দুর্নীতির ‘কারিগর’ পটুয়াখালীর প্রধান শিক্ষক মঞ্জুরুল
- আপডেট সময় : ১২:৪৬:৫৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী ২০১৯ ১৪০ বার পড়া হয়েছে
পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার কাছিয়াবুনিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) মো. মঞ্জুরুল আলম, যিনি এখন মানুষ গড়ার কারিগর থেকে দুর্নীতির কারিগর হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে বিদ্যালয়ের বিভিন্ন কর্মকান্ডে সীমাহীন দুর্নীতি করে প্রতি বছর ২০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন, সেশন ফি, জেএসসি এবং এসএসসির রেজিষ্ট্রেশন ফি ও পরীক্ষার ফরম পূরণ বাবদ অতিরিক্ত অর্থ আদায়সহ বিভিন্ন খাত থেকে ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে তিনি এসব অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন বিদ্যালয়ের অভিভাবক ও সাবেক শিক্ষকরা।
প্রধান শিক্ষক মো. মঞ্জুরুল আলম বিদ্যালয়টিকে সীমাহীন দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছেন বলে অভিযোগে গত বছরের ১২ আগস্ট তার বিরুদ্ধে বরিশাল মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষ বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অভিযোগ করে রাঙ্গাবালী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ আ: রাজ্জাকসহ ২৮জন ।
অভিযোগের অনুলিপি শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট ৮টি দপ্তরে প্রেরণ করা হয়। সম্প্রতি মঞ্জুরুলের বিরুদ্ধে এসব লাগামহীন অভিযোগের তদন্ত করলে তার সত্যতা পাওয়া যায়। সেখানে মঞ্জুরুলের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগগুলো হলো –
১। দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে মঞ্জুরুল প্রতি বছরের জানুয়ারি মাসে শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি ও সেশন ফিসহ নানা অজুহাতে ১ হাজার ২০০ টাকা বিনা রশিদে আদায় করেছেন।
২। মঞ্জুরুল আলম ২০১৮ সালের জেএসসি পরীক্ষায় রেজিষ্ট্রেশন ফি এবং ২০১৮-১৯ সেশনে নবম শ্রেণীর রেজিষ্ট্রেশনে বাড়তি টাকা আদায় করেছেন। ওইবছর এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ফরম পূরণ শিক্ষাবোর্ডের নির্ধারিত ফি ১ হাজার ২০০ টাকা ছিল।
কিন্তু মঞ্জুরুল আলম ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা আদায় করেন। আর প্রবেশপত্র (বিনামূল্য) বিতরণে কেন্দ্র ফি বাবদ জনপ্রতি ১ হাজার ১০০ টাকা এবং ব্যবহারিক পরীক্ষার জন্য ১ হাজার ৫০০ টাকা করে আদায় করেন।
৩। এছাড়া ওই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাত্র-ছাত্রীদের বোর্ড থেকে প্রদত্ত নম্বরপত্র (বিনামূল্য) সংগ্রহ করতে গেলে ১ হাজার টাকা করে আদায় করেন।
৪। বিভিন্ন শিক্ষাবর্ষে জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাত্র-ছাত্রীদের সার্টিফিকেট (বিনামূল্য) প্রদানে ৫০০ টাকা করে আদায় করছেন।
৫। বিভিন্ন শ্রেণীতে স্কলারশীপের টাকা উত্তোলন করে তিনি তার হাতে ২/৩ মাস রাখার পরে ছাত্র/ছাত্রীদের থেকে খরচ বাবদ ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আদায় করেছেন।
৬। অভিযোগ রয়েছে, উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয় থেকে বেঞ্চ তৈরির জন্য বরাদ্দ দিলে মঞ্জুরুল আলম সেই টাকা আত্মসাৎ করেন।
৭। ২০১৭ সালে বিদ্যালয়ের ঘর নির্মাণ ও বেঞ্চ তৈরির জন্য বিদ্যালয়ের ৩৬টি গাছ কাটেন তিনি। সেই গাছের কাঠ বিদ্যালয় আর ফেরত আনেননি। ধারণ করা হচ্ছে, সব গাছগুলো তিনি বিক্রি করে আত্মসাৎ করেছেন।
৮। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই বিদ্যালয়ের পুরাতন বিজ্ঞান ভবন এবং দুই কক্ষের পাকা দুইটি বাথরুম ভেঙে ইট, রট, লোহার দরজা ও গ্রীল বিক্রি করে সেই টাকা আত্মসাৎ করেন।
এসব লিখিত অভিযোগ অনুযায়ী, ২০১২ সাল থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত আয়-ব্যয়ের হিসাব না দিয়ে ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে মঞ্জুরুল আলম প্রতিবছরে ২০ লক্ষ টাকা হারে ৬ বছরে ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
গতবছরের ২৬ সেপ্টেম্বর বরিশাল মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক এবং ২৭ সেপ্টম্বর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের শিক্ষা ও কল্যাণ শাখার সহকারি কমিশনার এই অভিযোগের বিষয়টি আমলে নিয়ে রাঙ্গাবালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে তদন্ত পূর্বক প্রতিবেদন দাখিলসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পৃথক চিঠি দেন।
সে অনুযায়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এই অভিযোগের তদন্ত করে সত্যতা পান। চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি মঞ্জুরুল আলমের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন বরিশাল মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে দাখিল করা হয়।
ওই তদন্ত প্রতিবেদনের মন্তব্যে উল্লেখ করা হয়, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মঞ্জুরুল আলমের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
তবে এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলেও ১ টাকাও আত্মসাৎ করেননি দাবি করে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মঞ্জুরুল আলম বলেন, ‘বিদ্যালয়ের কাছ থেকে আমি উল্টো ৪২ হাজার ৬০০ টাকা পাই।’
তাহলে গত ৭ বছরে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিভিন্ন ফি বাবদ নেয়া অর্থের রশিদ দেখাতে না পারার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টা আমার দূর্ভাগ্য। পরীক্ষা হলসহ বিভিন্ন জায়গায় ব্যস্ততা থাকার কারণে কাগজপত্র গুছাতে পারিনি। আমার সব তথ্য প্রস্তুত ছিল। তদন্তে এলে আমি জ্ঞানহীন হয়ে পড়ি। তাই মানি রিসিপ্ট দেখাতে পারিনি।’
তিনি দাবি করেন, ‘আমি সরকারি একটা টাকাও আত্মসাৎ করিনি। ইউএনও যদি ২০১৮ সালের আয়-ব্যয় পুরোটা দেখলে বুঝতেন, আমি ৪২ হাজার ৬০০ টাকার মত স্কুলের কাছে পাওনা আছি।’
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাশফাকুর রহমান বলেন, ‘কাছিয়াবুনিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মঞ্জুরুল আলমের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের তদন্ত করে বরিশাল মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে দাখিল করা হয়েছে। পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান অবসরে যান। এরপরে সহকারী শিক্ষক মঞ্জুরুল আলম ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পান। মঞ্জুরুল আলমের দায়িত্বে এই ৭ বছরে বিদ্যালয়টির অবকাঠামোর তেমন কোন উন্নয়ন হয়নি বলে জানিয়েছেন অভিভাবক ও স্থানীয়রা। ওই বিদ্যালয়ের সুষ্ঠ শিক্ষার পরিবেশ ও মানউন্নয়নের জন্য সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান এবং পরিচালনা পর্ষদ গঠন প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।