বদলি নিয়ে শিল্পকলা একাডেমি ও মন্ত্রণালয় মুখোমুখি
- আপডেট সময় : ১২:০৩:৪৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২১ জুলাই ২০২১ ২০২ বার পড়া হয়েছে
নিজস্ব প্রতিবেদক: কয়েকজন কর্মকর্তাদের বদলির ঘটনায় জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে শিল্পকলা একাডেমিতে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক একাডেমির দশ কর্মকর্তাকে বদলির ঘটনায় এই জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ঢাকায় নিযুক্ত শিল্পকলা একাডেমির ১০ কালচারাল অফিসারকে বিভিন্ন জেলায় বদলির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একাডেমির দ্বা›িদ্বক পরিস্থিতি। একাডেমির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, শিল্পকলা একাডেমি একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। এর কার্যক্রম পরিচালিত হয় নিজস্ব আইনে। মন্ত্রণালয় তাতে হস্তক্ষেপ করতে পারেনা। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যে কোন প্রতিষ্ঠান পরিচালনার নিজস্ব আইন থাকলেও মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। চাইলে মন্ত্রণালয় যে কোন প্রতিষ্ঠানের যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বিষয়টি বর্তমানে আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে।
এর বাইরেও নানা জটিলতায় শিল্পকলা একাডেমিতে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে রয়েছে ক্ষোভ। এক যুগের বেশি সময় ধরে একাডেমির প্রবিধানমালা সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এতে পদোন্নতি বঞ্চিত হচ্ছেন বøক পদে কর্মরত কর্মকর্তারা। ৩০ বছরের পুরনো প্রবিধানমালার সংশোধন ঝুলে থাকায় শিল্পকলা একাডেমির কার্যক্রমে সৃষ্টি হয়েছে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা। বøক পদের আওতাধীন হওয়ায় কুড়ি বছরের বেশি সময় কাজ করেও পদোন্নতি পাচ্ছেন না অনেক কর্মকর্তা। এ ঘটনার বাইরে বিগত এক বছরে পরিষদের অনুমোদন ছাড়া সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে শিল্পকলা একাডেমির চারুকলা, নাট্যকলা, সঙ্গীত এবং গবেষণা বিভাগে চারজনকে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। একাডেমির প্রবিধানমালা অনুযায়ী, এই পদগুলো পদোন্নতি যোগ্য পদ। একাডেমিতে কর্মরত প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তারা যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে পরিচালক পদে নিযুক্ত হবেন। এইসব পদে সরাসরি নিয়োগের কারণে একোডেমিতে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত দক্ষ কর্মকর্তারা বঞ্চিত হয়েছেন।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন হলেও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে শিল্পকলা একাডেমি পরিচালিত হয় নিজস্ব আইনে। পাশাপাশি একাডেমির প্রশাসনিক কার্যক্রম নির্ধারিত হয় পরিষদের মাধ্যমে। ২৫ সদস্যবিশিষ্ট এই পরিষদের সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়ন করেন পরিষদের সদস্য সচিব হিসেবে নিযুক্ত একাডেমির মহাপরিচালক। ১৯৮৯ সালে প্রণীত বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আইন অনুযায়ী কাউকে বদলি করতে হলে সেটি পরিষদ সদস্যদের সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হবে এবং একাডেমির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে তা বাস্তবায়ন করবেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক।
জানা গেছে, গত ৭ এপ্রিল ভার্চুয়ালি শিল্পকলা শিল্পকলা একাডেমি পরিষদের ১২০তম সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে ঢাকায় পদায়নকৃত একাডেমির কালচারাল অফিসারদের কর্মবণ্টন, কর্মপরিধি ও বদলির বিষয়ে পরবর্তী সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়। পরবর্তীতে পরিষদের সদস্য সচিব হিসেবে একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী ওই সভার কার্যবিবরণীর খসড়া স্বাক্ষরের জন্য পরিষদের সভাপতি সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদের কাছে পাঠান। এরপর সেই কার্যবিবরণীর ভিত্তিতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় একাডেমির দশজন কালচারাল অফিসারকে বিভিন্ন জেলায় বদলির সিদ্ধান্ত নেয় এবং সিদ্ধান্তটি চিঠির মাধ্যমে একাডেমির মহাপরিচালককে জানিয়ে দেয়া হয়। চিঠির জবাবে একাডেমির মহাপরিচালক সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে জানান, পরিষদের সভায় সর্বসম্মতিক্রমে কালচারাল অফিসারদের বদলি বিষয়ক কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। একারনে মন্ত্রণালয়ের এই সিদ্ধন্তে শিল্পকলা একাডেমি আইনের লঙ্ঘন হয়েছে। খর্ব করা হয়েছে মহাপরিচালকের ক্ষমতা।
একাডেমি আইনের ৪ ধারা অনুযায়ী, একাডেমি পরিচালনা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিষদের ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং পরিষদ ক্ষমতা প্রয়োগের সেইসব কাজ করতে পারবে যা একাডেমির মাধ্যমে সম্পন্ন হবে। একাডেমি আইনের ৯ ধারার চার অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে একাডেমির মহাপরিচালক পরিষদ প্রদত্ত ক্ষমতার প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করবেন। তিনি একাডেমির প্রশাসন পরিচালনা করবেন। এছাড়া আইনের ১৯ ধারা বলে প্রয়োজনবোধে পরিষদ যে কোন বিষয়ে নির্ধারিত শর্তসাপেক্ষে একাডেমির মহাপরিচালককে কার্যক্রম পরিচালনার পূর্ণ ক্ষমতা অর্পণ করবে। এমন বাস্তবতায় একাডেমি আইনের ধারা অনুযায়ী পরিষদ চাইলেও একাডেমি পরিচালনার কোন ক্ষমতা মন্ত্রণালয়কে দিতে পারে না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া বদলির সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে সংশ্লিষ্ট কালচারাল অফিসারগণ গত ২৪ জুন আদালতে মামলা করেছেন।
প্রথম শ্রেণীর পদমর্যাদায় কস্টিউম ডিজাইনার হিসেবে ২৮ বছর ধরে শিল্পকলা একাডেমিতে কর্মরত রয়েছেন কামরুন্নাহার সৃষ্টি। আড়াই দশকের বেশি সময় ধরে কাজ করেও তার কোন পদোন্নতি হয়নি। সেট ডিজাইনার আলী আহমেদ মুকুল প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে ১৯ বছর ধরে একই পদে কাজ করছেন। দেড় দশকের বেশি সময় কাজ করেও তার পদোন্নতি হয়নি। কালচারাল অফিসার পদে ১৬ বছর আগে নিয়োগ পেয়ে অর্থ বিভাগের উপ-পরিচালকের চলতি দায়িত্বে নিযুক্ত রয়েছেন শহীদুল আলম। কয়েক দশক চাকরি পেয়ে পদোন্নতি না হওয়ায় তারা হতাশায় ভুগছেন উল্লেখ করে আলী আহমেদ মুকুল বলেন, এই বøক পদের অনেক কর্মকর্তা তিন দশক চাকরি করেও শেষ পর্যন্ত একই পদে থেকে অবসর নিয়েছেন। কেউ বা পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েই মৃত্যুবরণ করেছেন। অথচ প্রবিধানমালা পরিবর্তনের মাধ্যমে সকল দফতরে বøক পোস্ট বাতিল করে পদোন্নতির ব্যবস্থা করার সরকারী নির্দেশনা থাকলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। সংশোধনের মাধ্যমে যুগোপযোগী প্রবিধানমালা প্রবর্তনের মাধ্যমে আমরা এই বঞ্চনা থেকে রেহাই পেতে চাই।
বিষয়টি সম্পর্কে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী বলেন, এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল বৈঠকে কালচারাল অফিসারদের কর্মবণ্টন এবং পরবর্তীতে প্রয়োজনের ভিত্তিতে তাদের কোথায় বদলি করা হবেÑসে বিষয়ে প্রাথমিক আলোচনা হয়। এসব বিষয়ে পরবর্তী পরিষদ সভায় সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা ছিল। সেদিন বদলির বিষয়ে সর্বসম্মতিক্রমে পরিষদে কোন সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। পরবর্তীতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের একক সিদ্ধান্তে বদলির বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়। শিল্পকলা একাডেমি আইন অনুযায়ী এটা হতে পারে না। একাডেমির প্রয়োজনে এই কর্মকর্তাদের ঢাকায় রাখতে হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে তাদের বদলির বিষয়টি চূড়ান্ত করা হতো। একাডেমির মহাপরিচালক ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কাকে কোন দায়িত্ব দেয়া হবে বা কোথায় বদলি করতে হবে এটি আমার জানার কথা। একাডেমির আইনেও তাই রয়েছে। এর বাইরে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির কার্যক্রম পরিচালনায় ৭১টি প্রথম শ্রেণীর পদ থাকলেও গত তিন বছর ধরে ৩২টি পদই শূন্য রয়েছে। দায়িত্বের মধ্যে পড়লেও এইসব পদে জনবল নিয়োগ দিচ্ছে না সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। ঢাকার বাইরে থেকে ১৫ জন কালচারাল অফিসারকে এনে বিভিন্ন দায়িত্ব দিয়ে শূন্যতা পূরণের চেষ্টা করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দশজন কর্মকর্তাকে বদলির মাধ্যমে একাডেমিকে গভীর সঙ্কটে ফেলে দেয়া হলো।
গত এক বছরে পরিষদের সিদ্ধান্তের বাইরে চারজন পরিচালককে নিয়োগ দেয়া প্রসঙ্গে লিয়াকত আলী লাকী বলেন, মূলত পরিচালক পদটি পদোন্নতি যোগ্য পদ। প্রবিধান অনুযায়ী একাডেমির প্রথম শ্রেণীর একজন কর্মকর্তা প্রথম সাত বছর কাজ করার পর পদোন্নতি পেয়ে উপ-পরিচালক এবং পরবর্তী সাত বছর পরে পরিচালক নিযুক্ত হবেন। মন্ত্রণালয় থেকে গত এক বছরে নাট্যকলা, চারুকলালা, সঙ্গীত ও গবেষণা বিভাগে সরাসরি চারজন পরিচালককে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
এক্ষেত্রেও শিল্পকলা একাডেমি আইনের লঙ্ঘন ঘটেছে। একাডেমির পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তাদের বিষয়ে লাকী বলেন, একাডেমির ৩০ বছরের পুরনো প্রবিধানমালায় প্রথম শ্রেণীসহ দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর বেশিরভাগ পদই বøক পদ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত থাকায় এমনটা ঘটছে। এজন্য এক যুগেরও বেশি সময় ধরে একাডেমির প্রবিধানমালা সংশোধনের প্রস্তাব সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় সেই প্রস্তাব দীর্ঘসূত্রতার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে আছে।
একাডেমি পরিচালনা পরিষদ সদস্য বরিশাল শব্দাবলী থিয়েটারের সভাপতি সৈয়দ দুলাল বলেন, শিল্পকলা একাডেমি আইন অনুযায়ী পরিষদকে পাশ কাটিয়ে মন্ত্রণালয় এইসব বদলির সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। গত এপ্রিলে পরিষদের ১২০তম সভায় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একাডেমিতে কর্মরতরা কে কোন দায়িত্ব পালন করছে এবং কিভাবে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে তার বিস্তারিত প্রতিবেদন দিতে বলা হয় একাডেমির মহাপরিচালককে। সেই সভায় কর্মকর্তাদের বদলির বিষয়ে সর্বসম্মতিক্রমে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। মন্ত্রণালয়ের এই বদলির সিদ্ধান্তে আইন লঙ্ঘিত হয়েছে। এছাড়া গত এক বছরে চারটি পরিচালক পদে নিয়োগও আইন সঙ্গতভাবে হয়নি। মন্ত্রণালয় অযৌক্তিকভাবে শিল্পকলা একাডেমির ওপর কর্তৃত্ব আরোপের চেষ্টা করছে। পরিষদের আরেক সদস্য বিশিষ্ট সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, সেদিনের সভায় একাডেমিতে কতজন কর্মকর্তা আছেন এবং তারা কি দায়িত্ব পালন করছেন তাই জানতে চাওয়া হয়েছে এবং পরবর্তী সভায় প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। সেদিনের সভায় কর্মকর্তাদের বদলির বিষয়ে সর্বসম্মত কোন সিদ্ধান্ত হয়নি।
শিল্পকলা একাডেমির কর্মকর্তাদের বদলির বিষয়ে আইন লঙ্ঘনের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। পাল্টা যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, যে কোন প্রতিষ্ঠান পরিচালনার নিজস্ব আইন থাকলেও মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। মন্ত্রণালয় চাইলে যে কোন প্রতিষ্ঠান বা দফতরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সে কারণে মন্ত্রণালয় এই বদলির সিদ্ধান্ত দিয়েছে। সেই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বদলির নির্দেশপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা আদালতে গেছে। এখন আদালত যা বলবে তাই হবে।