অবশেষে এমএলএম প্রতারক শফিক গ্রেফতার
- আপডেট সময় : ০৯:৩৩:০৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৭ মে ২০২১ ১৪৯ বার পড়া হয়েছে
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ দেশে এমএলএম এর নামে পরিচালিত প্রতারণা বাণিজ্যের গডফাদার খ্যাত আইডিয়াল কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড (আইসিএল) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এইচ এন এম শফিকুর রহমান ও তার স্ত্রী শামসুর নাহারকে আটক করেছে র্যাব-৪। রাজধানীর বাংলামোটরের একটি বাসায় আত্মগোপনে থাকাবস্থায় বুধবার মধ্যরাতে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এমএলএম বাণিজ্যের নামে হাজার হাজার আমানতকারীর অন্তত সাত হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে চার বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি গা ঢাকা দেন। প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাৎ সংক্রান্ত তিনটি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত শফিকুর রহমানের বিরুদ্ধে আরো প্রায় অর্ধশত গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি থাকার খবর পাওয়া গেছে। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানা ও আদালতে শতাধিক প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাৎ সংক্রান্ত মামলা রয়েছে বলেও জানা গেছে।
র্যাব জানায়, ঢাকা, কুমিল্লাসহ দেশের ৩২টি জেলায় আইসিএল এর শাখা অফিস খুলে লোভনীয় মুনাফার লোভ দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। গ্রাহকরা লভ্যাংশসহ টাকা ফেরত নিতে গেলে তাদেরকে হুমকি, আটক করে মারধোর এমনকি অপহরণ করে অজ্ঞাত স্থানে আটক রেখে উল্টো তাদের কাছেই মোটা অঙ্কের টাকা পাওয়া সংক্রান্ত লিখিত রাখা হতো। এর আগেও অর্থ আত্মসাৎ ও প্রতারণার অভিযোগে শফিকুর রহমান কুমিল্লায় গ্রেফতার হলেও বাদীর জিম্মায় জামিন নিয়েই তিনি স্বপরিবারে উধাও হয়ে যান।
তার ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানায়, আদালতের সাজা ও গ্রেফতারী পরোয়ানা মাথায় নিয়ে চার বছরেরও বেশি সময় ধরে শফিকুর রহমান ঢাকাতেই আত্মগোপনে ছিলেন। সর্বোচ্চ গোপনীয়তায় নিরাপদে থাকার জন্য তিনি উত্তরা, কাঁঠালবাগান, বনানী, মগবাজার, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী ও মিরপুর এলাকায় নয়টি ফ্ল্যাট কিনে রেখেছেন। এছাড়া দাড়ি রেখে লম্বা আলখেল্লা ও হাজী রুমাল পরিধান করেই চলাফেরা করতেন তিনি। ফলে প্রতারিত মানুষজন তাকে সামনা সামনি দেখেও চিনতে পারতেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের অন্যতম শীর্ষ প্রতারক শফিকুর রহমান আইসিএল নামের একটি এমএলএম প্রতিষ্ঠানের এমডি থাকলেও তিনি আরসিএল, আইডিএল, এফআইসিএল, এফআইবিএল, প্রিভেইল, কনজারভেটিভ, মাল্টিভিশন, গেøাবাল, প্রাইম, বন্ধন, নিউ মডেল, সেমা, ওয়াইডিসিএল, সিসিএল, এসডিসিএল, আরডিসিএল, রিলেশনসহ প্রায় ৪০টি এমএলএম কোম্পানির প্রধান উপদেষ্টা রয়েছেন। প্রতারণামূলক কর্মকান্ডে জড়িত এসব প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি নিয়মিত লাখ লাখ টাকা বখড়া হাতিয়ে নিতেন।
ভুক্তভোগীরা জানান, সরকারি-বেসরকারি ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়াও প্রবাসী স্বামী, পুত্র কিংবা ভাইয়ের কষ্টার্জিত টাকা ব্যাংকের পরিবর্তে অধিক লাভের আশায় এসব প্রতিষ্ঠানে আমানত রেখেছিলেন। এ নিয়ে পারিবারিক অশান্তি, সংসার ভেঙেছে অনেক নারী গ্রাহকের। অনেকেই সরকারি চাকরি থেকে অবসরে গিয়ে পেনশনের সমুদয় টাকা শফিকুর রহমানের হাতে তুলে দিয়ে এখন পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। আমানত ও বিনিয়োগের টাকা ফেরত পেতে শফিকুর রহমানসহ তার ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আদালতে শতাধিক মামলা করেও কোনো সুরাহা পাচ্ছেন না তারা।
আইসিএল শুধু কুমিল্লা জেলার বিভিন্ন স্থানে শাখা স্থাপন করেই গ্রাহকদের কয়েকশ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে বেশ কয়েক জন গ্রাহক অভিযোগ করেন। কুমিল্লা সদর উপজেলা পরিষদ কোয়ার্টারের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা সাধন ভৌমিক জানান, অবসর জীবনে সুখের আশায় ২০১৩ সালে ৩০ লাখ ৫৭ হাজার টাকা প্রতিষ্ঠানের নগরীর কান্দিরপাড় শাখায় আমানত রাখি। আসল ও মুনাফাসহ আমার ৫৭ লাখ ৭১ হাজার টাকা পাওনা। তারা টাকা নিয়ে পালিয়েছে। জেলা সমবায় কার্যালয়ে অভিযোগ করেও কোনো ফল হয়নি। এখন আমি নিঃস্ব। একই প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক মো. জামশেদ ও খোরশেদ আলমসহ অন্তত ১৭ জন আমানতকারী একইভাবে প্রতারিত হয়েছেন বলে দাবি করেন। সর্বশেষ শফিকুর রহমান পলায়নপর অবস্থায় ঢাকার কেরানীগঞ্জে ঘাঁটি গেঢ়ে বসেন এবং একই কৌশলে প্রায় দেড়শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান।
বিভিন্ন গ্রাহকের লিখিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আইসিএল ও এর এমডি শফিকুর রহমানের ব্যাপারে অনুসন্ধানে নামে। দুদকের উপ পরিচালক নাসির উদ্দিনের প্রাথমিক অনুসন্ধানেই বেরিয়ে আসে, আইসিএল এর ব্যানারে ১২ বছর যাবত ৭০ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে সাত সহ¯্রাধিক কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ প্রতারণার জন্য ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুর রহমান ছাড়াও অপর ৯ জন পরিচালককে দায়ী করা হয়। পরিচালকরা বেশিরভাগই এমডি’র পরিবারের সদস্য কিংবা ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজন বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে দুদকের উপ পরিচালক হামিদুল হাসান এক দফা শফিকুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পরবর্তীতে হাজিরা দেওয়ার চিঠিও দেন। কিন্তু আত্মগোপনে থাকা শফিকুর রহমান আর কোনো সংস্থার তদন্ত কিংবা চিঠিকে পাত্তা দেননি।
এদিকে র্যাব ৪ এর উপঅধিনায়ক জানান, গ্রেফতারকৃত আইসিএল এমডি শফিকুর রহমানকে গ্রেফতারী পরোয়ানার ভিত্তিতে পল্টন থানায় সোপর্দ্দ করা হয়। এ খবর পেয়ে শফিকুর রহমানের দ্বারা প্রতারিত শত শত ভুক্তভোগী পল্টন থানার সামনে ভিড় জমায়। তবে পল্টন থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) জানান, গতকাল দুপুরেই শফিকুর রহমানকে ওয়ারেন্টের বিপরীতে সিএমএম কোর্টে পাঠানো হয়েছে।