ঢাকা ০২:১৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ




ভয়ঙ্কর রাজারবাগ পীর সিন্ডিকেট: নাজেহাল সাংবাদিকরাও!

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ১২:২১:২৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ অক্টোবর ২০২১ ৪১৮ বার পড়া হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজধানীর রাজারবাগ শরীফের পীর দিল্লুর রহমান ও তার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে মামলাবাজি সারাদেশে অসংখ্য মানুষকে হয়রানি জমি দখল সহ বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ নিয়ে প্রতিবেদন করায় অন্তত ডজনখানেক সাংবাদিককে হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগীদের দাবি, মিথ্যা মামলা দিয়ে সাধারণ মানুষকে দীর্ঘদিন ধরে চরম হয়রানি করে আসছে এই ‘মামলাবাজ সিন্ডিকেট’। সিআইডির তদন্তেও মিলেছে সেই প্রমাণ। মূলত হাইকোর্টের বিভিন্ন আদেশ, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও সিআইডির তদন্তের সূত্র ধরেই প্রতিবেদন করেন সাংবাদিকরা। আর তাতেই রোষানলে পড়তে হচ্ছে শক্তিশালী এই সিন্ডিকেটের। হুমকির শিকার বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ইতোমধ্যে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন।

পীর সিন্ডিকেটের হয়রানির শিকার হওয়া সাংবাদিকদের তালিকায় রয়েছেন- দৈনিক ইত্তেফাকের সিনিয়র রিপোর্টার জামিউল আহসান সিপু, এনটিভির স্পেশাল করেসপনডেন্ট সফিক শাহীন, যুমনা টিভির স্পেশাল করেসপনডেন্ট আব্দুল্লাহ তুহিন, ইন্ডিপেনডেন্ট টিভির সিনিয়র ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট আরাফাতুর রহমান, আরটিভির স্টাফ রিপোর্টার কাজী ফয়সাল, বাংলাভিশনের স্টাফ করেসপনডেন্ট এসএম ফয়েজ, নাগরিক বার্তা২৪.কমের বার্তা সম্পাদক নয়ন মুরাদ, মাছরাঙ্গা টিভির সিনিয়র রিপোর্টার জাহেদ সেলিম, ইন্ডিপেনডেন্ট টিভির সাংবাদিক তানভীর সুমন, সময়ের আলো পত্রিকার সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল মামুন ও মোস্তফা ইমরুল কায়েস।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, জমি দখলসহ পীর সিন্ডিকেটটির নানা অপকর্ম তুলে ধরে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় এনটিভির সাংবাদিক সফিক শাহীনসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সফিক শাহীন আমাদের সময়কে বলেন, “রাজারবাগের পীর ও তার মুরিদদের কর্মকা- নিয়ে ২০১৯ সালের ৮ থেকে ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত ছয় পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন করায় দুটি মামলা করা হয় আমাদের বিরুদ্ধে। একটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এবং অপরটি মানহানির। ‘মামলাবাজ সিন্ডিকেট সমতল থেকে পাহাড়ে’ শিরোনামে প্রতিবেদন সম্প্রচার হওয়ার পরই ক্ষিপ্ত হয়ে তারা এই মামলা ঠুকে দেয়।”

রাজধানীর শান্তিবাগের বাসিন্দা একরামুল আহসান কাঞ্চনের জমি নিতে না পেরে তার বিরুদ্ধে ৪৯টি মিথ্যা মামলা করার পেছনে সম্প্রতি এই পীর সিন্ডিকেট জড়িত মর্মে হাইকোর্টে প্রতিবেদন দিয়েছে সিআইডি। এ বিষয়ে সাংবাদিক সফিক শাহীন বলেন, ‘এখন আমাদের রিপোর্টের ন্যায্যতার প্রমাণ পাচ্ছে। প্রমাণিত হচ্ছে যে, গণমাধ্যম সঠিক রিপোর্টই করেছে। তারা বরাবরই বলে যে, তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আমি বলতে চাই, তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ ও জঙ্গি সম্পৃক্ততাসহ অনেক অভিযোগের তথ্য-প্রমাণ রয়েছে বিভিন্ন সংস্থার কাছে। আমরা শুধু একটি ফৌজদারি অপরাধের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে রিপোর্ট করেছি। এমনকি তাদের নিয়ে যারাই নিউজ করছে, তাদেরকেই হুমকি-ধমকি দিয়ে যাচ্ছে সিন্ডিকেটটি।’

জানা গেছে, এই পীর সিন্ডিকেটের রোষানলে পড়ে ৪৯টি মামলার আসামি কাঞ্চনের রিট দায়ের এবং এসব মিথ্যা মামলার পেছনে পীর সিন্ডিকেটের জড়িত থাকার বিষয়টি প্রমাণিত হয়। এর পর থেকেই ভুক্তভোগীরা সিন্ডিকেটটির বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছে। তাদের অনেকেই হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন, অনেকে আবার সাংবাদিকদের কাছেও অভিযোগ জানাচ্ছেন। সেই তথ্যই তুলে ধরা হচ্ছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে। সর্বশেষ আট ভুক্তভোগীর করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট গত ১৭ সেপ্টেম্বর পীর দিল্লুর রহমান ও তার সংগঠনের নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব সম্পত্তি রয়েছে তা নির্ণয় করে সেগুলোর উৎস সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে আদালতকে জানাতে দুদককে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে পীর ও তার পৃষ্ঠপোষকতায় ওলামা আঞ্জুমান বাইয়্যিনাত অথবা ভিন্ন কোনো নামে কোনো জঙ্গি সংগঠন আছে কিনা, খোঁজ নিয়ে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটকে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বলা হয়। আগামী ৩০ নভেম্বরের আগে দুদক ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটকে ওই আদেশ প্রতিপালন করে প্রতিবেদন দিতে হবে। পাশাপাশি রিট আবেদনকারী আট জনের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দায়েরের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নিতে সিআইডিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ওই আদেশের বিরুদ্ধে চেম্বার আদালতে পীর দিল্লুরের আবেদন খারিজ হয়ে যায়। ওই আদেশের পর যে গণমাধ্যমেই অনুসন্ধানী সংবাদ প্রকাশ পাচ্ছে, তাদেরকেই সিন্ডিকেটটি হুমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ।

জানা গেছে, গত ১৩ অক্টোবর থেকে ‘পীরের সম্পদের উৎস সন্ধানে দুর্নীতি দমন কমিশন’, ‘অত্যাচার ও দখলে অতিষ্ঠ পীরের নিজ গ্রামের বাসিন্দারা’, ‘পীরের নাম ভাঙিয়ে বিত্তশালী হয়ে উঠছেন মুুরিদরা’ শিরোনামে তিনটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন সম্প্রচার করে ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশন। প্রতিবেদনে দুদক, পীরের মুখপাত্র ও ভুক্তভোগীদের আইনজীবীর বক্তব্যও সম্প্রচার হয়। এর পরও প্রতিবেদককে হুমকি দেওয়া হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অনুসন্ধানী প্রতিবেদক তানভীর সুমন আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমিসহ অন্য সাংবাদিক যারা এ ধরনের প্রতিবেদন করছেন, তাদেরকেই পীরের লোকজন ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন।’

এদিকে পীর দিল্লুর শিষ্যদের হুমকি পেয়ে রাজধানীর কলাবাগান থানায় জিডি করেছেন দৈনিক সময়ের আলোর দুই প্রতিবেদক আব্দুল্লাহ আল মামুন ও মোস্তফা ইমরুল কায়েস। গত ১৭ অক্টোবর করা ওই জিডিতে তারা উল্লেখ করেন- গাড়িতে করে রাজারবাগের কথিত পীরের শিষ্যদের বিএসটিআইয়ের অনুমোদন ছাড়া পণ্য বিক্রি, দাম বেশি রাখা, সুন্নতি পণ্যের নামে প্রতারণা এবং আদালতের আদেশের পর কথিত পীরের আস্তানার বাইরের চিত্র তুলে ধরে দুটি বিশেষ প্রতিবেদন সময়ের আলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওই কথিত পীরের শিষ্যরা পত্রিকার অফিসিয়াল টেলিফোন নম্বরে কল করে প্রতিবেদন তৈরিকারী দুই প্রতিবেদককে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন।

এদিকে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রাজারবাগীদের হুমকির বিষয়টি সাংবাদিকদের তিন সংগঠন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ), বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (ক্র‌্যাব) এবং রিপোর্টার্স অ্যাগেইনেস্ট করাপশনকেও (র‌্যাক) লিখিতভাবে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী সাংবাদিকরা। তার ওই তিনটি সংগঠনের সদস্য। লিখিত অভিযোগে গত ৭ অক্টোবর তারা ডিআরইউ ও ক্র‌্যাবকে জানান, দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে রাজারবাগের পীর দিল্লুর রহমানের মামলাবাজ সিন্ডিকেট নিয়ে সংবাদ করে আসছেন দেশের মূলধারার গণমাধ্যমকর্মীরা। সাধারণ নিরীহ-নিরপরাধ মানুষকে মামলার জালে ফেলে সহায়সম্পদ হাতিয়ে নেয় এই পীর সিন্ডিকেট। নিরীহ মানুষ ওই চক্রের জাল থেকে বের হতে পারছেন না। এসব ঘটনায় প্রতিবেদন করায় মামলাবাজচক্র ভুক্তভোগীদের পাশাপাশি বিভিন্ন গণমাধ্যমকর্মীদেরও হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। অভিযোগসংক্রান্ত চিঠিতে চরম অতঙ্কের কথা উল্লেখ করে পেশাগত দায়িত্ব পালনে ডিআরইউ এবং ক্র‌্যাবকে পাশে দাঁড়ানোরও আহ্বান জানান তারা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাংবাদিক জামিউল আহসান সিপু আমাদের সময়কে বলেন, ‘দুই বছর আগে আমি এই সিন্ডিকেট নিয়ে রিপোর্ট করেছি। তাদের নিয়ে রিপোর্ট করার পর হুমকি-ধমকি পাওয়া এমন আট সাংবাদিক লিখিতভাবে ডিআরইউ, ক্র‌্যাব ও র‌্যাককে লিখিতভাবে জানিয়েছি। কারণ এই পীর ও সিন্ডিকেটের সদস্যরা দেশব্যাপী ছড়িয়ে রয়েছে। তারা বিশাল একটি চক্র। তাদের অপকর্ম প্রমাণিত হওয়ার রিপোর্ট হাইকোর্টে জমা পড়েছে। কখন কী হয়, কোন দুর্ঘটনা ঘটায়- এ জন্য আমাদের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে লিখিতভাবে সংগঠনকে জানিয়েছি।’ এর আগে ২০১০ সালে এই পীর সিন্ডিকেট নিয়ে প্রতিবেদন করায় অপরাধ বিচিত্রার সম্পাদক এসএম মোর্শেদ ও রিপোর্টার এমএম রইচের বিরুদ্ধেও মানহানির মামলা করেছিলেন পীর দিল্লুর রহমান।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গত ১০ অক্টোবর ডিআরইউর মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে এলে রাজারবাগ পীর সিন্ডিকেটের বিষয়টি তার দৃষ্টিতে আনেন সাংবাদিকরা। পরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘সাংবাদিকরা হয়রানি-হুমকি, এমনকি মামলার শিকার হলে তাদের পাশে দাঁড়াবে সরকার।’ মামলাবাজ সিন্ডিকেটের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও আশ্বস্ত করেন মন্ত্রী। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ডিআরইউর সভাপতি মোরসালিন নোমানী বলেন, ‘আমরা সাংবাদিকরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করি। বস্তুনিষ্ঠভাবে প্রকৃত সত্য তুলে ধরি। আমদের কোনো পক্ষ-বিপক্ষ নেই। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হয়রানির শিকার হলে তার তীব্র নিন্দা জানাই, প্রতিবাদ জানাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘সংগঠনের কেউ যাতে হয়রানির শিকার না হয়, সে জন্য সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। কেউ হয়রানি করলে সংগঠন হিসেবে সদস্যদের পাশে ডিআরইউ আছে ও থাকবে।’

জানতে চাওয়া হলে সাংবাদিকদের হয়রানির অভিযোগ অস্বীকার করে রাজারবাগ দরবার শরীফের মুখপাত্র মাহবুবুল আলম আরিফ বলেন, ‘আমরা নিজেরাও সাংবাদিক। আমরা সাংবাদিকবান্ধব। হাইকোর্ট যেটা বলেননি, সেটাও বলার চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। উসকানিমূলক, মিথ্যা, অপপ্রচার চালানোয় সংক্ষুব্ধ হয়ে আমাদের অনেকেই সংক্ষুব্ধ হয়েছেন। তবে কাউকে হুমকি দেওয়া হয়নি, কাউকে হয়রানিও করা হয়নি।’ তবে মাহবুবুল আলম আরিফের এমন বক্তব্য সঠিক নয় বলে দাবি করেন ভুক্তভোগী সাংবাদিকরা।

এই ভয়ঙ্কর পৃথিবীর সিন্ডিকেটের হয়রানির শিকার ভুক্তভোগীদের প্রশ্ন, দেশের আইন সরকারের চেয়েও শক্তিশালী ভন্ড রাজার বাগ দরবার শরীফ?

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :




ভয়ঙ্কর রাজারবাগ পীর সিন্ডিকেট: নাজেহাল সাংবাদিকরাও!

আপডেট সময় : ১২:২১:২৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ অক্টোবর ২০২১

নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজধানীর রাজারবাগ শরীফের পীর দিল্লুর রহমান ও তার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে মামলাবাজি সারাদেশে অসংখ্য মানুষকে হয়রানি জমি দখল সহ বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ নিয়ে প্রতিবেদন করায় অন্তত ডজনখানেক সাংবাদিককে হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগীদের দাবি, মিথ্যা মামলা দিয়ে সাধারণ মানুষকে দীর্ঘদিন ধরে চরম হয়রানি করে আসছে এই ‘মামলাবাজ সিন্ডিকেট’। সিআইডির তদন্তেও মিলেছে সেই প্রমাণ। মূলত হাইকোর্টের বিভিন্ন আদেশ, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও সিআইডির তদন্তের সূত্র ধরেই প্রতিবেদন করেন সাংবাদিকরা। আর তাতেই রোষানলে পড়তে হচ্ছে শক্তিশালী এই সিন্ডিকেটের। হুমকির শিকার বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ইতোমধ্যে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন।

পীর সিন্ডিকেটের হয়রানির শিকার হওয়া সাংবাদিকদের তালিকায় রয়েছেন- দৈনিক ইত্তেফাকের সিনিয়র রিপোর্টার জামিউল আহসান সিপু, এনটিভির স্পেশাল করেসপনডেন্ট সফিক শাহীন, যুমনা টিভির স্পেশাল করেসপনডেন্ট আব্দুল্লাহ তুহিন, ইন্ডিপেনডেন্ট টিভির সিনিয়র ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট আরাফাতুর রহমান, আরটিভির স্টাফ রিপোর্টার কাজী ফয়সাল, বাংলাভিশনের স্টাফ করেসপনডেন্ট এসএম ফয়েজ, নাগরিক বার্তা২৪.কমের বার্তা সম্পাদক নয়ন মুরাদ, মাছরাঙ্গা টিভির সিনিয়র রিপোর্টার জাহেদ সেলিম, ইন্ডিপেনডেন্ট টিভির সাংবাদিক তানভীর সুমন, সময়ের আলো পত্রিকার সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল মামুন ও মোস্তফা ইমরুল কায়েস।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, জমি দখলসহ পীর সিন্ডিকেটটির নানা অপকর্ম তুলে ধরে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় এনটিভির সাংবাদিক সফিক শাহীনসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সফিক শাহীন আমাদের সময়কে বলেন, “রাজারবাগের পীর ও তার মুরিদদের কর্মকা- নিয়ে ২০১৯ সালের ৮ থেকে ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত ছয় পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন করায় দুটি মামলা করা হয় আমাদের বিরুদ্ধে। একটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এবং অপরটি মানহানির। ‘মামলাবাজ সিন্ডিকেট সমতল থেকে পাহাড়ে’ শিরোনামে প্রতিবেদন সম্প্রচার হওয়ার পরই ক্ষিপ্ত হয়ে তারা এই মামলা ঠুকে দেয়।”

রাজধানীর শান্তিবাগের বাসিন্দা একরামুল আহসান কাঞ্চনের জমি নিতে না পেরে তার বিরুদ্ধে ৪৯টি মিথ্যা মামলা করার পেছনে সম্প্রতি এই পীর সিন্ডিকেট জড়িত মর্মে হাইকোর্টে প্রতিবেদন দিয়েছে সিআইডি। এ বিষয়ে সাংবাদিক সফিক শাহীন বলেন, ‘এখন আমাদের রিপোর্টের ন্যায্যতার প্রমাণ পাচ্ছে। প্রমাণিত হচ্ছে যে, গণমাধ্যম সঠিক রিপোর্টই করেছে। তারা বরাবরই বলে যে, তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আমি বলতে চাই, তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ ও জঙ্গি সম্পৃক্ততাসহ অনেক অভিযোগের তথ্য-প্রমাণ রয়েছে বিভিন্ন সংস্থার কাছে। আমরা শুধু একটি ফৌজদারি অপরাধের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে রিপোর্ট করেছি। এমনকি তাদের নিয়ে যারাই নিউজ করছে, তাদেরকেই হুমকি-ধমকি দিয়ে যাচ্ছে সিন্ডিকেটটি।’

জানা গেছে, এই পীর সিন্ডিকেটের রোষানলে পড়ে ৪৯টি মামলার আসামি কাঞ্চনের রিট দায়ের এবং এসব মিথ্যা মামলার পেছনে পীর সিন্ডিকেটের জড়িত থাকার বিষয়টি প্রমাণিত হয়। এর পর থেকেই ভুক্তভোগীরা সিন্ডিকেটটির বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছে। তাদের অনেকেই হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন, অনেকে আবার সাংবাদিকদের কাছেও অভিযোগ জানাচ্ছেন। সেই তথ্যই তুলে ধরা হচ্ছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে। সর্বশেষ আট ভুক্তভোগীর করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট গত ১৭ সেপ্টেম্বর পীর দিল্লুর রহমান ও তার সংগঠনের নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব সম্পত্তি রয়েছে তা নির্ণয় করে সেগুলোর উৎস সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে আদালতকে জানাতে দুদককে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে পীর ও তার পৃষ্ঠপোষকতায় ওলামা আঞ্জুমান বাইয়্যিনাত অথবা ভিন্ন কোনো নামে কোনো জঙ্গি সংগঠন আছে কিনা, খোঁজ নিয়ে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটকে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বলা হয়। আগামী ৩০ নভেম্বরের আগে দুদক ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটকে ওই আদেশ প্রতিপালন করে প্রতিবেদন দিতে হবে। পাশাপাশি রিট আবেদনকারী আট জনের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দায়েরের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নিতে সিআইডিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ওই আদেশের বিরুদ্ধে চেম্বার আদালতে পীর দিল্লুরের আবেদন খারিজ হয়ে যায়। ওই আদেশের পর যে গণমাধ্যমেই অনুসন্ধানী সংবাদ প্রকাশ পাচ্ছে, তাদেরকেই সিন্ডিকেটটি হুমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ।

জানা গেছে, গত ১৩ অক্টোবর থেকে ‘পীরের সম্পদের উৎস সন্ধানে দুর্নীতি দমন কমিশন’, ‘অত্যাচার ও দখলে অতিষ্ঠ পীরের নিজ গ্রামের বাসিন্দারা’, ‘পীরের নাম ভাঙিয়ে বিত্তশালী হয়ে উঠছেন মুুরিদরা’ শিরোনামে তিনটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন সম্প্রচার করে ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশন। প্রতিবেদনে দুদক, পীরের মুখপাত্র ও ভুক্তভোগীদের আইনজীবীর বক্তব্যও সম্প্রচার হয়। এর পরও প্রতিবেদককে হুমকি দেওয়া হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অনুসন্ধানী প্রতিবেদক তানভীর সুমন আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমিসহ অন্য সাংবাদিক যারা এ ধরনের প্রতিবেদন করছেন, তাদেরকেই পীরের লোকজন ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন।’

এদিকে পীর দিল্লুর শিষ্যদের হুমকি পেয়ে রাজধানীর কলাবাগান থানায় জিডি করেছেন দৈনিক সময়ের আলোর দুই প্রতিবেদক আব্দুল্লাহ আল মামুন ও মোস্তফা ইমরুল কায়েস। গত ১৭ অক্টোবর করা ওই জিডিতে তারা উল্লেখ করেন- গাড়িতে করে রাজারবাগের কথিত পীরের শিষ্যদের বিএসটিআইয়ের অনুমোদন ছাড়া পণ্য বিক্রি, দাম বেশি রাখা, সুন্নতি পণ্যের নামে প্রতারণা এবং আদালতের আদেশের পর কথিত পীরের আস্তানার বাইরের চিত্র তুলে ধরে দুটি বিশেষ প্রতিবেদন সময়ের আলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওই কথিত পীরের শিষ্যরা পত্রিকার অফিসিয়াল টেলিফোন নম্বরে কল করে প্রতিবেদন তৈরিকারী দুই প্রতিবেদককে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন।

এদিকে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রাজারবাগীদের হুমকির বিষয়টি সাংবাদিকদের তিন সংগঠন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ), বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (ক্র‌্যাব) এবং রিপোর্টার্স অ্যাগেইনেস্ট করাপশনকেও (র‌্যাক) লিখিতভাবে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী সাংবাদিকরা। তার ওই তিনটি সংগঠনের সদস্য। লিখিত অভিযোগে গত ৭ অক্টোবর তারা ডিআরইউ ও ক্র‌্যাবকে জানান, দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে রাজারবাগের পীর দিল্লুর রহমানের মামলাবাজ সিন্ডিকেট নিয়ে সংবাদ করে আসছেন দেশের মূলধারার গণমাধ্যমকর্মীরা। সাধারণ নিরীহ-নিরপরাধ মানুষকে মামলার জালে ফেলে সহায়সম্পদ হাতিয়ে নেয় এই পীর সিন্ডিকেট। নিরীহ মানুষ ওই চক্রের জাল থেকে বের হতে পারছেন না। এসব ঘটনায় প্রতিবেদন করায় মামলাবাজচক্র ভুক্তভোগীদের পাশাপাশি বিভিন্ন গণমাধ্যমকর্মীদেরও হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। অভিযোগসংক্রান্ত চিঠিতে চরম অতঙ্কের কথা উল্লেখ করে পেশাগত দায়িত্ব পালনে ডিআরইউ এবং ক্র‌্যাবকে পাশে দাঁড়ানোরও আহ্বান জানান তারা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাংবাদিক জামিউল আহসান সিপু আমাদের সময়কে বলেন, ‘দুই বছর আগে আমি এই সিন্ডিকেট নিয়ে রিপোর্ট করেছি। তাদের নিয়ে রিপোর্ট করার পর হুমকি-ধমকি পাওয়া এমন আট সাংবাদিক লিখিতভাবে ডিআরইউ, ক্র‌্যাব ও র‌্যাককে লিখিতভাবে জানিয়েছি। কারণ এই পীর ও সিন্ডিকেটের সদস্যরা দেশব্যাপী ছড়িয়ে রয়েছে। তারা বিশাল একটি চক্র। তাদের অপকর্ম প্রমাণিত হওয়ার রিপোর্ট হাইকোর্টে জমা পড়েছে। কখন কী হয়, কোন দুর্ঘটনা ঘটায়- এ জন্য আমাদের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে লিখিতভাবে সংগঠনকে জানিয়েছি।’ এর আগে ২০১০ সালে এই পীর সিন্ডিকেট নিয়ে প্রতিবেদন করায় অপরাধ বিচিত্রার সম্পাদক এসএম মোর্শেদ ও রিপোর্টার এমএম রইচের বিরুদ্ধেও মানহানির মামলা করেছিলেন পীর দিল্লুর রহমান।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গত ১০ অক্টোবর ডিআরইউর মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে এলে রাজারবাগ পীর সিন্ডিকেটের বিষয়টি তার দৃষ্টিতে আনেন সাংবাদিকরা। পরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘সাংবাদিকরা হয়রানি-হুমকি, এমনকি মামলার শিকার হলে তাদের পাশে দাঁড়াবে সরকার।’ মামলাবাজ সিন্ডিকেটের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও আশ্বস্ত করেন মন্ত্রী। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ডিআরইউর সভাপতি মোরসালিন নোমানী বলেন, ‘আমরা সাংবাদিকরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করি। বস্তুনিষ্ঠভাবে প্রকৃত সত্য তুলে ধরি। আমদের কোনো পক্ষ-বিপক্ষ নেই। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হয়রানির শিকার হলে তার তীব্র নিন্দা জানাই, প্রতিবাদ জানাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘সংগঠনের কেউ যাতে হয়রানির শিকার না হয়, সে জন্য সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। কেউ হয়রানি করলে সংগঠন হিসেবে সদস্যদের পাশে ডিআরইউ আছে ও থাকবে।’

জানতে চাওয়া হলে সাংবাদিকদের হয়রানির অভিযোগ অস্বীকার করে রাজারবাগ দরবার শরীফের মুখপাত্র মাহবুবুল আলম আরিফ বলেন, ‘আমরা নিজেরাও সাংবাদিক। আমরা সাংবাদিকবান্ধব। হাইকোর্ট যেটা বলেননি, সেটাও বলার চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। উসকানিমূলক, মিথ্যা, অপপ্রচার চালানোয় সংক্ষুব্ধ হয়ে আমাদের অনেকেই সংক্ষুব্ধ হয়েছেন। তবে কাউকে হুমকি দেওয়া হয়নি, কাউকে হয়রানিও করা হয়নি।’ তবে মাহবুবুল আলম আরিফের এমন বক্তব্য সঠিক নয় বলে দাবি করেন ভুক্তভোগী সাংবাদিকরা।

এই ভয়ঙ্কর পৃথিবীর সিন্ডিকেটের হয়রানির শিকার ভুক্তভোগীদের প্রশ্ন, দেশের আইন সরকারের চেয়েও শক্তিশালী ভন্ড রাজার বাগ দরবার শরীফ?