহিগঞ্জে এসেছিলেন শুধু ব্যবসায়িক উদ্দ্যেশে।
সেই মান্নালাল রায়ের হাত ধরেই মাহিগঞ্জে বসত জমজমাট তাজের হাট। সেখানে পাওয়া যেত রাজা বাদশাহর চাহিদানুযারী অনেক মূল্যবান তাজ। এই তাজ বিক্রির হাটই সময়ের পরিক্রমায় প্রসিদ্ধি লাভ করে তাজহাট নামে। যা বর্তমান রংপুর মহানগরীর প্রাণকেন্দ্র থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে। এই তাজহাট বাজারের এর কোল ঘেষেই দাড়িয়ে আছে প্রাচীন ঐতিহ্যের স্মারক তাজহাট জমিদার বাড়িটি। যার মূল ভবনটি ঐতিহাসিক এক প্রাচীন নিদর্শন।
বর্তমান তাজহাট বাজার হতে উত্তর দিত দিয়ে প্রধান ফটক অতিক্রম করে ক্রমান্বয়ে পশ্চিমে কয়েক’শ গজ পেরিয়ে জমিদার বাড়ির প্রধান প্রবেশ পথে আসা যায়।
রঙ্গপুরের প্রাচীন ইতিহাস থেকে জানা যায়, মান্নালালের তাজ বিক্রির হাট থেকে তাজহাট নামকরণ হয়। আর সেই থেকেই জমিদার বাড়িটি পরিচিতি পায় তাজহাট জমিদার বাড়ি হিসেবে। এই জমিদার বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন রাজা গোবিন্দ লালের পুত্র গোপাল লাল রায় (জি.এল রায়)। যিনি পরাক্রমশালী শাসক হিসেবে উনবিংশ শতাব্দীতে বৃহত্তর রংপুর শাসন করে।
তার শাসনামলেই দশ বছর (১৯০৮-১৯১৭) সময় ধরে বিভিন্ন নকশা ও কারুকাজ খচিত ভবনটি নির্মাণ করে প্রায় ২ হাজার নির্মাণশিল্পী। ৭৬.২০ মিটার দৈর্ঘ্য ভবনটি তৈরীতে ব্যবহার করা হয় বিদেশী সাদা মার্বেল পাথর। এতে নির্মাণ ব্যয় দাড়ায় প্রায় দেড় কোটি টাকা।
বর্তমানে রংপুর মহানগরীতে হাতে গোনা যে কয়টা বিনোদন কেন্দ্র রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম তাজহাট জমিদার বাড়ি আর এর ভিতরে গড়ে তোলা প্রত্নতত্ব জাদুঘরটি।
তাজহাট জমিদার বাড়িটি কোলাহল মুক্ত ছায়া ঘেরা সবুজ সমারোহে পরিবেষ্টিত আকর্ষণীয় পরিবেশে অবস্থিত। যার চারদিকে রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ শোভা, ফুলের বাগান, উত্তর ও দক্ষিণে কামিনী, মেহগনি, কাঁঠাল ও আম বাগান। রয়েছে সমসাময়িককালে খননকৃত বিশাল আকৃতির ৪টি পুকুর।
দূর থেকে ঢাকার আহসান মঞ্জিলের মতো দেখতে এ জমিদার বাড়িটির তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় রয়েছে মহারাজা গোপাল লাল রায়ের ব্যবহৃত নানা জিনিস। জমিদার বাড়িটি লাল ইট, শ্বেতপাথর ও চুনাপাথর দ্বারা নির্মিত বিধায় দেখতে চমৎকার। চারতলা বিশিষ্ট এ জমিদার বাড়িটির ভেতরে রয়েছে অসংখ্য কক্ষ, গোসলখানা ও অতিথি শয়নশালা।
১৯৪৭ সালে ঐতিহ্যবাহী এ জমিদার বাড়িটিকে পরিত্যক্ত ঘোষনা করে ৫৫ একর জমিসহ এগ্রিকালচার ইনিষ্টিটিউটকে দেওয়া হয়।
এরপর ১৯৮৪ সালের ১৮ মার্চ রংপুরের সন্তান তৎকালীন সামরিক শাসক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ জমিদার বাড়িটিকে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশন হিসেবে উদ্বোধন করেন। এতে রংপুর অঞ্চলের সাধারণ মানুষের দূর্ভোগ কমে আসে আইন সেবা পেতে। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের সাথে পাল্টে যায় জমিদার বাড়ির গল্প। ১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলে হাইকোর্ট ডিভিশন উঠে গেলে ১৯৯৫ সালে রাজবাড়িটি ১৫ একর জমি সহ প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর এর কাছে হস্তান্তর করা হয়।
২০০৫ সালে তাজহাট জমিদার বাড়িটিকে জাদুঘরে রূপান্তর করে প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর। জাদুঘরটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তৎকালীন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী বেগম সেলিমা রহমান।
বর্তমান জাদুঘরে ছোট কোরআন শরিফ, সম্রাট আওরাঙ্গজেবের স্বহস্তে লেখা খুৎবা, কবি শেখ সাদীর স্বহস্তে লেখা কবিতা, শিবলিঙ্গ, কষ্টিপাথরের মূর্তি, শিলামূর্তি, পোড়ামাটির ফলক, প্রাচীন মুদ্রা, সংস্কৃত ভাষায় লিখিত কিছু চিঠি, শিলালিপিসহ প্রায় ১০০ প্রকার বিরল প্রত্নতত্ব রয়েছে।
প্রতিদিনই তাজহাট জমিদার বাড়ির অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা জাদুঘর দেখতে দেশ-বিদেশ এর হাজার হাজার দর্শনার্থী ভীড় করে। দর্শনার্থীর তালিকায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল, মালদ্বীপসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও দর্শনার্থী। ২০০৫ সালে যেখানে দর্শনার্থী সংখ্যা ছিল ৫০ হাজার ৪’শত সেখানে বর্তমানে তা লক্ষাধিক ছড়িয়েছে গেছে।
জাদুঘরে প্রবেশ ফি দেশী দর্শনার্থীদের জন্য ১০ টাকা এবং বিদেশী দর্শনার্থীদের জন্য ১০০ টাকা। এখান থেকে বছরে বিপুল পরিমান অর্থ আয় করছে সরকার বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রংপুর অঞ্চলের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানাতে তাজহাট জমিদার বাড়ির সাথে যুক্ত জাদুঘরটি বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে। জাদুঘরের সংগ্রহ আরো বৃদ্ধি করার পাশাপাশি এখানে পিকনিক স্পট ও পর্যটন নগরী গড়ে তোলার জোর দাবী সচেতন পর্যটকপ্রেমীদের। তথ্য সূত্র: অনলাইন।