তানজুম তমাঃ ‘‘শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,/রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্তপায়ে হেঁটে/ অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন/ তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল, হৃদয়ে লাগিল দোলা/জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা/কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?/গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি;/‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'৷''
কবি নির্মলেন্দু গুণ বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণকে দেখেছেন অমর কবিতা হিসেবে৷সত্যিই তো এই ভাষণের প্রত্যেকটি কথাই কবিতা, প্রত্যেকটি বাক্য শিহরণ জাগানো এবং পুরো ভাষনে তৎকালীন প্রেক্ষাপট ফুটে উঠেছে।শুধু নির্মলেন্দু গুনই নন পশ্চিমা বিশ্ব তাঁকে বলেছে ‘পোয়েট অফ পলিটিক্স'।৭ই মার্চের সেই ভাষণেরই সফল পরিণতি স্বাধীন বাংলাদেশ৷স্বাধীনতার এত বছরেও ১৮ মিনিটের সেই ভাষণের আবেদন এতটুকু কমেনি৷৭ই মার্চের ভাষণের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর সার্বজনীনতা এবং মানবিকতা৷ যে-কোনো নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর জন্য এই ভাষণ সব সময়ই আবেদন সৃষ্টিকারী৷ এই ভাষণে গণতন্ত্র, আত্মনিয়ন্ত্রণ, স্বাধিকার, মানবতা এবং সব মানুষের কথা বলা হয়েছে৷
১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে আওয়ামীলীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী এই দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বিলম্ব করতে শুরু করে। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টজেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বান করেন। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে১লা মার্চ এই অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি ঘোষণা করেন। এই সংবাদে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ২রা মার্চ ঢাকায় এবং ৩রা মার্চ সারাদেশে একযোগে হরতাল পালিত হয়। তিনি ৩রা মার্চ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় সমগ্র পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
এই পটভূমিতেই ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বিপুল সংখ্যক লোক একত্রিত হয়; পুরো ময়দান পরিণত হয় এক জনসমুদ্রে।এ দিন বাঙালীর সমুখে উন্মোচিত হয়েছিল তাদের হাজার বছরের যাপিত জীবনের খতিয়ান। বাঙালি-জীবনের শ্রেষ্ঠ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ তথা মহাসমাবেশে নির্ধারণ হয়েছিল আমাদের হাজার বছরের নিয়তি, খুলে গিয়েছিল মুক্তির দখিন দুয়ার।বাঙালি সেদিন তৈরিই ছিল এমন একটি ঘোষণার জন্য।সেদিনের সেই মহাসমাবেশের তিনিই একমাত্র বক্তা যা বাংলাদেশতো বটেই, বিশ্বেও বিরল। তিনিই একমাত্র বক্তা, সঞ্চালক, নির্দেশদাতা ও সমাপনাকারী। যা বঙ্গবন্ধুতেই শুরু, বঙ্গবন্ধুতেই শেষ। রাজনৈতিক সমাবেশের ইতিহাসে এ এক অভূতপূর্ব ঘটনা।
এবার জেনে নেই আজকের তরুন প্রজন্মের উপর এই ঐতিহাসিক ভাষন কীভাবে প্রভাব ফেলছে?
রাহাত জয় জামান, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে জনতার সামনে দাড়ানো মানুষটার বজ্রকন্ঠে সেদিন সাড়ে সাত কোটি মানুষ স্বাধীনতার যে ডাক শুনতে পেয়েছিলো তা মুক্তির আশা ও সম্ভাবনায় উদ্বেলিত করেছিলো পুরো জাতিকে। আমরা এমন একটা প্রজন্ম যারা পাঠ্যবইয়ে বিকৃত ইতিহাস পড়ে স্কুলজীবন শুরু করি।বঙ্গবন্ধুর 'সোনার বাংলা' নির্মাণের অনুপ্রেরণা দেয় এই ভাষন। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এই দেশের আবাল বুদ্ধ বনিতা ঠিক একইভাবে অনুপ্রেরণা পেয়ে যাবে ৭ই মার্চের সেই মহাকাব্য থেকে।
নাজিফা ফারহীন,শিক্ষার্থী- জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ দীর্ঘদিনের শোষণ, বঞ্চনার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল একটি কণ্ঠ। অন্যায়, অগণতান্ত্রিক আচরণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাতিকে পরিপূর্ণভাবে জাগিয়ে তুলেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐ ভাষণ। তাই বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ আমাদের প্রেরণার চিরন্তন উৎস হয়ে থাকবে।
শাখাওয়াত অনু, শিক্ষার্থী- বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৭১ সালের ৭ ই মার্চ মুক্তিকামী বাঙালী জাতিকে মুক্তির বানী শুনিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।প্রতিটি জাতির জীবনে এমন কিছু ঘটনা থাকে,সবকিছুকে ছাপিয়ে যা সেই জাতির আত্মার অবিভাজ্য অংশ হয়ে ওঠে।বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ কেবল ঐতিহাসিক নিদর্শন নয়,গোটা জাতির প্রেরনা।সুতরাং ৭ই মার্চের ভাষণ প্রতিটি মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে দেশকে ভালবাসতে শেখায়।
আশশরাফুল ইসলাম, শিক্ষার্থী- খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
"মুক্তিযুদ্ধের দুই যুগ পরে আমার জন্ম। ততদিনে ইতিহাস বিকৃতির কবলে দেশ। সেই বিকৃতির মাঝেও যে সঠিক ইতিহাসটা প্রত্যক্ষ করেছি সেটা সাত মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়ার জন্য এই একটা ভাষণই যথেষ্ট। এই ভাষণ শুনেই তো লক্ষ বাঙালি রক্ত দিয়েছে, এটা দেশপ্রেমের বিরল দৃষ্টান্ত। আমি নিজেও আমার দেশপ্রেমের ভিত্তি হিসেবে এই ভাষণটাকেই প্রথমে রাখবো।
তানভীর এহসান,শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন আমি ক্ষমতা ও প্রধান মন্ত্রীত্র চাইনা,আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই(৭মার্চ)।একজন তরুণ হিসেবে আজ আমি তার কথায় কথা মিলিয়ে একটা কথাই বলতে চাই-আমি কোন পদ চাইনা,চাইনা কোন ক্ষমতা, আমি চাই তার স্মৃতিকে, আদর্শকে সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠা করতে।
স্বরাজ রায়, শিক্ষার্থী-স্যার সলিমুল্লাহ্ মেডিকেল কলেজ
স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরেও এখনো ৭ মার্চ এর ভাষন শুনলে আমার গা শিউরে ওঠে।এই ভাষনে এমন একটা যাদু শক্তি আছে যা আমাকে টানে,দেশের প্রতি যতই রাগ,অভিমান,ক্ষোভ থাকুক না কেন ভাষনটি শুনলে আবার নতুনকরে দেশের জন্য যেকোনো যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তে ইচ্ছা করে। ভাষনটি শুনলে মনে হয় আমার মনের কথাই যেন বঙ্গবন্ধু উনার তেজদীপ্ত কন্ঠে প্রকাশ করছেন।
আবুল বাশার মিরাজ, শিক্ষার্থী- বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল একটি অগ্নিশলাকা। ১৯৭১-এর ৭ই মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ এই ১৮ দিনে এই ভাষণ বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষকে প্রস্তুত করেছে মুক্তির সংগ্রামে – স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে। অার এ ভাষণটিই সবাইকে একত্রিত করেছিল স্বকস্ফূর্তভাবে যুদ্ধ অংশ গ্রহণ করতে। এরই সাথে অামরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ।
মোহা: রাকিবুল ইসলাম, শিক্ষার্থী- ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
জাতির পিতার ৭ ই মার্চের ভাষণ একটি পরাধীন জাতিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিল। জাতির পিতার ৭ ই মার্চের ভাষণ একটি পরাধীন জাতিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিল। স্বাধীনতার চার দশক পরও যখন আমি ১৮ মিনিটের দীর্ঘ এই ভাষণটি শুনি মনে হয় জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার জন্য বাকি কাজগুলি আমাদের যার যা কিছু আছে তাই দিয়েই বাস্তবায়ন করতে হবে।
পারভেজ পারু, শিক্ষার্থী- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
যদি আমাকে জিজ্ঞেস করা হয় মুক্তিযুদ্ধের নেপথ্যে কোন্ বিষয়টি চঁচলার ন্যায় প্রতিফলিত করেছে, আমি নির্দ্বিধায় বলব
৭-ই মার্চের ভাষণ। বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ভাষণে আমি খুঁজে পাই কোটি প্রাণের দেশপ্রেম,অবিচ্ছিন্ন ঐক্য,সংগ্রামী চেতনা,ত্যাগের ইতিহাস,স্বাধীনতার ক্ষুধা,বিজয়ের হাতছানি ও লাল-সবুজ পতাকা উড়ানোর তরে চিরকালের অধিকার। ৭-ই মার্চের ভাষণ,আমার প্রাণের স্পন্দন।কীভাবে নিরস্ত্র থাকা সত্ত্বেও সংগ্রাম করার সৎ সাহস রাখা যায়,সেটা আমি ৭-ই মার্চের ভাষণ থেকে উপলব্ধি করেছি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কোর ‘ইন্টারন্যাশনাল মেমরি অব দ্যা ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। হুম এটাই সেই ভাষণ যাকে বিশ্বের বিখ্যাত ভাষণগুলোর পাশাপাশি তুলনা করা হয়েছে গ্যাটিসবার্গ অ্যাড্রেসের সঙ্গে।
বসন্তের এক শুকনো টান টান দিনে একজন তরুন নেতা নিজেকে চালকের আসনে এনে একটি আন্দোলনকে জনগণের প্রাণের দাবিতে পরিণত করলেন। একটি ভাষণ একটি জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে যেভাবে উজ্জীবিত করেছিল, তার তুলনা আর কোনো কিছুর সঙ্গে হতে পারে না।