ঢাকা ১২:৪০ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ




আতঙ্কে সুনসান বনানী গুলশানের অভিজাত রঙ্গ পাড়া

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ১০:০৬:৪০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১০ অগাস্ট ২০২১ ১৭৭ বার পড়া হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক:

বিতর্কিত মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও মরিয়ম আক্তার মৌ গ্রেফতারের পর পালটে গেছে রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানীর চিত্র। বন্ধ হয়েছে অনৈতিক কাজে জড়িত অধিকাংশ সিসা লাউঞ্জ, ম্যাসাজ ও বিউটি পার্লার। পার্টি হাউস ও অসামাজিক কাজের ‘সেফ প্লেস’ হিসাবে পরিচিত কয়েকটি বাসার বাসিন্দারা গা-ঢাকা দিয়েছে। রাস্তায় নামি-দামি ব্র্যান্ডের গাড়ির রেস নেই বললেই চলে।

তারকা হোটেলগুলোতেও কমেছে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও তাদের সঙ্গী হওয়া সুন্দরী তরুণীদের আনাগোনা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দাদের বিশেষ নজরদারি আছে এসব এলাকায়। ম্যাসাজ ও বিউটি পার্লারের নামে অবৈধ কাজে জড়িত ১৭টি প্রতিষ্ঠান ও ১৩টি সিসা লাউঞ্জের তালিকা এখন গোয়েন্দাদের হাতে। যেকোনো সময় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে-এমন আতঙ্কে প্রতিষ্ঠানগুলোয় রীতিমতো সৃষ্টি হয়েছে সুনসান নীরবতা।

গত ১ আগস্ট দিবাগত রাতে গুলশান থেকে গ্রেফতার হয় মডেল পিয়াসা ও মোহাম্মদপুর থেকে মৌ। এরপর ৪ আগস্ট সন্ধ্যায় বনানীর বাসা থেকে গ্রেফতার হন অভিনেত্রী পরীমনি। গ্রেফতার হন তাদের কয়েক ঘনিষ্ঠ সহযোগীও। তাদের বিরুদ্ধে স্বর্ণ চোরচালান, অবৈধ অস্ত্রের কারবার, ব্ল্যাকমেইলিং, মাদক কারবার, বিদেশে অর্থ পাচার, শত শত কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি গিয়ে গাড়ি আমদানিসহ নানা অভিযোগ আসতে থাকে। তখন থেকেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে তথাকথিত মডেল ও রুপালি জগতের অনেকের মধ্যেই। যারা এক সময়ে পিয়াসা-মৌ ও পরীমনি চক্রের ঘনিষ্ঠ হয়েছেন। আতঙ্কে বন্ধ করে দেয় তাদের পরিচালিত অনেক প্রতিষ্ঠান।

একটি গোয়েন্দা সংস্থার হাতে রয়েছে গুলশান-বনানী এলাকার ম্যাসাজ ও বিউটি পার্লারের তালিকা। এর মধ্যে কেবল গুলশানেই এমন ৩০টি প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। যার ১০টিতে অনৈতিক কাজ হয়। এসব অনৈতিক কাজে থাই নাগরিকসহ বিদেশিরাও জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গত কয়েক দিন এসব প্রতিষ্ঠানে সরেজমিনে দেখা যায়, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই এখন তালা ঝুলছে। ভবনগুলোর নিরাপত্তারক্ষীরা জানান, লকডাউনেই প্রতিষ্ঠানের মূল গেট বন্ধ করে ভিতরে তাদের কাজ চলত। তবে এক সপ্তাহ ধরে প্রতিষ্ঠানটির মালিক, কর্মচারী ও সেবা গ্রহীতা কেউই আসছে না।

অনৈতিক কাজ করা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে- গুলশান বনানী রোডের একটি ভবনের ১১ তলার একটি ‘হেলথ ক্লাব এন্ড স্পা’। যাতে ১৬ জন স্টাফ রয়েছে। যার মধ্যে ১০ জনই মহিলা। যাদের দিয়ে পুরুষদের শরীর ম্যাসাজসহ অনৈতিক কাজ করা হয়। গুলশান-২ এর ৪১ নং সড়কের একটি বাসার ২য় তলায় থাকা একটি ‘স্পা ম্যাসাজ পার্লার’। যেখানে নয়জন স্টাফের ৮ জনই নারী। যারা অনৈতিক কাজে জড়িত। নাম রয়েছে গুলশান-২ এর ৩৫ নং সড়কের একটি ভবনের চতুর্থ তলার ‘রোজ স্পা’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের। যেখানে মোট ৮ জন স্টাফের ৫ জনই মহিলা। গুলশান-২ এর ৪১নং সড়কের একটি ভবনের ২য় তলার ‘স্পা এন্ড সেলুন’ এর নাম রয়েছে তালিকায়। এর মালিক একজন থাই নাগরিক। যেখানে ১৬ জন স্টাফের মধ্যে ১৩ জনই মহিলা। মালিকসহ এখানকার চারজনই থাই নাগরিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

তালিকায় আরও নাম রয়েছে-গুলশান-১ এর একটি টাওয়ারের ‘হেলথ ক্লাব স্পা এন্ড সেলুন’ এর। যেখানে ৬ জন স্টাফের ৪ জনই মহিলা। গুলশান-১ এর আরেকটি টাওয়ারের লিফট-২০ এর ‘রেসিডেন্স সেলুন’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। যেখানে কেবল দুইজন পুরুষ আছে। এখানে বহিরাগত মহিলাদের এনে অনৈতিক কাজ হয় বলে উল্লেখ রয়েছে। গুলশান-১ এর ১৬ নং সড়কের একটি ভবনের পাঁচ তলায় ‘শাইনিং স্পা’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে নয়জন স্টাফ রয়েছে। যার মধ্যে ছয় জন মহিলা ও তিনজন পুরুষ। গুলশান-২ এর ৪৪ নং সড়কের একটি ভবনের চতুর্থ তলায় একটি ‘থাই স্পা’ এর নাম আসে সেখানে। যাতে ৭ জন মহিলা ও ২ জন পুরুষ রয়েছে। গুলশান-১ এর ১৩১ নং সড়কের একটি বাড়িরর চতুর্থ তলার ‘বিউটি কেয়ার’ এর নামও রয়েছে তালিকায়। যেখানে ৬ জন পুরুষ ও ৮ জন মহিলা কাজ করে থাকেন।

কেবল স্পা সেন্টার ও বিউটি পার্লারই নয়, ভয়ে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে গা-ঢাকা দিয়েছে অনেক পার্টি হাউস ও সিসা লাউঞ্জের নিয়ন্ত্রকরা। গোয়েন্দা তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, কেবল বনানীর ১১ নম্বর সড়ক ঘিরেই ১৩টি সিসা লাউঞ্জ গড়ে ওঠে। এদের কয়েকটি অবৈধভাবে মাদক কারবারেও জড়িত। এসব প্রতিষ্ঠানের পাঁচটিতে গিয়ে দেখা যায়, মূল ফটকে তালা ঝুলছে। এর মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তায় নিয়োজিতদের সঙ্গে কথা হয় যুগান্তরের। এরমধ্যে রয়েছে, ব্লক-ডি এর একটি ভবনের দ্বিতীয় তলার একটি, ব্লক-ই এর একটি, ব্লক এইচ এর একটি। তারা জানান, মূলত মডেলরা গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই এই লাউঞ্জগুলো বন্ধ। সেখানে নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের কথাও স্বীকার করেন তারা।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. আসাদুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ম্যাসাজ পার্লার, বিউটি পার্লার, সিসা লাউঞ্জ বা পার্টি হাউস যেই নামই আসুক না কেন, কোনো অনৈতিক বা অপরাধমূলক কাজের খবর পেলে আমার সঙ্গে সঙ্গে আইনানুগ ব্যবস্থা নেব। যারাই জড়িত থাকুক কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। অভিযানের মাধ্যমে অনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে পিয়াসাকে গ্রেফতারের পর অনৈতিক কাজের মাধ্যমে ‘ব্ল্যাকমেইলিং’ এ জড়িতদের অনেক ‘সেফ প্লেস’ এখন ফাঁকা। সংশ্লিষ্টরা জানান, ‘সেফ প্লেস’ এর নামে এসব বাসায় ধনীর দুলালদের ঘনিষ্ঠ হতো চক্রের তরুণীরা। অনেক নামি-দামি ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরাও সেখানে যেত। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে গোপন ক্যামেরা দিয়ে তাদের বিশেষ মুহূর্তের ভিডিও ধারণ করা হতো। যেগুলো দিয়ে চক্রটি ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিত মোটা অংকের অর্থ। এছাড়াও অনেক সময় বিভিন্ন বাসাতেও হতো পার্টি। যেখানে মাত্রাতিরিক্ত নেশা জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করে অনেকেই অচেতন হয়ে পড়ত। তাদেরকেও করা হতো ব্ল্যাকমেইল। কিছু কিছু পার্টিতে আবার ‘পার্টি গাল’রা অতিথিদের সঙ্গ দিয়ে সেগুলোর ভিডিও ও স্থিরচিত্র ধারণ করত। যা দিয়ে পরবর্তীতে ফাঁদে ফেলা হতো। গুলশান-বনানী এলাকায় এমন অন্তত ২৩টি বাসা রয়েছে। অভিনেত্রী মডেল কেলেঙ্কারির পর এসবের অধিকাংশই এখন বন্ধ রয়েছে বলে জানা গেছে। বনানীর একটি সিসা লাউঞ্জের নিরাপত্তায় নিয়োজিতরা জানান, একটি সিসা লাউঞ্জের মালিক ব্লক এইচের ৭নং সড়কের একটি ভবনের দোতলার বাসায় নিয়মিত পার্টির আয়োজন করত। যেখানে নায়ক-নায়িকাদেরও যাতায়াত ছিল। অভিনেত্রী মডেলদের গ্রেফতারের পর সেটিও বন্ধ হয়েছে।

গত সাতদিন গুলশান-বনানী এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, পূর্বের ন্যায় সেখানে আর নামি-দামি ব্র্যান্ডের গাড়ির চলাচল নেই। সেই পুরনো আড্ডাও নেই। ইতোমধ্যে যাদের নাম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদ ও গণমাধ্যমে এসেছে তাদের অনেকেও গা-ঢাকা দিয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, এরা কেবল মডেলদের সঙ্গে গল্প করে বা আড্ডা দেয় এমন নয়, বড় বড় অপরাধেও সম্পৃক্ত হয়েছেন তারা। পিয়াসা চক্র গ্রেফতারের পর আলোচনার বাইরে থাকতেই অপকর্মের গডফাদাররা জনসমাগম এড়িয়ে চলছেন। অনেকে আবার রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে কেনা অবৈধ গাড়ি আটকের ভয়ে বাসা থেকে সেভাবে বের হচ্ছেন না। রোববার রাতে গুলশান-২ এ এমন একজনের সঙ্গে কথা হয় যুগান্তরের। তিনি বলেন, ‘অবস্থা যা শুরু হয়েছে তাতে গাড়ি নিয়ে বের হওয়ার উপায় নেই। যেকোনো সময় যে কেউ ধরা পড়তে পারে।’

জানতে চাইলে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, কারও বাসায় বার বানানো, অবৈধভাবে মাদক গ্রহণ ও বেচাবিক্রির বিরুদ্ধে সবসময় আমাদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। সম্প্রতি অভিনেত্রী পরীমনিকে গ্রেফতার যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। সিসা লাউঞ্জের আড়ালে কেউ অবৈধ কর্মকাণ্ড ও মাদক কারবারে জড়িত হলে তাদেরকেও ছাড়া দেওয়া হবে না।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :




আতঙ্কে সুনসান বনানী গুলশানের অভিজাত রঙ্গ পাড়া

আপডেট সময় : ১০:০৬:৪০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১০ অগাস্ট ২০২১

নিজস্ব প্রতিবেদক:

বিতর্কিত মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও মরিয়ম আক্তার মৌ গ্রেফতারের পর পালটে গেছে রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানীর চিত্র। বন্ধ হয়েছে অনৈতিক কাজে জড়িত অধিকাংশ সিসা লাউঞ্জ, ম্যাসাজ ও বিউটি পার্লার। পার্টি হাউস ও অসামাজিক কাজের ‘সেফ প্লেস’ হিসাবে পরিচিত কয়েকটি বাসার বাসিন্দারা গা-ঢাকা দিয়েছে। রাস্তায় নামি-দামি ব্র্যান্ডের গাড়ির রেস নেই বললেই চলে।

তারকা হোটেলগুলোতেও কমেছে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও তাদের সঙ্গী হওয়া সুন্দরী তরুণীদের আনাগোনা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দাদের বিশেষ নজরদারি আছে এসব এলাকায়। ম্যাসাজ ও বিউটি পার্লারের নামে অবৈধ কাজে জড়িত ১৭টি প্রতিষ্ঠান ও ১৩টি সিসা লাউঞ্জের তালিকা এখন গোয়েন্দাদের হাতে। যেকোনো সময় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে-এমন আতঙ্কে প্রতিষ্ঠানগুলোয় রীতিমতো সৃষ্টি হয়েছে সুনসান নীরবতা।

গত ১ আগস্ট দিবাগত রাতে গুলশান থেকে গ্রেফতার হয় মডেল পিয়াসা ও মোহাম্মদপুর থেকে মৌ। এরপর ৪ আগস্ট সন্ধ্যায় বনানীর বাসা থেকে গ্রেফতার হন অভিনেত্রী পরীমনি। গ্রেফতার হন তাদের কয়েক ঘনিষ্ঠ সহযোগীও। তাদের বিরুদ্ধে স্বর্ণ চোরচালান, অবৈধ অস্ত্রের কারবার, ব্ল্যাকমেইলিং, মাদক কারবার, বিদেশে অর্থ পাচার, শত শত কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি গিয়ে গাড়ি আমদানিসহ নানা অভিযোগ আসতে থাকে। তখন থেকেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে তথাকথিত মডেল ও রুপালি জগতের অনেকের মধ্যেই। যারা এক সময়ে পিয়াসা-মৌ ও পরীমনি চক্রের ঘনিষ্ঠ হয়েছেন। আতঙ্কে বন্ধ করে দেয় তাদের পরিচালিত অনেক প্রতিষ্ঠান।

একটি গোয়েন্দা সংস্থার হাতে রয়েছে গুলশান-বনানী এলাকার ম্যাসাজ ও বিউটি পার্লারের তালিকা। এর মধ্যে কেবল গুলশানেই এমন ৩০টি প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। যার ১০টিতে অনৈতিক কাজ হয়। এসব অনৈতিক কাজে থাই নাগরিকসহ বিদেশিরাও জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গত কয়েক দিন এসব প্রতিষ্ঠানে সরেজমিনে দেখা যায়, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই এখন তালা ঝুলছে। ভবনগুলোর নিরাপত্তারক্ষীরা জানান, লকডাউনেই প্রতিষ্ঠানের মূল গেট বন্ধ করে ভিতরে তাদের কাজ চলত। তবে এক সপ্তাহ ধরে প্রতিষ্ঠানটির মালিক, কর্মচারী ও সেবা গ্রহীতা কেউই আসছে না।

অনৈতিক কাজ করা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে- গুলশান বনানী রোডের একটি ভবনের ১১ তলার একটি ‘হেলথ ক্লাব এন্ড স্পা’। যাতে ১৬ জন স্টাফ রয়েছে। যার মধ্যে ১০ জনই মহিলা। যাদের দিয়ে পুরুষদের শরীর ম্যাসাজসহ অনৈতিক কাজ করা হয়। গুলশান-২ এর ৪১ নং সড়কের একটি বাসার ২য় তলায় থাকা একটি ‘স্পা ম্যাসাজ পার্লার’। যেখানে নয়জন স্টাফের ৮ জনই নারী। যারা অনৈতিক কাজে জড়িত। নাম রয়েছে গুলশান-২ এর ৩৫ নং সড়কের একটি ভবনের চতুর্থ তলার ‘রোজ স্পা’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের। যেখানে মোট ৮ জন স্টাফের ৫ জনই মহিলা। গুলশান-২ এর ৪১নং সড়কের একটি ভবনের ২য় তলার ‘স্পা এন্ড সেলুন’ এর নাম রয়েছে তালিকায়। এর মালিক একজন থাই নাগরিক। যেখানে ১৬ জন স্টাফের মধ্যে ১৩ জনই মহিলা। মালিকসহ এখানকার চারজনই থাই নাগরিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

তালিকায় আরও নাম রয়েছে-গুলশান-১ এর একটি টাওয়ারের ‘হেলথ ক্লাব স্পা এন্ড সেলুন’ এর। যেখানে ৬ জন স্টাফের ৪ জনই মহিলা। গুলশান-১ এর আরেকটি টাওয়ারের লিফট-২০ এর ‘রেসিডেন্স সেলুন’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। যেখানে কেবল দুইজন পুরুষ আছে। এখানে বহিরাগত মহিলাদের এনে অনৈতিক কাজ হয় বলে উল্লেখ রয়েছে। গুলশান-১ এর ১৬ নং সড়কের একটি ভবনের পাঁচ তলায় ‘শাইনিং স্পা’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে নয়জন স্টাফ রয়েছে। যার মধ্যে ছয় জন মহিলা ও তিনজন পুরুষ। গুলশান-২ এর ৪৪ নং সড়কের একটি ভবনের চতুর্থ তলায় একটি ‘থাই স্পা’ এর নাম আসে সেখানে। যাতে ৭ জন মহিলা ও ২ জন পুরুষ রয়েছে। গুলশান-১ এর ১৩১ নং সড়কের একটি বাড়িরর চতুর্থ তলার ‘বিউটি কেয়ার’ এর নামও রয়েছে তালিকায়। যেখানে ৬ জন পুরুষ ও ৮ জন মহিলা কাজ করে থাকেন।

কেবল স্পা সেন্টার ও বিউটি পার্লারই নয়, ভয়ে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে গা-ঢাকা দিয়েছে অনেক পার্টি হাউস ও সিসা লাউঞ্জের নিয়ন্ত্রকরা। গোয়েন্দা তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, কেবল বনানীর ১১ নম্বর সড়ক ঘিরেই ১৩টি সিসা লাউঞ্জ গড়ে ওঠে। এদের কয়েকটি অবৈধভাবে মাদক কারবারেও জড়িত। এসব প্রতিষ্ঠানের পাঁচটিতে গিয়ে দেখা যায়, মূল ফটকে তালা ঝুলছে। এর মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তায় নিয়োজিতদের সঙ্গে কথা হয় যুগান্তরের। এরমধ্যে রয়েছে, ব্লক-ডি এর একটি ভবনের দ্বিতীয় তলার একটি, ব্লক-ই এর একটি, ব্লক এইচ এর একটি। তারা জানান, মূলত মডেলরা গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই এই লাউঞ্জগুলো বন্ধ। সেখানে নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের কথাও স্বীকার করেন তারা।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. আসাদুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ম্যাসাজ পার্লার, বিউটি পার্লার, সিসা লাউঞ্জ বা পার্টি হাউস যেই নামই আসুক না কেন, কোনো অনৈতিক বা অপরাধমূলক কাজের খবর পেলে আমার সঙ্গে সঙ্গে আইনানুগ ব্যবস্থা নেব। যারাই জড়িত থাকুক কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। অভিযানের মাধ্যমে অনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে পিয়াসাকে গ্রেফতারের পর অনৈতিক কাজের মাধ্যমে ‘ব্ল্যাকমেইলিং’ এ জড়িতদের অনেক ‘সেফ প্লেস’ এখন ফাঁকা। সংশ্লিষ্টরা জানান, ‘সেফ প্লেস’ এর নামে এসব বাসায় ধনীর দুলালদের ঘনিষ্ঠ হতো চক্রের তরুণীরা। অনেক নামি-দামি ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরাও সেখানে যেত। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে গোপন ক্যামেরা দিয়ে তাদের বিশেষ মুহূর্তের ভিডিও ধারণ করা হতো। যেগুলো দিয়ে চক্রটি ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিত মোটা অংকের অর্থ। এছাড়াও অনেক সময় বিভিন্ন বাসাতেও হতো পার্টি। যেখানে মাত্রাতিরিক্ত নেশা জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করে অনেকেই অচেতন হয়ে পড়ত। তাদেরকেও করা হতো ব্ল্যাকমেইল। কিছু কিছু পার্টিতে আবার ‘পার্টি গাল’রা অতিথিদের সঙ্গ দিয়ে সেগুলোর ভিডিও ও স্থিরচিত্র ধারণ করত। যা দিয়ে পরবর্তীতে ফাঁদে ফেলা হতো। গুলশান-বনানী এলাকায় এমন অন্তত ২৩টি বাসা রয়েছে। অভিনেত্রী মডেল কেলেঙ্কারির পর এসবের অধিকাংশই এখন বন্ধ রয়েছে বলে জানা গেছে। বনানীর একটি সিসা লাউঞ্জের নিরাপত্তায় নিয়োজিতরা জানান, একটি সিসা লাউঞ্জের মালিক ব্লক এইচের ৭নং সড়কের একটি ভবনের দোতলার বাসায় নিয়মিত পার্টির আয়োজন করত। যেখানে নায়ক-নায়িকাদেরও যাতায়াত ছিল। অভিনেত্রী মডেলদের গ্রেফতারের পর সেটিও বন্ধ হয়েছে।

গত সাতদিন গুলশান-বনানী এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, পূর্বের ন্যায় সেখানে আর নামি-দামি ব্র্যান্ডের গাড়ির চলাচল নেই। সেই পুরনো আড্ডাও নেই। ইতোমধ্যে যাদের নাম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদ ও গণমাধ্যমে এসেছে তাদের অনেকেও গা-ঢাকা দিয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, এরা কেবল মডেলদের সঙ্গে গল্প করে বা আড্ডা দেয় এমন নয়, বড় বড় অপরাধেও সম্পৃক্ত হয়েছেন তারা। পিয়াসা চক্র গ্রেফতারের পর আলোচনার বাইরে থাকতেই অপকর্মের গডফাদাররা জনসমাগম এড়িয়ে চলছেন। অনেকে আবার রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে কেনা অবৈধ গাড়ি আটকের ভয়ে বাসা থেকে সেভাবে বের হচ্ছেন না। রোববার রাতে গুলশান-২ এ এমন একজনের সঙ্গে কথা হয় যুগান্তরের। তিনি বলেন, ‘অবস্থা যা শুরু হয়েছে তাতে গাড়ি নিয়ে বের হওয়ার উপায় নেই। যেকোনো সময় যে কেউ ধরা পড়তে পারে।’

জানতে চাইলে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, কারও বাসায় বার বানানো, অবৈধভাবে মাদক গ্রহণ ও বেচাবিক্রির বিরুদ্ধে সবসময় আমাদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। সম্প্রতি অভিনেত্রী পরীমনিকে গ্রেফতার যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। সিসা লাউঞ্জের আড়ালে কেউ অবৈধ কর্মকাণ্ড ও মাদক কারবারে জড়িত হলে তাদেরকেও ছাড়া দেওয়া হবে না।